আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২০ ● ১৬-৩১ আশ্বিন, ১৪২৭
প্রবন্ধ
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া সফরের নব্বই বছর
অশোক সিংহরায়
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘‘চলতি ঘোড়ার আকাশে-পা-তোলা ছবির থেকে প্রমাণ হয় না যে, বরাবর তার পা আকাশেই তোলা আছে।’’ অর্থাৎ চলনের শৈল্পিক রূপটি ধরতে না পারলে, একটি বিশেষ মুহূর্ত থেকে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মুক্তমনা শিল্পী; তিনি নিজেকে স্থবিরতার কোন অচলায়তনে বন্দী করে রাখেননি; মনের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমের সমস্ত দরজা জানালা খুলে রেখেই চলেছে তাঁর সাহিত্য সাধনা এবং কর্মোদ্যোগ। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘‘বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশের নানা অবস্থা এবং আমার নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল আমি চিন্তা করেছি এবং কাজও করেছি। যেহেতু বাক্য রচনা করা আমার স্বভাব সেইজন্যে যখন যা মনে এসেছে তখনি তা প্রকাশ করেছি। রচনাকালীন সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনের সঙ্গে সেই-সব লেখার যোগ বিচ্ছিন্ন করে দেখলে তার সম্পূর্ণ তাৎপর্য গ্রহণ করা সম্ভবপর হয় না। যে মানুষ সুদীর্ঘকাল থেকে চিন্তা করতে করতে লিখেছে তার রচনার ধারাকে ঐতিহাসিকভাবে দেখাই সংগত’’ (রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত, ‘কালান্তর’)। এই নিবন্ধেও আলোচনা করব তাঁর রচনার ধারাকে ঐতিহাসিকভাবে বিচার করেই।
১৯১৭ সালে রুশ-বিপ্লব সংঘটিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী মার্চ মাসে) সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসকে উৎখাত করে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়। অক্টোবরে (নভেম্বরে) অন্তর্বতীকালীন সরকারের জায়গায় বলশেভিক (কমিউনিস্ট) সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
অখন্ড ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশের অধীনে। হিংসায় বিশ্বাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘সেই বঙ্গবিভাগের উত্তেজনার দিনে একদল যুবক রাষ্ট্রবিপ্লবের দ্বারা দেশে যুগান্তর আনবার উদ্যোগ করেছিলেন। আর যাই হোক, এই প্রলয়হুতাশনে তাঁরা নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন, এইজন্যে তাঁরা কেবল আমাদের দেশে কেন সকল দেশেই সকলেরই নমস্য। তাঁদের নিষ্ফলতাও আত্মার দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। তাঁরা পরমত্যাগে পরমদুঃখে আজ একটা কথা স্পষ্ট জেনেছেন যে, রাষ্ট্র যখন তৈরি নেই তখন রাষ্ট্রবিপ্লবের চেষ্টা করা পথ ছেড়ে অপথে চলা - পথের চেয়ে অপথ মাপে ছোটো, কিন্তু সেটাকে অনুসরণ করতে গেলে লক্ষ্যে পৌঁছনো যায় না... সমস্ত দেশের অন্তঃকরণ থেকে সমস্ত দেশের উদ্ধার জেগে উঠে, তার কোনো একটা অংশ থেকে নয়।’’ (সত্যের আহ্বান, ‘কালান্তর’; রচনাকালঃ অক্টোবর/নভেম্বর, ১৯২১)।
