আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

যত আদিম মহাদ্রুম

অনিন্দিতা রায় সাহা


শহুরে সবুজায়ন

ছোটবেলায় ইস্কুলের সহায়িকা বইতে থাকতো ‘দিবাবসান’, ‘অরণ্য-প্রকৃতি’ বা এই জাতীয় কোনো আরণ্যক পাঠ্যাংশ। কখনো এক টুকরো পালামৌ। একটু বড়ো হয়ে পরিচয় লবটুলিয়া বইহার আর ফুলকিয়া বইহারের বিস্তীর্ণ বনভূমির সঙ্গে। আরো পরে জেনেছি মানুষের মনে কী মায়াময় মোহের সৃষ্টি করে অরণ্যের দিনরাত্রি। মোটামুটি এইটুকুই আমাদের অরণ্যের সঙ্গে শহুরে সখ্য। ফুটপাথে কোনো চেনা গাছের ছায়া, বাড়ির ছাদে কয়েকটা ফুলগাছের টব, মধ্যবিত্তের ছোট্ট আবাসনের বারান্দায় উঁকি দেওয়া কটি পাতাবাহার। বাকিটুকু পরিচয় গানে, কবিতায়, ছবির রঙে।

এ হেন একটি নাগরিক জীবনে আরণ্যক ভাবনাচিন্তার দরকার হয়ে পড়েছে পরিবেশের স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদে। নানা রকম আলোচনা চলছে শহরে গাছ বঁচিয়ে রাখা, নতুন গাছ লাগানো, আর গাছগাছালির আদমশুমারি নিয়ে। কলকাতা শহরে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে নষ্ট হয়েছে কয়েক সহস্র বড়ো গাছ। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের বেহিসাবী ক্ষতির হিসাবের চেষ্টা চলছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন প্রকার নির্মাণকার্য উপলক্ষ্যে গত পাঁচ বছরে দিল্লির প্রায় দেড় হাজার গাছ কাটা পড়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । এর মধ্যে অনেকগুলি একশো বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এবং বিরল প্রজাতির গাছ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কংক্রিটে রাস্তা বাঁধানো গাছের মৃত্যুর একটি বড়ো কারণ। এ ছাড়া আছে মাটি খুঁড়ে তার পাঠানোর ব্যবস্থা। বৈদ্যুতিক সরবরাহের তার, রাস্তার আলোর তার, সিসিটিভি ক্যামেরার তার, আরো কত প্রকার খননকার্য চলছে নিয়মিত। এই ক্ষতিপূরণ করতে হলে আরো গাছ লাগাতে হবে, করতে হবে শহুরে সবুজায়ন (urban greening)। যে সব অঞ্চলে গাছ কম, মৃত অথবা উৎপাটিত, সেখানে পুঁততে হবে নতুন গাছের চারা।

