আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২০ ● ১৬-৩১ আশ্বিন, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

কৃষি সংস্কার অথবা কৃষক সংহার


গলার জোরে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরে অধ্যাদেশকে আইন বানানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল। সংসদীয় সংস্কৃতির রীতিনীতি, প্রথা, সর্বপরি বিধি উপেক্ষা করে ধ্বনিভোটে অর্থাৎ গলার জোরে কৃষি আইনের সংশোধনী হিসেবে জারি করা দুটি অধ্যাদেশকে ২০ সেপ্টেম্বর রবিবার আইনসম্মত করে তোলার বন্দোবস্ত পাকা করা হল। তৃতীয় অধ্যাদেশের বেলায় অবিশ্যি গলার শিরা ফোলানোর প্রয়োজন হয়নি। রবিবারের অশালীন আচরণের প্রতিবাদে সোমবার সংসদ ছিল বিরোধীবিহীন। কাজেই শূন্য ময়দানে টেবিল চাপড়িয়ে বিজয়বার্তা ঘোষিত হল।

রাজ্যসভায় জোর করে বিল পাশ করানোর পরে, বিরোধী দলগুলি রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছিল এই আইনকে অনুমোদন না দেওয়ার। রাষ্ট্রপতি সেই সব অনুরোধে কর্ণপাত না করে কৃষি আইনে সই করেছেন। ভারতবর্ষের কৃষিক্ষেত্রে নতুন আইন প্রবর্তন হয়েছে। ইতিমধ্যেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বলে নবলব্ধ আইনের গৌরবকীর্তন শুরু হয়ে গেলেও সারা দেশে কিন্তু কৃষকের হাহাকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় এই হাহাকার যে কোনো মুহূর্তে হুঙ্কার হয়ে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে জারি করা হয়েছিল তিনটি অধ্যাদেশ। তিনটি অধ্যাদেশই ছিল কৃষিক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের সংশোধনী। অধ্যাদেশ সংসদের মঞ্জুরী না পেলে কার্যকর থাকে না। তখন আবার নতুন করে অধ্যাদেশ জারি করতে হয়। কিন্তু অধ্যাদেশ পুনর্নবীকরণের একটা সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপটে সংসদের নিম্নকক্ষে সহজে অনুমোদন পাওয়া গেলেও উচ্চকক্ষে বিষয়টি সহজলভ্য না-ও হতে পারে এমন কোনো ধারণা সম্ভবত ছিল না। বহু পরীক্ষায় স্বীকৃত দীর্ঘদিনের শরিক এই তিনটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে মন্ত্রিসভা ত্যাগ করতে পারে এমনটা বোধ হয় কল্পনাও করা হয়নি। সাবেক শরিকের পথে সময়ভিত্তিক সমর্থকরাও এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় শুরু হয় দুশ্চিন্তা। কারণ উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সঠিকভাবে প্রমাণিত নয়। অগত্যা বাহুবলের বদলে উচ্চগ্রামে কণ্ঠস্বরের দাপট দেখিয়ে বাজিয়ে দেওয়া হল বিজয়ভেরী।

‘দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন)’, ‘দ্য ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিয়োরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস’ এবং ‘দ্য এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামিডমেন্ট অর্ডিন্যান্স) ২০২০’ বিল তিনটি সংসদে পেশ করতে না করতেই কৃষিজীবী মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে রাষ্ট্রকে জানিয়ে দেয় যে এই তিনটি বিল কোনোমতেই আইনে পরিণত করা উচিত হবে না। কৃষিপণ্যের অনিয়ন্ত্রিত বিক্রি-ব্যবস্থা, চুক্তিবদ্ধ কৃষিজ উৎপাদন এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা এমএসপি) অপসারণ হওয়ার সম্ভাবনা সামগ্রিকভাবে দেশের কৃষি ক্ষেত্রকে বিপর্যস্ত করে দেবে বলে উত্তর ভারতের কৃষিজীবী মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। কিন্তু সংসদের নিম্নকক্ষে সংখ্যাধিক্যের অহঙ্কারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকায় কোনো কিছুই ভ্রূক্ষেপ করা হয়নি। সর্বপরি সংক্রমণ প্রতিহত করতে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সংসদের বাদল অধিবেশন বোধ হয় আরও সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু উচ্চকক্ষে বিরোধীদের সঙ্গে সমবেত হয়ে শরিকদের প্রবল আপত্তি আন্দাজ করতে পেরেই সংসদীয় রীতিনীতি, বিধি, প্রথা অবজ্ঞা করে বিলের প্রস্তাবে জবরদস্তি মোহর লাগিয়ে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হল।

