আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭
প্রবন্ধ
‘করোনা-কবচ’-এর ফাঁদ
প্রবুদ্ধ বাগচী
গত ছ-সাত মাসে কোভিড-জনিত পরিস্থিতিতে একটা প্রসঙ্গ বারবার ঘুরে আসছে যে, এই অতিমারি অবস্থায় এক বিরাট সংখ্যক মানুষ যখন বিপন্ন হয়ে রয়েছেন তখন আরেকটা অংশ নানানভাবে এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে নেমেছেন। সেই দলের মধ্যে প্রথম সারিতে আছে আমাদের অতিচালাক কেন্দ্রীয় সরকার। মানুষের ঘরবন্দি অবস্থার সুযোগে তারা একের পর এক এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, মনে হচ্ছে, আহা এমন সুখের সময় এতদিন আসেনি কেন! অর্থনৈতিক স্বেচ্ছাচার তো আছেই তার সঙ্গে শিক্ষানীতি, ঋণনীতি নিয়ে পরের পর সিদ্ধান্ত, রাজ্যগুলির জিএসটি ক্ষতিপূরণ নিয়ে ঔদাস্য - এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। এটাকে যদি ম্যাক্রো লেভেলের হিসেবে ভাবি তাহলে মাইক্রো লেভেলেও এর কিছু কিছু উদাহরণ আমরা খুঁজে পাব। এই অতিমারির সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে স্যানিটাইজারের ওপর আঠারো শতাংশ হারে জিএসটি চাপালেন সেটা এরকমই একটা দৃষ্টান্ত। আবার এই রোগের আশঙ্কাকে সামনে রেখে বেসরকারি হাসপাতালগুলি যেভাবে রোগীদের থেকে বেপরোয়াভাবে চিকিৎসার টাকা আদায় করছেন, যেভাবে হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাওয়া হচ্ছে তাতে মনে হয়, করোনা কার্যত তাঁদের কাছে মহামুনাফার মরশুম। অন্যদিকে ছোটখাটো বিষয়গুলি - করোনা সন্দেহভাজন রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করা হয়েছে, মৃত করোনা রোগীর নিকটাত্মীয়দের থেকে মৃতদেহ দেখানোর জন্য উৎকোচ দাবি করা হচ্ছে - এগুলো সবই মানুষের বিপন্নতার বিনিময়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা। কিন্তু এই সবের মধ্যেই একটা বিষয় কিছুটা পেছনে চলে গেল, কারণ অনেকেই মনে করেছেন এটা এক ধরনের রিলিফ দেওয়ার ব্যাপার তাই কেউ কিছু বললেন না।
কথাটা হল কোভিড স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিমা নিয়ে। কোভিড নিয়ে দেশে সরকারি সচেতনতা বা তোড়জোড় শুরু হয়েছে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। তখনো সরকারিভাবে আশা করা হয়েছিল একুশ দিনের লকডাউন পালন করলে ও থালা-বাসন বাজালে রোগ উধাও হয়ে যাবে। হল ঠিক তার বিপরীত। দিনে দিনে রোগ বেড়ে চলল আর তার সঙ্গে তৈরি হতে থাকল আরো নানা নৈরাজ্য। জুন মাস নাগাদ যখন রোগ বেশ একটা ভাল রকম আশঙ্কার দিকে এগোচ্ছে ঠিক তখনই শুরু হয়ে গেল আনলক, আগের থেকে অনেক কিছু শিথিল করে চালু হল কাজকর্ম। এই সময়েই সামনে এল করোনা নিয়ে স্বাস্থ্যবিমাগুলি। বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি যারা স্বাস্থ্যবিমা শিল্পে পরিষেবা দিয়ে থাকে তারা প্রায় সবাই নেমে পড়ল এই ব্যবসায়। এই সময়কালে একশ্রেণির মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়েছে, তাই নেটে যে কোনো ওয়েবসাইট খুললেই তার গায়ে গায়ে উঠে আসছে এই বিমার বিজ্ঞাপন। শাড়ি জামা কাপড়ের মতোই তার নানান রং ও বিভঙ্গ।
