আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭
প্রবন্ধ
করোনার ‘রাম’ দাওয়াই
দীপ্তেশ মিত্র
দেশ বিদেশের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী, গবেষক যখন দিন-রাত এক করে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, এই বিশ্ব মহামারির হাত থেকে কীভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায় তার জন্য মাথার চুল ছিঁড়ছেন ঠিক তখনি বাবা আবির্ভূত হলেন, সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়ী আবিষ্কার ‘করোনিল’। একটি দু'টি নয় একেবারে তিন তিনটি, কম্বো প্যাক, সাত দিনে করোনা খতম, দাম মাত্র ৫৪৫ টাকা। উত্তাল হয়ে উঠল ভারতীয় মিডিয়া, দেশ ব্যাপী একটাই আলোচনা বাবা রামদেবের ‘করোনিল’! মানুষ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন মহল থেকে উলটো সুরও ভেসে আসতে থাকল। এই বিষয়ে জনৈক টিভি সাংবাদিক বাবাকে প্রশ্ন করলে পদ্মাসনরত অবস্থায় মৃদু অভিমানের সুরে বাবা বলেন, “দেশ বিদেশের বড় বড় বিজ্ঞানী, গবেষকরা যা করে দেখাতে পারল না তা এক ভারতীয় সাধু কী করে করলো! তাই এই ক্ষোভ”।
বিশ্বাস করুন বাবা আপনার প্রতি আমার এতটুকু ক্ষোভ নেই বরং আমি তো খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম যে বাবা এত দেরি করছে কেন? ইস্ এতো দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাবা কবে করোনার সঞ্জীবনী বুটি নিয়ে আসবে, কবে আমাদের উদ্ধার করবে, কবে মানুষ এই মহাপ্রলয় থেকে মুক্তি পাবে। এই মহা বিপর্যয়ে আপনি বিরত থাকবেন এটা হতে পারে না, আমি মানতেই পারছিলাম না, চারি দিকে করোনার ওষুধের জন্য ত্রাহি ত্রাহি রব - বাবা এত দেরি করে ফেললেন! আমি তো ভেবেছিলাম লক-ডাউনের প্রথম সপ্তাহেই আপনি করোনার ওষুধ নিয়ে আবির্ভূত হবেন আর বলবেন - লক-ডাউন হাটাও। আপনার আবিষ্কৃত ওষুধের (করোনিল) সব উপাদানই-তো আপনার বাগানে ছিল (তুলসী, অশ্বগন্ধা, গিলয়), তাছাড়া এই উপাদানগুলো তো আপনার আবিষ্কৃত, বহু দুরারোগ্য ব্যাধিতে ব্যবহৃত, ক্যান্সার থেকে শুরু করে কুষ্ঠ, গাঁটের ব্যথা থেকে হার্ট, সব কিছুতেই এর বহুল ব্যবহার! সে না হয় কখনো গোল গোল বড়ি করে, না হয় কাঁচা চিবিয়ে, কখনো বা ভেজে কখনো বা শুকিয়ে, না হয় নিঙড়ে সিরাপ, সাথে সকাল-বিকাল দু'বেলা কপালভাতি ব্যাস। আপনি বাগানে যেতেন, ছিঁড়তেন আর বোতল বন্দি করতেন, ব্যাস হয়ে গেল ওষুধ তৈরি। পরীক্ষা নিরীক্ষা সে আবার কি? ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফ্রায়াল আপনার লাগে নাকি! আপনি একবার মুখে বলে দিলেই তো হল। পাবলিক গিলবে না মানে, বাপ বাপ করে গিলবে, ভক্তিভরে গিলবে, যে জনগণ চোখ-কান বন্ধ করে অমৃতের ন্যায় ঢক ঢক করে গোমূত্র গিলতে পারে, তাদের কাছে আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট।
তা বাবা আপনার এই কালজয়ী মহান আবিষ্কারের নেপথ্য কাহিনী যখন দু-নয়ন ভরে আপনার পোষিত টিভি চ্যানেলে দেখছিলাম, বুকটা গর্বে ভরে যাচ্ছিল, উত্তেজনায় আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল (মাথা বাদ দিয়ে)। অক্সফোর্ড, হাভার্ড-এর সেই বিজ্ঞানী, গবেষকদের কথা বার বার মনে পড়ছিল, ইস্; মুখগুলি নির্ঘাত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে নয়ত বা দেয়ালে মাথা ঠুকছে। প্রাচীন ভারতীয় জড়িবুটি ও চিকিৎসা পদ্ধতির গুরুত্ব বা মাহাত্ম্য এরা কতটুকুই বা জানে, শুধু নাক সিঁটকানো! এবার বুঝবে ঠ্যালা! চারিদিকে ভারতের জয়ধ্বনি হবে, দিকে দিকে চর্চিত হবে প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা পদ্ধতির, বর্ষিত হবে অভিনন্দন। চীন, জাপান, ইতালি, ফ্রান্স সর্বত্র আপনি দু'হাত ভরে ওষুধের যোগান দিয়ে যাবেন; করোনা-নীল হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে, আর চড়চড় করে লাল হয়ে উঠবেন আপনি; একেবারে গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম।
