আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

পুনঃপাঠ

যে মানুষটি মুখোশ কাড়তেন

অশোক মিত্র


বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু ঈর্ষাও করতাম সেই সঙ্গে। নিজের মধ্যে যে-গুণের অভাব, অন্য কারো মধ্যে তা দীপ্যমান দেখলে ঈর্ষান্বিত হওয়া মানুষের স্বভাব। আমার নিজের মধ্যে খাদ আছে অনেক, অনেক অস্থৈর্য, অনেক দ্বিধাবিভক্তি, অনেক প্রচ্ছন্ন অথবা অপ্রচ্ছন্ন সুবিধান্বেষণ প্রবৃত্তি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই সমস্ত কিছুর বাইরে ছিলেন বরাবর, সেই চল্লিশের দশকে প্রথম আলাপ হবার সময় থেকে শুরু করে আমৃত্যু। একটা পর্যায়ের পর, আত্মশোধনের পরিসর সংকুচিত হয়ে আসে। আমি যা কোনদিন হ'তে পারবো না, অথচ যা হবার জন্য অন্তঃস্থিত একটি আকুতি অবিরত হাঁসফাঁস করছে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তা হয়েছেন, হতে পেরেছেন এই আত্ম-অনুশোচনা-মিশ্রিত মুগ্ধতাবোধ এই এতগুলি বছর ধরে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। চেতনার উন্মেষের প্রথম থেকে একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত, একটি মানুষ তাঁর আদর্শে অবিচল আছেন সেই আদর্শের নিজের জীবনে প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন, কোন জড়তা নেই, গ্লানিবোধ নেই, এমনটা চট করে দেখা যায় না। এটা অথচ যে হওয়া সম্ভব বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তা দেখিয়েছিলেন। গাছেরটাও খাবো - তলারটাও কুড়োবো - আপাততঃ এই মানসিকতা মধ্যবিত্ত বাঙালী সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে উপনিবেশ বিস্তার করেছে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে এই নব উপনিবেশবাদের শিকার হতে দেন নি। যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন, সেই প্রথম থেকেই। তাঁর সঙ্গে তাঁর পরিবারস্থ সকলকে এই যুদ্ধহেতু অঢেল, জাগতিক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, যা তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি।

এবং সেই কারণেই তাঁর কাব্যচর্চা নিয়ে আলাদা কোনো আলোচনা আমি অপ্রয়োজনীয় মনে করি। কবিতা তাঁর কাছে আদর্শ-ধ্যানধারণা-জীবনাবেগ সমাজে, ছিটিয়ে দেওয়ার , ছড়িয়ে দেওয়ার উপকরণ ছিল, কবিতাকে তাই তিনি ব্যবহার করতেন। তিনি, তাঁর সত্তা, তাঁর সমাজচেতনা কর্তৃপুরুষ, কবিতা ক্রীড়নক। তাঁর স্বভাব-প্রতিভায় কোনো ঘাটতি ছিল না, কাব্যগত প্রকরণ কৌশল ইত্যাদিও তাঁর পরিচয়ের বাইরে ছিল না, এই শ্রেণী-বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায়ও ইচ্ছা করলেই আখের গুছিয়ে নিতে পারতেন, কিন্তু প্রথাগতবিখ্যাতিতে তিনি পুরোপুরি আসক্তিহীন ছিলেন। কবিতাকে ব্যবহার করা হবে, কবিতা দ্বারা ব্যবহৃত হবো না - নিজের কাছে তাঁর মতো এমন ধারা অঙ্গীকার অন্য ক'জন আর করতে পরেছেন, অথবা ক'রে সেই অঙ্গীকার রক্ষা করতে পেরেছেন? আমার অন্তত জানা নেই।

এই মানুষটি ধোপাবাড়ির পোশাক পরতেন না তাঁর আলাপ আলোচনাকেও পরাতেন না। আমরা বাঙালি মধ্যবিত্তরা চিরকালই দ্বিরাচারী, বাইরে একরকম বলি, মনের মধ্যে আরেকরকম চিন্তামতঅভিমত পুষে রাখি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কপটতাও নিজের ক্ষেত্রে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পেরেছিলেন। সুতরাং আমরা তাঁর কাছ থেকে স্পষ্ট কথা শুনতে পেতাম, রূঢ় কথা, নির্দয় কথা। দয়া-দয়াহীনতার সামাজিক সরঞ্জাম একটু খটোমটো, যেকথা অকপটে ব্যাখ্যায় শুনলে আমার জ্ঞানের পরিধি বাড়বে, পরিণামে আমারই উপকার হবে, তাকে কেন মমতাহীন বলে অভিহিত করা হবে তা নিয়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়তো ভেবেছেন, হয়তো ভাবাটাকেও অকারণ-বিলাসিতা বলে নিরূপণ করেছেন। কিন্তু তাঁর স্পষ্টভাষণ শুনতেই তো তাঁর কাছে যেতাম।

আর যাওয়া হবে না। উচিত কথা স্পষ্ট, সতেজ, দেশজ ভাষায় বলার মতো লোক আমাদের সমাজে আরো কমল। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন, এই উক্তিরও তেমন মানে হয় না। স্মৃতিও শেষ পর্যন্ত আমাদের বৈশ্য সমাজে ব্যবহার্য জিনিস হয়ে যায়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অন্তত সেই অপমানের হাত থেকে অব্যাহতি পাবেন, এই মুহূর্তে এইটুকু আমার আশা। সব আশা তো ফলবান হয় না, তাই শেষ পর্যন্ত আশা ছাপিয়ে আশংকা।

সুতরাং শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক আক্ষেপেই আমাকে ফিরে আসতে হয়। অন্তত একটি ব্যক্তি, যিনি বেলা-অবেলা-কালবেলায় আমাকে গাল পাড়তেন, আমার মুখোশ খুলে দিতেন, তিনি মিলিয়ে গেলেন, আমি আমার ভণ্ডামি নিয়ে এখন, নিশ্চিন্ত, উল্লম্ফনবৃত্তিতে মনোনিবেশ করতে পারবো।

_______________________
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অশোক মিত্রের এই শ্রদ্ধার্ঘ পুনর্মুদ্রণ করলাম। নিবন্ধটির প্রথম প্রকাশ সাংস্কৃতিক খবর, দশম বর্ষ, ৪০ সংখ্যা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৯০।