আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

সমসাময়িক

সংক্রমণ বিষয়ক সতর্কতা এবং শারদোৎসব


১৭ই সেপ্টেম্বর উষালগ্নে আকাশবাণী প্রচলিত প্রথায় 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গজীবনে ছড়িয়ে পড়েছে শারদোৎসবের আগমনী বার্তা। পরের সপ্তাহে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পশ্চিমবঙ্গের প্ৰশাসনিক প্রধান ঘোষণা করলেন যে, বারোয়ারি দুর্গাপূজা উদযাপনের জন্য ৩৭ হাজার পূজা কমিটির প্রত্যেকটিকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে। তিনি আরও জানান যে, ৮০ হাজার পথ-ব্যবসায়ী বা হকারকে দুর্গাপূজা উপলক্ষে মাথাপিছু ২ হাজার টাকা করে এককালীন অনুদান দেওয়া হবে। কোন সমীক্ষায় ৩৭ হাজার এবং ৮০ হাজার সংখ্যায় উপনীত হওয়া গেল তা সংবাদমাধ্যমে উল্লিখিত হয়নি। হকারদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও বারোয়ারি পুজোর সংখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। গত কয়েক বছরের সংবাদপত্র থেকে জানা যায় যে বাড়ির পুজো এবং সর্বজনীন পুজো মিলিয়ে রাজ্যে প্রায় ৩০ হাজার দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। বাড়ির পুজোর সংখ্যা নির্ণয় কঠিন কাজ নয়। গত কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা আবাসনের পুজোগুলিকে কোন পর্যায়ে ফেলা যায়? বাড়ির পুজো না সর্বজনীন? সংখ্যায় আড়াই থেকে তিন হাজার। তারাও কি সরকারি অনুদান পাবে? এবং এইসব বিষয়ে কেউ প্রশ্নও করেননি। সরকারি বয়ানেও ব্যাখ্যা নেই। পূজা কমিটির জন্য ১৮৫ কোটি টাকা এবং হকারদের জন্য ১৬ কোটি টাকা বাজেটের কোন বিভাগ থেকে বরাদ্দ করা হবে সে ব্যাপারেও কোনো উচ্চবাচ্য নেই। তবে পুজোমণ্ডপগুলিকে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে। এবং সেরা স্বাস্থ্য সচেতন পুজোমণ্ডপের আয়োজকদের পুরস্কৃত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

দিকে দিকে এই বার্তা রটে যেতে না যেতেই সর্বজনীন পুজোর উদ্যোক্তারা কাজে লেগে পড়েছেন। প্রচলিত প্রক্রিয়ায় মণ্ডপ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। বড়জোড় কোথাও কোথাও মণ্ডপের আকার আয়তন কিঞ্চিত সংক্ষিপ্ত। আনন্দের আতিশয্যে হয়তো এ বছরের উৎসব সংক্রান্ত বিশেষ বিধিনিষেধ বিষয়ক বিজ্ঞপ্তির কথা খেয়াল নেই। সরকারি নির্দেশিকা অনুসারে কতগুলি মণ্ডপ নির্মাণ হয়েছে তা যথাসময়ে প্রত্যক্ষ করা যাবে। তবে পুরোপুরি মানা হচ্ছে না বলেই হয়তো পুলিশের তরফে এমন পরিস্থিতিতে পুজোর ভিড় থেকে যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়, সে জন্য সরকারি নির্দেশিকার তথ্য বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বাস্তবে এইসব নির্দেশিকার কতটুকু মানা হবে তা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে জানা যাবে। তবে রাজ্য সরকারের ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে ইতিমধ্যে পুজোর বাজারে ভালোই ভিড় হচ্ছে। সংক্রমণ প্রতিহত করতে যাঁরা গত দু’শো দিন ধরে দিবারাত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা কিন্তু এই জনসমাগম দেখে শঙ্কিত। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা উৎসবের জেরে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে সংক্রমণ। বিশেষজ্ঞ-গবেষকদের একাংশ উৎসবের মরশুম সম্পর্কে ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, আগামী দেড় মাস সংক্রমণের দিক থেকে খুব ‘গুরুত্বপূর্ণ’ অধ্যায় হতে চলেছে। যেখানে সামান্য অসতর্কতাও হু-হু করে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে শুধু আশঙ্কা প্রকাশই নয়, বাস্তবেও যে তা-ই ঘটবে, সংক্রমণের অভিমুখ ও জনসাধারণের আচরণ দেখে তেমনটাই মনে করছেন অনেকে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ জীবনযাপনের ক্লান্তির জেরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত জনতার মাস্ক পরায় অনীহা এসেছে, হাত ধোয়ার অভ্যাস ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছে এবং পারস্পরিক দূরত্ব-বিধি না মানার প্রবণতা তাদের মধ্যে স্পষ্ট। তাই ভিড়ে ঠাসাঠাসি করেই সব বাজারে পুজোর কেনাকেটা চলছে। একটি অংশের মানুষ মাস্ক পরছে ঠিকই, কিন্তু সেই সংখ্যা এতটাই নগণ্য যে, জনস্রোতের কাছে তার গুরুত্ব থাকছে না। এখনও পর্যন্ত কোভিড-১৯ সম্পর্কে যেটুকু জানা গেছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে, জমায়েত হলে সংক্রমণ বাড়বেই। একাধিক সমীক্ষাও সে দিকেই নির্দেশ করছে।

