আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২০ ● ১৬-৩১ আশ্বিন, ১৪২৭
প্রবন্ধ
প্লেগ বিচিত্রা
মানস প্রতিম দাস
মহামারী বা বিশ্বমারী যেমন মানুষের প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করার ভয় দেখায় তেমনি রেখে যায় এমন সব উদাহরণ যা আগামীদিনে সুরক্ষার পাঠ দিতে পারে। হতে পারে কোভিড-১৯-এর বিভীষিকার কাছে প্লেগের ভয় আজ ক্ষীণ তবু সেই রোগের কিছু ইতিহাস সব যুগে প্রাসঙ্গিক। এই নিবন্ধে তারই দুটো পর্ব।
ডেকামেরন
ইতালিয় গদ্যের এক অসামান্য সঙ্কলন ডেকামেরন। লিখেছিলেন গিওভানি বোকাচ্চিও (১৩১৩-১৩৭৫)। ঠিক কোন সময়ে লেখা হয়েছিল এই বই তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সাধারণভাবে মনে করা হয় যে ১৩৪৯ থেকে ১৩৫৩ সালের মধ্যে রূপ পেয়েছিল তাঁর এই গল্পগুলো। সাহিত্যের বিশেষজ্ঞরা বিচার করবেন যে এই সঙ্কলনের উৎকর্ষ ঠিক কোথায়, মধ্যযুগীয় ধারা থেকে সরে এসে কীভাবে এই সব গল্প মানুষের সক্ষমতায় আস্থা রেখে ক্লাসিকাল হয়ে উঠেছিল। আমরা বরং বইয়ের গঠনটা একটু জেনে নিই। প্লেগে আক্রান্ত ফ্লোরেন্স শহর ত্যাগ করে গ্রামাঞ্চলে যায় সাত জন নারী এবং তিন জন পুরুষ। ফিয়েসোল নামে একটা জায়গায়, সুন্দর একটা বাড়িতে ঠাঁই নেয় তারা। দশ জনের প্রত্যেকে এক-একদিন করে রাজত্ব করার সুযোগ পায় গোষ্ঠীর বাকিদের উপর। সে-ই ঠিক করে দেয় কেমন গল্প বলবে অন্যরা। এমনভাবেই বলা হয় একশো গল্প।
প্রত্যেক দিনে গল্পের ধরন আলাদা। প্রথম দিনে বেশ বুদ্ধি করে, মজা করে মানুষের নানা দোষ নিয়ে আলোচনা হল। দ্বিতীয় দিনের গল্পে জয় হল ভাগ্যের কিন্তু তৃতীয় দিনে মানুষের ইচ্ছাশক্তির জয় হল। চতুর্থ দিনে এল বিয়োগান্ত ভালোবাসার গল্প। পঞ্চম দিনে এরই একটা ভিন্নতর রূপ দেখা দিল, প্রথম দিকে হোঁচট খেতে থাকা প্রেমের কাহিনির সুখী পরিণতি হল। ষষ্ঠ দিনে বুদ্ধিমত্তা আর খুশির গল্প বলল সবাই। সপ্তম, অষ্টম ও নবম দিনে ছলচাতুরি, প্রতারণা ইত্যাদির কাহিনি বর্ণিত হল। দশম দিনে আগের দিনগুলোর মূল সুরকে আনা হল এবং বেশ চড়া ঢঙে পরিবেশন করা হল। এটা পরিষ্কার যে বোকাচ্চিও সব গল্প নিজে লেখেন নি, প্রচলিত লোকগাঁথা থেকে তিনি ধার করেছিলেন বহু আখ্যান। কিন্তু বিষয়বস্তুই তো গল্পের সব নয়, পরিবেশনের ভঙ্গী হল আসল। সেখানেই বোকাচ্চিও অনন্য। ডেকামেরনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও তার আকর্ষণ হারায় নি। আজও সেই সব গল্প আবিষ্ট করে পাঠককে, মনোরঞ্জন করে সংগ্রাহকের।
তবে নিছক গল্প বলার থেকে আরও কিছু গুরুত্ব আছে ডেকামেরন বইটার যা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। ১৩৪৮ খ্রীষ্টাব্দে ফ্লোরেন্সে প্লেগের যে মহামারী দেখা দেয় তাতে বিপর্যস্ত হয় গোটা শহর। ধূসর অতীত থেকে মৃত্যুর সঠিক হিসাব পাওয়া চিরদিনই কঠিন কিন্তু শোনা যায় যে শহরের জনসংখ্যার ষাট শতাংশের মৃত্যু হয়েছিল রোগের আঘাতে। বোকাচ্চিও নিজে দেখেছিলেন যে শহরের পথে-পথে দিনে-রাতে মানুষ ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। অন্যদিকে বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে নিজেদের বাড়ির মধ্যেই, মৃতদেহ পচে গেলে তার গন্ধে মৃত্যুর বার্তা পাচ্ছে প্রতিবেশীরা। এই ভয়াবহ মহামারী মানুষে-মানুষে বন্ধন চুরমার করে দিয়েছিল। ভাই ছেড়ে যাচ্ছে ভাইকে, কাকা ছেড়ে দিচ্ছে ভাইপো-ভাইঝির হাত, বোন ত্যাগ করছে ভাইকে - এই সব ঘটনা অতি সাধারণ হয়ে দাঁড়াল। মানুষ কোথায় গিয়ে নিরাপত্তা পাবে তার কোনো হদিশ ছিল না। কেউ লুকোতে চাইছে ঘরের মধ্যে, আবার কেউ-কেউ দল বেঁধে ঘুরে বেড়াছে এখানে-ওখানে। এসব কথা বর্ণনা করে গিয়েছিলেন বোকাচ্চিও। একইসঙ্গে লিখেছিলেন সেই দশ জনের কথা যারা ফ্লোরেন্স ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে গল্পের দুনিয়া গড়ে তুলেছিল। সেই আশ্রয় বাস্তব ছিল না কল্পিত তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক, আসল কথাটা হল আমরা পেয়েছি এক অনুপম সাহিত্য।
ডেকামেরনের গুণকীর্তন করতে গিয়ে অনেকেই প্লেগের সময়, অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা অবস্থায় গল্প শোনার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। কোয়ারান্টাইন বা সোশ্যাল আইসোলেশন, যাই বলি না কেন, মানুষের মনের উপর প্রবল চাপ তৈরি করে। এমন পরিস্থিতিতে গল্প শুনে মনকে তরতাজা রাখা যায়। ডেকামেরন রচনার সময় মুখে-মুখে গল্প শোনানোর মত বিনোদনের বিকল্প তো আর ছিল না! সেটাকেই প্রধান করে তুলেছেন বোকাচ্চিও। তবে এই বইকে শুধুমাত্র প্লেগকেন্দ্রিক ভাবলে ভুল হবে। বোকাচ্চিওর জীবনের বহু ওঠাপড়ার কাহিনি ঠাঁই পেয়েছে এইসব গল্পে। রাজসভায় তাঁর উপস্থিতির কথাই ধরা যাক। একত্রিশ বছর বয়সে যখন ইতালির নেপলসে আসেন বোকাচ্চিও তখন রাজা রবার্টস প্রয়াত। উনিশ বছর বয়সে রবার্টসের নাতনি জিওভানা বসলেন সিংহাসনে, রাজসভায় উচ্চ স্থান পেলেন বোকাচ্চিও। জিওভানা বিয়ে করলেন হাঙ্গেরির রাজার ভাই আন্দ্রিয়াসকে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই নিহত হলেন আন্দ্রিয়াস, রানিকে সন্দেহ করা হল হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে। পরিস্থিতি এমন হল যে জিওভানাকে পালাতে হল এবং পোপ যতদিন অবধি তাঁকে নির্দোষ বলে রায় দেন নি ততদিন নিজের জায়গায় ফিরতে পারেন নি তিনি। আত্মগোপনের এই পর্বে রাজসভার আরও অনেকের সঙ্গে জিওভানার সঙ্গে ছিলেন বোকাচ্চিও। বলা হয়, রানির মনোরঞ্জনের জন্যই নাকি তিনি সেই সব গল্প সংগ্রহ করেছিলেন যা পরে ডেকামেরনে সুচারুভাবে বিন্যস্ত হয়েছিল।
