আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২০ ● ১৬-৩১ আশ্বিন, ১৪২৭

সমসাময়িক

দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক


হাতে হাতে স্মার্টফোন চালু আছে সর্বক্ষণ। আটার থেকে ডেটা সস্তা হলে এমনটাই তো হয়। সেই বাস্তবতাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠছে পথ চলা, কথা বলার নিত্য নতুন নির্দেশিকা। প্রয়োজন ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন সফ্টওয়্যার বা চলতি কথায় অ্যাপ্ তৈরি করে হুকুম দেওয়া হচ্ছে অমুক সুবিধা পেতে হলে তমুক অ্যাপ্ আপনার স্মার্টফোনে ডাউনলোড করে নিন। ব্যাস! রাষ্ট্রের অথবা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব শেষ। এরপর নতুন অ্যাপ্ ঠিকমতো ডাউনলোড না হলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।

হাতে স্মার্টফোন থাকলেও ব্যবহারকারী এস্-মার্ট না-ও হতে পারেন, এই ছোট্ট বিষয়টা খেয়াল থাকে না। কাজেই নতুন নির্দেশিকা থেকে গেল নাগালের বাইরে। অতএব স্মার্টফোনের মালিক হওয়া সত্ত্বেও নিছক অজ্ঞতা বা অদক্ষতার জন্য উন্নত প্রযুক্তির মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে নীরবে তৈরি হয়ে গেল দুটি শ্রেণি। যাঁদের হাতে অ-স্মার্টফোন আছে? সোজাসাপটা জবাব, তাঁরা এই সুযোগ ব্যবহারের উপযোগী নয়। আর যাঁদের কাছে কোনো ফোন-ই নেই? তাঁদের তো হিসেবের মধ্যেই আনা হয়নি। বাতিল শ্রেণি বরং ভূপেন হাজারিকার গানে গলা মিলিয়ে গাইতে থাকুক, ‘প্রথম না হয়, দ্বিতীয় না হয়, তৃতীয় শ্রেণির আমরা সবাই…’।

জনজীবন অবরুদ্ধ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গেছিল। পরিষেবার কাজে নিযুক্ত কর্মীদের ঘরে বসে কাজ করতে বলে দেওয়া হল। যে এলাকায় নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নেই অথবা বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায়শই বিঘ্নিত হয় সেই সব কর্মীদের তো সমূহ বিপদ। অনেকেই কাজ বাঁচাতে স্থানান্তরী হলেন। যাঁরা ব্যর্থ, তাঁদের কাজ হারিয়ে গেল। যোগ্যতা দক্ষতা অভিজ্ঞতা জলাঞ্জলি দিয়ে হয়ে গেলেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

স্কুল কলেজের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। স্মার্টফোন ল্যাপটপ বা কম্পিউটার থাকলে লেখাপড়ার সুযোগ বহাল থাকবে। অন্যথায় কী আর করা যায়! শিক্ষক-শিক্ষিকারা তো প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত। যে সব শিক্ষক-শিক্ষিকারা পেরে উঠছেন না তাঁদের সম্পর্কে ভাববার কেউ নেই। অথবা কর্তৃপক্ষের সময় নেই। অতএব ঝাঁকেঝাঁকে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা হঠাৎ করে হয়ে গেলেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

সমাজ কিন্তু নীরবে এই শ্রেণি বিভাজন সমর্থন করে গেছে বা যাচ্ছে। হয়তো কখনোসখনো একটু উচ্চঃস্বরেই উচ্চারিত হয়েছে অনলাইনে লেখাপড়া না হোক মিড ডে মিলের চাল ডাল আলু খাতা এমনকি স্যানিটাইজর সরবরাহ তো বন্ধ হয়নি। সেই সমাজ আবার ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে মুখর। সংবাদপত্রে পাতাজোড়া খবর। সারা দেশের পঁচিশ লক্ষ ছাত্রছাত্রী কীভাবে পরীক্ষা দিতে যাবে, যাতায়াতের সময় বা পরীক্ষা কেন্দ্রে যদি সংক্রমণ ঘটে তাহলে কী হবে ইত্যপ্রকার দুশ্চিন্তা-আশঙ্কায় টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলের সান্ধ্য অধিবেশনে জমজমাট তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। পঁচিশ লক্ষের বাইরে আরও অনেক লক্ষ ছাত্রছাত্রী সাধারণ কলেজের স্নাতক স্তরে কীভাবে ভর্তি হতে পারে তা নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, সংবাদ মাধ্যমের কোনো মাথাব্যথা নেই। সত্যিই তো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের নিয়ে চিন্তার অবকাশ কোথায়!