নথিতে তিনটি বিল আলাদাভাবে প্রদর্শন করা হলেও তিনটি বিলই কিন্তু অঙ্গাঙ্গীভাবে সংযুক্ত। ‘দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন)’ বিল আইনে পরিণত হলে যে কোনো ব্যবসায়ী বা বেসরকারি সংস্থা সরাসরি চাষির কাছ থেকে কৃষিজ পণ্য কিনে নিতে পারবে। এর ফলে নাকি কৃষকরা বাজারের সর্বোচ্চ মূল্য পাবেন। এই বিল আইন হয়ে কার্যকর হলে কৃষিজ পণ্যের কারবারিরা ও মজুতদাররা একসঙ্গে বেশি কৃষিজ পণ্য কিনবার সুযোগ পেলেও বাজারের সর্বোচ্চ দাম দেবেন কিনা তার নিশ্চয়তা কে দেবে? দেশের কৃষিজ পণ্য বেশি করে বিদেশে রপ্তানি হয়ে গেলে ব্যাবসায়ীরা লাভবান হবেন ঠিকই, কিন্তু দেশের বাজারে প্ৰথমে দাম পরে পণ্য সাধারণ মানুষের আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাবে। ফলে তৈরি হবে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করা খাদ্য সঙ্কট। ১৯৪৩ বা বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরে তো এমনটাই হয়েছিল।

২০০৩-এ ভারত সরকারের তৈরি মডেল এপিএমসি (এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি) আইনে রাজ্যগুলিকে কৃষি বিপণনের জন্য পাইকারি বাজারের পরিকাঠামো তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এই আইনের ফলে দেশে এই মুহূর্তে প্রায় ৬ হাজার ৯০০টি মান্ডি সক্রিয়। উত্তরপ্রদেশে ২০১৮-১৯-এর হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ৭৫টি জেলার ২৫১টি মান্ডিতে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার ব্যাবসা হয়েছে। সেস ও কর মিলিয়ে ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার উপর আয় করেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার।

২০১৬-র পরে এই মান্ডিগুলি নিজেদের মধ্যে ই-নাম ব্যবহার করে পণ্য লেনদেনও করে। ই-নাম মানে ইনাম বা পুরস্কার নয়। গোটা দেশের কৃষি বাজারগুলোর মধ্যে লেনদেনের অনলাইন বাজারের ইংরাজি নাম (ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট বা eNAM)। বাংলায় রাষ্ট্রীয় কৃষি অনলাইন বাজার বলা যায়। ২০১৬-এর এপ্রিল মাসে যখন এটা চালু হয়, তখন অবশ্য এই ব্যবস্থাকে কৃষককে পুরস্কার বা উপহার হিসাবেই প্রচার করা হয়েছিল।

মান্ডি ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর কৃষিতে রাজ্যের অধিকারের উপর কোপ পড়েনি। প্রতিটি রাজ্যই তার সীমার মধ্যে কৃষকের স্বার্থ রাখতে নিজের নিজের দৃষ্টিতে যা ভাল বুঝেছে তা করেছে। বিহার তো ২০০৬-এ এপিএমসি ভিত্তিক মান্ডি তুলে দিয়েছে। বিহারের অভিজ্ঞতা থেকে কি কিছুই শেখার নেই?