সারসংক্ষেপ জেনেছি আগেই, এবারে জেনে নেওয়া যাক গল্প বলার খেলায় কেমনভাবে যুক্ত হয়ে পড়লেন দশ জন নরনারী। গল্প শুরুর আগে প্লেগের বর্ণনা দিয়েছেন বোকাচ্চিও। প্রাচ্যের দেশে মৃত্যুর প্রক্রিয়া নাকি শুরু হত নাক থেকে রক্তপাতের মাধ্যমে। কিন্তু ইউরোপে বা নির্দিষ্ট করে ফ্লোরেন্সে ব্যাপারটা ঘটেছিল অন্যরকমভাবে। শিশু অথবা পরিণত বয়সের নারী-পুরুষের বগলে বা কুঁচকিতে ফোলা ভাব দেখা দিল। কারো ক্ষেত্রে সেই স্ফীতি একটা আপেলের আকার নিল, কোথাও সেটা দেখাল একটা ডিমের মত। চলতি ভাষায় লোকে এটাকে বলত ফোঁড়া। পরে এগুলো ছড়িয়ে পড়ত সারা দেহে। শরীরে কালো বা নীল দাগ ফুটে উঠত। শুরুর এই ফোঁড়াই হোক বা নীল-কালো দাগই হোক, এগুলো ছিল মৃত্যুর নিশ্চিত পূর্ব-লক্ষণ। কোনো চিকিৎসা ছিল না এই রোগের, তখনকার চিকিৎসকদের পরামর্শে কোনো কাজই হত না। আরও একটা বড় সমস্যা ঘটেছিল এই সময়, মানবদেহের অঙ্গসংস্থান বা রোগ নিরাময়ের জ্ঞান ছাড়াই অনেকে নিজেদের ডাক্তার বলে দাবি করা শুরু করল। ফলে যেখানে বাঁচানোর কিছুটা সুযোগ অন্ততঃ ছিল সেখানেও উপসর্গ দেখা দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে মারা পড়তে লাগল রোগী। রোগ যে কতটা ছোঁয়াচে হতে পারে তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন বোকাচ্চিও। রোগীকে দেখতে আসা, তার সঙ্গে কথা বলা সুস্থ মানুষও সহজে আক্রান্ত হয়ে পড়ছিল। রোগীর পোশাক স্পর্শ করা বা যে পাত্রে সে খেয়েছে সেটা ছোঁয়া থেকেও আশ্চর্যজনকভবে রোগ ছড়াচ্ছিল। মৃত মানুষের পোশাকও ছিল বিপজ্জনক! মৃতদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া পোশাকে কুকুর-বিড়াল শুয়ে থাকলে বা সেটার সংস্পর্শে এলেও তারা রুগ্ন হয়ে দু’একদিনের মধ্যে মারা পড়ছিল।
মানুষের মধ্যে দু’রকম আচরণ দেখা যাচ্ছিল। এক দল খুব সংযতভাবে এমন বাড়ির মধ্যে বাস করতে লাগল যেখানে কোনো অসুস্থ মানুষ নেই। বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলতেন না তাঁরা, জানালা দিয়ে অসুস্থ মানুষের আর্তনাদ বা মৃত মানুষকে নিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনলেও তাকিয়ে দেখতেন না। উচ্চ মানের খাবার ও পানীয় গ্রহণ করতেন, ঘরের মধ্যে সঙ্গীতের চর্চায় মন দিতেন। আর এক দল ছিল ঠিক উলটো, সারা দিন ইচ্ছেমত ঘুরে-খেয়ে-পান করে দিন কাটাতেন এই সব মানুষরা। কারো সঙ্গে কথা বলতে আপত্তি নেই তাঁদের, দূর থেকে মৃত্যু বা অসুস্থতার ঘটনা দেখলে ব্যঙ্গ করতেন তাঁরা। নিজেদের বাড়িতে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না এই সব মানুষদের, যে কোনো আগন্তুক ঢুকে পড়তে পারত খেয়ালখুশি মত। তবে হ্যাঁ, অসুস্থ মানুষের কাছে ঘেঁষতেন না এঁরা। সে ব্যাপারে সতর্কতা ছিল চূড়ান্ত। শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী লোকেদেরও অবশ্য বাদ দেওয়া যায় না যাদের বোকাচ্চিও একবার ‘নিষ্ঠুর’ বলে উল্লেখ করে রেখেছেন।
এমনই একটা পরিস্থিতিতে, এক মঙ্গলবার, সান্তা মারিয়া নভেলার চার্চে উপাসনার পরে সাত জন মহিলা বেরিয়ে এলেন যাঁদের মধ্যে কিছু-না-কিছু সম্পর্ক ছিল। হয় তারা বন্ধু, নয়ত প্রতিবেশী আর নয়ত মা-মেয়ে। সবথেকে বয়স্ক মহিলার বয়স আটাশ এবং কনিষ্ঠার বয়স আঠেরোর মধ্যে হবে। প্রত্যেকেই ভদ্র এবং মার্জিত। এঁদের নাম জানা ছিল না বোকাচ্চিওর, তাই চেহারার বৈশিষ্ট্য দেখে তিনি নিজেই নাম দিলেন - প্যাম্পিনিয়া, ফিলামেটা, ফিলোমেনা, এমিলিয়া, লরেটা, নেইফিলে