কিন্তু বাবা একি শুনলাম; আপনার নামে নাকি হাফ ডজন খানেক FIR হয়েছে! কী অবস্থা! কৌন হে ইয়ে লোগ? কাহা সে আতে হে? ছিঃ; ছিঃ; নোবেলপ্রাপ্তি যোগ্য এহেন আবিষ্কারকে সন্দেহ? কত্ত বড় সাহস! হিংসে বাবা হিংসে শালা অ্যান্টি ন্যাশনালিস্ট; ইস্ মার্কেটে হাতে গোনা কয়েকটি বাবা টিকে আছে তাও এদের সহ্য হয়না; বাবা হীনতায় ভুগছি; বাবা রামরহিম, আশারাম বাবা ওরা থাকলে ওরা-ও চেষ্টা করতো (জেলের বাইরে) করোনার ওষুধ নিয়ে এত চিন্তা করতে হত না।
যাই হোক, তা বলে বাবা করণ জোহর এমন করল আপনার সঙ্গে; থুড়ি আয়ুষ মন্ত্রক; (ওটা তো অন্য কেস)। কোথাকার কথা কোথায় লিখছি! আনন্দ বাবা আনন্দ! আপনার আবিষ্কারের আনন্দে সব গুলিয়ে যাচ্ছে যে! তা আয়ুষ মন্ত্রক আপনার এই ওষুধের প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে? কেন বাবা কেন? - নেশন ওয়ান্টস্ টু নো? পাছে ট্রাম্প মহাশয়ের কান অব্ধি না পৌছায়। ওনার কানে একবার পৌঁছালে আর রক্ষে নেই; মহাশয় খুবই দুশ্চিন্তায়; গ্যালন গ্যালন ‘সসুরা (স্বাসারি) চেয়ে পাঠাবে; শেষে সিরাপের জল কোন দিকে গড়ায় সে কথা ভেবেই হয়ত… তাছাড়া এখন তো আমাদের লোকাল ফর ভোকাল হতে হবে। যাক শুদ্ধ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করোনার ওষুধ পাওয়া গেল, সব থেকে বড় কথা কোনো সাইড এফেক্ট নেই।
বাবা আপনি আবার বড় মন করে বলে বসলেন যে গরীবদের বিনা পয়সায় এই ওষুধ দেবেন। কী দরকার বাবা গরীবরা লক-ডাউনে এমনিতেই মরেছে; আর বাকি যেগুলো আছে কয়েক দিনের মধ্যেই আত্মনির্ভর হয়ে যাবে, সে ব্যাপারটা বিকাশ দেখছে, আপনার স্বাস্থ্যবান ভক্তরাই আগে গিলুক। তাদের জন্য ভাবার কেউ নেই, তারা বড্ড অসহায়।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যখন বেড়ালটা রুমাল হয়ে গেল, মানে যখন শুনলাম যে করোনিল দ্বারা কোনও ভাবেই করোনার চিকিৎসা সম্ভব নয়। এটা স্রেফ বাবার ধাপ্পাবাজি; আসলে এখানেই পার্থক্য বিজ্ঞান আর চাটুকারিতার, বিজ্ঞান কখনো চাটুকারিতার আশ্রয় নেয় না, বিজ্ঞান সত্য, পরীক্ষিত এবং সর্বত্র প্রমাণিত, ফলে বিজ্ঞানের রাস্তাটাও কঠিন। তাই হয়তো ওষুধ তৈরি হতে এই বিলম্ব। করোনার ওষুধ আবিষ্কার হোক মানুষ এই মহামারির হাত থেকে মুক্তি পাক এবং সেই সফলতা একজন ভারতীয়ের হাত ধরেই আসুক, তা সে রাম, শ্যাম, যদু, মধু যেই হোক না কেন; কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তা যেন হয় বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, বিজ্ঞান নির্দেশিত পথে।
লেখাটি এখানেই শেষ করা যেত কিন্তু বাবার ধাপ্পাবাজি গ্রামবাংলায় কী প্রভাব ফেলল তার একটি ছোট ঘটনার কথা না বলে থাকতে পারছিনা। আমার মায়ের কথাই বলি; ইস্ বেচারি করোনার ভয়ে কেমন কুঁকড়ে ছিল; দীর্ঘ লক-ডাউনে যাত্রা পথ বলতে ঘর থেকে রাস্তার কল পর্যন্ত; সারা দিন টিভি দেখে দেখে যথেষ্ট আপডেটেড হয়ে উঠেছিলো, উহান থেকে শুরু করে - হু (WHO) হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন থেকে টেড্রস ঘেব্রেইসাস (হু- প্রধান) সব তাঁর নখদর্পণে, আর ইমিউনিটি বৃদ্ধি সংক্রান্ত