জুন মাসে শুরু হল ধাপে ধাপে অবরোধ উম্মীলন। অসামরিক বিমান চলাচল আরম্ভ হল। নানানরকমের নির্দেশিকা জারি করে যাত্রী পরিবহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় কারো খেয়াল হয়নি যে সবার কাছে স্মার্টফোন না-ও থাকতে পারে। যাত্রীর বয়স, স্বাস্থ্যের খবর থেকে শুরু করে টিকিট, বোর্ডিং পাস সবকিছুই স্মার্টফোনের পর্দায় দৃশ্যমান না হলে বিমানবন্দরের অন্দরে প্রবেশ নিষেধ। জরুরি প্রয়োজন থাকলেও বাদবাকিদের যাত্রা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব নিয়ে কোনো সামাজিক আলোড়ন না হওয়ায় রাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দেওয়া হল যে এইরকমের বিভাজনে সমাজের আপত্তি নেই। নীরবে সৃষ্টি হয়ে গেল আরেকরকম দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

পরবর্তী পর্যায়ে ট্রেন এমনকি মেট্রোর যাত্রীদের জন্য একই নিয়ম প্রয়োগ করা হয়েছে। সমাজ নীরব। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে প্রযুক্তি ভিত্তিক শ্রেণি বিভাজনের বিষয়ে সামাজিক সম্মতি আছে।

এখানেই শেষ নয়। পুরসভা, পুলিশ, চিকিৎসা সহ আরও অনেক পরিষেবার সুযোগ পাওয়ার জন্য স্মার্টফোন ছাড়া গতি নেই। ২০২০-র সূচনা লগ্নে সারা দেশে পঞ্চাশ কোটির থেকে সামান্য বেশি স্মার্টফোন চালু ছিল। অনেকেই আবার একাধিক স্মার্টফোনের অধিকারী। তর্কের খাতিরে সংখ্যা হিসেবে পঞ্চাশ কোটিকে মেনে নিলেও বলতে হয় দেশের অবশিষ্টাংশ, সংখ্যায় যা আশি কোটির থেকেও বেশি তাদের জন্য রাষ্ট্র আদৌ চিন্তিত নয়। অর্থাৎ দেশের বেশিরভাগ মানুষই রাষ্ট্রের নিক্তিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যে সব প্রচার চালিয়ে যাওয়া হয়েছে বা হচ্ছে তাও পুরোপুরি সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশের উপযোগী। ঘন্টায় একবার করে বিশ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরামর্শ দেশের কত শতাংশ মানুষের পক্ষে পালন করা সম্ভব? যে দেশের অধিকাংশ মানুষ মাসে একবার সাবানের ছোঁয়া পেলে বর্তে যায়, জল সংগ্ৰহ করতে জীবন জেরবার, এই ধরনের পরামর্শ নিশ্চিতরূপে তাদের জন্য নয়। প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে সব সচেতনতা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়।

সংবাদ মাধ্যমে তো বটেই এমনকি সরকারের স্বাস্থ্য সচেতনতা সংক্রান্ত প্রচারে এমন সব উপাদান সমৃদ্ধ নিদান দেওয়া হচ্ছে অধিকাংশ ভারতীয়র পক্ষে যা প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের পক্ষে হয়তো সেইসব মহার্ঘ উপাদান সংগ্ৰহ সম্ভব। এক্ষেত্রেও বাদবাকি সকলেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