কিন্তু নতুন আইন প্রয়োগ করা হলে সংবিধানে যৌথ তালিকায় থাকা কৃষির উপর রাজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়ার রাস্তা খুলে যাবে। অর্থাৎ বিষয়টি ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের মূল সুরের বিরোধী। যৌথ তালিকায় থাকার কারণেই কেন্দ্রের এ বিষয়ে শেষ কথা বলার পূর্ণ অধিকার আছে বলে রাষ্ট্র এই সুযোগে আরও একবার চোখ রাঙাচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে যে কৃষি বিপণন ব্যবস্থাকে মান্ডির ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে মুক্তি দিতেই এই আইন। মান্ডি থাকছে। কিন্তু পণ্যকে মান্ডিতেই বিক্রি করার বিষয়ে কৃষকের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না বলে যুক্তি সাজানো হয়েছে। কৃষি পণ্য চলাচলের উপর রাজ্যের আর কোনো অধিকার থাকবে না। মান্ডির বাইরে কৃষিপণ্য লেনদেনের উপর কোনো সেস বা কর বসানোর অধিকারও আর রাজ্যগুলির হাতে থাকবে না। আধিপত্যের সুবাদে রাজ্যের হাত থেকে আয়ের সব রাস্তা কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এপিএমসি-র মূল কারণটাই ছিল যাতে কৃষকরা অন্তত ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত না হয়। মান্ডি ব্যবস্থা ছিল কৃষকের হাতে সেই দাম তুলে দেওয়ার প্রকৃষ্ট ব্যবস্থা। মান্ডি ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বাস্তুঘুঘু আস্তানা গেড়েছে বলে যে অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায় তা নিশ্চয়ই বাস্তবভিত্তিক। কিন্তু মাথা ব্যথা নিরসনে মুন্ডচ্ছেদ একমাত্র দাওয়াই হতে পারে না। মান্ডি-র ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ আছে। এপিএমসি ভিত্তিক মান্ডি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার পর নতুন আইনে কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকার কী ভাবে রক্ষা করা হবে তা কিন্তু স্পষ্ট করে বলা হয়নি।

এই প্রসঙ্গেই আসছে দ্বিতীয় আইনটি। ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসিওরান্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল, ২০২০। এই আইনে চুক্তি চাষের কথা বলা হয়েছে। আইনে কীভাবে কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে চুক্তি হবে তার একটা রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী কৃষকরা চুক্তি মেনে চাষ শুরু করার আগেই ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে দাম নির্ধারণ করবে। স্বাভাবিকভাবে কোন ফসলের জন্য কতদিনের মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে তা বীজ বপনের আগেই স্থির হয়ে যাবে। প্রয়োজনে বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি ক্রেতা কী ভাবে সরবরাহ করবে, পণ্যের গুণমান ইত্যাদির কথা থাকবে সেই চুক্তিতে। ওই চুক্তির ভিত্তিতেই দু’পক্ষ লেনদেন করতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু এই আইনে কোথাও বলা নেই দাম নির্ধারণের ভিত্তি কী হবে? চুক্তির মেয়াদ শেষে সেই জমি অন্য ফসল উৎপাদনের যোগ্যতা হারিয়ে ফেললে কী হবে? বলা নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাদন প্রথার আদর্শ উত্তরণ। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো কৃষকের বিরুদ্ধে চুক্তি ভাঙার অভিযোগ নিয়ে ক্রেতা আদালতে অভিযোগ আনলে কৃষককে তো ঘটি-বাটি-মাটি বিক্রি করে নিজেকে দায়মুক্ত হতে হবে। পিছনের দিকে এগিয়ে চলার আদর্শ দৃষ্টান্ত।

প্রশ্ন উঠেছে তৃতীয় আইনটি নিয়েও। এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল বা অত্যাবশ্যক পণ্য আইন। এই আইন বলবৎ হলে চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ ও আলুর মতো পণ্য আর অত্যাবশ্যকীয় বলে বিবেচিত হবে না। এর ফলে এইসব নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, গুদামজাত করা বা বিক্রি করার উপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। শুধু তাই নয়, রাজ্যের হাতে আপৎকালীন বণ্টন বা রাশ টানার অধিকারও আর থাকবে না। কেন্দ্রের হাতে চলে যাবে এ সম্পর্কিত যাবতীয় সিদ্ধান্ত। কতটা কেন্দ্রের গুদামে ধরে রাখা হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে দামের ওঠা পড়া দেখে। পচনশীল পণ্যের দাম যদি ৫০ শতাংশ আর অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বাড়ে তা হলে সরকার মাঠে নামবে, অন্যথায় নয়।