একটা কথা এই সুযোগে বলে নেওয়া দরকার, কোভিড পরিস্থিতি একটা বিরাট অংশের মানুষের কাছে যেমন সমস্যার জন্ম দিয়েছে, ঠিক তেমনই একটা সম্পন্ন অংশ যাঁদের সংগতি আছে, তারা মনে করেছেন, নিজেদের বাড়ির মধ্যে আটকে রাখলে এবং অনলাইনে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে সন্তুষ্ট থাকলেই রোগের আঁচ আর তাঁদের গায়ে লাগবে না। বস্তুত, কোভিড সংক্রমণের মূল সূত্র অন্য মানুষ বা সমবেত মানুষের সংস্পর্শ - সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারলেই অনেকটা নিরাপদ থাকা সম্ভব। এই শ্রেণির মানুষদের জীবিকা বা মাসিক আয়ের ক্ষেত্রে কোভিড কোনো বিপদ ডেকে আনেনি, ফলে এঁদের হাতে টাকাকড়ি ছিল, এখনো আছে। অন্যপক্ষে সেই মার্চ মাস থেকে আজ (সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মূলধারার মিডিয়া কোভিড নিয়ে কেবল আশঙ্কার দিকটাই প্রচার করেছে বেশি, এখনো করে চলেছে। ফলে একদিকে রোগ নিয়ে বাড়তি একটা আশঙ্কার বোঝা এবং সেটাকে টপকে নিজের জীবন নিশ্চিত করার জন্য বিমার দিকে হাত বাড়ানো - পরোক্ষ একটা বাজার কিন্তু এভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্যবিমা শিল্প এই বাজারটাকে কব্জা করেছে।
এই পর্যন্ত কিছু বলার ছিল না। যারা বিমা শিল্পে বিনিয়োগ করেছেন তারা তাঁদের ব্যবসা বাড়াতে চাইবেন এর মধ্যে আপত্তির কীই বা থাকতে পারে? কিন্তু কথাটা হল, আলাদা করে করোনার জন্য বিমা কেন? যে কোনো স্বাস্থ্যবিমা যখন করানো হয় তখন বিমাকারীকে জানিয়ে দেওয়া হয় কোন কোন রোগের জন্য তিনি কী পরিমাণ বিমার অর্থ পাবেন, কী কী ক্ষেত্রে তিনি তা পাবেন না। করোনা-ভাইরাস বাহিত রোগটি আজকে শিরোনামে এলেও আসলে অন্য ভাইরাস-বাহিত রোগের সঙ্গে তার চরিত্রগত খুব একটা ফারাক নেই। আর সাধারণভাবে বিমা যখন করানো হয় তাতে যে কোনো ভাইরাস-বাহিত রোগের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে তার চিকিৎসার খরচ বিমাকারীর পাওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই যারা কোনো না কোনো স্বাস্থ্যবিমার অধীনে আছেন তাদের জন্য করোনা-বিষয়ক আলাদা বিমা করানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। সরকারি বিমা কোম্পানিগুলি সেই কারণেই কিন্তু কোনো করোনা-কবচ জাতীয় বিমা চালু করার কথা এখনো সেভাবে ভাবেনি। কিন্তু বেসরকারি বিমা সংস্থাগুলো এখানে একটা মস্ত চালাকির গল্প তৈরি করে ফেলেছে। তারা কিন্তু তাদেরই কোনো বিমাকারীর মাথায় এই ভয় সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছে যে, এই অতিমারি কালে বাড়তি একটা বিমা করিয়ে রাখা খুবই দরকারি। ফলে যিনি ইতিমধ্যেই নিজের বা পরিবারের জন্য একটি স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম দিচ্ছেন যা হয়তো আগামী আট-নয় মাস তাকে সুরক্ষা দিতে পারত, এবং সাধারণভাবে তাতে করোনা সংক্রান্ত রোগের চিকিৎসা হতেই পারত, তিনি কিন্তু ভয়ের ফাঁদে পা দিয়ে আরেকটা স্বল্পকালীন বিমা করিয়ে ফেলে কয়েক হাজার টাকা খরচ করে ফেলছেন। টাকা কেউ খরচ করতেই পারেন, কিন্তু বিষয়টা এক ধরনের প্রতারণার পর্যায়ে গেলে সেটা নিয়ে কথা বলতেই হয়।
হিসেব করে দেখতে গেলে আমরা যদি সম্ভাব্য বিমাকারীদের দুটো ভাগে ভাগ করি - একদল এই মুহূর্তে বিমার প্রিমিয়াম দিচ্ছেন, অন্যদল এখনো কোনো বিমা করেননি - তাহলে এই নতুন করোনা-কবচ দুই ধরনের উপভোক্তার কাছে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। প্রথম দলটির কথা আমরা আগেই বললাম, এবার অন্য দলটির কথা। তারা সাধারণভাবে বিমা করেননি, কিন্তু এই অতিমারির আবহে বিমা কিনছেন। এই কেনার পেছনে একটা সূত্র তার নিজের বা