শহরে গাছ লাগানোর উদ্দেশ্য তার জৈবিক গুণাবলীকে আমাদের জীবনে ব্যবহার করা। শীতলতা, শোভা আর ছায়াপ্রদান ছাড়াও গাছ ভূমিক্ষয় রোধ করে, বৃষ্টির জল ধরে রাখে এবং সর্বপরি বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ ও সঞ্চয় করে। বাতাসে মিশে থাকা অন্যান্য গ্যাস যে দূষণ সৃষ্টি করে, গাছ তাকেও অঙ্গে ধারণ করে থাকে। এ ছাড়া বাতাসে ভেসে থাকা বিভিন্ন প্রকার ও আয়তনের ধূলিকণা গাছের পাতায় বসে গেলে সেই ধূলিকণাগুলির আরো ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতা কমে যায়। এক কথায় বায়ুদূষণ রোধে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। শহুরে এলাকায় ও শিল্পাঞ্চলে গাছ কাটা পড়ে সবচেয়ে বেশি আর দূষণ সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সমস্যার সমাধান হিসেবে এসেছে এই নতুন ধারণাগুলি, শহরের সবুজ পরিকাঠামো (green infrastructure বা GI) গঠন এবং শহুরে সবুজায়ন (urban greening) প্রক্রিয়া। GI-কে বলা যেতে পারে একটি সবুজ জাল যার মধ্যে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রকার জৈবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া আর মানুষের বহুবিধ কার্যাবলী। শহরে সবুজায়নের উদ্দেশ্য এই জৈবিক পদ্ধতিগুলির সংরক্ষণ ও তার উপকারিতাকে কাজে লাগানো। এর মধ্যে আছে বাতাস থেকে দূষক কমিয়ে বাতাসের গুণগত মান বৃদ্ধি, বাতাসের তাপমাত্রা হ্রাস, শব্দ দূষণ রোধ ইত্যাদি। শহরের যে কোনো জায়গাই সবুজায়নের আওতায় পড়তে পারে। বাগান, পার্ক, রাস্তার ফুটপাথ বা ডিভাইডার অথবা আজকাল যে দেখা যায় খাড়া দেওয়াল আর ফ্লাইওভারের পিলার, এই সবগুলিকেই সবুজ করে তোলার কাজ শুরু হয়েছে।
 

গাছের সারি চৌকিদার

বায়ু দূষণ রোধের কাজে বৃক্ষের ভূমিকা হলো পাহারাদারের মতো। এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে হাওয়ায় ভেসে থাকা ধূলিকণা (suspended particulate matter বা SPM) নিজের শরীরে ধারণ করে গাছ। বিভিন্ন আয়তনের ধূলিকণা (PM ১০,২.৫, ১) গাছের পাতার ছাঁকনিতে ধরা পড়ে। আর তার ফলেই বৃক্ষপ্রাচীর হয়ে ওঠে বায়ুদূষণের সঙ্গে লড়াইতে মানুষের হাতিয়ার। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে সব অঞ্চল গাছের সারি দিয়ে ঘেরা, তার বাইরে আর ভেতরে SPM-এর মাত্রা লক্ষ্যণীয়ভাবে আলাদা। এই পার্থক্যের মাত্রা ১০% থেকে ২৫% পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে। সঙ্গত কারণেই PM ১০-এর ক্ষেত্রে তারতম্য সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। ধূলিকণার আয়তন যত বড়ো, ছাঁকনিতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা তত বেশি। মোট ধূলিকণা হ্রাসকরণের মাত্রা কোনো কোনো শিল্পাঞ্চলের ক্ষেত্রে ৫০% থেকে ৬০% অবধি দেখা গিয়েছে। এ ছাড়া শহরের মধ্যিখানে যেসব অঞ্চল রাস্তার ধারে, যেখানে যানবাহনের চাপ বেশি, কিংবা যেসব এলাকা পেট্রল পাম্পের কাছে, সেই ধরনের জায়গায় গাছের সারি থাকলে এই দূষণ মাত্রার পার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।

এই দূষণ কমার হিসাবটি অতি সরল। ধূলিকণা হ্রাসকরণ/দুর্বলতাসাধনের সূচক (dust attenuation factor) হলো বাইরের দূষণ মাত্রা ও ভিতরের দূষণ মাত্রার আপেক্ষিক পার্থক্যের একটি শতকরা হিসাব। এ ক্ষেত্রে গাছের সারি হচ্ছে এলাকাটির প্রাচীর। এলাকাটির বাইরে দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে উপরিউক্ত নানা কারণে। অনুমান করা যায় যে, গাছ পেরিয়ে ভিতরে আসার পর বাতাসে দূষকের মাত্রা কম হবে। PM মাপার যন্ত্র দিয়ে এই রিডিংগুলি নেওয়া হয়। বাইরের বাতাসের PM-এর পরিমাণ ও ঘনত্ব এবং ভিতরের বাতাসের PM-এর পরিমাণ ও ঘনত্ব এবার সহজেই তুলনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন সমীক্ষাতে দেখা গিয়েছে যে, এই সূচকটির মান একের চেয়ে কম। অর্থাৎ গাছ থাকার কারণে বাইরের সব PM ধূলিকণা ভিতরে ঢুকতে পারে নি। আরো দেখা গিয়েছে, বড়ো বড়ো গাছের সারির পরে যদি আরো নীচু গাছের সারি থাকে, আর তারও পরে যদি জমিতে ঘাস থাকে, তাহলে হাওয়ায় ভেসে থাকা ধূলিকণার মাত্রা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। অর্থাৎ বিভিন্ন গাছপালা নিজ নিজ উচ্চতায় পাহারাদারী করে চলছে অবিরত।
 

