আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২০ ● ১৬-৩১ আশ্বিন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

চাকরি ক্রমশ মরীচিকা হয়ে যাচ্ছে

গৌতম হোড়


ছবিটা খুব পরিষ্কার। সরকারি চাকরির আশা না করাই ভালো। কিছুদিন আগে সংসদে কেন্দ্রীয় পার্সোনেল মন্ত্রী হিসাব দিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সকারের প্রায় সাত লক্ষ পদ খালি। ৩৮ লক্ষ অনুমোদিত পদ। তার মধ্যে কমবেশি ৩১ লক্ষ পদে লোক আছে। এই ঘোষণার পর দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। একটা হলো, ভারতীয় রেলে বেসরকারি সংস্থাকে ট্রেন চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে। আইআরসিটিসি-র হাতে তেজস ট্রেন চালাবার দায়িত্ব দিয়ে যে পরীক্ষাটা হয়েছিল, এ বার সেটা অনেক ব্যাপক আকারে হবে। বেশ কিছুদিন হলো, রেলের অনেক পরিষেবার বেসরকারিকরণ হয়ে গিয়েছে। ক্যাটারিং, স্টেশন পরিষ্কার রাখা সহ অনেক ক্ষেত্র আউটসোর্স করা হয়েছে। এ বার বেসরকারি সংস্থা ট্রেনও চালাবে। তার মানে রেলে চাকরির আরও সংকোচন হবে।

কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরের মধ্যে রেলই সব চেয়ে বড় নিয়োগকর্তা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের ৩১ লক্ষ কর্মীর মধ্যে ১২ লক্ষ ১৮ হাজার ৩৩৫ জন হলেন রেলের কর্মী সেখানে যত বেসরকারিকরণ হবে, ততই স্বাভাবিকভাবে কর্মীসংখ্যা কমবে। বস্তুত এই ধরনের একটি সার্কুলারও গত জুনে জারি হয়েছিল। তা নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পরেই রেল বোর্ডের ডিজি এইচআর আনন্দ এস খাতি জানিয়ে দেন, রেলের চাকরির ‘‘রাইটসাইজিং হবে, ডাউনসাইজিং নয়।’’ ইকনমিক টাইমসের ১৯ জুলাইয়ের খবর হলো, খাতি বলেছেন, কিছু কর্মীর কাজের চরিত্র বদল হবে, কিন্তু কারও কাজ যাবে না। তার আগে জেনারেল ম্যানেজারদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ৫০ শতাংশ খালি পদে নিয়োগ করা যাবে না। নতুন কোনো পদ তৈরি করা হবে না।

এই পরিস্থিতিতে খাতির ব্যাখ্যা, রেল নন স্কিলড পদগুলি কমিয়ে দক্ষ বা স্কিলড কর্মীদের নিতে চায়। তাই সেই সব পদ তৈরি করতে চায়। আগের সার্কুলারের মানে না কি সেটাই। যে সব পদে কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে, বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, সেখানে যথারীতি নিয়োগ প্রক্রিয়া চলবে। বোঝাই যাচ্ছে, খাতি আপাতত বিতর্ক ধামাচাপা দিতে চাইছেন। যদি ধরে নেওয়া হয়, তিনি ধ্রুব সত্য কথা বলছেন, তা হলে আগের সিদ্ধান্তে কেন তা উল্লেখ করা হলো না। কেন বলা হলো না, ৫০ শতাংশ অদক্ষ পদ তুলে দিয়ে সমপরিমাণ দক্ষ শ্রমিকদের পদ তৈরি করা হবে। অদক্ষ কর্মীদের পদে লোক নিয়োগ তো এখনই বন্ধ করে দেওয়া হবে। নতুন করে দক্ষ কর্মীদের কবে নেওয়া হবে? প্রশ্ন তো উঠবেই। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রেলের স্ট্যান্ডিং কমিটি রেলব্রিজগুলির অবস্থা নিয়ে একটা রিপোর্ট দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, রেলব্রিজগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য অনুমোদিত পদের তুলনায় কর্মীসংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ কম। মানে ৪০ শতাংশ পদে আর লোক নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই সরকারি চাকরির সংকোচন হয়েছে। আগের নির্দেশে তো সেই কথাটাই বলা হয়েছিল। আজ হোক বা কাল, সেই পথেই রেল চলতে পারে।

