আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

কমিউনিটি কিচেন থেকে রেড ভল্যান্টিয়ার্সঃ একটি সোভিয়েত উত্তরাধিকার

অর্ক রাজপন্ডিত


লকডাউন পর্বে কারা সাধ্যমত পাড়ায় পাড়ায় বিলি করলো চাল তেল নুন ডাল আলুর প্যাকেট? কারা চাঁদা তুলে পাড়ায় মহল্লায় খুলে ফেললো কমিউনিটি কিচেন? কারা পাড়ার রাস্তার মোড়ে নামলো স্যানিটাইজাশেনের কাজে? কারা ফেরি করলো বিনামূল্যে সবজি, ওষুধ? কারা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে স্থায়ী সস্তার জনতার ক্যান্টিন?

কমিউনিস্টরা।

লকডাউন থেকে আমফান। লকডাউন পেরিয়ে আনলক পর্বেও। ধারাবাহিক ভাবে। অবিশ্রাম। কমিউনিস্ট কর্মীরাই ধারাবাহিকভাবে থেকেছেন মানুষের পাশে, বলা ভালো সবচেয়ে গরিব মানুষটির পাশে।

মার্চ মাসের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে এখনও। যাদবপুরের জ্যোতি দেবী শ্রমজীবী ক্যান্টিন পেরিয়ে এসেছে দেড়শোটি দিন। যাদবপুর থেকে বেলঘড়িয়া, বেলঘড়িয়া থেকে বাঁকুড়ার সোনামুখী। একের পর এক স্থায়ী শ্রমজীবী ক্যান্টিন, জনতার ক্যান্টিন চলছে। স্থায়ী ক্যান্টিনগুলি ছাড়াও লকডাউন পর্বে গোটা রাজ্য জুড়ে চলেছে হাজারো কমিউনিটি কিচেন, দিনের পর দিন গরিব মানুষকে খাবার জুগিয়েছে কমিউনিস্ট কর্মীদের চাঁদা তুলে চালানো এই কিচেনগুলি। রাজ্য জুড়ে চলেছে বিনামূল্যে সবজি বাজার, চলেছে বাড়িতে বাড়িতে বিনামূল্যে রেশন বিলি। কারা করলো এই বিপুল কর্মযজ্ঞ?

কমিউনিস্টরা।

মৌলিক প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, একাজ শুধু কমিউনিস্টরা কেন অনেক সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানও করে। ভারত সেবাশ্রম সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন বা নানান রঙের এনজিও’দের সঙ্গে কমিউনিস্টদের একাজে ফারাক কোথায়? মিশনারি কাজের সঙ্গে কমিউনিস্টদের ফারাক কোথায়?

প্রশ্ন উঠতে পারে, মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিগত ৬ মাস ধরে অক্লান্তভাবে সঙ্কটের সময় মানুষের পাশে থাকার, যৌথ রান্নাঘর চালানোর রসদ কমিউনিস্টরা পেল কোথায়? প্রশ্ন উঠতে পারে রাজ্য জুড়ে চলা এই বিপুল কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকরা এত অফুরান জীবনীশক্তিই বা পেল কোথায়?

আজকের এই কমিউনিস্টদের কমিউনিটি কিচেন, স্থায়ী শ্রমজীবী ক্যান্টিন বা আজকের এই তরতাজা কমবয়সী কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ‘রেড ভল্যান্টিয়ার্স’ কি আকাশ থেকে পড়লো? আজকের কমিউনিস্টদের পরিচালিত কমিনউনিটি কিচেন, সস্তার অথচ পুষ্টিকর খাবারের স্থায়ী শ্রমজীবী ক্যান্টিনগুলি বা স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়োজিত আজকের ‘রেড ভল্যান্টিয়ার্স’ একটি লেনিনীয় ও সোভিয়েত ভাবনার ফসল।

বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রথম কমিউনিটি কিচেনের ধারণা গড়ে ওঠে নারীমুক্তির প্রশ্নটিকে সামনে রেখে। কমিউনিস্ট সমাজে মহিলাদের গৃহস্থালীর জন্য মজুরি না পাওয়া শ্রম, বিনা মজুরিতে গৃহস্থালীর জন্য রান্না থেকে ঘর মোছা কীভাবে দেখবে সমাজতন্ত্র? বিনা মজুরিতে মহিলাদের গৃহস্থালীর শ্রম ব্যবস্থা আদপে একটি পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যা নারীমুক্তির পথে বাধা। আলেকজান্দ্রা কোলনতাই ‘কমিউনিজম অ্যান্ড ফ্যামিলি’ বইটিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি হাজির করেন। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে মহিলা শ্রমজীবী ও কৃষিজীবীদের প্রথম জাতীয় সম্মেলনে কোলনতাই সওয়াল করেন গৃহস্থালীর বিনা মজুরির দাসত্ব থেকে মহিলাদের মুক্তি দিতে হলে প্রয়োজন বিস্তৃত সামাজিক ক্যান্টিন, কেন্দ্রীয় যৌথ রান্নাঘর। সোভিয়েত রাশিয়ায় গড়ে ওঠা কমিউনিটি কিচেনগুলির উৎস ছিল গৃহস্থালীর শ্রম দাসত্ব থেকে মহিলাদের মুক্তি দেওয়া। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত গ্রেগরি শেগালের তৈরি বিখ্যাত সোভিয়েত পোস্টার ‘ডাউন উইথ কিচেন শ্লেভারি’তে মূর্ত হয়ে উঠেছে গেরস্থালির হেঁশেল ছেড়ে মহিলাদের ক্ষমতায়ন।

সরকারি উদ্যোগেই গড়ে উঠতে শুরু করে সরকার পরিচালিত সস্তার যৌথ রান্নাঘর, রুশ ভাষায় যার নাম ‘স্তোলোভায়া’। ‘ফুড ইজ ফুয়েল’, যেমন বলেছিলেন লেনিন। সোভিয়েত কমিউনিটি কিচেনগুলিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল সুষম পুষ্টির ক্ষেত্রে, কোনো কমিউনিটি কিচেনই পুষ্টির সঙ্গে আপোষ করেনি।

কোলনতাইয়ের প্রশ্নগুলির উত্তর লেনিন হাজির করেছিলেন ১৯১৯ সালে প্রকাশিত পুস্তিকা ‘এ গ্রেট বিগিনিং’এ, । রান্নাঘর ও গৃহস্থালীর বিনা মজুরির শ্রম থেকে মহিলাদের মুক্তির অন্যতম শর্ত হল ‘যৌথ রান্নাঘর, ‘নার্সারি’, ‘কিন্ডারগার্টেন’ গড়ে তোলা, লেনিনের মতে এই সবগুলিই হল ‘শুটস অফ কমিউনিজম’, সাম্যবাদের প্রবাহগুলির প্রয়োগ।

রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালিন সময়েই ‘পিপলস কমিশারিয়েট ফর ফুড সাপ্লাইজ’র উদ্যোগে গড়ে উঠতে থাকে এই যৌথ সামাজিক রান্নাঘরগুলি। লেনিনের মত ছিল অপুষ্টির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়ে উঠতে হবে এই স্তোলোভায়া বা যৌথ রান্নাঘরগুলিকে। একলা একক রান্নাঘরের থেকে বেশি কার্যকরি পরিষ্কার ঝকঝকে যৌথ রান্নাঘর, পুষ্টিকর খাবার রান্না এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বন্টন। লেনিন মনে করতেন, কমিউনিটি কিচেন শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে কমিউনিস্ট চেতনা গড়ে তোলবার, কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণেরও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খাবারের পুষ্টি নিয়ে সোভিয়েতে সচেতনতা এমনই ছিল বিপ্লবের তিন বছর বাদেই ১৯২০ সালে গড়ে উঠেছিল ‘ইন্সটিটিউট অফ সাইকোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশন’।

‘পিপলস কমিশাররিয়েট ফর ফুড সাপ্লাইজ’র জোরালো মত ছিল, কমিউনিটি কিচেনে যেভাবে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, পুষ্টি মাথায় রেখে রান্না তৈরি হতে পারে তা কখনো একক ব্যক্তিগত রান্নাঘরে তৈরি হতে পারে না। ‘ডাউন উইথ প্রাইভেট কিচেন’ নামের ছোট্ট পুস্তিকায় কোলনতাই সওয়াল করেন, ‘প্রতি পরিবারের সদস্যরা তাঁরা শুধু নিজেরাই রান্না করে খাবার খান সেখানে বিজ্ঞানসম্মত রান্না ও পুষ্টি প্রশ্নের বাইরে। একজন মহিলা যখন পরিবারের জন্য রান্না করছেন তিনি তো সেই আরেকজন মহিলার থেকেই রান্না শিখছেন যাঁর কোনো বিজ্ঞানসম্মত রান্নায় ডিপ্লোমা নেই’।

রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় থেকেই শহর থেকে শহরে বাড়তে থাকে কমিউনিটি কিচেনগুলি। ১৯১৮’র অক্টোবরে মস্কো শহরে কমিউনিটি কিচেনের সংখ্যা ছিল যেখানে ৮৮১টি, ১৯১৯ সালের জুন মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৫০’এ। পেট্রোগাড শহরে একই সময়কালে ২০০টি থেকে কমিউনিটি কিচেনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪০টি।

আজকের রাশিয়াতেও সোভিয়েত ঐতিহ্য হিসাবে আধুনিক রেস্টুরেন্ট বা কাফেটারিয়ার বেশে হলেও ফিরে আসছে ‘স্তোলোভায়া’রা, সাবেক সোভিয়েত রান্নার স্বাদ নিতে ভিড় জমান পর্যটকরা।

বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ায় ‘কমিউস্ট সমাজ সৃজনের জন্যই গড়ে উঠেছিল কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, রুশ ভাষায় ‘কমিউনিস্ট সাবটনিকস’। রুশ ‘সাবটনিক’ শব্দের অর্থ ভল্যান্টিয়ার, বাংলায় স্বেচ্ছাসেবক।

‘কমিউনিস্ট সাবটনিকস’রা , কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নতুন সোভিয়েত সমাজ গড়ে ওঠার জন্য কেমন কার্যকারী ছিল লেনিন লিখেছেন ‘এ নিউ বিগিনিং’ পুস্তিকায়। সমাজতন্ত্রের জন্য অক্লান্ত জীবনীশক্তির অধিকারী এই কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকরা নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ছিলেন প্রধান কারিগর। প্রতি শনিবার ৬ ঘন্টার স্বেচ্ছাশ্রম দিতেন ‘কমিউনিস্ট সাবটনিক’রা, নতুন জন্ম নেওয়া সমাজতন্ত্রকে রক্ষার জন্য। লেনিন লিখেছেন, ‘কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকদের অক্লান্ত স্বেচ্ছাশ্রম আমাদের নিজেদের রক্ষণশীলতা থেকে জয়, আমাদের বিশৃঙ্খলতা থেকে জয়, পেটি বুর্জোয়া ইগোইজম থেকে জয়’।

বিপ্লবী যাপন, কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণের উৎসাহ কীভাবে একজন অদক্ষ শ্রমিকের মধ্যেও শ্রমে বিপুল উৎপাদনশীলতার জন্ম দিতে পারে তা হাতে কলমে করে দেখিয়েছিলেন ‘কমিউনিস্ট সাবটনিক’রা। ‘এ নিউ বিগিনিং’ পুস্তিকাতে লেনিন তুলে ধরেছেন প্রাভদা পত্রিকায় লেখা একাধিক রিপোর্টাজ। ১৯১৯ সালের ১৭ মে প্রকাশিত প্রাভদা পত্রিকায় উঠে এসেছে মস্কো কাজান রেলপথ নির্মাণে কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকদের নিরলস স্বেচ্ছাশ্রমের বিবরণ।

মস্কো কাজান রেলপথ নির্মাণে বাধা ছিল কম সংখ্যায় শ্রমিক, কম উৎপাদনশীলতা, লোকোমোটিভ সারাই নিয়মিত না হওয়া। কমিউনিস্ট কর্মীরা এবং সমর্থকরা ৭মে নিজেরা সভা করে ঠিক করেন তাঁরা প্রতিদিন এক ঘন্টা অতিরিক্তি শ্রম বিনা মজুরিতে করবেন, এবং সপ্তাহের ৬ ঘন্টা অতিরিক্ত স্বেচ্ছাশ্রম তাঁরা দেবেন শনিবার। ১০ মে শনিবার সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে কমিউনিস্ট সেচ্ছাসেবকরা শুরু করলেন তাঁদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া ৬ ঘন্টার স্বেচ্ছাশ্রম। প্রাভদা পত্রিকা লিখেছে, ‘কমিউনিস্টদের স্বেচ্ছাশ্রমের ৬ ঘন্টায় ওয়াগন লোডিং’র কাজের উৎপাদনশীলতা সাধারণ মজুরদের উৎপাদনশীলতার থেকে ছিল ২৭০ গুণ বেশি। সেদিনের মত কাজ যখন শেষ হল কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকরা ফেটে পড়লো আনন্দে, একসাথে সবাই মিলে গাইলো কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’।