এবং শেষ জন হলেন এলিসা। এঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করলেন কোনোরকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। প্যাম্পিনিয়া বললেন, নিজেদের জীবনকে রক্ষা করার অধিকার আছে সবার। এখান থেকে বাড়ি ফিরে গেলে সে অধিকারের কোনো মানে থাকে না, চারদিকে কেবল অসুস্থতা আর মৃতদেহ। তার থেকে বরং আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। সেখানে প্রকৃতি কত সুন্দর! প্লেগ সেখানে হানা দেয় না এমন নয় কিন্তু শহরের মত এমন মৃত্যুমিছিল নেই সেখানে। এই কথা সমর্থন করেও ফিলোমেনা বললেন যে আমরা সবাই মহিলা। নিজে থেকে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে আমাদের? এলিসার সমর্থন পেলেন তিনি। ঠিক এই সময় তিন জন যুবাপুরুষ এগিয়ে এলেন মহিলাদের দিকে। সব থেকে ছোট যে যুবক তাঁর বয়স হবে পঁচিশের মত। নিজেই এঁরা নিজেদের নাম জানালেন - প্যামফিলো, ফিলোস্ত্রাতো এবং ডায়োনিও। তিনজনকেই পছন্দ হল এই মহিলাদের। কয়েকজন তো তখনই প্রেমে পড়তে শুরু করলেন! মোটামুটিভাবে ঠিক হল, এঁদের সঙ্গেই মহিলারা যাবেন নিজেদের গন্তব্যে। তিন জন ভৃত্যকেও অবশ্য বেছে নিলেন যুবা পুরুষরা। পর দিন ভোরে তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন নিজেদের লক্ষ্যপূরণে এবং অনেকটা হাঁটার পর এমন একটা পাহাড়ের কাছে এলেন যার উপরে ছিল অসামান্য একটা প্রাসাদ। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ঘর ছিল সেখানে এবং চারপাশে ছিল সুন্দর তৃণভূমি এবং বাগান।
প্যাম্পিনিয়া এবার বললেন, শহর থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনাটা আমিই দিয়েছিলাম আর তাই এখানে কীভাবে থাকব তা আমিই ঠিক করে দেব। শৃঙ্খলা আর সুব্যবস্থা ছাড়া কোনো আনন্দই স্থায়ী হতে পারে না। ঠিক সেই কারণে আমাদের একজন প্রশাসক থাকবেন প্রত্যেক দিনের জন্য। তিনি হবেন সেই দিনের চীফ কমাণ্ডার, আমরা তাঁকে সম্মানের সঙ্গে মেনে চলব। প্যাম্পিনিয়াকেই প্রথম দিনের জন্য চীফ কমাণ্ডার করা হল এবং তিনি দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন সবার জন্য। সময় কাটানোর জন্য তাস-দাবা সবই ছিল কিন্তু প্যাম্পিনিয়া সেগুলো বাতিল করে অন্য একটা প্রস্তাব দিলেন - সবাই নিজের মত করে গল্প বলবে। প্রস্তাব মানা হলে তিনি বললেন, প্রত্যেকের কাছে যে কাহিনি সবথেকে বেশি সুখকর, সেই গল্পটাই সে আজ বলবে এখানে। এভাবেই শুরু হল ডেকামেরনের পথ চলা। সে পথ আজও শেষ হয় নি।
রোম সাম্রাজ্যের প্লেগ
রোমান সাম্রাজ্যের পত্তন এবং বিস্তার নিয়ে কম বই লেখা হয় নি পৃথিবীর ইতিহাসে। সে প্রসঙ্গ এখানে ততটা প্রয়োজনীয় নয়। তার থেকে জরুরি ওই সাম্রাজ্যের পূর্ব ভাগের বিশেষ সময়ের ঘটনার আলোচনা। সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন ঠিক করলেন যে সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করবেন। ৩৩০ খ্রীষ্টাব্দের কথা সেটা, মে মাসের ১১ তারিখে রোম থেকে প্রশাসনিক কেন্দ্র চলে