গাছগাছালির যোগ্যতা

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সব গাছের পুলিসী করার ক্ষমতা কি সমান? অবশ্যই নয়। তাই সবুজ বেল্ট বা হরিৎ পট্টি তৈরি করতে হলে বিচার করতে হবে কোন শ্রেণির গাছ দূষণ রোধের কাজে বেশি উপযুক্ত। শহরের এলাকা অনুযায়ী এবং গাছের দূষণ হ্রাস করার ক্ষমতা অনুযায়ী গাছ নির্বাচন করা উচিত। যে কোনো চারা রোপণ করে বনমহোৎসব পালন করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।

গাছের যোগ্যতা বিচারের জন্য বিজ্ঞানীরা কয়েকটি হিসাবের সাহায্য নেন। এর মধ্যে আছে দূষণ সহ্যশক্তি, গাছের আকৃতি-প্রকৃতি এবং অন্যান্য উপকারিতার একটি পূর্ণ বিশ্লেষণ। এর জন্য কয়েকটি সূচক গণনা করা হয়। সবগুলি মাপ বিচার করে একটি সর্বাঙ্গীন সূচক পাওয়া যায়। আর তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, শহরের কোন অঞ্চলে কি ধরনের বৃক্ষরোপণ করে সবুজায়ন করা যুক্তিযুক্ত।

ক. দূষণ সহ্যশক্তি সূচক

গাছের পাতা পরীক্ষা করে দূষণ সহ্যশক্তি সূচক (air pollution tolerance index বা APTI) গণনা করা হয়। কোন গাছ কতখানি গ্যাসীয় দূষণ ও সূক্ষ্ম ধূলিকণা সহ্য করতে পারবে তা নির্ভর করে চারটি জিনিসের ওপর: পাতার ক্লোরোফিলের মাত্রা, অ্যাসকরবিক এ্যাসিডের পরিমাণ, অম্ল-ক্ষারক অনুপাত (ph factor) আর আপেক্ষিক জলের পরিমাণ। গবেষণাগারে গাছের পাতা পরীক্ষা করে এই চারটি মান ও তার ভিত্তিতে বিভিন্ন গাছের APTI গণনা করা হয়। যে পাতায় এ্যাসিডের উপস্থিতি বেশি, জলের মাত্রাও ভালো এবং অবশ্যই ক্লোরোফিল বেশি, সেইসব গাছের বেশি সবুজ পাতাগুলি বেশি সহজে দূষণ কমাতে পারে।

APTI-এর মান যত বেশি হবে, সেই গাছ তত বেশি সূক্ষ্ম ধূলিকণা ও গ্যাসীয় দূষকগুলিকে নিষ্ক্রিয় করতে পারবে। এই সূচকের মান অনুসারে গাছকে সংবেদনশীলতার বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। চিরহরিৎ, পর্ণমোচী, ঝোপঝাড় ও ঘাসজাতীয় গাছের APTI এবং সংবেদনশীলতা আলাদা হয়। যেমন, পর্ণমোচী বৃক্ষের ক্ষেত্রে এর মান ১৪-২৪, চিরহরিৎ হলে ১২-২০, ঝোপঝাড় ১০-১৮ এবং ঘাস হলে ১৬-২৯। এগুলি সাধারণভাবে প্রাপ্ত APTI মানের ভিত্তিতে সংজ্ঞাবদ্ধ করা হয়েছে। এই উচ্চসীমার ওপরেও কোনো কোনো গাছ থাকে। সেগুলি আরো বেশি মাত্রায় দূষণ সহ্য করতে পারে। এই হিসেব অনুযায়ী আমাদের খুব চেনা কিছু গাছের গুণ দেখা যাক। জানাশোনা পর্ণমোচী শ্রেণির গাছের মধ্যে আছে শিরীষ (৩২), অমলতাস (২৮), নিম (২২), অশ্বত্থ (২০), পেয়ারা (১৮), আমলকি ও তেঁতুল (১৪)। চিরহরিৎ শ্রেণির মধ্যে ভালো অর্থাৎ দূষণ রোধকারী গাছেরা হল বট (১৯), দেবদারু (১৮), অর্জুন (১৬) ইত্যাদি। আমাদের অতি প্রিয় আম (১২), আতা (১০) সজনে (১২) ইত্যাদি গাছেরা এই ব্যাপারে একটু পিছিয়ে আছে। অন্যদিকে কাঁটাঝোপের দিকে তাকালে দেখা যায় সবচেয়ে ভালো গাছ বোগেনভিলিয়া (৩০)। রাস্তার দুই ধারে বোগেনভিলিয়ার ঝাড় লাগানোর কারণ শুধু তার রঙের বাহার নয়, তার দূষণ সহ্য করার ক্ষমতাও। আকন্দ (২৭), লেবু (১৫) আর গোলাপ (১২) আছে তার পরেই। বিভিন্ন গবেষণায় এই মানগুলির কিছু তারতম্য পাওয়া যায়। তবে মোটামুটিভাবে সংখ্যাগুলি উল্লিখিত মানের কাছাকাছিই থাকে। পার্থক্যের একটি মূল কারণ হল নানা জায়গায় পরীক্ষিত গাছগুলি আগে থেকেই নানা মাত্রায় দূষণের শিকার। তাই বিশুদ্ধ মাপ পাওয়া একটু কঠিন।

শুধু APTI খারাপ হওয়ার অপরাধে কিন্তু একটি প্রজাতির গাছকে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। সহ্যশক্তি সূচক ছাড়াও আরো অনেকগুলি বিচার্য বিষয় আছে। APTI-এর সঙ্গে সেইগুলি দেখে একটা বৃহত্তর সূচক তৈরি করা হয়। গাছগাছালির শেষ বিচার হয় তখন।

খ. আনুমানিক পারদর্শিতা সূচক

দূষণ সহ্যশক্তি সূচক থেকে আমরা এবার এগোবো আরো বড়ো একটি সূচকের দিকে, যার নাম আনুমানিক পারদর্শিতা সূচক (anticipated performance index বা API) । এটি গণনা করার জন্য যে অতিরিক্ত বিষয়গুলি দেখা হয়, তা হল গাছের প্রকৃতি (plant habit), পাতার মাপ (laminar size), গাছের চাঁদোয়ার বিস্তার (canopy size) ইত্যাদি। এগুলির জন্য গাছকে কিছু নম্বর বা গ্রেড দিলে হিসেবের সুবিধা হয়। এইসব জৈবিক গুণাগুণের পাশাপাশি গাছটির অর্থনৈতিক মূল্যের (economic value) জন্যও একটা গ্রেড দেওয়া হয়। বিচার্য গাছের ১/২/৩টি ব্যবহার্য গুণ থাকা দরকার। যেমন, ওই গাছের পাতা, ফল, ফুল কোনো কাজে লাগে কিনা, ওই গাছে মৌমাছি চাক বানায় কিনা ইত্যাদি। এগুলি সবই API গণনার অন্তর্ভুক্ত। API হল এইসব জৈবিক সূচক, দূষণ সহ্যশক্তি সূচক ও অর্থনৈতিক সূচকের একটি সম্মিলিত গড়। গাছের পাতার APTI যেমন দূষণকে নিষ্ক্রিয় করতে কার্যকরী হয়, তেমনি পাতার প্রকৃতি, মসৃণতা ইত্যাদিও দূষক ধূলিকণা ধারণে সাহায্য করে। API এই সবগুলি লক্ষণকে একত্র করে একটি সম্মিলিত মান দেয়। শেষ পরীক্ষায় কোন গাছ পাস আর কোন গাছ ফেল, তা স্থির হবে এইবার। API যদি ৩০% এর কম হয়, তবে সেই গাছ পুরোপুরি বর্জ্যনীয়। ৩১% থেকে ৫৯% হলে তা মন্দের ভাল। আর ৬০% এর ওপর হলে সেই গাছকে ক্রমাগত ভালো, আরো ভালো, উৎকৃষ্ট ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়। ৯০% এর ওপরে যে গাছের মান, সে এই বিচারে শ্রেষ্ঠ।