রুশ-বিপ্লব সম্বন্ধে তাঁর ধারণা তখনও অনুকূল নয়। ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে (রচনাকালঃ জুন/জুলাই, ১৯২৬) তিনি লিখছেন, ‘‘ইদানীং পশ্চিমে বলশেভিজম ফ্যাসিজম প্রভৃতি যে-সব উদযোগ দেখা দিয়েছে আমরা যে তার কার্যকারণ তার আকার-প্রকার সুষ্পষ্ট বুঝি তা নয়; কেবল মোটের উপর বুঝেছি যে গুন্ডাতন্ত্রের আখড়া জমেছে।... রাশিয়ার জার-তন্ত্র এবং বলশেভিক-তন্ত্র একই দানবের পাশমোড়া দেওয়া।’’ অর্থাৎ এই পর্যন্ত দেশের সহিংস-বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও সে পথের তিনি সমালোচক; গান্ধিজীর সঙ্গে পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও প্রীতির সম্পর্ক থাকলেও চরকা-চালনায় আদৌ কোনো গুরুত্ব দিতে রাজি নন; রাশিয়ার জারতন্ত্র এবং বলশেভিক মতবাদের পার্থক্য তাঁর কাছে বোধগম্য নয়।
১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘মুক্তধারা’ নাটক। এখানে উত্তরকূটের রাজার নির্দেশে যন্ত্ররাজ বিভূতি মুক্তধারা ঝরনাকে লৌহযন্ত্রের বাঁধ তুলে বেঁধেছে যাতে শিবতরাইয়ের অবাধ্য প্রজারা চাষের জল না পেয়ে বশ মানে। শিবতরাইয়ের নির্ভীক বৈরাগী ধনঞ্জয়, যাকে শিবতরাইয়ের লোক সবচেয়ে বেশি মানে সে রাজা রণজিৎকে খাজনা না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলে, ‘‘যা তোমার নয় তা তোমাকে দিতে পারব না।... আমার উদবৃত্ত অন্ন তোমার, ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়।... ওরা তো ভয়ে দিয়ে ফেলতে চায়, আমি বারণ করে বলি প্রাণ দিবি তাঁকেই প্রাণ দিয়েছেন যিনি।’’ আবার, শিবতরাইয়ের গণেশ সর্দার যখন ধনঞ্জয়কে বলে, ‘‘ঠাকুর, একবার হুকুম করো ঐ ষণ্ডামার্কা চন্ডপালের দন্ডটা খসিয়ে নিয়ে মার কাকে বলে একবার দেখিয়ে দিই’’; তখন তার উত্তরে ধনঞ্জয় বলে, ‘‘মার কাকে না বলে তা দেখাতে পারিস নে? জোর বেশি লাগে বুঝি? ঢেউকে বাড়ি মারলে ঢেউ থামে না, হালটাকে স্থির করে রাখলে ঢেউ জয় করা যায়।... মার জিনিসটাকেই একেবারে গোড়া ঘেঁষে কোপ লাগাও... মাথা তুলে যেমনি বলতে পারবি লাগছে না, অমনি মারের শিকড় যাবে কাটা।’’ নাটকের সমাপ্তিতে যুবরাজ অভিজিৎ বাঁধের ত্রুটিজনিত দুর্বল অংশে আঘাত করে মুক্তধারাকে মুক্ত করে নিজে জলের তোড়ে ভেসে গেল।
কিন্তু ১৯২৬ সালে প্রকাশিত নাটক ‘রক্তকরবী’-তে অন্য সুর। যক্ষপুরীর রাজা পাতালে সুড়ঙ্গ খোদাই করিয়ে সে ধন হরণে লালায়িত; খোদাইকরেরা মাটির তলা থেকে রাজার সোনা তোলার কাজে নিযুক্ত; রাজার অন্তরঙ্গ পার্ষদ সর্দারদের ব্যবস্থাগুণে খোদাইকরদের কাজের মধ্যে ফাঁক পড়তে পারে না; খোদাইকরদের মধ্যে কেউ বিশ্বস্ততার যোগ্যতাগুণে মোড়ল হয়; গোঁসাইজি আছেন ফৌজের চাপে নুয়ে পড়া খোদাইকরদের ধর্মকথা শোনাতে - প্রতিপালিত হন সর্দারের অন্নে; রাজা থাকেন জটিল জালের আবরণের আড়ালে। নন্দিনী এক ব্যতিক্রমী চরিত্র; মাটির নিচের নয়, মাটির উপরিতলের প্রাণের, রূপের, প্রেমের, সহজ সুখের, সহজ সৌন্দর্যের। নন্দিনী বলে, ‘‘রঞ্জন আমাকে কখনো কখনো আদর করে বলে রক্তকরবী।... আমার রঞ্জনের ভালোবাসার রঙ রাঙা।’’ (মুক্তধারার যুবরাজ অভিজিতের ভক্তির ফুল শ্বেতপদ্ম, পার্থক্যের শুরু এখান থেকেই)। নন্দিনী যখন বলে, ‘‘ওদের মাঝখানে বিধাতা যদি খুব একটা হাসি হেসে উঠেন, তা হলে ওদের চটকা ভেঙে যেতে পারে। রঞ্জন বিধাতার সেই হাসি।’’ অধ্যাপক তার জবাবে বলেন, ‘‘দেবতার হাসি সূর্যের আলো, তাতে বরফ গলে, কিন্তু পাথর টলে না। আমাদের সর্দারদের টলাতে গেলে গায়ের জোর চাই।’’ নন্দিনী রাজাকে নির্ভয়ে বলতে পারে, ‘‘এতদিন যাদের ভয় দেখিয়ে এসেছ তারা ভয় পেতে একদিন লজ্জা করবে।’’ অধ্যাপক প্রসঙ্গক্রমে নন্দিনীকে বলেন, ‘‘থাকবার জন্যে মরতে হবে, এ কথা বলে সুখ পাও তো বলো। কিন্তু থাকবার জন্য মারতে হবে, এ কথা যারা বলে তারাই থাকে।’’ নন্দিনীর মুখ থেকে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয় গোঁসাইয়ের উদ্দেশ্যে, ‘‘তোমাদের ধ্বজদন্ডের দেবতা, সে কোনো দিনই নরম হবে না। কিন্তু জালের আড়ালের মানুষ চিরদিনই কি জালে বাঁধা থাকবে। যাও যাও, যাও। মানুষের প্রাণ ছিঁড়ে নিয়ে তাকে নাম দিয়ে ভোলাবার ব্যবসা তোমার।’’ নাটকের শেষ অঙ্কে কারিগররা বন্দীশালা ভেঙে ফেলেছে, চলেছে লড়তে। শেষ দৃশ্যে রঞ্জন মৃত পড়ে আছে; নন্দিনীর রক্তকরবীর কঙ্কণ লুটোচ্ছে ধুলোয়, হাতখানি রিক্ত করে সে চলে গেছে শেষ মুক্তিতে।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৫ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে পাঁচবার সোভিয়েত ভ্রমণের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। প্রস্তুত মন এবং প্রত্যাশা নিয়ে তিনি সোভিয়েত দেশ ভ্রমণ এবং পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৩০ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মস্কো পৌঁছন; সোভিয়েত দেশে ছিলেন ২৫শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই সফর নিয়েই লেখেন ‘রাশিয়ার চিঠি’। আপ্লুত কবি লেখেন, ‘‘আপাতত রাশিয়ায় এসেছি - না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।... সনাতনের গদি দিয়েছে ঝাঁটিয়ে, নূতনের জন্যে একেবারে নূতন আসন বানিয়ে দিলে।... এখানে যে প্রকান্ড ব্যাপার চলছে সেটা দেখে আমি সব চেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি।... দেরি সইছে না; কেননা জগৎ জুড়ে এদের প্রতিকূলতা, সবাই এদের বিরোধী - যত শীঘ্র পারে এদের খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে - হাতে হাতে প্রমাণ করে দিতে হবে, এরা যেটা চাচ্ছে সেটা ভুল নয়, ফাঁকি নয়।’’ তাই তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘‘পৃথিবীতে যেখানে সব চেয়ে বড়ো ঐতিহাসিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান সেখানে নিমন্ত্রণ পেয়েও না আসা আমার পক্ষে অমার্জনীয় হত।’’