দেশের সব রাজ্যে কৃষিপণ্যের দাম কি একভাবে কমে বা বাড়ে? তাহলে কীভাবে এই দামের ওঠা-পড়া দেখা হবে সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাস্তবে সংস্কারের নামে কৃষকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের এই প্রবণতা কিন্তু দেশের মূল সাংবিধানিক ভিত্তিই নষ্ট করতে পারে।

সবমিলিয়ে নতুন আইন প্রয়োগ করা হলে -
• রাজ্যের হাত থেকে কৃষি ব্যবস্থা পুরোপুরি কেন্দ্রের অধিকারে চলে যাবে।
• রাজ্যের হাতে মান্ডির বাইরে কৃষি থেকে আয়ের কোনো উপায় থাকবে না।
• মান্ডিতে কতজন কৃষক আসবেন? কৃষি পণ্যের কারবারিরা নিজেদের স্বার্থে মান্ডির কমিশন এজেন্ট বা ফড়েদের মাধ্যমে কৃষকের পণ্য মাঠ থেকে সরাসরি হাতিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেবেন।
• এমএসপি নির্ধারিত দাম মান্ডির বাইরে আদায় হওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় জবরদস্তি করার সুযোগ থাকবে।
• চুক্তিভঙ্গে সরকার সাধারণ কৃষকের পাশে কীভাবে থাকবে অথবা আদৌ থাকবে কিনা তা অনুচ্চারিত।
• অত্যাবশ্যক নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ আর আলু অত্যাবশ্যক থাকবে না। রাজ্যের হাতেও বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো অধিকার থাকবে না। ফলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সঙ্কটের সম্মুখীন হতে বাধ্য।
• নানান আইন সত্ত্বেও ছোটো কৃষকরা ফড়েদের হাতের শিকার। যেটুকু আইনি ব্যবস্থা ছিল কৃষক স্বার্থ রক্ষায় তাও তুলে নেওয়া হবে নতুন ব্যবস্থায়। কৃষি পণ্য লেনদেনে কৃষক স্বার্থ দেখার খাতাকলমের ব্যবস্থাটুকুও তুলে নেওয়া হবে।
• তৈরি হবে তিন ধরনের বাজার। মান্ডি, চুক্তি চাষ, ও মান্ডির বাইরের বাজার। মান্ডি তৈরি হয়েছিল ফড়েরা যাতে কৃষকদের জমি থেকে পণ্য তুলে তাদের অত্যাচার না করতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত ফড়েদের যাওয়ার রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে। ফলে নামে মান্ডিকে অস্বীকার না করলেও বাস্তবে মান্ডি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না।

কৃষি পণ্যের বাজারে সর্বগ্রাসী থাবা বসাতে যে ক্রেতারা আগ্রহী তারা নিশ্চয়ই মেঠো ব্যাপারী নয়। লক্ষ লক্ষ টন পণ্য বাজারে আনার আগে সঠিক পদ্ধতিতে তার সংরক্ষণ এবং চাহিদা অনুযায়ী সাজিয়ে গুছিয়ে বাজারে পৌঁছে দিতে যে বিপুল আয়োজন দরকার তার জন্য অনেক অ-নে-ক পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়। সাধ থাকলেও সাধ্য কজনের আছে? ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন উৎপাদন ও পরিষেবার ক্ষেত্রে তাদের সদর্প উপস্থিতি উপলব্ধি করা গেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি গোষ্ঠী সরকারি আনুকূল্যে দেশের প্রায় সমস্ত উৎপাদন ও পরিষেবা ব্যবস্থা করায়ত্ত করে নিয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পরিষেবা ব্যবস্থার কথা যত কম বলা যায় তত ভালো। মানুষের হাতে টাকা নেই। বিদেশের চাহিদা কমে গেছে। কাজেই পরিষেবা ব্যবস্থা ধুঁকছে। পর্যটন হোটেল রেস্তোরাঁ ইত্যাদি শিল্প বিপর্যস্ত। বেশিরভাগই বন্ধ। বাকিরা খাবি খাচ্ছে। খুব শিগগিরিই কোনো উন্নতির ন্যূনতম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প গত ৪০ বছরে এমন পতন দেখেনি। ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে ১৯% ছোটো ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটের। ৩৭% এর কাছে প্রয়োজনীয় কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো পুঁজি অর্থাৎ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল নেই। মাইক্রো স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রি, যা নাকি দেশের জিডিপির ৩৭.৫% জোগান দেয় বলে দাবি করা হয়, তার অবস্থা সব্বার জানা। সবমিলিয়ে ত্রহ্যস্পর্শযোগ চলছে।

