আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

একুশে জুলাই পরবর্তী রাজনীতি

মইদুল ইসলাম


গত ২১ জুলাই, তৃণমূলের রাজনৈতিক সমাবেশে, করোনা অতিমারির সাবধানতা অবলম্বনের জন্য মানুষের ভিড়, কলকাতা শহর দেখল না। টিভি ও সমাজমাধ্যমে তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য শুনল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক এবং রাজনৈতিক মহল। বাংলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বক্তৃতা বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় সামনে আসে। প্রথমত বিজেপি-কংগ্রেস-সিপি(আই)এমের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তাঁর দল লড়ছে এবং তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার যতদিন থাকবে ততদিন বিনামূল্যে রেশন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা পাবে রাজ্যের মানুষ এবং ‘আত্মসম্মান নিয়ে বাংলা বাঁচবে’। কারণ রাজ্যের আয় তিনি গরিবের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে বিলিয়ে দেবেন। দেখবেন অসহায়, অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষের স্বার্থ। দ্বিতীয়ত, রাজ্যের উন্নয়ন থেমে নেই কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা ও অসম্মান-এর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বাংলার মানুষকে মাথা উঁচু করে বলতে হবে ‘কেন্দ্রীয় সরকার তথা দিল্লী জেনে রেখ বহিরাগতরা বাংলা চালাবে না। বাংলা বাংলার লোকেরা চালাবে।’ তৃতীয়ত বিরোধী শিবিরে কিছু মানুষের রাজনৈতিক জন্ম এমন একটি ঘরানায় হয়েছে যা বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। এই কথাগুলো নতুন কিছু নয়। এহেন কথা বামফ্রন্ট জমানায় জ্যোতি বসু প্রায়ই বলতেন। গরিব মানুষের স্বার্থের কথা, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা এবং একটি বাঙালি রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা মূলত উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও বর্বরতার রাজনীতি থেকে আলাদা।

মমতা ব্যানার্জি তাঁর ইংরেজি আত্মজীবনীর এক জায়গায় ২১ জুলাই ১৯৯৩ সালের ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তার বঙ্গানুবাদ করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায় - “আমার আঘাত কেবল গুণ্ডাদের দ্বারা হয়নি যারা আসলে পশ্চিমবাংলার শাসক দলের পার্টি ক্যাডার ছিল। আমার সহকর্মী এবং আমি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছিলাম। আমার এখনও মনে আছে ২১শে জুলাই ১৯৯৩ সালে আমাদের যুব আন্দোলনের উপরে পুলিশের বর্বর আক্রমণ। তেরো জন মানুষ মারা যান। অন্তত এক হাজার মানুষ আহত হয় এবং আমাদের সকলকে পুলিশের হাতে বেশ মার খেতে হয়। সবথেকে বেশি আঘাত আমার তলপেট ও কোমরে লাগে। আঘাত এতই তীব্র ছিল যে আমাকে অস্ত্রোপচার করতে হয় এবং ১৯৯৪-৯৫ সাল পর্যন্ত একটি শল্য-চিকিৎসার বেল্ট পরতে হয়” (মাই আনফরগেটেবেল মেমরিজ, রলি বুকস, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪২)।