সাধারণভাবে মনে হতে পারে যে দূষণ সহ্যশক্তি (APTI) বেশি হলেই গাছ সার্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে। কিন্তু কোনো কোনো গাছ কম APTI সত্ত্বেও অন্যান্য জৈবিক ও অর্থনৈতিক বিচারে এগিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত জিতে যেতে পারে। বিভিন্ন সমীক্ষার ফল অনুযায়ী আনুমানিক পারদর্শিতার খেলায় বিজয়ীরা হল অশ্বত্থ, বট, দেবদারু, জারুল, পলাশ, কাঠগোলাপ (চম্পা), নিম, বট, অমলতাস, আম ইত্যাদি। এদের কারুর পাতা বড়ো, কারো পাতা ভারী ও খসখসে, কারো পাতা বেশি সবুজ, আবার কারো পাতায় অম্লের ভাগ বেশি। অন্যদিকে, ছোট পাতা হওয়া সত্ত্বেও বিরাট চাঁদোয়ার গুণে আর উপকারের নিরিখে এগিয়ে আসে নিম। APTI কম হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভালো ফল দেখায় আম। এগুলি সবই আকারে বড়ো গাছ। বেড়ে উঠতে সময় লাগলেও এরাই দীর্ঘস্থায়ী ও বেশি উপকারী। তাই দ্রুত বর্ধনশীল গাছের মোহে না পড়ে উপকারিতার বিচার করে গাছ নির্বাচন করা প্রয়োজন।

গ. জলবায়ু সংক্রান্ত অবস্থান

ভালো গাছ তো বাছা হল। তাহলেই কি অভিপ্রেত ফল পাওয়া যাবে? অনেকটাই যাবে। তবে সঙ্গে থাকা চাই জলবায়ুর সহায়তা। স্থানীয় তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা ও হাওয়ার গতিবেগ গাছের দূষণ হ্রাস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দূষণ হ্রাসকরণ অনেকাংশেই জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল।

তাপমাত্রা কম হলে দূষণ বেশি হয়। এই কারণে শীতকালের বাতাস বেশি দূষিত। সে ক্ষেত্রে আমাদের চৌকিদারের ওপর চাপ বেশি। আশানুরূপ কাজ করলেও ভালো গাছেরা সব ঋতুতে সমান পারদর্শিতা দেখতে পারে না। অন্যদিকে বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি হলে তাতে দূষক ধরা পড়ে বেশি। শুধু তাই নয়, জলীয় আবহাওয়ায় জলকণাগুলিতে ধুলো আটকে যায়। এর ফলে প্রদূষক কণাগুলি আয়তনে বাড়তে থাকে ও হাওয়াতে ভাসতে থাকে।

এবার দেখা যাক, হাওয়ায় কী খবর মেলে। বাতাসের গতিবেগ প্রদূষক ধুলিকণাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে অন্য দিকে। সে ক্ষেত্রে গাছের কাজ কম এবং পরিবেশ অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার। খুব ঘিঞ্জি এবং দূষিত অঞ্চলও শুধু হাওয়ার অভিমুখের গুণে দূষণের প্রভাব থেকে বেঁচে যেতে পারে। অন্যদিকে হাওয়া বেশি পরিমাণ ধূলিকণা বয়েও আনতে পারে। তখন পারদর্শী গাছেরাও হিমশিম।