পরিবারের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা এবং তার চিকিৎসা করাতে গেলে যে বিপুল ব্যয় হবে তার একটা অংশ ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা রাখা। কিন্তু দুই দলের কাছেই একটা ধাঁধা আছে। তা হল, সাধারণভাবে স্বাস্থ্য বিমার সময়কাল এক বছর - প্রতিবছরে একবার করে তা রিনিউ করাতে হয়। রিনিউ করার সময় বিমাকারীর বয়স, শারীরিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি দেখে নতুন করে বিমার প্রিমিয়াম ধার্য করা হয়। কিন্তু এই করোনা বিমার আয়ুকাল কারোর ক্ষেত্রে তিন মাস কারোর ক্ষেত্রে নয় মাস (৩১ মার্চ ২০২১ এর বেশি এই বিমার আয়ুকাল নয়) - এই কয়েক মাস বাদে রোগের প্রকোপ কতটা থাকবে বা কমে যাবে তার হদিশ কে দিল? একই বিমায় একজনকে সমস্ত রোগের জন্য এক বছরের কভারেজ দেওয়া হচ্ছে আবার অন্য আরেকটি বিমায় একটি বিশেষ রোগের জন্য মাত্র কয়েক মাসের জন্য কভারেজ দেওয়া হচ্ছে - বিষয়টার মধ্যে কি খুব স্বচ্ছতা আছে? আর যারা এর আগেই নিজেরা স্বাস্থ্যবিমার অধীন আছেন, তারা কিন্তু একই সময়ে একই ধরনের রোগের জন্য দু'বার বিমার প্রিমিয়াম দিলেন! তাছাড়া, সাধারণভাবে স্বাস্থ্যবিমায় এক বছর কোনো ক্লেম না হলে বিমাকারী একটা বোনাস পান এবং পরিষেবা প্রদানকারীর পরিষেবা পছন্দ না হলে তিনি একই সুবিধেসহ অন্য বিমা কোম্পানিতে নিজের পলিসি সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। এই করোনা বিমার ক্ষেত্রে এই সুবিধে নেই। নিছক একটা ভয়ের চাষ করে তবে কি মানুষকে বিভ্রান্ত করছে না এইসব বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো?
তবে এই কাহিনির এখানেই শেষ নয়। ভাবার বিষয় আরো আছে। বহুল বিজ্ঞাপিত এই করোনা-কবচ পলিসিগুলির জন্য ওয়েট পিরিয়ড রাখা হয়েছে পনেরো দিন (অর্থাৎ বিমা করবার পর কমপক্ষে পনেরো দিন পরে হাসপাতালে ভর্তি হলে বিমার টাকা পাওয়া যাবে) এবং সর্বোচ্চ বিমাকৃত রাশি পাঁচ লক্ষ টাকা (সর্বনিম্ন রাশি পঞ্চাশ হাজার টাকা)। করোনা-ভাইরাস-বাহিত রোগের লক্ষণগুলি যদি খেয়াল রাখি তাহলে সারা দেশে যা চিত্র দেখা যাচ্ছে, কোনো মানুষ পজিটিভ হলে যদি তার কোনো বাড়তি সমস্যা বা কোমর্বিডিটি ফ্যাক্টর না থাকে তাহলে মোটামুটি পনেরো দিনে তিনি সুস্থ হয়ে যেতে পারেন, অন্তত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অবস্থা থাকছে না। তার মানে একজন বিমাকারী যদি বিমা করার পরেই আক্রান্ত হন, তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে বিমার টাকা পাওয়ার অধিকারী হবেন - কার্যত যার কোনো প্রয়োজনই হবে না। পরের কথা হল, বিমারাশির অঙ্ক। সারা দেশেই সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে রোগের চিকিৎসা হচ্ছে, কোথাও কোথাও কিছু বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা কোভিড রোগীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে সেখানে সরকারি নীতিতেই রোগীদের পরিচর্যা হচ্ছে। পড়ে রইল বেসরকারি হাসপাতালের সেইসব বেড যেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেরা চিকিৎসা করছেন। এই চিকিৎসার খরচ বিষয়ে আজ অবধি কোনো স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম রূপায়ণ হয়নি। কিছু কিছু রাজ্যে সেই রাজ্যের সরকার এই ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন বলে শোনা যায়, কিন্তু বেসরকারি ও কর্পোরেট হাসপাতালগুলির