দেশের সব জায়গায় একসঙ্গে সংক্রমণ শীর্ষে পৌঁছচ্ছে না। বরং বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্নভাবে একাধিকবার (মাল্টিপল) সংক্রমণ ঘটছে। উৎসবের মরশুমে এই তথ্যও চিন্তার বিষয়। পুজোয় জমায়েতের কারণে যদি সংক্রমণের হার বাড়ে, তা হলে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হতে পারে।

যদিও এ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। উৎসবের সপ্তাহ দুয়েক আগে পুজোর বাজারে মাস্কহীন ‘অসতর্ক’ জনতার লাগামহীন আচরণ তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যে তর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা হল পুজোর বাজার জমে না উঠলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছে যাবেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত ছ’-সাত মাসে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। সংক্রমণের দাপটে অসংখ্য কাজছাড়া এবং কাজহারা মানুষের তালিকায় সরাসরি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ না থাকলেও তাঁদের অবস্থা সঙ্গিন। সংক্রমণের তীব্রতা এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে জনজীবন বিপর্যস্ত। অর্থনীতির আঙিনায় স্বস্তির বাতাস বইতে দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হলে ক্রেতাদের বাজারে যাওয়ার অবাধ অনুমতি না দিয়ে উপায় নেই। আবার অবাধ গতিবিধির সুবাদে সামান্যতম অসতর্কতার সুযোগে সংক্রমণের তীব্রতা এক লহমায় অনেক বেড়ে যেতে পারে। এ এক জটিল সমীকরণ যার কোনো সহজ সমাধান সূত্র নেই। আবার ভারসাম্য বজায় রেখে কোনো নিশ্চিন্ত নিদানপত্র রচনা করাও সম্ভব নয়। সামান্যতম অসতর্কতার ফলে বিরাট বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। যেমনটা হয়েছে কেরলে। অথচ গোড়ার দিকে করোনা সংক্রমণ রোখার প্রশ্নে কেরল আশাতীত ভাল ফল করেছিল। কিন্তু বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না-করে ওনাম উৎসবে কেরলবাসী মেতে ওঠায় গত এক মাসে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে সংক্রমিতের সংখ্যা। ওনামের ঠিক পরেই ২ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর কেরলে রোগী বেড়েছিল ২২ হাজার ১৩৩ জন। ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবরের সপ্তাহে সেই সংখ্যাটাই বেড়ে হয়েছে ৮৪ হাজার ৯৫৮।

কেরলের এই পরিসংখ্যান দেখিয়েই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের হুঁশিয়ারি, আসন্ন উৎসবের মরশুমে স্বাস্থ্যবিধি না-মানলে পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কিছু রাজ্যের একই অবস্থা হতে পারে। দুর্গাপুজো, দশেরা, দীপাবলি ও ছটপুজো আসন্ন। আমজনতা যদি নিয়মের তোয়াক্কা না-করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ফের সংক্রমণ কয়েক গুণ বাড়বে।

