আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২০ ● ১৬-৩১ আশ্বিন, ১৪২৭

সমসাময়িক

উপোসের পদধ্বনি


“লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল, তার পরে কে ভিক্ষা দেয়! - উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তার পরে রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গোরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজ ধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ী বেচিল। জোত জমা বেচিল। তার পর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কিনে? খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল”। (বঙ্কিমচন্দ্র, আনন্দ মঠ, প্রথম পরিচ্ছেদ)

১২৭৬ তথা ১৭৭০ এর মন্বন্তরের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ১৭৫৭-এ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ১৩ বছরের মাথায় বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিন কোটির মধ্যে এক কোটি মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে থেকে মারা যান। মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের কর আদায় কিন্তু কমে নি। উলটে রাজস্ব আদায় বেড়ে যায়। চাল ডালের ব্যাবসা করে ইংরেজ কোম্পানি ও তাঁদের অনুগতরা ফুলে ফেঁপে ওঠেন।

কোম্পানি আগে কাপড়ের ব্যবসা করলেও এখন সব ব্যাবসা দখলে তৎপর হয়ে ওঠে। ২০২০ সালে ভারতে এখন গুজরাট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজত্ব। পেট্রোল ডিজেল গ্যাস বিদ্যুৎ প্ল্যাস্টিক হীরা টেলিকম নিয়ে তাঁরা আর ব্যস্ত নেই। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যাবসায় নেমেছে। এবং চাইছে সব কিছুর দখল নিতে।

করোনা সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখদায়ক হলেও মোদী সরকার ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষক আদানি আম্বানির কাছে অতীব সুখদায়ক। ইচ্ছে মতো আইন আনা গেছে। লক ডাউনের অজুহাতে কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ নেই। আন্দোলন নেই। সংসদ প্রশ্নহীন। মিডিয়া মূলত এখন মোডিয়া। সেই সুযোগে জুন মাসে প্রথম অধ্যাদেশ জারি করা হল অত্যাবশ্যক পণ্য আইন বলে কিছু থাকবে না। চাল ডাল আলু পেঁয়াজ নুন তেল মশলার ইচ্ছে মতো দাম বাড়ানো যাবে কমানো যাবে।

শুনতে খুব ভালো। পেট্রোল ডিজেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ তোলার সময় এক কথা বলা হয়েছিল। বিশ্ববাজারে দাম কমলে এখানেও দাম কমবে। বিশ্ববাজারে তেল মাইনাসের বিক্রি হলেও এখানে ৮০-৮৩ টাকা তেলের দাম। এই প্রথম ডিজেলের দাম পেট্রোলের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। চাল ডাল আলু পেঁয়াজ নুন সব্জি মশলা - এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। ডিজেলের দাম বাড়লে সবের দাম বাড়ে। বেড়েছে। সংসদে কৃষি বিল ও অত্যাবশ্যক আইন বে-আইনিভাবে পাশ হওয়ার আগে থেকেই জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন।

গত চার মাসের ব্যবধানে অন্তত ১০ রকম নিত্যপণ্যের মূল্য অব্যাহতভাবে বেড়েছে। চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনো লঙ্কা ও আদা। এর মধ্যে কেবল চালের মূল্যই বেড়েছে কেজিতে ৪-৫ টাকা। আটার মূল্য বেড়েছে ১০ টাকা। ডালের মূল্য বেড়েছে কেজিতে ১৫-২০ টাকা। সয়াবিন তেলের মূল্য ২০ টাকারও বেশি। গত এক মাস আগেও ২৫ টাকায় যে পেঁয়াজ পাওয়া যেতো, এখন সেই পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। গত বছর নভেম্বরে এই পেঁয়াজ কিনতে ২০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। অথচ চাষি বেচেছিল পাঁচ পয়সা দরে (হ্যাঁ, পাঁচ পয়সা)। রসুনের দাম বৃদ্ধি কিলোতে বেড়েছে ৫০ টাকা। শুকনো লঙ্কার মূল্য কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। কাঁচা লঙ্কার ১০০ টাকা। প্রতি কেজিতে। বাজারে কুমড়োর কিলো ৩০-৩৫ টাকা। বাকি ঢেঁড়শ, ঝিঙ্গে, পটল ৪০-৫০ টাকা কেজি। আলু এ-পর্যন্ত রেকর্ড করেছে। ৩৫-৪০ টাকা কেজি। টমেটো ধরাছোঁয়ার বাইরে ৮০-১০০ টাকা। ফুলকপি ৩০-৪০ টাকা। মাছের দাম বেড়েছে ৩০-৫০ টাকা। খাসির মাংসের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। ডিমের দাম বেড়েছে প্রতি ডজনে ১২ টাকা। ইলিশের কথা ধনীর জন্যই তোলা থাক।