এই দুর্দিনে দেশের অন্নদাতারা কিন্তু নিজেদের দায়িত্ব নীরবে পালন করে গেছেন। জিডিপি-র পরিসংখ্যান শূন্যের থেকে প্রায় ২৪ শতাংশ নেমে যাওয়ার মরশুমে কৃষি ক্ষেত্রের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। কাজেই এই মুহূর্তে পুঁজি বিনিয়োগের সেরা জায়গা কৃষি। কিন্তু প্রচলিত আইনগুলি পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল। কাজেই পুঁজির সমর্থনে এগিয়ে এসে সমস্ত বাধাবিপত্তি দূর করে দেওয়া হল।

প্রচার চলছে যে এই নতুন আইন চালু হলে কৃষক স্বাধীনতা পাবে। আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে। অথচ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে এই আইন পুঁজিকে অবাধ বিচরণের স্বাধীনতা দেবে।

এই পরিসরে কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীনদের দ্বিচারিতা আবারও প্রমাণিত হয়ে গেল। ২০১১-য় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তখনকার প্রধানমন্ত্রীকে সমস্ত রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন এমএসপি অব্যাহত রাখতে হবে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার লক্ষ্যে সেই মানুষটিই আজ এমএসপি তুলে দেওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করছেন এই আইনগুলি পাশ করিয়ে। মান্ডির বাইরে যারা কৃষিপণ্য ক্রয় করবেন তারা এমএসপি দেবেন কেন? প্রধানমন্ত্রী জোর গলায় বলছেন এমএসপি চালু থাকবে। তাহলে কেন আইনে তা লিখে দিচ্ছেন না। বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি যেই দাবি তুলেছিলেন, আজ তাকে বাস্তবায়িত করছেন না কেন?

২০১৪-য় পাশ হওয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইন অনুসারে মাঠে ফসল থাকাকালীনই বেসরকারি সংস্থা কৃষকের কাছ থেকে তা কিনে নিতে পারে। রীতিমতো আইন পাশ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষিপণ্যের বাজারে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশের পথ খুলে দিয়েছিল। ২০১৭-য় একটি সংশোধনী এনে কৃষিপণ্যের ই-ট্রেডিং বা অনলাইন বাণিজ্য এবং বিপণনও বৈধ করা হয়। বাজার থেকে সেস বা কর বসিয়ে আয়ও করেছে নিজেদের মতো করে। এমনকি পণ্য চলাচলের উপর লাগামও নিজেদের হাতে রাখতে পেরেছে। সেই সরকারের প্রধান এখন কেন্দ্রীয় আইনের বিরোধিতায় মুখর! রাজ্যে বৃহ‍ৎ পুঁজিকে কৃষিপণ্যের বাজারে ঢালাও অনুমোদন দিয়ে এখন কেন্দ্রীয় আইনের বিরোধীতা করা দ্বিচারিতার পরিচয়। জনগণের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা না রাখা সময় বিশেষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

পুঁজির স্বাধীনতা বাড়িয়ে পুঁজিকে আত্মনির্ভর করে তোলার প্রক্রিয়া সক্রিয়। পক্ষে বিপক্ষে এই নিয়ে দিবারাত্র বিতর্ক-বিবাদ চলছে। কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই এমন সামান্যতম শতাংশের ভারতীয় পরম নির্লিপ্তিতে নিমজ্জিত হয়ে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে সান্ধ্য অবসর যাপন করুন, রাষ্ট্র তাতে খুশি হতে পারে। তাঁদের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনায় কৃষিজীবী মানুষ মোটেও গুরুত্ব দেন না। কৃষিজীবী মানুষের কাছে এ হল টিকে থাকার লড়াই। রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে কৃষিজীবী মানুষের লড়াই শুরু হয়েছে। তাঁদের চোখে দৃঢ় প্রত্যয় - কৃষি সংস্কারের নামে কৃষক সংহার কোনোমতেই হতে দেওয়া হবে না।