আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২০ ● ১৬-৩১ আশ্বিন, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

শ্রমিকের দাসত্ব নির্মাণ


আপনার আশেপাশে, বাড়িতে, অফিসে, রাস্তায়, কারখানায়, শহরে, গ্রামেগঞ্জে যা কিছু দেখছেন তা তৈরি করেছে শ্রমিক, তাদের শ্রম দিয়ে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকের কোনো দাম নেই, যতক্ষণ না সে উদ্‌বৃত্ত মূল্য বা মুনাফা মালিকের সিন্দুকে তুলে দিতে পারে। নিজের শ্রমশক্তি বেচে শ্রমিক মালিকের হাতে যে মুনাফা তুলে দেয়, তার পরিবর্তে শ্রমিকের মজুরি যৎসামান্য। তবু, সম্পদহীন শ্রমিকের কাছে বেচার জন্য শুধু আছে তার শ্রমশক্তি। তাই বারবার শ্রমিককে ফিরে আসতে হয় মালিকের কারখানায়। বাড়তে থাকে মুনাফা, সম্পদ। শ্রমিক থেকে যায় তার শ্রমিক মহল্লায়, জল-কাদা-নর্দমা-পাঁকের মধ্যে বয়ে চলে জীবন। বিজ্ঞজনেরা তত্ত্ব আউড়ান যে পুঁজির পুণ্যেই শ্রমের পুণ্য। পুঁজি যত বাড়বে, মুনাফা যত বাড়বে, বিনিয়োগ যত বাড়বে, শ্রমিকের মজুরিও বাড়বে। অর্থ‍াৎ পুঁজিবাদী বিকাশ আপন নিয়মে আর্থিক বৈষম্য হ্রাস করবে।

ভারতের বিগত ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ভারতে আর্থিক বৈষম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে, ভারতে যখন বৃদ্ধির হার সর্বাধিক ছিল (২০০৩-২০০৮) সেই সময় মোট উৎপাদনে শ্রমিকের অংশ সর্বনিম্ন হয়েছে, প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। বর্তমানে উৎপাদনে শ্রমিকের অংশ সামান্য বাড়লেও তা পুঁজির থেকে ঢের কম এবং ১৯৯১ পূর্ববর্তী সময়ের এক তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ, ভারতে আর্থিক সংস্কার শ্রমিক শ্রেণির পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু তাতে কী! অতিমারি চলছে, ২ কোটির বেশি নিয়মিত বেতনে নিযুক্ত মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, দেশে অভূতপূর্ব আর্থিক সংকট। ২০২০-২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ২৪ শতাংশ। লাখো লাখো শ্রমিক লকডাউনের মধ্যে কাজ হারিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। তবু, সব সমস্যার সমাধান হিসেবে শ্রমিকের পিঠ যেই দেওয়ালে এসে ঠেকেছে সেই দেওয়ালটাই ভেঙে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। তিনটি শ্রম আইন সংক্রান্ত বিল সংসদে পেশ করা হয়েছে, যা লোকসভায় পাশ হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি শিল্প সম্পর্ক সংক্রান্ত, একটি বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের সুরক্ষা সংক্রান্ত, এবং অপরটি তাদের সামাজিক সুরক্ষ সংক্রান্ত। তিনটি বিল একত্রে শ্রম বাজারের নমনীয়তা বৃদ্ধি করার ধাপ হিসেবে এক যুগান্তকারী সংস্কার বলে দাবি করছে সরকার। এর ফলে নাকি দেশে বৃদ্ধির হার বাড়বে, শ্রমিকরা অধিক সুরক্ষা পাবেন, ইত্যাদি নানাবিধ দাবি শোনা যাচ্ছে। অথচ, সত্য ঠিক এর বিপরীত।

শিল্প সম্পর্ক সংক্রান্ত আইনটি বানানো হয়েছে তিনটি আইনকে একত্রিত এবং পরিবর্তন করে। এই তিনটি আইন হল, ট্রেড ইউনিয়ন আইন ১৯২৬, শিল্পে কর্মসংস্থান সংক্রান্ত আইন ১৯৪৬ (Industrial Employment Standing Order Act, 1946) এবং শিল্প সংঘাত সংক্রান্ত আইন ১৯৪৭ (Industrial Disputes Act, 1947)। এই আইনে বলা আছে যে আইনটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য পুঁজি এবং শ্রমিকের মধ্যে শিল্প সংঘাত কম করা এবং শ্রমিক ও পুঁজির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে শিল্পের বিকাশ ঘটানো।