ইত্যবসরে ‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দবন্ধের প্রচার ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সামাজিক সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য এই বিশেষ শব্দবন্ধের দরকার ছিল। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে জনজীবন সম্পূর্ণ বা আংশিক অবরুদ্ধ থাকায় সামাজিক সংহতি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া গেছে। মানুষের চোখে সহানুভূতির দৃষ্টি হারিয়ে গেছে। সকলের চোখে এখন সন্ত্রস্ত চাহনি। এই তো আদর্শ সময়! অতএব সবার অগোচরে নয় বরং সকলের সম্মতি নিয়েই আরও হাজারো অপকর্মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়ে চলেছে সামাজিক বিভাজন। তৈরি হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

প্রযুক্তির ভিত্তিতে তৈরি করা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ছাড়াও কোথাও কোথাও সরাসরি আইন মোতাবেক সামাজিক বিভাজন শুরু হয়েছে। পনেরোই আগস্টের আনুষ্ঠানিক বার্তায় মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজ্যের সমস্ত সরকারি চাকরিতে ভূমিপুত্রদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। মাত্র তিন দিনের মধ্যে ১৮ আগস্ট একটি ভিডিয়ো বার্তায় মুখ্যমন্ত্রী জানালেন এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে মধ্যপ্রদেশের সমস্ত সরকারি চাকরিতে শুধুমাত্র রাজ্যের যুবসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাই সুযোগ পায় কারণ রাজ্যের সম্পদের উপরে কেবলমাত্র ভূমিপুত্রদেরই অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ বাদবাকি সকলেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

প্রায় একই সময়ে অসম সরকারের সহযোগী সংগঠন নতুন করে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। সাংসদের সংখ্যা তিনশোর কোটা পেরিয়ে যাওয়ার পরে ২০১৯-এর জুলাই মাসের মাঝামাঝি ১৯৮৫-র অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করে দেয়। কমিটির শীর্ষে আসীন গুয়াহাটি উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বিপ্লব কুমার শর্মা।

২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে কমিটির প্রতিবেদন রাজ্য সরকারের কাছে জমা পড়ার পর আজ অবধি সরকারিভাবে এই প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু গত ১১ অগস্ট সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে শর্মা কমিটির সুপারিশ ফাঁস করে দেওয়া হয়। ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনের নির্যাস অনুসারে অসমিয়া এবং আদি বাসিন্দা বা ‘খিলঞ্জিয়া’ না হলে অসমে কোনও ভারতীয় নাগরিকের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকারই থাকছে না।

গত ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে যখন অসম উত্তাল তখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, শর্মা কমিটির প্রতিবেদন হুবহু রূপায়িত হবে। প্রতিশ্রুতি শুনিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এই প্রতিবেদন তাই কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করতেই পারে। এতে আছে, অসমে বিধানসভা এবং লোকসভা আসনের ৮০ থেকে ১০০ শতাংশই অসমিয়াদের জন্য সংরক্ষিত রাখা দরকার। বিধান পরিষদ গঠন হলে সেখানে ১০০ শতাংশ অসমিয়া প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তাব এই প্রতিবেদনে নাকি করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্গের চাকরির বেলায়ও একইরকম সংরক্ষণ ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রস্তাবও নাকি এই সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত। জমির মালিকানায় অসমিয়াদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এবং সামগ্রিকভাবে এই ব্যবস্থাপত্রে সাংবিধানিক অনুমোদনও থাকবে বলে দাবি করা হয়েছে। বাদবাকিরা এইসব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ অসম রাজ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অসম সরকারের পক্ষ থেকে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করা হয়নি।

সবমিলিয়ে শ্রেণি বিভাজন প্রক্রিয়া সামগ্রিকভাবেই খুব দ্রুত গতিতে হয়ে চলেছে। এইসব বিভাজন নিয়ে সমাজ এখন মুখর নয়। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায় যে এই ধরনের বাধ্যতামূলক মৌনতাই আকস্মিকভাবে সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করে।