রেলের যুক্তি, তাঁদের খরচের ৬৫ শতাংশই চলে যাচ্ছে, বেতন ও পেনশন দিতে। তা হলে তারা আধুনিকীকরণ করবে কী করে, পরিষেবাকে উন্নতই বা করবে কী করে? এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু হলো চাকরির সুযোগ কমতে থাকা, তাই রেলের স্বাস্থ্য ফেরানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। ঘটনা হলো, খরচ কমানোর চক্করে রেল কর্মী বাড়ানো দূরে থাক, ক্রমশ কমাতে শুরু করেছে। রেলের বেসরকারিকরণ যত বেশি হবে, ততই সরকারি কর্মীর সংখ্যাও কমবে, এটা বুঝতে রকেট সায়েন্স জানার দরকার নেই। গত কয়েক বছরের হিসাব সেই কথাই বলে। সংকোচন সমানে হয়ে চলেছে।

এ বার আসি আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে। এয়ারপোর্ট। করোনাকালে দেশের মোট ছ-টা এয়ারপোর্ট আদানি গোষ্ঠীকে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। প্রথমে জুলাই মাসে তিনটি এবং আগস্টে তিনটি এয়ারপোর্ট তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই নিয়ে বিশ্ব টেন্ডার ডাকা হয়েছিল। তার মধ্যে থেকে আদানির কপালে শিকে ছিঁড়েছে। লখনউ, আমেদাবাদ, জয়পুর, ম্যাঙ্গালুরু, তিরুবনন্তপুরম, গুয়াহাটি এয়ারপোর্টের অপারেশন, ম্যানেজমেন্ট ও ডেভলাপমেন্টের কাজ তারা করবে। পিপিপি মোডে এই কাজ হবে। এর জন্য এয়ারপোর্ট অথরিটি এক হাজার সত্তর কোটি টাকা পাবে। বিজনেস টুডে জানাচ্ছে, অসামরিক পরিবহন মন্ত্রী হরদীপ পুরি বলেছেন, এয়ারপোর্ট অথরিটির হাতে দেশে একশোর বেশি এয়ারপোর্ট আছে। তার মধ্যে আরও কিছু এয়ারপোর্ট এভাবে বেসরকারি সংস্থাকে লিজে দিয়ে দেওয়া হবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে আরও একশোটির মতো এয়ারপোর্ট তৈরি করবে এএআই।

তার মানে এয়ারপোর্ট থেকেও ক্রমশ হাত গুটিয়ে নিচ্ছে সরকার। দিল্লি, মুম্বই সহ বড় শহরের কয়েকটি এয়ারপোর্ট আগেই বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আরও ছয়টি এয়ারপোর্টকে তুলে দেওয়া হলো। এরপর বাকিগুলোকেও দেওয়া হবে। তার মানে এখানেও সরকারি চাকরির সুযোগ কমে গেল। বস্তুত, এভাবেই তো খালি পদে লোক নিয়োগ না করতে করতে প্রায় সাত লক্ষ কর্মী কমে গেছে। ভবিষ্যতে তা আরও কমবে। আর যেভাবে রেল, বিমান সহ বিভিন্ন পরিষেবা দ্রুত বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চলেছে সরকার, তাতে অদূর ভবিষ্যতে কর্মীসংখ্যা আরও অনেকটা কমলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যোজনা কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ আমলা অমিতাভ রায় যেমন মনে করেন, করোনার সময় সরকার কখনও ৩৩ শতাংশ কর্মী, কখনও ৫০ শতাংশ কর্মীকে নিয়ে কাজ করিয়েছে। এটাও একটা পরীক্ষা ছিল। তারা দেখে নিয়েছে, কত কম কর্মীকে দিয়ে কাজ চালানো সম্ভব। ভবিষ্যতে তাই কর্মীসংখ্যা আরও কমালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর এই সরকারের মন্ত্রই তো মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ননেন্স। মিনিমাম গভর্নমেন্টে তো বেশি কর্মীর প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।

এ তো গেল সরকারি চাকরির কথা। বেসরকারি হাতে রেল, বিমান সহ অন্য ক্ষেত্র গেলে সেখানে চাকরির সুযোগ বাড়ার কথা। কিন্তু মুসকিল হলো বেসরকারি চাকরির অবস্থা তথৈবচ। সেখানে চাকরির নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। গতবছর মার্চ মাসে মিন্ট-এর রিপোর্ট বলছে, মোদী সরকার শ্রম আইন বদল করেছে। নতুন নিয়মে কোম্পানিগুলি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর্মী নিয়োগ করতে পারবে। ২০১৬তে এটা বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে চালু করা হয়েছিল। একমাস, সপ্তাহ বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তি করা যাবে। তারপর কোনো নোটিশ না দিয়েই কাজ শেষ করে দেওয়া যাবে। চুক্তি বাতিল হলে কর্মীরা কোনো বাড়তি বেতনও পাবেন না। কাজের সময়ও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি সংস্থার হাতে রয়েছে মোক্ষম অস্ত্র, হায়ার অ্যান্ড ফায়ার।

করোনাকালে ভারতে ১ কোটি ৮৯ লক্ষ বেসরকারি সংস্থায় চাকুরিজীবী তাঁদের চাকরি হারিয়েছেন। সেন্টার ফল মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ডিজিটাল মিডিয়া দ্য ওয়্যার জানাচ্ছে, এপ্রিলে চাকরি হারিয়েছিলেন ১ কোটি ৭৭ লক্ষ মানুষ। মে মাসে ১০ লক্ষ। জুনে আবার ৩৯ লক্ষ লোক চাকরি পান। জুলাইতে আবার ৫০ লক্ষ লোকের চাকরি গেছে।

হায়ার অ্যান্ড ফায়ারের অমোঘ নিয়মের ব্যতিক্রম নয় সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িতরাও। একসময় যে সব সংবাদপত্র সংস্থায় চাকরি করাকে সরকারি চাকরির থেকেও নিরাপদ বলে মনে করা হতো, সেখানেও যথেচ্ছ ছাঁটাই হয়েছে। সংবাদপত্রের অনেক এডিশন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রচুর কর্মীকে ইস্তফা দিতে বলা হয়েছে।

হায়ার অ্যান্ড ফায়ার নীতি ও চুক্তিভিত্তিক কাজের ফলে বেসরকারি চাকরিতেও কোনো নিরাপত্তা নেই। আর আমাদের দেশে যেহেতু সামাজিক নিরাপত্তা নেই, তাই চাকরি গেলে অকুলপাথারে পড়তে হয়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পেনশন নামক ব্রহ্মাস্ত্র আছে। কিন্তু বেসরকারি চাকরিতে তাও নেই। আর আমাদের তো উন্নত দেশের মতো সামাজিক নিরাপত্তা নেই, কবে হবে, আদৌ হবে কি না কেউ জানে না, ফলে অবস্থা খুবই খারাপ। করোনাকালে উন্নত দেশে চাকরি হারালে সামাজিক নিরাপত্তার কারণে মানুষের অসুবিধা হয়নি। সরকারের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চেপেছে ঠিকই, কিন্তু লোকে বেঁচেছেন। ভারতে আনলকের পর অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে কাজ আবার কিছুটা হলেও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সংরক্ষিত ক্ষেত্রে যে প্রায় দু-কোটি মানুষ কাজ হারালেন তাঁদের কী হবে? ভবিষ্যতে তাঁরা যদি কাজ ফিরেও পান, তা হলে তাঁরা কি আর আগের বেতন পাবেন? সন্দেহ আছে। কাজ কতজন ফিরে পাবেন, কতজন আগের বেতনে পাবেন, এই দুই বিষয়েই সন্দেহ আছে। যাঁরা ৪৫ বা তার বেশি বয়সে চাকরি হারাচ্ছেন, তাঁদের শোচনীয় অবস্থার কথা বলে বোঝাবার দরকার হয় না।

ফলে ছবিটা আদৌ উজ্জ্বল নয়, বরং বড়ই উদ্বেগজনক। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় খবর, গুজরাটে ১২ হাজার ক্লাস থ্রি পদের জন্য ৩৭ লক্ষ আবেদনকারী। এর মধ্যে গ্রামে ১৮০০ চাকরির জন্য আবেদন করেছেন ১৯ লক্ষ। গুজরাট দেশের সম্পন্ন রাজ্যের মধ্যে একটি। আর এটাও করোনার আগের ছবি। এখন হলে সংখ্যাটা অনেকটাই বাড়ত। ২০১৮ সালেরটা তো রেকর্ড। রেলের ১ লক্ষ পদের জন্য ২ কোটিরও বেশি আবেদনকারী। সেই আবেদন কী করে বাছাই হলো, কীভাবে চিঠি পাঠানো হলো, পরীক্ষা নিয়ে কী করে নিয়োগ হলো কে জানে। তবে এখন যা অবস্থা, তাতে ওই রেকর্ডও ভেঙে যেতে পারে। তাই এ বড় সুখের সময় নয়। বড়ই চিন্তার, আতঙ্কের, জীবনযুদ্ধের সময়।