একুশে জুলাই নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর অন্যরকম ভাষ্য আছে। “(২১ জুলাই, ১৯৯৩) যুব কংগ্রেসিরা ‘মহাকরণ অবরোধের’ ডাক দেয়। ওদের দাবি ছিল, পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে। মানে ঐ হামলাবাজি আর কী! নির্বাচনে জনসমর্থন না পেয়ে গুণ্ডামি করে গায়ের জোরে সরকারকে গদিচ্যুত করা! এ কোনো সভ্য পদ্ধতিই নয়। অপরাধমূলক কর্মসূচি। কিন্তু ওরা তাই করল। শুধু করল নয়, ঐ দিন চৌরঙ্গি চত্বর ও কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ইঁট, পাটকেল, লাঠি, রিভলবার, তলোয়ার, বোমা ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যুব কংগ্রেসিরা হামলা চালায়। কেন্দ্রীয় সরকারকে আমরা জানিয়েছিলাম, কীভাবে কংগ্রেসি নেতারা ঐ দিন দলীয় কর্মীদের উসকানি দিয়েছিলেন পুলিশ-কর্মীদের আক্রমণ করতে। অসংখ্য গাড়িতে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। ভাঙচুর করে। পাঁচজন পুলিশকর্মী ওদের আক্রমণে জখম হয়েছিল বলে আমাকে জানানো হয়েছিল। ফলে বাধ্য হয়েই পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছিল। কয়েকজন তাতে প্রাণ হারান। এ জন্য কংগ্রেসই পুরোপুরি দায়ী। সে কারণে আমি বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবদার মেনে নিইনি। ওদেরই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও হিংসাশ্রয়ী আচরণের চূড়ান্ত পরিণতিতে তরতাজা কতগুলি প্রাণ নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু তাতেও ওদের শুভবুদ্ধি জাগেনি। বনধ ডেকে আবার অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি” (যত দূর মনে পড়েঃ রাজনৈতিক আত্মকথন, ১৯৯৮, এনবিএ, পৃষ্ঠা ৪৯৫)। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তৃণমূল কংগ্রেস বাংলায় এক নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর দুই বছরের মাথায় জ্যোতিবাবু বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলার রাজনৈতিক মহল থেকে বাংলার রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাত্রেই জানেন যে ২১ জুলাই ১৯৯৩ সালে রাজ্যের মুখ্যসচিব পরে তৃণমূলের মন্ত্রী-সাংসদ হন।

২১শে জুলাই নিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর যেমন একটি লিখিত বিবরণ আছে তেমন সেই সময় বিরোধী দলের নেত্রী তথা বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর একটি পালটা ভাষ্য আছে। রাজনৈতিক দিক থেকে ঘটনাটি পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে সংসদীয় গণতন্ত্রে, ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছাবার রাস্তা মানুষের জনপ্রিয় সমর্থন ছাড়া হয় না। তাই ঐ ঘটনার মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১৯৯৬ সালের লোকসভা ও বিধানসভা ভোট একসঙ্গে হয়। বিধানসভায় বামফ্রন্ট ২৯৪ এর মধ্যে ২০২ আসন পায়। ভোট পায় ৪৮.৫৯%। লোকসভায়, রাজ্যে ৪২ আসনের মধ্যে ৩৩ আসন পায়। গোটা দেশে বামফ্রন্ট ৫২ আসন পায়। জ্যোতি বসু-কে প্রধানমন্ত্রী করার সুযোগ আসে যার সদ্‌ব্যবহার না করার জন্য, জ্যোতিবাবু পার্টির সিদ্ধান্তকে আমৃত্যু ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলতে দ্বিধা করেননি।

এই রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে একটি দ্বিদলীয় প্রতিযোগিতা হলে কেন্দ্রীয় সরকার গড়তে পারবে এমন একটি দল বা জোট অতীতে বহুবার ভাল ফল করেছে। রাজ্যস্তরে তেমন পাকাপোক্ত সংগঠন না থাকলেও সর্বভারতীয় কোনো দল বা জোট একটি লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল করে তেমন নজিরও আছে। যেমন ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট সরকার মাত্র সাত বছর অতিক্রম করে। কংগ্রেস দলটির ১৯৮২ সালের বিধানসভার সময় থেকে সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দলটি ১৬টি লোকসভা আসন জেতে এবং ৪৮.১৬% ভোট পায়। ৪৮.৪৩% ভোট পেয়ে বামফ্রন্ট পায় ২৬ আসন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনটি মোটামুটি ১৯৮৪ সালের সঙ্গে তুলনা করা যায় যেখানে এই রাজ্যে মূলত একটি দ্বিদলীয় নির্বাচন হয়। ১৯৮৪ সালের মতো কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল পূর্বতন লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় অধিক ভোট এবং আসন সংখ্যা নিয়ে পুনরায় জয়ী হয়। রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল পায় ২২ আসন, সরকারে আট বছর থাকার পর। ভোট পায় ৪৩.৬৯% এবং কেন্দ্রীয় শাসক দল পায় ৪০.৬৪% ভোট ও ১৮ আসন।