তাঁর এই সফরে তিনি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতি-কর্মী, মৈত্রী সমিতির নেতৃবর্গ - এককথায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে মিলিত হয়েছেন; আন্তরিক অভ্যর্থনা পেয়েছেন; সফরকালে রাশিয়ায় তাঁর চিত্র-প্রদর্শনীতে হয়েছিল উৎসাহী মানুষের ভিড়। এই ভ্রমণে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণের এরকম কিছু উক্তি তুলে ধরলে বোঝা যাবে তিনি কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেনঃ ‘‘এরা তিনটি জিনিস নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত আছে। শিক্ষা, কৃষি এবং যন্ত্র। এই তিন পথ দিয়ে এরা সমস্ত জাতি মিলে চিত্ত, অন্ন এবং কর্মশক্তিকে সম্পূর্ণতা দেবার সাধনা করেছে।... অন্যদেশে শিক্ষা যে করে শিক্ষার ফল তারই - ‘দুধুভাতু খায় সেই’। এখানে প্রত্যেকের শিক্ষায় সকলের শিক্ষা।... শুধু শ্বেত-রাশিয়ার জন্যে নয় - মধ্য-এশিয়ায় অর্ধসভ্য জাতির মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে।’’
‘‘আমরা শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি এরা সমস্ত দেশ জুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে। যেমন শিক্ষার ব্যবস্থা তেমনি স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যতত্ত্ব সম্বন্ধে সোভিয়েত রাশিয়ায় যেরকম অনুশীলন চলছে তা দেখে য়ুরোপ আমেরিকার পন্ডিতেরা প্রচুর প্রশংসা করছেন।... নূতন শস্যের প্রচলন শুধু এদের কৃষি-কলেজের প্রাঙ্গণে নয়, দ্রুতবেগে সমস্ত দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।... এরা কঠিন পণ করেছে পাঁচ বছরের মধ্যে সমস্ত দেশকে যন্ত্রশক্তিতে সুদক্ষ করে তুলবে, বিদ্যুৎশক্তি বাষ্পশক্তিকে দেশের এক ধার থেকে আর-এক ধার পর্যন্ত কাজে লাগিয়ে দেবে।... মেয়েদের এবং শিশুদের সর্বপ্রকার সু্যোগের জন্য সোভিয়েত গবর্মেন্টের দ্বারা যেরকম সব ব্যবস্থা হয়েছে এরকম আর কোথাও হয় নি।... এখানে ইস্কুলের ছেলেদের আঁকা অনেকগুলি ছবি আমরা পেয়েছি - দেখে বিস্মিত হতে হয়; সেগুলো রীতিমতো ছবি, কারও নকল নয়, নিজের উদ্ভাবন।... রাশিয়ার নাট্যমঞ্চে যে কলাসাধনার বিকাশ হয়েছে সে অসামান্য।... এরা সমাজে রাষ্ট্রে কলাতত্ত্বে কোথাও নূতনকে ভয় করে নি।... যে পুরাতন ধর্মতন্ত্র এবং পুরাতন রাষ্ট্রতন্ত্র বহু শতাব্দী ধরে এদের বুদ্ধিকে অভিভূত এবং প্রাণশক্তি নিঃশেষপ্রায় করে দিয়েছে এই সোভিয়েত-বিপ্লবীরা তাদের দুটোকেই দিয়েছে নির্মূল করে।’’ কৃষিক্ষেত্রের একত্রীকরণ বা যৌথখামার কৃষি-ব্যবস্থা রূপায়ণ বিষয়ে তিনি কৃষকদের থেকে জানতে পারেন যে কোথাও কোথাও নিজের সম্পত্তির প্রতি মমত্ব ও সংস্কার বাধা হলেও স্বাতন্ত্রিক প্রণালীর চেয়ে ঐকত্রিক প্রণালীতে ঢের ভালো জাতের এবং অধিক পরিমাণে ফসল উৎপন্ন করানো যায় বলে কৃষকদের অংশগ্রহণ দিনে দিনে বাড়ছে।