ওনামের পরে কেরলে কোভিড সংক্রমণ এক ধাক্কায় সাড়ে সাতশো শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই দৃষ্টান্ত দেখে সংক্রমণ রোধে নবরাত্রিতে গর্বা নাচ বাতিল করেছে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র। মহারাষ্ট্রে গনেশ চতুর্থী উৎসব দু’একটি জায়গা ছাড়া নীরবে উদযাপিত হয়েছে। পুনে শহরে উৎসবের আমেজ মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার ফলে সংক্রমণ বেড়ে যায়। অন্যত্র গণেশ চতুর্থী নিয়ে কোনো মাতামাতির খবর পাওয়া যায়নি। ওডিশা সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সীমিত পরিসরে রথযাত্রার অনুমতি দিলেও সর্বজনীন দুর্গাপুজো, দশেরা, দীপাবলি ও ছটপুজো সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ঝাড়খণ্ড সরকারের নির্দেশিকায় পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে দুর্গাপুজোয় আপত্তি নেই। মণ্ডপের আকার-আয়তন সীমিত করতে হবে। মণ্ডপের ভেতরে কোনোসময়ই পুরোহিত ও তাঁর সহকারী সহ ৭ জনের বেশি থাকা চলবে না। প্রতিমার উচ্চতা ৪ ফুটের বেশি করা যাবে না। দুর্গাপুজো উপলক্ষে কোনো মেলার আয়োজন নিষিদ্ধ। ভোগ-প্রসাদ বিতরণ করা যাবে না। সর্বোপরি কনটেইনমেন্ট এলাকায় দুর্গাপুজো পুরোপুরি বন্ধ। দুর্গাপুজো নিয়ে অসম সরকারের নির্দেশিকাও প্রায় একইরকম। অসমের পূজামণ্ডপে একসাথে ২০ জন থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে বিসর্জনের সময় মাত্র ৫ জনকে প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিমা দর্শনের সময় কোনো দর্শনার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে উদ্যোক্তাদের দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানোর কথা অসম সরকারের নির্দেশিকায় বলা আছে। ত্রিপুরা সরকারের নির্দেশিকা অনুসারে এই বছরের চাঁদা সংগ্রহ হবে স্বেচ্ছামূলক। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করা যাবে না। অনলাইনে চাঁদা সংগ্রহ করতে হবে। পূজামণ্ডপ হবে উন্মুক্ত। কাছাকাছি এলাকায় দুটি মণ্ডপ থাকতে পারবে না। প্রসাদ বিতরণ নিষিদ্ধ। দিনের যে কোনো সময় ৫ থেকে ১০ জনের বেশি দর্শণার্থী একসঙ্গে কোনো মণ্ডপে থাকতে পারবে না। প্রতিমার উচ্চতা ১০ ফুটের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। এবং পুজো উপলক্ষে কোনো গানবাজনার আসর বা মেলার আয়োজন করা যাবে না। দিল্লি সরকার দেরিতে হলেও একটা নির্দেশিকা জারি করেছে। সেই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আগামী ৩১শে অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত দিল্লিতে কোনো ধরনের মেলা, প্রদর্শনী, সমাবেশ ইত্যাদির আয়োজন করা যাবে না। এমনকি অস্থায়ী খাবারের দোকান খোলারও অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। সর্বজনীন পূজার উদ্যোক্তারা সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে পুজোর ধারাবাহিকতা ও পরম্পরা রক্ষার জন্য ঘট পুজো করা হবে। কোনো মণ্ডপ হবে না। শুধুমাত্র স্থায়ী মন্দির যেখানে নিত্য পূজার ব্যবস্থা আছে এবং বৎসরান্তে শারদীয় দুর্গাপূজা আয়োজিত হয় সেই মন্দিরগুলিতে পুজো হবে। তবে ভোগ-প্রসাদ বিতরণ হবে না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে বাড়ি ও বারোয়ারি মিলিয়ে কমবেশি ৩২ হাজার পূজার আয়োজন হয়। বাংলাদেশ সরকার দুর্গাপূজার আয়োজকদের সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই বছরের শারদীয় দুর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্জনে কোনো শোভাযাত্রা করা হবে না। এছাড়াও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। হাত ধোওয়া, স্যানিটাইজার প্রয়োগ এবং মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হবে। পূজামণ্ডপে জনসমাগম কমানোর জন্য অঞ্জলি প্রদান অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেল-এ লাইভ প্রচারের জন্য পূজার উদ্যোক্তারা ব্যবস্থা করবে। জনসমাগম সীমিতকরণসহ অন্যান্য নির্দেশনাবলী মিডিয়ায় প্রচারের ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করবে।