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস আর বামফ্রন্টের মধ্যে আসন ভিত্তিক বোঝাপড়া হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস পরাজিত হয় কিন্তু বিধানসভায় একটি বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি প্রধান বিরোধী হয় ২০১৪ সালের লোকসভা পরবর্তী সময়ে বিজেপির বাড়বাড়ন্তের পরেও। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কোনো জোট হল না। তৃণমূল বিরোধী বহু ভোটার বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস ত্যাগ করে বিজেপির দিকে চলে গেল। তৃণমূলের ভোট ২০১৪ সালের লোকসভার তুলনায় ৩.৯০% বাড়ল যদিও ২০১৬ বিধানসভার নিরিখে মাত্র ১.২১% কমেছিল। ২০১৪ সালের নিরিখে তৃণমূলের আসন ১২টি কমে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল তাদের আশাব্যাঞ্জক ফল না করার একটি কারণ হল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধী শূন্য করার মানসিকতা নিয়ে শাসক দলের তৃণমূল স্তরের কর্মীদের তাণ্ডব এবং বহু ক্ষেত্রে ব্যাপক রিগিং। তার সঙ্গে শাসক দলের নীচের তলার কর্মীদের তোলাবাজি ও দুর্নীতি আরেকটি বড় কারণ হয়। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোট না করার ফলে কার্যত একটি দ্বিদলীয় নির্বাচনী লড়াই হয় যেখানে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের বহু সমর্থক ও ভোটার মনে করেছিল যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণতান্ত্রিক অধিকার কাড়ার জন্য ও স্থানীয়স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে এবং সেক্ষেত্রে বিজেপি ছাড়া আর অন্য কোনো বিকল্প নেই।

বাংলার বিধানসভায় এখনও বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস মিলে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তি আছে যারা রাজনৈতিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে কখনও বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনী জোট করেনি। তৃণমূলের ক্ষেত্রে তা বলা যাবে না কারণ দলটির রাজনৈতিক ময়দানে অভিষেক হয়েছিল বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাতের মধ্য দিয়ে ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। পরবর্তী কালে ২০০৪ লোকসভা ও ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপি জোট রাজ্যের মানুষ দেখেছিল। ২১ জুলাই পার হয়ে যেতে না যেতেই রাজ্যে কংগ্রেস দলের সভাপতি তথা তৃণমূলের প্রাক্তন লোকসভা সাংসদ, সোমেন মিত্র প্রয়াত হন। অন্যদিকে সিপি(আই)এম-এর ট্রেড ইউনিয়ন নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর প্রয়াণ ঘটে। অভিজ্ঞ নেতাদের মৃত্যু হলে সেই শূন্যতা ভরাট হয়ত অন্য কেউ করবেন। কিন্তু ২১ জুলাই, মুখ্যমন্ত্রী যে বক্তব্য রেখেছিলেন, সেই কথা প্রনিধানযোগ্য। আগামী দিনে বাংলার রাজনীতি তাকিয়ে থাকবে বাংলার শাসক ও বিরোধী রাজনীতির ইস্যু কি হবে সেই দিকে।

ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক জনবিরোধী নীতি প্রণয়ন করে চলেছে। যেমন রেল ও বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি ক্ষেত্রকে বিকিয়ে দেবার ব্যবস্থা। এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করার তোড়জোড়। সম্প্রতি অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী বলেছেন যে, বিমান চালনার দায় সরকার নিতে পারে না। প্রতিরক্ষা খাতে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশী বিনিয়োগের ব্যবস্থা আর এদিকে স্বনির্ভর ভারত গড়ার বুলি শোনাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী! কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের প্রাক অবসর ব্যবস্থার মাধ্যমে আসলে ছাঁটাই করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি অধ্যাদেশ চালু করা হয়েছে যেখানে ছোট ও মাঝারি কৃষকের স্বার্থের তুলনায় কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ বেশি দেখা হয়েছে। করোনা অতিমারি চলাকালীন যখন মানুষ আর্থিক ক্ষতি ও বেকারত্বের সমস্যায় জর্জরিত তখন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে আরও বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করল না কেন্দ্রীয় সরকার। একের পর এক স্বৈরতান্ত্রিক আইন এবং জরুরি বিধির মাধ্যমে মোদী জমানা নবউদারবাদী সংস্কারের নামে সরকারী ব্যয় কমিয়ে আনছে যখন বিভিন্ন খাতে সরকারী ব্যয় এবং কর্মসংস্থান জনিত সুরক্ষা বাড়ানো প্রয়োজন। একুশে জুলাই নিয়ে রাজনীতি না হয় আবার পরের বছর হবে। কিন্তু তার আগে এই জরুরি আর্থিক ইস্যুগুলো নিয়ে বাংলায় রাজনীতির ক্ষেত্রকে আন্দোলিত করতে বৃহত্তর প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক পরিসর কি তৈরি?