পরের প্রতিটি শনিবার সোভিয়েতে যুক্ত হল ‘কমিউনিস্ট শনিবার’ হিসাবে, কমিউনিস্টদের নতুন সমাজ গঠনের জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের দিন। মস্কো কাজান রেলপথ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে নতুন উৎসাহে প্রতিদিন যুক্ত হতে শুরু করলেন পার্টির বাইরে থাকা সমর্থক দরদীরাও। আলেক্সানদ্রোভস্কায়া রেল লাইনে কমিউনিস্ট স্বেছাসেবকরা প্রথম কাজ শুরু করলেন ১৭ মে, তাঁরা নিজেরা সভা করে ঠিক করলেন ৯৮ জন স্বেচ্ছাসেবক অতিরিক্ত ৫ ঘন্টার শ্রম দেবেন বিনা মজুরিতে শুধু মাত্র রাতে দ্বিতীয়বার খাওয়ার জন্য তাঁরা পাবেন হাফ পাউন্ড রুটি। শুধু মস্কো নয় গোটা রাশিয়া জুড়েই ছড়িয়ে পড়তে লাগলো ‘কমিউনিস্ট সেচ্ছাসেবক’দের কাজ সমাজতন্ত্রকে রক্ষার জন্য, লেনিনের লেখা ‘কমিউনিস্ট কনস্ট্রাকশন’-এর কাজ।

লেনিন ‘এ নিউ বিগিনিং’-এ লিখেছেন, ‘সর্বহারার একনায়কত্ব মানে শুধু শোষকের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ নয়, সর্বহারা প্রতিনিধিত্ব করে এবং জন্ম দেয় শ্রমের উচ্চতর সামাজিক সংগঠনের, এটি প্রয়োজনীয় একারণেই এটি হল সেই শক্তির উৎস যা নিশ্চিত করে কমিউনজমের চূড়ান্ত বিজয় অবশ্যসম্ভাবী’।

সোভিয়েত স্বেচ্ছাসেবকরা ছিলেন সেই অক্লান্ত জীবনীশক্তির বাহিনী যা নতুন সমাজ গঠনে, ‘কমিউনিস্ট কনস্ট্রাকশন’-এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

আজকের সঙ্কটকালে কমিউনিস্টদের কমিউনিটি কিচেন, আজকের ‘রেড ভল্যান্টিয়ার্স’দের অক্লান্ত স্বেচ্ছাশ্রমে তাই কোনো মিশনারি আত্মতুষ্টি নেই, সমাজসেবার বিমূর্ত ধারণা নেই, যা আছে তা হল ‘কমিউনিস্ট কনস্ট্রাকশন’র স্বপ্নবুনন। সোভিয়েত উত্তরাধিকার।

যাদবপুরে জ্যোতিদেবী শ্রমজীবী ক্যান্টিনের খিচুরি আলুভাজা বা ছুটির দিনের বাসন্তী পোলাও মুরগির মাংসের প্যাকেট কুড়ি টাকার বিনিময়ে গরিব প্রান্তিক মানুষের হাতে তুলে দেওয়া চলতি অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার বিপ্রতীপে সাম্যের সমাজ নির্মাণের স্নপ্নকে আরও আঁকড়ে ধরা, আরও যত্নে অনুশীলনে সেই স্বপ্নকে পরিচর্যা করা।

যাদবপুরের স্থায়ী ক্যান্টিন বা বাঁকুড়ার লালমাটির রান্নাঘর শুধু মাত্র কয়েকজন মানুষকে স্থায়ী কাজ দিচ্ছে না, শুধু মাত্র রোজ দুপুরে কুড়ি টাকায় পুষ্টিকর খাবার তুলে দিচ্ছে না, প্রতিদিন জন্ম দিচ্ছে অক্লান্ত জীবনীশক্তির কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকদেরও।

লকডাউন পর্বের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত রাজ্য জুড়ে চলা হাজারো কমিউনিটি কিচেন, বিনামূল্যের সবজি বাজার, বাড়িতে বাড়িতে রেশন বিলিতে, পাড়ায় মহল্লায় স্যানিটাইজেশনের কাজে কেবল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাই যুক্ত থাকেননি, প্রতিদিনের এই কাজে যুক্ত হয়েছেন উদ্যমী পরিশ্রমী নতুন প্রজন্মের তরতাজা ছেলেমেয়েরা, তাঁদেরকে কমিউনিস্ট হিসাবে গড়ে তোলার দায় থেকে যায় কমিউনিস্ট পার্টির, সংগঠকদের। ‘এ নিউ বিগিনিং’এ লেনিন লিখেছেন, ‘এই নতুন শুরু হওয়া, এই কমিউনিস্ট সাবটনিকদের ব্যবহার করতে হবে পার্টি গঠনে। পার্টিতে সদস্যভুক্ত করতে হবে ছ’মাসের ট্রায়াল বা প্রোবেশন পর্বের বিপ্লবী কাজের ধারার ভিত্তিতে’।

করোনা সঙ্কটকালে রাজ্য জুড়ে চলা কমিউনিস্ট কর্মীদের কাজ, একের পর এক কমিউনিটি কিচেন, স্থায়ী ক্যান্টিন, স্যানিটাইজেশনের কাজ কতটা উঠে আসছে সাধারণ মানুষের আলোচনায়? লকডাউন পর্বে কমিউনিস্টদের কাজ কতটা নিয়ে যাওয়া গেল সাধারণ মানুষের মধ্যে? প্রতিটি কমিউনিস্ট কর্মী কি গর্বিত হন একাজে? তাঁরা কি গর্ব ভরে নিজের পাড়ার নিজের বাড়ির পাশের মানুষটিকে জানাতে পেরেছেন তাঁদের কাজের কথা? বামপন্থী পত্রপত্রিকায় কি ব্যাপকভাবে সেই জানানোর কাজটি করা হচ্ছে? সেই জানানোর কাজটি জরুরি।

লেনিন লিখেছেন, ‘বুর্জোয়াদের দিকে তাকাও। তারা কেমন ভালোভাবে জানে যে তাদের প্রয়োজনের জন্য কেমনভাবে বিজ্ঞাপন করতে হয়! তাদের সংবাদপত্রের লক্ষ লক্ষ কপি কীভাবে পুঁজিবাদীদের মডেল এন্টারপ্রাইসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে, কেমন ভাবে মডেল বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানকে নির্মাণ করা হয় জাতীয় গৌরবের হিসাবে‌! আমাদের কাগজ সেই পরিশ্রম করে ওঠে না শ্রেষ্ঠ কমিউনিটি কিচেনটির বা নার্সারিটির প্রতিদিনের বিবরণ দিয়ে মডেলে পরিণত করতে। আমাদের কাগজ এই ধরণের কাজগুলিকে তেমন পাবলিসিটি দেয় না, বিস্তারিতভাবে বিবরণ দেয় না শ্রমশক্তি সঞ্চয়ের, ক্রেতার সুবিধার, কম খরচের উৎপাদনের, গৃহস্থালীর দাসত্ব থেকে মহিলাদের মুক্তির, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উন্নতির বিষয়ে যা সফল হয়ে উঠতে পারে কমিউনিস্টদের কাজে এবং যা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে পুরো সমাজে, সব শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে’।

লেনিনই শিখিয়ে গেছেন। কমিউনিস্টদের কাজের কথা, সফলতার ঠাসবুনোট খুঁটিনাটি প্রতিটি বিবরণ তুলে ধরতে হবে, বলতে হবে, লিখতে হবে ছড়িয়ে দিতে হবে।

কমিউনিস্টদের বিকল্পের অনুশীলন, আজকের কমিউনিস্টদের ‘কমিউনিটি কিচেন’, আজকের কমিউনিস্টদের স্থায়ী ক্যান্টিন যে একটা ‘মডেল’ তা বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে প্রতিষ্ঠিত করার দায় তাই কমিউনিস্টদেরই।