এহেন পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক প্রধান পুজোর উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা ছাড়াও অন্যান্য অনেক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। বিদ্যুৎ, দমকল ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে কর পরিহারের কথা জানিয়েছেন। এবং তিনি পঞ্জিকার বাইরে গিয়ে তৃতীয়া থেকে একাদশী পর্যন্ত দুর্গাপূজার সময়রেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য চারটি দিন ধার্য করেছেন। এইভাবে কি পূজাপাঠের দিনক্ষণ-তিথি পাল্টিয়ে দেওয়া যায়? পাঁজিপুঁথি নিয়ে যাঁরা নিয়মিত চর্চা করেন তাঁরা কোনো প্রতিবাদ করেননি। অন্য কোনো মহলেও প্ৰশ্ন ওঠেনি। সর্বত্র একটা মেনে নেওয়া মানিয়ে নেওয়ার মনোভাবের ফলে এই ধরনের আগ্রাসী মানসিকতা সম্প্রসারিত হচ্ছে। সমাজের হিতের জন্য এই প্রবণতা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়।

এখানেই শেষ নয়। কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের প্রশাসন বোধ হয় জনজীবন এলোমেলো করে দেওয়ার ব্যাপারে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ‘করোনাকে লকডাউন’ করিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ট্রাকের চাকায় সংক্রমণ ছড়ানোর দাবি করে তিনি সংক্রমণের নতুন মাত্রা সংজ্ঞায়িত করেছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীমহোদয় যিনি আবার লব্ধপ্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক, সংক্রমণ নিয়ে নিত্য নতুন মন্তব্য বলিষ্ঠ স্বরে ঘোষণা করে চলেছেন। তাঁর পরামর্শ, মেলা বা জমায়েত এড়িয়ে উৎসবের দিনগুলি প্রিয়জনের সঙ্গে বাড়িতেই পালন করুন। তিনি আরও বলেছেন, ‘‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুজো-পার্বণে যোগ দেওয়ার নির্দেশ কোনও ধর্ম বা ঈশ্বর দেননি। এ-ও বলেননি, প্রার্থনা করার জন্য মণ্ডপ, মন্দির বা মসজিদে যেতে হবে।’’ সংক্রমণের মাত্রা অনুভব করে তিনি জানিয়েছেন যে, এই অবস্থায় আসন্ন উৎসবের মরশুমে দেশবাসীকে সাবধানে ও সতর্কভাবে থাকতে হবে। ‘‘বিশ্বাস বা ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য দলে দলে উৎসবে যোগ দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। সেটা হলে আমরা কিন্তু অনেক বড় বিপদে পড়ব। কৃষ্ণ বলেছিলেন, নিজের লক্ষ্যে মনোনিবেশ কর। আমাদের এখন লক্ষ্য করোনাকে পরাস্ত করে মানবজাতিকে রক্ষা করা। এটাই আমাদের ধর্ম। এটাই গোটা বিশ্বের ধর্ম।’’ এই যুক্তি ব্যাখ্যা করে তিনিই আবার এমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পরামর্শ দিয়েছেন যা চিকিৎসা শাস্ত্র সম্মত নয়। পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক প্রকাশিত সেপ্টেম্বরের ‘ইকনমিক লুকআউট’ রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, দেশে সেপ্টেম্বরেই সংক্রমণ সর্বোচ্চ শিখর পার করেছে। আর দেশের প্রধান সেবক এখন উইন্ড মিলের মাধ্যমে বাতাস থেকে একই সঙ্গে অক্সিজেন ও বিশুদ্ধ পানীয় জল নিষ্কাশন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত। রাষ্ট্র এবং রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব যাঁরা পালন করছেন তাঁদের চিন্তা ভাবনার বৈচিত্র রীতিমতো উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে বদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির সুযোগে আনন্দে বাঁধনহারা হয়ে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত সতর্কতা উপেক্ষা করে উৎসবের আঙিনা জনজোয়ারে ভেসে গেলে সংক্রমণের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যেতে পারে। সরকারি নিয়মনীতি অনুসারে নয়দিন ধরে চলতে থাকা দুর্গাপূজা সম্পন্ন হওয়ার পর চারদিন ধরে চলতে থাকা প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সুনিয়ন্ত্রিত না করতে পারলে মহামারী বা অতিমারী অচিরেই মরকে পরিণত হতে পারে। বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, প্রশাসক সকলেই এই অজানা আশঙ্কায় রীতিমতো চিন্তিত। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত নীতি নির্ধারক জনমোহিনী বাণী উচ্চারণ করে পরবর্তী নির্বাচনের সলতে পাকানো শুরু করতেই পারেন। কিন্তু তার ফলাফল কী কী হতে পারে তা নিয়েই আতঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, প্রশাসক। সাম্প্রতিক উদাহরণ ইয়োরোপের একাধিক দেশ। অবরুদ্ধ জনজীবনে সামান্য শিথিলতা দেওয়ার ফলে সংক্রমণের দ্বিতীয় জোয়ার দেখা দিয়েছে। তড়িঘড়ি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে পরিস্থিতি মোকাবিলায় জার্মানির সরকার ফৌজকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছে। উৎসবের আনন্দে উচ্ছলিত জনজোয়ারে সংক্রমণ যাতে সম্প্রসারিত না হতে পারে তার জন্য ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও পুলিশের কাজের পরিসর এবং দায়িত্ব বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকের বোধ হয় খেয়াল থাকে না পুলিশ কোনো যন্ত্র নয়, রক্তমাংসের মানুষ। গত কয়েক মাসে আড়াই হাজারের বেশি পুলিশকর্মী সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। উৎসবের প্রাবল্য নিয়ন্ত্রণে দিনরাত্রি এক করে ধারাবাহিকভাবে দিনের পর দিন কাজ করতে করতে তাঁরা অসুস্থ না হলেও ক্লান্তিতে অবসন্ন হতেই পারেন। এতকিছু মাথায় রেখে অকস্মাৎ সংক্রমণ বেড়ে গেলে কোথায় কীভাবে কোন রোগীকে স্থানান্তরিত করা হবে তার নীল নকশা প্রণয়নে প্রশাসন আপাতত চূড়ান্ত ব্যস্ত।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একদা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘আগামী বছরে দুর্গোৎসব হবে ডিসেম্বর মাসে’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, নভেম্বর ৩, ২০১০)। তাঁর অনুসরণে বলা যেতে পারতো আপাতত শারদোৎসব মুলতুবি থাক; পরে পরিস্থিতি বুঝে করা যাবে। বিশেষত যে রাজ্যে পুজো-পার্বণের দিনক্ষণ পাঁজিপুঁথির বদলে প্রশাসনিক প্রধানের মর্জিমাফিক নির্ধারিত হয়, সেখানে এই নির্দেশ সহজেই দেওয়া যেত। সর্বোপরি এইসব বিষয়ে এই রাজ্যে কোনো প্রশ্ন করা হয় না।

ভয়াবহ পরিণতির আগাম আশঙ্কায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি বন্ধ করতে ধর্ম নির্ভর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নীতি নির্ধারকের কাছে আবেদন জানানোর বদলে জনসাধারণের কাছেই বিনীত আবেদন করা এই সময়ের কর্তব্য। সংক্রমণ প্রতিহত করার প্রক্রিয়ায় তালি-থালি-দেওয়ালি কার্যকর হয়নি। বরং বিগত কয়েক মাসের অবরুদ্ধ জীবনযাপন প্রক্রিয়া কার্যকর হয়েছে। উৎসবের আতিশয্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার বিস্মরণে তা যেন ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে না যায়।