অথচ এই আইনে শ্রমিকদের অধিকারকে বিপুলভাবে সংকোচন করা হয়েছে। এর অন্তত তিনটি দিক রয়েছে যা আলোচনার দাবি রাখে। প্রথম, যে সমস্ত কারখানায় ১০০-র বেশি শ্রমিক নিযুক্ত আছেন সেই সমস্ত কারখানায় কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই করতে হলে সরকারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। বর্তমান আইনে এই সীমা বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। অর্থাৎ ৩০০ জন বা তার বেশি শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে তবেই ছাঁটাই করার জন্য সরকারের অনুমতি প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৭-১৮ সালে ভারতের সংগঠিত ক্ষেত্রে ২০০ জনের কম শ্রমিক নিযুক্ত কারখানায় মোট শ্রমিকের ৩৫ শতাংশ নিযুক্ত ছিল। ২০০ থেকে ৫০০ জনের কম শ্রমিক নিযুক্ত কারখানায় মোট শ্রমিকের ১৯ শতাংশ নিযুক্ত। অতএব ৩০০ জনের কম শ্রমিক নিযুক্ত কারখানায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি শ্রমিক নিযুক্ত আছেন। নতুন শিল্প সম্পর্ক আইনের ফলে এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে ছাঁটাই করার পথে পুঁজিপতিদের আর কোনো বাধা রইল না। সমস্যা এখানেই শেষ নয়। আইনে বলা আছে যে সরকার চাইলে এই ঊর্ধ্বসীমা আরো বাড়াতে পারে, যথাযথ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। তার মানে সরকারের মর্জি মতন শ্রমিকদের ছাঁটাই করা যাবে কি না, তা নির্ধারিত হবে। কাল যদি সরকার এই সীমাকে ১০০০০ শ্রমিক করে দেয়, তাহলে সম্পূর্ণ সংগঠিত ক্ষেত্রকেই মর্জিমতো ছাঁটাইয়ের অন্তর্গত করে নেওয়া যাবে।

দ্বিতীয়ত, এই আইনের মাধ্যমে কার্যত ধর্মঘট করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ধর্মঘট করতে হলে ১৪ দিনের নোটিস দিতে হবে। তার মধ্যে যদি কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে সরকারি আধিকারিক সমস্যা সমাধানের সূত্র বের করার সভা ডেকে দেন, তাহলে ৬০ দিন আর কোনো ধর্মঘট করা যাবে না। অতএব, এই আইনের ফলে কার্যত শ্রমিকদের ধর্মঘট করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আবার সরকারি তথ্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে বিগত বহু বছর ধরে ধর্মঘটের সংখ্যা নিম্নগামী, ধর্মঘটের জন্য নষ্ট হওয়া শ্রমদিবসের সংখ্যাও তলানিতে এসে ঠেকেছে। ধর্মঘট করার মতন রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক জোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু লকআউটের সংখ্যা ঊর্ধ্বগামী রয়েছে। কিন্তু তবু, শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত ধর্মঘটের অধিকারকেই খর্ব করা হচ্ছে। আবার কর্তৃপক্ষ বেআইনি লক-ডাউন করলে শুধুমাত্র দ্বিতীয়বার একই বেআইনি কাজের ক্ষেত্রে তাদের জেল হতে পারে। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষেত্রে একবার বেআইনি ধর্মঘট করলেই শ্রমিকদের জেল হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। বোঝাই যাচ্ছে পাল্লা কার দিকে ভারি। আইনে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে যে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার বিরুদ্ধে লকআউটের ভয় দেখাতে পারবেন না। অথচ, একের পর এক কারখানায় এই প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে চলে আসছে। সরকারের উপস্থিতিতে সই হওয়া চুক্তি মালিকপক্ষ মানেনি, তার বহু উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু আজ অবধি কোনো শিল্প আইন এই চুক্তিভঙ্গকে বেআইনি ঘোষণা করেনি।