খুচরো ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তে এবং হিমঘরে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারেও বেড়েছে। শোনা যাচ্ছে, হিম ঘরের সব আলু এ-বার দুয়েকটি কর্পোরেট সংস্থা কিনে নিয়েছে। তারাই ঠিক করছে দাম। চাষির আলু আগস্টে সাধারণভাবে জুলাইয়ে বিক্রি হয়ে যায়। কারণ, আলু বেচা টাকায় তাঁরা ধান চাষ করেন। ছোট আলু ব্যবসায়ীরাও বেচে দেন আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের শুরুতেই। পড়ে থাকে হিমঘর মালিক বা ধনীদের কেনা আলু। সেই আলু বেশি দাম দিয়ে কিনে নিয়েছে একটি কর্পোরেট সংস্থা। পশ্চিমবঙ্গের কোনো সংবাদমাধ্যম এ-খবর করতে নারাজ। রাজস্থান নিয়ে কিন্তু খবর হয়েছে ইংরেজি দৈনিকে। টমেটোর দাম ২০০ টাকা কিলো। এক সপ্তাহে ৫০-৮০ টাকা বেড়েছে। কারণ আম্বানির সংস্থা রিলায়েন্স কৃষক মান্ডি থেকে ৫০ শতাংশ টমেটো কিনে নিয়েছে। ফড়েদের কাছে টমেটো অমিল। বড়ো ফড়ে রিলায়েন্স তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাচে ঘেরা দোকানে সে-সব বিক্রি করছে। খুচরো বিক্রেতারা পাচ্ছেন না। লক ডাউনের শুরুতে আলুর পাইকারি দর ছিল ১৬০০-১৭০০ টাকা কুইন্টাল। ওটাই মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারিতে পাওয়া যেতো ২৪০০ টাকায়। বাজারে ২৫ টাকা কিলো। পেঁয়াজ বাজারে ছিল ২৮ টাকা কিলো। পাইকারি দোকানে ২১০০ টাকা কুইন্টাল। পরে বাজারে রাজ্য সরকারে টাস্ক ফোর্স নামায় আলু পেঁয়াজের দাম কিলো পিছু ৩-৫টাকা কমে। জুন মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অধ্যাদেশ জারি করে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন তুলে দেয়। তার পর আর টাস্ক ফোর্স বাজারে নেই। জিনিসের দাম বাড়তে বাড়তে আগুন। আগে জিনিসের দাম বাড়লে আন্দোলন হতো। এখন সব দলের মুখে কুলুপ। রাজ্যের শাসক দল - বাম আমলে এতো দাম খাব কী? - বলে মিছিল করেছিল। এখন সে-কথা তাঁদের মনে করাবে কে?

কিছু বিকল্প চালু হয়েছে। রাজ্য সরকারের একটি প্রকল্প আছে। সিঙ্গুর ভাঙ্গড় থেকে সব্জি কিনে এনে বেচা। ২০১২ থেকে শুরু হয়েছে। সেখানে দাম তুলনায় কম। কিন্তু সেগুলির সংখ্যাও সামান্য। আরো বাড়ানো জরুরি। রাজ্যগুলির উচিত সোনিয়া গান্ধীর পরামর্শ মেনে কৃষি ও অত্যাবশ্যক পণ্য আইন না মানা। পৃথক আইন আনা। কিন্তু অনেকেই নানাভাবে রিলায়েন্সের কাছে বাঁধা পড়ে যাচ্ছেন - এতে কতোটা কাজ হবে কে জানে।

অন্যদিকে সিপিআই(এম)-এর কর্মীরা যাদবপুর, বেহালা, টালিগঞ্জ, বেলঘড়িয়া, হিন্দমোটর অঞ্চলে শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালু করেছেন। চালু করেছেন সস্তার সব্জি বাজার। এটা একটা ভালো বিকল্প। কিন্তু একমাত্র বিকল্প নয়। খুচরো বিক্রেতা হাজার হাজার। তাঁরাও যাতে বাঁচেন, চাষি যাতে ন্যায্য মূল্য পান - সেদিক দেখতে হবে সরকারকেই। কেন্দ্রীয় সরকার কালা কুম্ভকর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আদানি আম্বানির স্বার্থরক্ষা ও যে-কোনো মূল্যে ভোটে জেতা বা ক্ষমতা দখল করা ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্য নেই। একমাত্র গণ-আন্দোলনের তীব্র ঢেউ সরকারকে পথে আনতে পারে। যে-পথ দেখাছে পাঞ্জাব হরিয়ানা বা উত্তরপ্রদেশের চাষিরা।

পশ্চিমবঙ্গে এখন সকলই ইভেন্ট। পূজা এবং আন্দোলন - দুই-ই। তাই দুর্গাপূজার সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কোথায় যায় - সেটা দেখে যেতে হবে। আপাতত রাজ্য সরকার পুজো কমিটিগুলিকে ১৮৫ কোটি টাকা দিয়েছে এই দুঃসময়ে যাতে পুজোর আনন্দ মাটি না হয়। সেই টাকা দিয়ে আরো কত কী করা যেত, চাষিদের কত সুবিধা হত, কতজন রেশন পেতেন, কতগুলি নতুন কোভিড শয্যা হত বা ভেন্টিলেটর কেনা যেত তা ভেবে দেখার মত। একটি সরকার কেন পুজো করার জন্য টাকা দেবে সেই প্রশ্ন তোলার লোকেরও অভাব আছে।

এই বাজারে গৃহস্বামী এবং তাঁর পরিচারক - দুজনকেই যেতে হয়। এক দামে কিনতে হয়। তবু হেলদোল নেই। রাজ্য সরকার সক্রিয় হোন। বিরোধীরাও পথে নামুন। সাধারণ মানুষ ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের হিন্দু মুসলিম বানানো তক্কো ভুলে সামিল হোন। না হলে ব্যাংকের সুদ কমছে, ডি এ নেই - কেন্দ্রে এবং রাজ্যে। বেসরকারি ক্ষেত্রে কয়েক কোটি কর্মী ছাঁটাই।

মানুষকে কি ‘আনন্দ মঠ’-এর যুগে ফিরে যেতে হবে, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনে। ১৯৪৪-এর মতো রাস্তায় রাস্তায় কি শোনা যাবে - একটু ফ্যান দাও মা। উপোসের দিন ক্রমেই সমাগত মানুষের।