সঠিক গাছ আর উপযোগী আবহাওয়া একসঙ্গে মিলে সৃষ্টি করতে পারে একটি কার্যকরী সবুজ এলাকা। আবহাওয়া তো ঋতু অনুযায়ী বদলাতে থাকবে। তাই বলা যেতে পারে, গাছের সঠিক নির্বাচনটাই বেশি জরুরি। API আমাদের এই কাজেই সাহায্য করে। শহুরে সবুজায়নের জন্য তাই সর্বাগ্রে এই হিসেবটাই করা প্রয়োজন। যে গাছগুলি এই বিচারে ভালো, তাদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা দরকার। মৃত গাছের পরিবর্তে বা আনকোরা নতুন গাছ যখনই লাগাবার সময় আসবে, আমাদের বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
 

শেষ কথা

আমরা গাছকে ব্যবহার করছি আমাদের বর্ম হিসেবে, দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে। এতে আমরা নিজেরা বাঁচলেও গাছের ক্ষতি তো হচ্ছেই। একটা গোটা অঞ্চলের গাছের মৃত্যু বা শুকিয়ে যাওয়ার হার দেখে সে অঞ্চলের দূষণের মাত্রার ধারণা করা যায়। যদি এলাকার গাছগুলির সহ্যশক্তি ও পারদর্শিতার সূচক মান জানা থাকে, তাহলে দূষণের হিসেবটা সহজেই করা যেতে পারে। আমাদের প্রিয় গাছেরা আহত হয়েও জানিয়ে দেয় দূষণের বিপদসংকেত। মনুষ্যকৃত দূষণের পাপ কিন্তু কোনোভাবেই স্খলন হয় না।

পরিবেশদূষণ রোধে গাছের ভূমিকা নিয়ে যে সমস্ত গবেষণা হয়েছে, তা প্রায় সবই ভারত, বাংলাদেশ ও চীনদেশের পরিপ্রেক্ষিতে। উন্নত বিশ্বে এই বিষয়ে গবেষণায় উৎসাহ কম। ধরে নেওয়া যেতে পারে এর কারণ এইটাই যে, দূষণের সমস্যা প্রধানত এই অঞ্চলেই কেন্দ্রীভূত। অন্যদিকে, ভাবতে ভালো লাগে যে বিভিন্ন গাছের এই বিশাল সম্ভারও তো পৃথিবীর এই অংশেই দেখা যায়। উন্নয়নশীল দেশের শত সমস্যার মধ্যে দূষণ একটি বড়ো সমস্যা। প্রকৃতির কাছে আমাদের হাত পেতে সমাধান খুঁজতে হবে। আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে সবুজ অঞ্চল, লাগাতে হবে আরো অজস্র সুবিবেচিত ও সুনির্বাচিত গাছ। তখন আমাদের শহরের বুকের মাঝেই বলা যাবে, ‘এ যে দৃশ্য দেখি অন্য, এ অরণ্য, এ যে বন্য’।


তথ্যসূত্রঃ

Kumar, S. R., Arumugum, T., Anandakumar, C., balakrishnan, S., Rajavel, D. (2013), Use of plant species in controlling environmental pollution, Bulletin of Environment, Pharmacology and Life Sciences, 2, 52-63.

Patel, D. & Kumar, N., (2018), An evaluation of APTI and API of some tree species considered for green belt development: A case study of Nandesari industrial area, Vadodara, Gujrat, India, Open Journal of Air Pollution, 7, 1-13.

Yousufzai, A., Durani, A . & Durrani, H (2018), Assessment of APTI and API of common roadside trees, International Journal of Multidisciplinary Research and Development, 5(1), 45-54.