তাঁর অর্জিত অগাধ জ্ঞানের কথা আর নাই বা বললাম। এক্ষেত্রে টিভির পাশাপাশি অবশ্য পাড়া প্রতিবেশীরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে; যেমন - কুমড়ো, পেঁপে দিয়ে ডিমের ঝোল সাথে ভাসমানরত থানকুনি পাতা (ভিটামিন A to Z-এর এক ঘোলাটে মিশ্রণ)। ইদানীং হ্যান্ড স্যানিটাইজারেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এহেন করোনা সচেতন মানুষটাকে দেখি পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত, বিষয় বাবার আবিষ্কার করোনিল। কিন্তু সমস্যা বাঁধাল গিলয়। মানে তুলসী, অশ্বগন্ধা তো পাওয়া যাবে কিন্তু গিলয়-টা কী ? টুকুর মা একশো শতাংশ গ্যারান্টি দিয়ে বলে উঠল ইহা নিশ্চিত মাছের চামড়া, ছোটবেলায় তার বাপের বাড়ির ওদিকে (হাসনাবাদ) এই মাছ পাওয়া যেত। টুকুর মায়ের কথা শুনে এ দিকে চাপে পড়ে যায় বেলা পিসি; উনি আবার নিরামিষ ভোজী, তুলসী, অশ্বগন্ধার রসের সাথে মাছের চামড়ার মিশ্রণ; ফ্যাকাসে হয়ে যায় তার মুখ, ধমকের সুরে টুকুর মাকে থামিয়ে দিয়ে ফোন লাগায় তার ছোট দেওরকে, সে আবার পেশায় একজন ডাক্তার, রাজস্থানে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করেন।
যাই হোক দিন সাতেক চলল এই গিলয় খোঁজা। ওদিকে বাবার করোনিল মরে ভূত; মানে বাবা ১৮০ ডিগ্রি পালটি, কিন্তু সে সব কিছুই তাদের কান পর্যন্ত পৌছুলো না, সকাল-বিকাল দু-বেলা করে তারা তুলসী, অশ্বগন্ধা ও গিলয়ের শরবত খেয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কিছু বলতে গেলেই রেগে যাচ্ছে, মার্ক টয়েন যথার্থই বলেছেন - “মানুষকে বোকা বানানো সহজ কিন্তু বোঝানো কঠিন যে তাদের বোকা বানানো হচ্ছে”। কিন্তু এর দায় কি আমরা এড়াতে পারি? প্রশ্নটা উঠেই যায়, বাবা রামদেবের করোনিল আবিষ্কারের ঘটনা ভারতীয় মিডিয়া যে হারে প্রচার করল, কিন্তু তার ধাপ্পাবাজিটা কেন ব্রেকিং নিউজ হল না? ভারতীয় সংবিধানে সাইনটিফিক টেম্পারের কথা বলা হয়েছে সেই সংবিধানের অংশীদার হয়ে কীভাবে মিডিয়া জ্যোতিষ, তন্ত্র, মন্ত্র ইত্যাদির দৈনন্দিন প্রচার করে যায়? উত্তর আসবে না আমি জানি! কিন্তু এহেন বাবারা বার বার আবির্ভূত হবেন অন্য কোনো সময় অন্য কোনো প্রেক্ষাপটে। ঠিক যেমন কয়েক দিন আগে এক হরিপদ (জ্যোতিষী) বলে বসল যে সূর্যগ্রহণ-এর পরেই করোনা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে কী পরিণতি তা সবার সামনে, শুধু মাত্র মিডিয়ার ওপর দায় বর্তালে চলবে না পাশাপাশি আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার, গেরুয়া বসনধারী লম্বা দাড়ি যুক্ত ব্যক্তি সে যদি আবার নিরামিষভোজী হয়, তাহলেই আমাদের নিজস্ব যুক্তি, বিচারবোধের বারোটা পাঁচ বেজে যায়, আমরা মনে করি তার কাছে যেন অলৌকিক জ্ঞানের ভাণ্ডার, তিনিই সঠিক ও সবজান্তা।
এক মহামারির সঙ্গে আমরা বাস্তবে লড়াই করছি ঠিকই কিন্তু আর এক মহামারি অজান্তে, অন্তরালে থেকেই খোবলা করে দিচ্ছে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে এবং সেটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে কেউ তার খবর রাখছে না। সবথেকে ভয়ের বিষয় হল যখন দেখি একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও রাষ্ট্র নিজ দায়িত্বে তার প্রচার ও প্রসার ঘটাচ্ছে (প্রসঙ্গ - মন্দির নির্মাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষ চর্চার স্বীকৃতি ইত্যাদি), ভাবার সময় এসেছে… করোনামুক্ত পৃথিবীর পাশাপাশি কুসংস্কারমুক্ত পৃথিবীও ভীষণ জরুরী নয় কি?