বরং বেড়েছে লিখিত চুক্তিহীন শ্রমিকের সংখ্যা। ২০০৪-০৫ সালে সেই বেতনপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ৫৯ শতাংশের কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত হওয়ার কোনও লিখিত চুক্তি ছিল না। ২০১৭-১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৭১ শতাংশ। এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিক, যাঁদের লিখিত চুক্তিই নেই, তাঁরা কোন শ্রম আইনের আওতায় নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত করতে পারবেন? অন্যদিকে, সংগঠিত ক্ষেত্রে লাগাতার ঠিকা শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৩৬ শতাংশ ঠিকা শ্রমিক যারা অধিকাংশ শ্রম আইনের আওতায় আসে না। বাড়তে থাকা ঠিকা শ্রমিকদের প্রেক্ষাপটে সরকার পুঁজিপতিদের স্বার্থে নতুন আইনে নির্দিষ্ট মেয়াদ ভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগের অনুমতি দিল। এর ফলে কোনো শ্রমিককে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নিয়োগ করা হবে, সেই মেয়াদ ফুরোলে, চাকরির নটে গাছটিও মুরোবে। সংসদের শ্রম বিষয়ক স্ট্যাণ্ডিং কমিটি প্রশ্ন করে যে নির্দিষ্ট সময়কালের কোনো নিম্নসীমা বা ঊর্ধ্ব সীমা বেঁধে দেওয়ার কথা সরকার ভাবছে কি না। স্পষ্ট জানানো হয় যে কোনো সীমা নেই। আপনাকে যখন খুশি যতক্ষণের জন্য নিয়োগ করে আপনাকে আবার চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত পাকা হয়ে গেল। এমনকি, কতবার এমনভাবে আপনি নিযুক্ত হতে পারেন, তারও কোনো সীমা সরকার বেঁধে দেয়নি। অর্থাৎ, আপনাকে ১ বছরের জন্য নিয়োগ করে, তারপরে ১ মাসের ব্যবধানে আপনাকে আবার পরবর্তী এক বছরের জন্য নিয়োগ করা হবে। আপনি সর্বক্ষণ মালিককে খুশি রাখতে চাইবেন, কারণ তা না হলে আপনার চুক্তির পুনর্নবীকরণ হবে না। শ্রমিকের অধিকার, ধর্মঘট, এই সব তখন অন্য গ্রহের কথা হয়ে যাবে। বাড়তে থাকা চুক্তি শ্রমিকরা প্রকারান্তরে পুঁজিপতিদের দাসে পরিণত হবেন।

শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার আইনের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সরকার সর্বজনীন সুরক্ষার কথা না বলে যে সমস্ত কর্মস্থলে ১০ বা তার অধিক শ্রমিক রয়েছে, শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই এই আইন বলবত হবে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ অসংগঠিত ক্ষেত্র এই আইনের আওতার বাইরে। সংসদের স্টাণ্ডিং কমিটিও সর্বজনীন সুরক্ষার কথা বলে, কিন্তু সরকার তা ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। আগে, যে-সমস্ত কারখানায় কাজ করার ঝুঁকি বেশি রয়েছে, সেই সব ক্ষেত্রে শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষের একটি যৌথ সুরক্ষা কমিটি গঠনের শর্ত ছিল। বর্তমান আইনে এই শর্ত বাতিল করা হয়েছে। এখন কর্তৃপক্ষ চাইলে অনুরূপ কমিটি গঠন করতে পারেন। অর্থাৎ, সুরক্ষা বিষয়টি শ্রমিকের অধিকার থেকে পর্যবসিত হল কর্তৃপক্ষের দয়ায়।

এই আইনে অনেক গোল গোল কথা বলার পরে, মোক্ষম কথাটি বলা হয়েছে শেষে (অনুচ্ছেদ ১২৭)। এখানে বলা আছে যে রাজ্য সরকার যদি মনে করে যে এই আইনগুলি আর বলবত রাখার দরকার নেই তবে তারা তা নোটিস জারি করে করতে পারবে। নতুন কারখানার ক্ষেত্রে যদি রাজ্য সরকার মনে করে কারখানায় কর্মসংস্থান হবে এবং জনস্বার্থে তা জরুরি, তাহলে তারা সেই কারখানার ক্ষেত্রে সমস্ত রকম বিধিনিষেধকে বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারে। যেকোনো কারখানাতেই কর্মসংস্থান তৈরি হয়, যা কোনো না কোনোভাবে জনস্বার্থে জরুরি বলে ঘোষণা করা যেতেই পারে। অর্থাৎ, আইনে নানা সুরক্ষার কথা বলা হলেও রাজ্য সরকারগুলি নিজেদের মনমর্জি মতন যখন তখন সমস্তটাই বাতিল করতে পারে। পুঁজির সামনে শ্রমের আইনি দাসত্বে পরিণত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে রাষ্ট্রের নায়েবি।