এল বাইজ্যান্টিয়ামে। তবে সম্রাটের নামের থেকে বড় নাম আর কী হতে পারে আর তাই বাইজ্যান্টিয়ামের নাম পাল্টে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যে হয়ে গেল কনস্ট্যান্টিনোপল। আজ সেটা ইস্তানবুল। এমনি-এমনি তো আর কোনো সম্রাট একটা নতুন শহর বেছে নেন না, কিছু সুবিধে নিশ্চয়ই ছিল সেই জায়গার। ভৌগোলিক দিকের কথাটা প্রধান আলোচ্য। গোল্ডেন হর্ন নামে একটা জলপথ আছে শহরের পাশে যার প্রান্তে একটা প্রাকৃতিক মোহনা মিলেছে বসফরাস প্রণালীর সঙ্গে। এই দুটোর জল আবার মিলিত হয় মারমারা সাগরের জলরাশির সঙ্গে। এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে এটা এমন এক জায়গা যেখানে বসে যাবতীয় জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এজিয়ান সাগরের মধ্যে দিয়ে ভূমধ্যসাগরে কেউ যেতে ইচ্ছে করুক কিংবা উত্তরে কৃষ্ণসাগরের দিকে হাল ঘোরানোর বাসনা রাখুক, কনস্ট্যান্টিনোপলের হুকুম ছাড়া তার এগোনোর অনুমতি নেই। ফলে খুশিমত অর্থ আর সম্পদ যোগানের সুযোগ দিয়েছিল এই অবস্থান।
তবে সুবিধের জায়গায় বসে থাকলেই তো আর চলে না, নিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হয়। সম্রাট বদলাতে থাকলেও এই উদ্বেগ গেল না। ৩৯১ সালের নভেম্বরে সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস কনস্ট্যান্টিনোপলকে সুরক্ষিত করতে গোল্ডেন গেট বানানোর কাজ শুরু করালেন। পাথরে বানানো বারো মিটার উঁচু এই প্রবেশ দ্বারের দু’দিকে ছিল স্তম্ভ আর ছিল তিনটে খিলান। কিন্তু ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে গথ বাহিনীর হাতে রোমের পরাজয়ে আতঙ্কিত হলেন দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস। তিনি বুঝলেন যে আরও বেশি নিরাপত্তা দিতে হবে তাঁর রাজধানীকে। এই সময়েই তিনটে স্তরে প্রাচীর গঠন শুরু হল শত্রুদের আক্রমণ রুখতে। ৪৩৯ সালে শেষ হল সাড়ে ছ’ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীরের নির্মাণ। মারমারা সাগরের উপকূল থেকে গোল্ডেন হর্ন মোহনা অবধি পুরো এলাকাটা ঘিরে ফেলল এই সুরক্ষা প্রাচীর। আরব বাহিনী থেকে শুরু করে স্লাভ যোদ্ধারা, সবাই চেষ্টা করলেন এই প্রাচীরকে ভাঙতে কিন্তু ইতিহাসের কোনো পর্বেই সফল হতে পারল না আক্রমণকারীরা।
এই সাম্রাজ্যে ষষ্ঠ শতকে, ৫২৭ থেকে ৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দ অবধি রাজত্ব করেন প্রথম জাস্টিনিয়ান। যুদ্ধবিগ্রহে বেশ সফল ছিলেন তিনি। সাম্রাজ্যের পশ্চিম ভাগের শাসকরা যে সব এলাকা খুইয়েছিলেন সেগুলো তিনি আবার জয় করলেন। দক্ষ সেনাপতি বেলিসারিয়াসের সাহায্যে ফিরে পেলেন উত্তর আফ্রিকা, স্পেন ও ইতালি। কিন্তু চোখে দেখা যায় এমন শত্রুদের হারানো সহজ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুরা সেই তুলনায় প্রায় অপ্রতিরোধ্য। ঐতিহাসিকদের মত, চীন ও ভারত হয়ে বাণিজ্যের সূত্রে প্লেগের জীবাণু পৌঁছে গেল আফ্রিকার সেই অঞ্চলে যেখানে রয়েছে বিশাল সব হ্রদ - ভিক্টোরিয়া, টাঙ্গানাইকা, মালাউই ইত্যাদি। মিশরে পৌঁছতেও সময় লাগল না। বাইজ্যান্টাইন আমলের ইতিহাসকার সিজারিয়া নীল নদের উত্তর ও পূর্ব পাড়ের অঞ্চলকে রোমান সাম্রাজ্যে প্লেগ ছড়ানোর উৎস বলে বর্ণনা করেছেন। প্লেগ গবেষক ওয়েণ্ডি ওরেন্ট জানিয়েছেন যে এখান থেকে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ল দুটো অভিমুখে - আলেকজান্দ্রিয়া এবং প্যালেস্তাইন। বয়ে নিয়ে গেল কালো ইঁদুর যার বৈজ্ঞানিক নাম র্যাটাস র্যাটাস। শস্য ভর্তি জাহাজে সেগুলো পাড়ি দিল রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীর দিকে।
দুটো কারণে প্লেগ ছড়াল সহজে - যুদ্ধ আর শস্য উৎপাদনে ঘাটতি। ইতিহাসকাররা দেখেছেন যে সেই সময়ে দক্ষিণ ইতালিতে স্বাভাবিকের নীচে নেমে গিয়েছিল তাপমাত্রা, কমে যায় সূর্যকিরণের পরিমাণ এবং তার ফলে মার খেল ফসলের উৎপাদন। এমন আবহাওয়া রয়ে গেল প্রায় এক দশক ধরে। এর ফলে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ খাবারের সন্ধানে ঘুরতে লাগল এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। এদিকে নানা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম জাস্টিনিয়ান লড়াই করছেন বিভিন্ন শত্রুর সঙ্গে। ইতালিতে তাঁর প্রতিপক্ষ অস্ট্রোগথ, উত্তর আফ্রিকায় লড়াই ভ্যাণ্ডাল আর বার্বারদের সঙ্গে। এতেও শেষ নেই। বিভিন্ন দিক থেকে ফ্র্যাঙ্ক, স্লাভ আর আভারদের আক্রমণ ঠেকাতে হচ্ছিল তাঁকে। যুদ্ধ মানেই প্রচুর সৈন্যের সমাবেশ আর বিপুল পরিমাণ খাবারদাবারের যোগান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। মিশর থেকে জাহাজে করে আসা শস্যের সঙ্গে ছিল ইঁদুরের দল। সেগুলোর গায়ে লেপ্টে থাকা মাছি বন্দরগুলোর আশেপাশে ছড়িয়ে দিল প্লেগের জীবাণু - ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস। দেখা গেল, উত্তর ইউরোপে এই রোগ ছড়াল না, গ্রামাঞ্চলেও রোগের দাপট দেখা দেয় নি। কিন্তু বন্দরের কাছাকাছি থাকা কনস্ট্যান্টিনোপলে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল রোগ। কেউ বাদ গেল না, এমনকি সম্রাট নিজেও আক্রান্ত হলেন। তিনি বেঁচে গেলেও হাজার-হাজার মানুষের মৃত্যু ঠেকানো গেল না। প্রোকোপিয়াসের লেখা ‘দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অফ দ্য কোর্ট অফ জাস্টিনিয়ান’ জানাচ্ছে যে সেই সময় প্রতি দিন রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে মারা যাচ্ছিল প্রায় দশ হাজার মানুষ। আধুনিক ইতিহাসকাররা সংখ্যাটাকে তিন হাজারে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা অবশ্যই কোনোভাবে কম নয়। কোথায় ফেলা হবে এত মৃতদেহ? কবরখানা ভর্তি হয়ে গেলে গণসমাধি দেওয়ার জন্য দীর্ঘ গর্ত খোঁড়া হল, তাতেও যখন সামলানো গেল না তখন সমুদ্রের মধ্যে নিক্ষেপ করা হল মৃত শরীরগুলোকে। মৃতদেহ সরাতে কাজে লাগানো হল সেনাবাহিনীকে। চার মাস ধরে চলল তাণ্ডব। তারপরে কি থামল? ওয়েণ্ডি ওরেন্ট জানিয়েছেন, পরের তিনটে শতক ধরে টিঁকে ছিল এই রোগের দাপট। শেষ বার মহামারী হয় ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে। তার পরে অবশ্য চতুর্দশ শতক অবধি এমন বিভীষিকা দেখতে হয় নি ইউরোপকে।