সমাজের সর্বস্তরের সম্পূর্ণতার সাধনা দেখে কবির গভীর উপলব্ধি, ‘‘জনসাধারণ ছাড়া এখানে আর-কিছুই নেই। এরা সমাজগ্রন্থের পরিশিষ্ট অধ্যায় নয়; সকল অধ্যায়েই এরা।’’
সোভিয়েত রাশিয়া সফরকালে বিদ্যালয়-শিক্ষার্থীদের সাথে রবীন্দ্রনাথ।
১৯৩১ সালে ‘রাশিয়ার চিঠি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘কালের যাত্রা’। ‘রথের রশি’ নাটিকাতে দেখি স্বয়ং রাজা, পুরোহিত, নর্মদাতীরের বাবাজি, রাজার পিছনে থাকা বেনে ধনপতিদের দল, কেউ রথের রশিকেই নড়াতে পারল না। সন্ন্যাসী বলল, ‘‘কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও গভীর গর্ত। করতে হবে সব সমান, তবে ঘুচবে বিপদ।’’ শেষে এতদিন যারা রথের চাকার তলায় পড়ত সেই শূদ্রের দল রথের রশি ছুঁতেই চাকা সশব্দে পেল গতি, রথ নিজের জায়গা থেকে নেমে পড়ল রাস্তায় ধনপতিদের ও সৈনিকদের আতঙ্কিত করে। নাটিকায় কবি চরিত্র বলল, ‘‘একদিকটা উঁচু হয়েছিল অতিশয় বেশি, ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে, সেইখান থেকে মারলেন টান, বড়োটাকে দিলেন কাত করে। সমান করে নিলেন তাঁর আসনটা।... যারা এতদিন মরে ছিল তারা উঠুক বেঁচে; যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।’’
১৯৩৩ সালে নেপালী বৌদ্ধ-সাহিত্যের গল্প অবলম্বনে ‘চন্ডালিকা’ নাটকটি লেখেন তিনি। এখানে চন্ডাল-কন্যা প্রকৃতির কন্ঠে দিয়েছেন সেই সাহস যাতে বৌদ্ধভিক্ষু আনন্দ যে তাকে ‘‘জল দাও’’ বলে পান করেছিল তৃষ্ণার জল, দিয়েছিল জলদানের সম্মান; তাঁকে মন্ত্র পড়ে এনে দিতে বলে তার মাকে, বলে, ‘‘তাঁকেই মানি যিনি আমাকে মানেন। যে ধর্ম অপমান করে সে ধর্ম মিথ্যে। অন্ধ করে, মুখ বন্ধ করে সবাই মিলে সেই ধর্ম আমাকে মানিয়েছে। কিন্তু, সেদিন থেকে এই ধর্ম মানা আমার বারণ।’’
কিন্তু সবটাই প্রশস্তি নয়; কিছু আশংকা ও অস্বস্তির কথাও প্রকাশ করেছেন কবি। ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে তিনি লিখেছেন, ‘‘শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে - কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না - সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।’’ ‘রথের রশি’ নাটিকাটিতেও কবি চরিত্র বলছে, ‘‘তারপর কোন-এক যুগে কোন-একদিন আসবে উলটোরথের পালা। তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া।’’
তাই রবীন্দ্রনাথের রুশ সফরের নব্বই বছর পূর্তিতে প্রাথমিকভাবে রুশ-বিপ্লব সম্বন্ধে কবির ধারণার অস্পষ্টতা, পরে অনুপ্রাণিত হওয়া, রাশিয়া সফরে নূতন জগত গড়ার কর্মকান্ড দেখে আপ্লুত হওয়া, তাঁর সাহিত্যেও রুশ-বিপ্লবের প্রভাব পড়া একই সাথে ভবিষ্যতের আশংকা প্রকাশ। সমস্ত বিষয়টা ঐতিহাসিক ভাবে দেখা এবং চর্চা হওয়াটা বেশি প্রয়োজনীয় আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে। সবশেষে বলার কথা, ‘‘মনেরে আজ কহ যে,/ভালো মন্দ যাহাই আসুক/সত্যেরে লও সহজে।’’