পুঁজিবাদের মধ্যে মুক্তির বীজ যারা যুগ যুগ ধরে খুঁজে এসেছেন, তারা বোঝেননি যে পুঁজিবাদ ততদিন ভদ্র থাকে যতদিন সমাজতান্ত্রিক বিকল্প মানুষের চোখের সামনে রয়েছে। তাই এটা কাকতালীয় নয়, যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে নবউদারবাদের চাকা তীব্র গতি লাভ করেছে। ভারতে বর্তমানে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার সমস্ত বিরোধী মতকে অপরাধী ঘোষণা করে পুঁজির রথের মুখ্য সারথি হয়েছে। তবে, পুঁজির তাঁবেদারি করা আর পুঁজিবাদের অর্থনীতি বোঝা এক নয়। প্রশ্ন হল শ্রম আইনের এই সব পরিবর্তন করলে কি দেশের বৃদ্ধির হার বাড়বে?

এই সম্পাদকীয়র পরিসরে বিস্তারে আলোচনা করা সম্ভব নয়। শুধু বলা যেতে পারে অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং তথ্যের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে শ্রম আইন শিথিল করলে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ে, কথাটি নেহাতই মিথ্যা। আসলে শ্রম আইন শিথিল করার উদ্দেশ্য অন্য। শ্রমশক্তি পুঁজিবাদী বাজারে পণ্য। কিন্তু সেই পণ্যটির চরিত্র বাকি সমস্ত পণ্যের থেকে আলাদা। আপনি যখন বাজারে গিয়ে আলু কিনছেন, আলুটি আপনি সেদ্ধ করে খাবেন না ভেজে তা নিয়ে আলুর কোনো মত থাকে না, কারণ আলু মানুষ নয়। কিন্তু শ্রমশক্তি নিহিত থাকে মানুষের মধ্যে। তাকে যেমন খুশি কাজ করানো যায় না, জোর করলে সে প্রতিবাদ করে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে এই দ্বন্দ্বকে কমানোর উদ্দেশ্যে শ্রম আইনগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে শ্রমিকেরও মনে হয়, তাঁর কিছু অধিকার রয়েছে। কিন্তু পুঁজি সেই সমস্ত অধিকার কেড়ে শ্রমিকদের দাসে পরিণত করতে চায়, কারণ মুনাফা বানাবার তাদের তাগিদ। কিন্তু পুঁজিবাদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এহেন শোষণের বীজ আবার তার থেকে তৈরি হওয়া সংকট। এই ভাবে শ্রমিকের পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে দেওয়ালটি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমবে, বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে তা চাহিদার সংকটকে আরো প্রবল করবে এবং ভারতের রপ্তানি ব্যাপকভাবে না বাড়া অবধি ভারতের মন্দাবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু শ্রমিকদের নিংড়ে, পণ্যের দাম কমিয়ে বিশ্ববাজারের দখল নেওয়া সহজ নয়। তথ্য বলছে শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিলে বা তাদের প্রকৃত মজুরি কমালেই যে বেশি রপ্তানি করা যাবে, তার কোনো প্রমাণ নেই।

অতএব, বিষয়টির রাজনীতি বোঝা জরুরি। সংকটাপন্ন পুঁজি সংকটের সমাধান খুঁজছে শ্রমিকদের জব্দ করে। এতে পুঁজির সংকটের সমাধান হবে না। কিন্তু শ্রমিকদের আগামীদিনের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব হবে। বর্তমান শাসক দল যেই কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ভারতে করছে, যেখানে ভিন্নমতের কোনো স্থান নেই, সেখানে আত্মনির্ভর ভারতের জন্য শ্রমিকরা আত্মত্যাগ করতে যদি রাজি না হয়, তবে তাদেরও দেশদ্রোহী বলা হবে। যেমন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদ ছাড়া কিছু থাকবে না। এই রাজনৈতিক আখ্যান নিয়ে বিজেপি গোটা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিরোধীরা শ্রমিক আইনের এই ভয়াবহ পরিবর্তনের পরে রুটিন মাফিক দুটি সভা-সমিতি, একদিনের রাস্তা অবরোধ করবেন নাকি দীর্ঘমেয়াদী শ্রেণি রাজনীতির আশ্রয় নিয়ে এক বিকল্প রাজনীতির জন্ম দেবেন, সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে।