আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

বীরেন্দ্র ২০২০

পল্লববরন পাল


‘আরেক রকম’।
অর্থাৎ, যে রকমে অভ্যস্ত আমরা, সেই রকম নয় - অন্য রকম - অন্যরকম মানুষ - কিম্বা একটা কোনো ঘটনা বা মানুষকে অন্য চোখে দেখা - এই অন্য চোখ কী? মানে রঙিন চশমা পরে দেখাকে নিশ্চয়ই অন্য চোখে দেখা বলে না - ওটা দেখার বাণিজ্যকরণ - দেখার বিশ্বায়িত চরিত্র - যেখানে মূল্য মানে শুধুই অর্থমূল্য, মূল্যবোধ নয় - ও সব বোধ-টোধ বিবেক-টিবেকও প্রয়োজনে অর্থমূল্যে কেনা বেচা যাবে - এমন একটা ‘ঘুষিল’-সুশীল সময়, এমন একটা ‘মূল্য’বান পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শতবার্ষিকী চর্চা - দেশদ্রোহীতা বা হার্মাদীয় লক্ষণের কেস্‌ খাবো না তো?

‘...এভাবে মানুষ নিয়ে খেলা...
গান নিয়ে ছবি নিয়ে, নুন আর রুটি নিয়ে
দেশের আকাশ জল মাটি আলো অন্ধকার নিয়ে
এই খেলা, এই ভয়ংকর খেলা

এর চেয়ে আর কী নরক, স্বাধীন স্বদেশে!’
[প্রতিবাদ, ১৯৬৩]

আজকের বিশ্বায়িত যাপন-দর্শনে যখন ‘যদি ভাবো কিনছো আমায় ভুল ভেবেছো’ বা ‘আমাকে না আমার আপোশ কিনছো তুমি’ বলার পরেও দেখি আস্ত মানুষটা তার বিজ্ঞাপিত আদর্শ সহ অন্যদের থেকে চড়া দামে বেমালুম বিক্রি হয়ে যান এবং বুক চিতিয়ে হাসিমুখে রাষ্ট্রবন্দনায় নির্লজ্জ মুখর থাকেন, যখন ‘সততার প্রতীক’ থেকে ‘সত্যমেব জয়তে’ - প্রশাসন থেকে বিচারব্যবস্থার সব উচ্চারণের পিছনেই রাষ্ট্রযন্ত্রের হিংস্র উল্লাস ও আনুগত্যের শর্ত থাকে - বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকা সময়ের এই দ্বিচারী চরিত্রের সঙ্গেই আমাদের ইদানিং শান্তিপূর্ণ সহবাস - মুখোশিত সোচ্চার দাম্পত্য - যে সময় আমাদের শিখিয়েছে, প্রতিবাদী মুখ মানে হয় সে গিলোটিন সম্পর্কে অজ্ঞ গণ্ডমূর্খ নয়তো নিজের পিঠে বর্ধিত বিক্রয়মূল্যের স্টিকার সাঁটাচ্ছে, পাক্কা শয়তান - এর বাইরে কিছু হতেই পারে না।

ঠিক এইসময়ে মহার্ঘ বিদ্রুপের অট্টহাসির মতো স্বগর্বে এসে গেলো কবি বীরেন্দ্রর জন্মশতবার্ষিকী।

হে বর্তমান গোমূত্রপায়ী প্রজন্ম, তোমরা যতই মুখ বেঁকিয়ে সংখ্যাতত্ত্বের অহঙ্কার ছোঁড়ো, যতোই কুধর্ম আর ব্রাহ্মণ্যবাদী ছুরিতে দেশের মানচিত্র আর সংবিধানকে কুচিকুচি কাটো, যতোই চা আর চপ বেচার ছবি দেখিয়ে দেশ বেচার ষড়যন্ত্র-উৎসবে বগল আর থালি বাজাও, প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে উনি লিখেছেন -

‘...ভয়ংকর গর্ব দেব বুকে তোর
ঘরে বাইরে একসঙ্গে মারণযজ্ঞের পুরোহিত
হবি তুই। স্বদেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখবি শত্রু মেরে
আর কাড়বি স্বদেশের ভাত আশ্রিতের গলা টিপে!

এরপর তোর নিন্দা করবে যে, ধিক সে বেল্লিক!’
[মহাদেবের দুয়ার]

বিশ্বায়ন খুব সন্তর্পণে চুপিচুপি শিখিয়ে দিয়েছে - ঈশ্বরের অপর নাম বাণিজ্য, বাণিজ্যেরও অপর নাম ঈশ্বর। এই সার্বিক ঐশ্বরিক বাণিজ্যকরণের যুগে, যখন সমস্ত তথাকথিত মানবিক সম্পর্কের গায়ে কর্পোরেট পণ্যমানের স্টিকার, একান্নবর্তী পরিবার ভাঙতে ভাঙতে যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যিখানে ফেস্‌বুক হোয়াটস্যাপের দেওয়াল আর সন্তানের সঙ্গে মহাদেশ দূরত্ব, রাস্তায় অমুকবাবু হেসে ‘ভালো আছেন?’ জিজ্ঞেস করলেই মাথার মধ্যে এ-প্লাস-বি-হোলস্কোয়ার সমীকরণে ডুব দিয়ে প্রশ্নের পিছনে ‘আসল’ উদ্দেশ্যের গণিত সন্ধান - অথচ চৌষট্টি বছর আগেই উনি লিখলেন -

‘...খণ্ড খণ্ড করে কাটা কুমারীর বিবর্ণ শরীর
ট্রাঙ্কে রেখে জ্ঞাতি তার হাসতে হাসতে ইস্টিশনে নামে
যেন এক আগন্তুক। সেন্টমাখা রুমাল হাতড়িয়ে
পাশের পকেট থেকে, রুমালের স্বেদ মুছে তাকায়
পরিচ্ছন্ন বাথরুমে সৌম্য যুবা; রাত্রির নির্জনে
ফোঁটাফোঁটা রক্ত ঝরে পাইপ বেয়ে অন্ধ নর্দমায়।...

রাত্রির ঈশ্বরদের, যতদূর তাকানো সম্ভব
শুধু ঈর্ষা ষড়যন্ত্র সিফিলিস রক্ত আর পুঁজ,
আণবিক ঠাণ্ডা যুদ্ধ, পাশবিক কথোপকথন!’
[বিংশ শতাব্দি - উত্তরখণ্ড]

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগেই গত হয়েছেন বীরেন্দ্র, ১৯৮৫তে। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর পৃথিবী জুড়ে ঘনীভূত পুঁজিবাদের ভুবনায়ন জীবনের সর্বস্তরে পুঁজির ব্যবসায়িক লগ্নি এবং সেই সূত্রে লাভ-ক্ষতির ব্যালেন্সসিট নিয়মিত আপডেট রাখায় আমাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে। আমাদের যন্তরমন্তর ঘরে ঢুকিয়ে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে - যায় যদি যাক প্রাণ, রাষ্ট্রও আদপে একটা কর্পোরেট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান - মানুষের শিক্ষা স্বাস্থ্য এমনকি সুরক্ষাও রাষ্ট্রের লগ্নি, এবং তার থেকে লভ্যাংশ আদায়ই মূল লক্ষ্য। যেসব লগ্নিতে টাকা দ্বিগুণ তিনগুণ উঠে আসে না, সে লগ্নি বন্ধ। বেচে দাও। কবিরা তো ভবিষ্যতদ্রষ্টা - ১৯৬০এ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন -

‘...তারা এক পয়সায় দেশকে বেচে
কেউ সাধু কেউ ফকির সেজেছে!...

তারা এখনো কেউ খায়নি পাছায়
খ্যাপা ঘোড়ার শক্ত পায়ের লাথি;
তারা নির্ভয়ে তাই দেশ বেচে খায়
ভাবটা যেন জমিদারের নাতি।’
[এক পয়সায় দেশ বেচেছে]

আজ পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা কোভিড অতিমারীর জন্য আবশ্যিক ‘দৈহিক দূরত্ব’কে সামাজিক দূরত্বের তকমা এঁটে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের কৌশলী নির্দেশে সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কন্ঠরুদ্ধ, আর সাধের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আইনে টপাটপ বিরুদ্ধবাদী আরেকরকমদের সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করে জেলবন্দীকরন - কোথাও কোনো প্রতিবাদী স্বর যেন না থাকে - রাষ্ট্রের তীক্ষ্ণ নজর। বীরেন্দ্র আপাদমস্তক রাজনৈতিক কবি, অথচ বাঁধাধরা শ্লোগানের বাইরেও তাঁর কবিতা সংক্ষিপ্ত সংকেতময় এবং অন্তরঙ্গ নিবিড় বিশ্বাসের বিশুদ্ধতায় পরিশীলিত। লিখছেন -

‘...কাল সমস্ত রাত ধরে
একটা ভয়ংকর সাপ আর কয়েকটা মানুষ আমাকে খুন করল;
কেউ বাধা দিল না - কেউ-না - শুধু যে মানুষগুলি
কবরখানায় শুয়েছিল
তারা একে একে আমার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছিল; তারা
ফিসফিস করে কথা বলছিল
বোধহয় যুদ্ধের কথা।...
তারপর সবাই পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছল।
আর সাপটা, তাদের সব কথা যেন গিলছিল, সেও পকেট
থেকে রুমাল বের করল;
তারপর বলল, দশ টাকা দিলে সে রুমালটা বিক্রি করবে;
কেননা এই টাকা জওয়ানদের পাঠানো হবে। তারা সাপটাকে
সভাপতি করল।...’
[সভা ভেঙে গেলে, ১৯৬৪]

যে সমাজ শাসকের পোষমানা সরীসৃপ, সেই সমাজের দর্পণে দর্পিত সাহিত্যেরও দৃষ্টি যে সেই মুনাফার দিকেই থাকবে - স্বাভাবিক। তাই ‘পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়’ ঘোষণার পিছনেও প্রচ্ছন্ন থাকে বাণিজ্যের রাজনীতি। কবিরাও ইদানিং কাব্য ব্যবসায়ী - অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক পদ্য লেখেন সগৌরবে। বীরেন্দ্রের কবিতায় প্রেম প্রকৃতি মানুষ সমাজ - সবকিছু তাঁর সমাজতন্ত্রে অগাধ বিশ্বাস ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় জারিত ও প্রকাশিত। তাই বাণিজ্যিক পত্রিকায় রোদ্দুর-ধর্ষিত ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’ রঙিন ছবিসহ খবর হয়, এমনকি ‘নকশালবাড়ি’র মধ্যেও বাণিজ্যের গুড়ের গন্ধ থাকে, কিন্তু কবি বীরেন্দ্রর শতবর্ষ সেখানে খবর হয় না। জীবদ্দশায় স্বীকৃতিও দেয়নি। অবশ্য জীবিত বীরেন্দ্র সেইসব কর্পোরেট স্বীকৃতির তোয়াক্কাও করেননি। কারণ, ভণ্ডামি নয়, কোনো গোপন আর্থিক স্পন্সরশিপেরও প্রশ্ন ওঠে না, সত্যিসত্যিই বীরেন্দ্র বিশ্বাস করতেন ‘ফুল ফুটুক - তবেই বসন্ত’, সত্যিসত্যিই ফুটপাথের খিদের মধ্যে বীরেন্দ্র তাঁর কবিতার স্পষ্ট উচ্চারণ খুঁজে পেয়েছেন -

‘পেটের আগুন খিদে
হাঁটতে শিখছে।
লাল রক্ত খিদে
পৃথিবী দেখছে।

হাতদুটি তার খিদে
কেবল বলে - “দে”।
পা দুটি তার খিদে
পৃথিবী গিলছে।’
[ফুটপাথের কবিতা - দুই, ১৯৮১]

লিটল ম্যাগাজিনের কবি হিসেবেই বিপুল মানুষের কাছে অসম্ভব স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা। কোনো কর্পোরেট পত্রিকা তাঁর কবিতা কোনোদিন ছাপেনি। অথচ তাঁর অগুনতি কবিতায় সুর সংযোজন করে গান পরিবেশন করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অজিত পাণ্ডে, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পীরা। বাণিজ্যিক প্রকাশনার জগত থেকে শত হস্ত দূরে দাঁড়ানো অভিমানী আহত কবি বীরেন্দ্র এই উপেক্ষার পালটা কার্ড বা ফোল্ডারে অথবা অল্প কয়েক পৃষ্ঠার বই ছাপিয়ে কাঁধের ব্যাগে ঝুলিয়ে বইমেলার ঘাসে অথবা নাগরিক পথে হেঁটে হেঁটে পাঠকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সেতু নির্মাণ করে সম্পর্ক নিবিড়তর ও সহজ করেছেন। কর্পোরেট সাহিত্যকে বরং উনি মুখ ভেঙচে অনুকম্পা দেখিয়ে নিজস্ব সাহসী ভঙ্গিতে তাঁর শাণিত শব্দাস্ত্রের সামনে দাঁড় করিয়েছেন -

‘... এমন ভয় আমি
জীবনে পাইনি;
...না ডাক্তার, সাপ নয়। দিনের আলোয় সাপ আমার
কী করতে পারে;
যাকে দেখলাম, সে একজন কবি। সে কবিতা লেখে, আর
যাতে মাইনে বাড়ে
সেজন্য রোজ ঘুম থেকে উঠেই মস্ত বড়ো একটা বাড়িতে যায়,
সেখানে গিয়ে একজন মানুষের পা টেপে।
সে কবিতা লেখে, আর একজন মানুষের পা টেপে -
ডাক্তার! তখন আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে; আর আমি
তার মুখ প্রথম দেখেছি!

ডাক্তার! আমাকে বাঁচান!...’
[টাইফয়েড]

ঢাকঢাক গুড়গুড় আমাদের সামাজিক চরিত্র। আমরা জানলা-দরজা বন্ধ একলা ঘরে চীৎকার করি, আয়নার বিপরীতে কাল্পনিক অসত্যের উদ্দেশে অনভিধানিক বিশেষণ প্রয়োগে নৈতিক দায়িত্ব পালন করে আত্মশ্লাঘা বোধ করি, কিন্তু বাস্তবে সেই অসত্যের মুখোমুখি হলে বুকের মধ্যে একশো কুকুরের কোরাস ঘেউঘেউ, হৃৎপিণ্ড নেমে আসে হাঁটুতে, জিভ নির্বিকল্প সমাধিগ্রস্ত, মাথার মধ্যে ফিসফিস করে কেউ বলে ওঠে - তুমি নিজে কি ভিন গ্রহের জীব নাকি সত্যযুগ থেকে এখানে সাতদিনের মধুচন্দ্রিমায় এসেছো? আসলে জল থেকে অসহায়কে উদ্ধার করতে গেলে নিজে জলে নামতে হয় - সমসাময়িক কবির উদ্দেশ্যে শিরদাঁড়া সোজা রেখে উনিই লিখতে পারেন -

‘নীরেন! তোমার ন্যাংটো রাজা
পোশাক ছেড়ে পোশাক পড়েছে!
নাকি, তোমার রাজাই বদলেছে?
সেই শিশুটি কোথায় গেল
যেই শিশুটি সেদিন ছিল?
নীরেন, তুমি বলতে পারো,
কোথায় গেল সে?...
পোষাক ছাড়া নীরেন, আমরা,
সবাই যে ন্যাংটো।
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই
রাজার রাজত্বে!
কিন্তু তুমি বুঝবে কি আর;
তোমার যে ভাই, মাইনে বেড়েছে!’
[নীরেন, তোমার ন্যাংটো রাজা]

কৈশোরের জীবনানন্দ প্রভাবে ‘চোখে কি অবসাদ?/ তোমার চোখ চুম্বনে চুম্বনে আমি মুছে নেব’ বলে যেদিন দেখলেন ‘রাত ফুরলে দিন আসে না - শুধু আকাল, শুধু শ্মশান-/ শ্মশান জুড়ে ভুতের নৃত্য’, দেখলেন ‘দুপুরে বাঘ পাড়া কাঁপায়’ - ‘মুখের ভাষা কালিন্দীর জলে ছুঁড়ে দিয়ে’ আচমকা নয়, ধীরে ধীরে বিনির্মিত হলো স্পষ্ট ক্ষুধার্তের অসহায়তা ও ক্রোধ, পীড়নের সপাট প্রতিবাদ - ‘যাকে জানতি সূর্য্যি ঠাকুর/ সে এখন ডাকাতের রাজা। আকাশ খেয়ে, মাটি খেয়ে/ তার খিদে মেটে নি - এবার তোদের খাবে’ - ‘চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও/ লিখে দিতেন, ‘পৃথিবী ঘুরছে না’।/ পৃথিবী তবুও ঘুরছে, ঘুরবেও;/ যতই তাকে চোখ রাঙাও না’ -

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আগাপাশতলা একজন ‘আরেক রকম’ মানুষ, ‘আরেক রকম’ কবি - যেরকম মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি আশৈশব, যেরকম মানুষ হয়ে ওঠার কথা ছিলো আমাদের সকলের, যেরকম মানুষের হাতে সভ্যতার সুন্দর ভবিষ্যত গড়বার অঙ্গীকার থাকবার কথা ছিলো - এই দেখুন, ‘কথা ছিলো’ ‘কথা ছিলো’ বলে আমার কথায় প্রচ্ছন্ন ফুটে উঠছে হতাশা, অথচ অসম্ভব আশাবাদী কবি বীরেন্দ্র লিখছেন -

‘সমস্ত পৃথিবী করো মানুষের একটি জন্মভূমি
মানুষের প্রেমে দীপ্ত, শ্রমে মুখরিত তপস্যায় পরিশুদ্ধ, অমল স্বদেশ;
পৃথিবীর এ-দেশ ও-দেশ, নানা রঙ, নানা ভাষা, নানা জাতি -
সকল কিছুর ঊর্ধ্বে মন্ত্র করো মনুষ্যত্ব, জীবনের একটিই সম্মান।
আমাদের জ্যেষ্ঠ সহোদর যাঁরা, প্রত্যাশা করেন
ঝড়ে জলে অন্ধকারে মানুষ নিজের ধর্মে একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে।’
[জ্যেষ্ঠ সহোদর যাঁরা, ১৯৬৫]

যতোই রাষ্ট্র ঠিক করে দিক মানুষ কী খাবে, কী খাবে না - গোমাংস না গোমূত্র - যতোই বশংবদ সাহিত্য ঠিক করে দিক মানুষ কী পড়বে আর কী পড়বে না - জীবিতাবস্থাতেও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তাকে তারা ঠেকাতে পারেনি। এই করোনা আবহেও তাই তাঁর শতবার্ষিকী পালনে ঘরবন্দী মানুষের তুমুল উৎসাহ। সামাজিক মাধ্যম দেখলেই তাঁর এখনও জনপ্রিয়তার উত্তাপ স্পর্শ করা যায়। ওনারই কবিতাকে স্মরণ করি -

‘...তোমার মুখ মনে পড়ে। চারপাশের স্তাবকের অস্পষ্ট মিছিলে
কেনাবেচা, চিৎকার, অশ্লীল উন্মাদ হাসি সবকিছু ছাপিয়ে আশ্চর্য
একটি উজ্জ্বল মুখ। স্পষ্ট হয় সমুদ্রের অগাধ অতল গভীরতা
নির্ভয় মুক্তির দেশ, হৃদয়ে হৃদয়, চেতনায় নবজন্ম ধ্রুব হয়।’
[ভাইয়ের মুখ, ১৯৫৭]

সর্বার্থেই ব্যতিক্রমী, একজন সত্যিকার ‘আরেক রকম’ মানুষ - কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় - কবি হিসেবে তিনি কতোটা শুদ্ধ বা মহৎ, সমসাময়িক অন্যান্য বিখ্যাত বাঙালী কবিদের সঙ্গে বীরেন্দ্রর তুল্যমূল্য আলোচনা, অথবা বাঙলা কাব্য ইতিহাসে তাঁর অবস্থানের মাননির্ণয় করবেন সাহিত্যের পণ্ডিতেরা। আমি সামান্য কবিতাপ্রেমী - পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বাঙলা কবিতার সঙ্গে আমার সহবাস। আমার মতো অসংখ্য পাঠক সহ বাঙলার লক্ষ লক্ষ পীড়িত মানুষ যারা কবি বীরেন্দ্রর ঘনিষ্ঠ আপনজন, তাদের সবার সঙ্গে আরেক কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতায় মনের কথা বলে উঠি -

‘...আবার আরেকটি দিন শুরু হবে কাল, তার আগে
উদ্যত রাত্রির কাছে মানুষের কিছু দাবি দাওয়া
আর অমীমাংসা আছে, ফুঁসে উঠে আক্ষেপানুরাগে
নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ আর বেঁকে যাওয়া
এবং জড়িয়ে ধরা ভুবনমোহিনী কবিতাকে -

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের বিবেকের মতো...’