লবির জোর এতই বেশি তারা এগুলো মানছেন কি না তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। এই রাজ্যের খবর আমরা বেশি পাই। এখানে বেসরকারি হাসপাতালগুলো একেবারে নিজেদের খুশিমতো চিকিৎসার খরচ নিচ্ছেন, সরকারি নির্দেশনামা মানার কোনো দায় তাদের নেই এবং স্বাস্থ্য কমিশনের অ্যাডভাইসারি তারা আন্তরিকভাবে পালন করছেন এমন খবর নেই। ফলে চিকিৎসার ব্যয় আকাশছোঁয়া। সাধারণভাবে পাঁচ লক্ষ টাকার বিমা থাকলে বড় বড় রোগ/অপারেশন-এর (ওপেন হার্ট সার্জারি, কিডনি প্রতিস্থাপন ইত্যাদি) খরচ অনেকটাই কুলিয়ে যায় কিন্তু করোনা চিকিৎসার জন্য একেকটি হাসপাতাল আট-দশ লক্ষ টাকার বিল করে দিচ্ছেন। অথচ এই রোগের চিকিৎসার জন্য কোনো দামী ওষুধ, ইঞ্জেকশন, অপারেশন সরঞ্জাম কিছুই প্রয়োজন নেই। ফলে বিমার সর্বোচ্চ সীমার জন্য প্রিমিয়াম দিলেও তাতেও শ্যাম ও কুল দুইই রক্ষা পাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আরেকটা দরকারি কথা হল, করোনা রোগের চিকিৎসার জন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম পিপিই কিট ইত্যাদির জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলি সমস্ত চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বিপুল অর্থ দাবি করছেন - এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে যেখানে রোগীর জন্য ওষুধ লেগেছে মাত্র হাজার টাকা আর পিপিই কিট বাবদ দাবি করা হয়েছে দুই লক্ষ টাকা - সাধারণভাবে এই খরচ (পরিভাষায় যাদের বলা হয়, মেডিকাল ডিসপোজেবল) স্বাস্থ্যবিমায় পাওয়া যায় না। বিমা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, আইআরডিএ, কয়েকমাস আগে (২৩ জুন, ২০২০) বিমা সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছিল এই সুরক্ষা সরঞ্জামের খরচ যাতে গ্রাহক পেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে, ইদানিং সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তারও একটা সীমা থাকবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলি কীভাবে ও কতখানি সেই খরচ দেখাতে পারবে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একই আইসিইউ ইউনিটে কুড়ি জন রোগী থাকলে তাদের যদি চারজন ডাক্তার দেখেন, প্রত্যেকের কাছ থেকে তারা পিপিই কিটের মূল্য দাবি করছেন। এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ও ব্যয়ের ভারসাম্য না থাকলে বিমাকারীদের কোনো সুবিধে নেই। জোরালো বিজ্ঞাপনের আড়ালে এই সত্য কিন্তু ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
সব শেষে আসে বিমা করার পর সেই বিমার টাকা ফেরত পাওয়ার প্রসঙ্গ অর্থাৎ ক্লেম পাওয়া। এই বিষয়ে, বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা সংস্থাগুলোর মোটেও তেমন সুনাম নেই। কয়েক বছর আগে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ক্লেম দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সব থেকে বেশি হয়রানি করেছে একাধিক বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা সংস্থা আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই হয়রানির অজুহাত হল পুরোনো রোগের উল্লেখ করে বিমার দাবি নাকচ করা (পরিভাষায় প্রি-একজিস্টিং ডিজিজ)। করোনা বিমার ক্ষেত্রে বিমার টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন, তা একটা তথ্যের দিকে নজর