প্লেগের আক্রমণে ভূমধ্যসাগরের চারপাশের এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হল, দুর্বল হল জাস্টিনিয়ানের প্রতাপ। সুযোগ নিল শত্রুরা। স্ক্যাণ্ডিনেভিয়া অঞ্চলের উপজাতি লোম্বার্ডরা উত্তর ইতালিতে ঢুকে সেখানে বাইজ্যান্টিয়াম সাম্রাজ্যের ছোট সৈন্যদলকে সহজেই পরাস্ত করল। এতে ইতালিয় উপদ্বীপের যে খণ্ডন হল তা উনবিংশ শতকের আগে আর জোড়া লাগে নি। উত্তর আফ্রিকায় আরবদের হাতে পর্যুদস্ত হল রোমানরা। এখানেও কারণ সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতা। সেনাদলে ভর্তি হওয়ার লোক কই তখন? একইভাবে জমি পড়ে থাকলেও চাষ করার মত মানুষ নেই। ফলে কৃষিতেও এল বিপর্যয়। অথচ জাস্টিনিয়ান তাঁর সাম্রাজ্য বাড়ানোর অভিযান থামাবেন না, বিপন্ন মানুষের কাছ থেকে কর নেবেন একই হারে আর জনকল্যাণে মন না দিয়ে চার্চ নির্মাণে কাজে লাগাবেন তাঁর প্রশাসনকে। এমন সম্রাটরাই কি মহান বলে গণ্য হন ইতিহাসে?
বিজ্ঞানের পক্ষ থেকে একটা প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। জাস্টিনিয়ান প্লেগের জীবাণু কি কোনো রূপে এখনও জীবিত আছে? মানুষের মধ্যে কি আবার মহামারী ঘটাতে পারে এর কোনো স্ট্রেইন বা রূপভেদ? এ ব্যাপারে গবেষণা হয়েছে এবং একটা অনুসন্ধানের কথা তো উল্লেখ করাই যায়। নর্দার্ন অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ডেভ ওয়াগনার এবং তাঁর সহযোগীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ষষ্ঠ শতক এবং চতুর্দশ শতকের ইউরোপীয় প্লেগের জীবাণুর মধ্যে কি মিল রয়েছে? জাস্টিনিয়ান প্লেগে মৃত মানুষের কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয় জার্মানির ব্যাভেরিয়া থেকে। তারপর সেগুলোর দাঁতের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন বিজ্ঞানীরা। কারণ একটাই, প্লেগের জীবাণু ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস থাকে রক্তে এবং দাঁতের মধ্যে অনেক রক্তজালিকা রয়েছে। ষষ্ঠ শতকের জীবাণুর ডি-এন-এ নিয়ে আজকের সময়ে জানা সবরকম রূপভেদের সঙ্গে তুলনা করেন বিজ্ঞানীরা। কিছু সাদৃশ্য থাকলেও আপাদমস্তক মিল খুঁজে পান নি তাঁরা। অর্থাৎ প্লেগ আজও ঘটতে পারে জীবাণুর মাধ্যমে কিন্তু জাস্টিনিয়ান প্লেগের বিশেষ ধরণ আজ আর টিঁকে নেই। বিবর্তনের কানাগলিতে গিয়ে সেটা লুপ্ত হয়েছে।
আজও ইঁদুরদের প্রায় দু’শো প্রজাতি প্লেগের জীবাণুর নানা ধরণ বয়ে নিয়ে বেড়ায়। সেগুলোর শরীর থেকে কোনো একজন মানুষের শরীরে এবং তার পরে গোটা সমাজে রোগ ছড়ানো অসম্ভব কিছু নয়। এটা যদি আশঙ্কার কথা হয় তবে আশার কথা হল, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন আজকের দুনিয়া এবং সবথেকে মোক্ষম কথাটা হল এই যে আজ ইয়ারসিনিয়া পেস্টিসকে কাবু করার মত অ্যান্টিবায়োটিক আছে আমাদের হাতে।