ফেরালেই স্পষ্ট হবে। সারা দেশে যে-সংখ্যক মানুষ এই রোগের প্রকোপে মারা গেছেন তাদের প্রায় ৮২ শতাংশ কোনো অন্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন যাকে বলা হচ্ছে কোমর্বিডিটি ফ্যাক্টর। সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর খতিয়ান থাকছে তাতে এই চিত্রটা খুব পরিষ্কার। এই রাজ্যের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা উল্লেখ করা থাকছে, সেখান থেকেও একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। এখন কথাটা হল, কোনো মানুষের যদি সাধারণভাবে এই রোগ হয় এবং তার যদি কোনো অন্য রোগ না থাকে তাহলে তিনি সহজেই সুস্থ হবেন, হয়তো বা হাসপাতালে ভর্তি না হয়েই। আর যারা ওই অন্য রোগগুলিতে (এই ক্ষেত্রে ফুসফুসের অসুখ, হৃদযন্ত্রের রোগ, সুগার, কিডনি-সংক্রান্ত রোগ ইত্যাদি) ইতিমধ্যেই আক্রান্ত তাঁদের সম্ভাবনা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ও রোগের জটিলতার মুখোমুখি হওয়া। কিন্তু এই পুরোনো রোগের অজুহাতে তাঁদের ক্লেম বাতিল হয়ে যাওয়ার ষোলো আনা সম্ভাবনা থেকেই গেল। ফলে দশ জন বিমাকারীর মধ্যে দু'জনের হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার হবে না, আর আট জনের দরকার হবে কিন্তু তারা বিমার টাকা পাবেন কি না সেটা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা। নানা লোভনীয় কথা শুনে যারা বিমা করাচ্ছেন তারা এই দিকটা ভেবে দেখেছেন তো?
এবার আরেকটা কথা। বিমা চালু করার মূল সূত্র হল রাশিবিজ্ঞানের সম্ভাব্যতার একটা গাণিতিক তত্ত্ব। কত মানুষ আক্রান্ত হবেন, কত জন মারা যেতে পারেন এর একটা হিসেব-নিকেশ থাকে যার ওপরে বিমাশিল্প দাঁড়িয়ে থাকে। করোনা-বাহিত রোগের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই বলা হয়েছে এর মৃত্যুহার তিন শতাংশের কাছাকাছি যা ভারতে অন্যান্য রোগের মৃত্যুহারের থেকে অনেক কম। একশো জন রোগীর মধ্যে তিন জন মারা যেতে পারেন, বাকি সাতানব্বই জন দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। যাকে অতিমারি বলা হচ্ছে তার মধ্যেও কিন্তু এই হিসেবটা তেমন বদলে যায়নি, যদিও সর্বস্তরে ঘটা করে তার প্রচার বাঁধা হয়েছে অন্যসুরে এবং রোগ হলে কী হবে এই অনিশ্চয়তাটাই আমাদের মনে প্রবল ভয়ের মতো গেঁথে দেওয়া হচ্ছে - যেন রোগ হলেই মৃত্যু এবং সেটা আটকে দেওয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ও সুচিকিৎসা দরকার। আর তাই চিকিৎসার খরচ থেকে বাঁচবার জন্য দরকার করোনা-কবচ বিমা। বেসরকারি হাসপাতালের অর্থগৃধ্নু আস্ফালন, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা আর তার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের দিগভ্রষ্ট প্রচার সব মিলিয়ে ঘনিয়ে তুলেছে একটা গভীর খাদের মুখ - সেই গহ্বরের ভিতর দিয়ে আমরা আলো খুঁজছি করোনা বিমায়। কোটি কোটি উপভোক্তা বিমা কিনছেন, বাজার শাঁসালো হচ্ছে। অথচ কেউ একবার যদি ভাবেন, সত্যিই যদি করোনা অতিমারি হত, যদি তাতে মৃত্যুর হার সীমা ছাড়িয়ে যেত, তাহলে কিন্তু কোনো বিমা সংস্থা নতুন কোনো স্বাস্থ্যবিমার পলিসি বাজারে আনতেন না - সেক্ষেত্রে তো বিমাকারীর ক্লেম দিতে গিয়ে তাঁদের কোম্পানি লাটে উঠে যেত। আমরা এই দিকটা যতদিন না ভেবে দেখি, আপাতত এই লোক ঠকানো কারবার তাই চলছে, হয়তো বা চলবেও। সর্বনাশের এই প্রহরে কারোর কারোর তো পৌষ মাস হবেই!