আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭
প্রবন্ধ
অধিকারভেদঃ বিদ্যাসাগর, কুইন ভিক্টোরিয়া, শ্রীরামকৃষ্ণ
আশীষ লাহিড়ী
দামোদর সাঁতরে মা-র কাছে যাওয়া, কিংবা ছোটোবেলায় রাস্তায় গ্যাসবাতির আলোয় লেখাপড়া করার (যদিও কলকাতার রাস্তায় যখন গ্যাসবাতি চালু হয়, তখন তাঁর বয়স সাঁইত্রিশ) মতন প্রচুর মিথ বিদ্যাসাগরকে নিয়ে প্রচলিত। তার মধ্যে নিরন্তর প্রচারের গুণে যে-মিথটি হিন্দু বাঙালির কাছে বড়োই প্রিয়, এবং কার্যত অবিসংবাদিত, সেটি হল - যতই তেজস্বী পণ্ডিত হোন বিদ্যাসাগর, ‘ঠাকুর’ তাঁকে যুক্তিতর্কে ধরাশায়ী করেছিলেন এবং ‘পরাজিত’ বিদ্যাসাগর ‘ঠাকুরে’র প্রতি ভক্তিতে গদ্গদ হয়েছিলেন! আজ এই জন্ম-দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি যে-সমস্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে দেখানো হচ্ছে, বিদ্যাসাগর শ্রীরামকৃষ্ণর প্রতি কত ভক্তিপরায়ণ। খুব সচেতনভাবে এই মিথটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে; কেননা বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদ আর শ্রীরামকৃষ্ণর ভক্তিবাদ একই মোহনায় এসে মিশেছিল, এই গপ্পোটি চালু করে দিতে পারলে ভদ্রলোক বাঙালির দু নৌকায় পা-দেওয়া নীতিবোধ পরম স্বস্তি লাভ করবে।
মিথটি - অধিকাংশ মিথের মতন - সর্বৈব মিথ্যা। বরং ঘটনা লোকবিশ্বাসের ঠিক বিপরীত। বস্তুত শ্রীরামকৃষ্ণই বিদ্যাসাগরকে দলে টানতে না-পেরে নিতান্ত মুষড়ে পড়েছিলেন। আর বিদ্যাসাগর সৌজন্য সহকারে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। বেশি গবেষণা করতে হবে না, উদ্বোধন-শংসায়িত দুই খণ্ডে প্রকাশিত কথামৃত তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।
শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ‘সাধ’ মেটানোর জন্য ৫ আগস্ট ১৮৮২ বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়িতে গিয়েছিলেন, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণর সনির্বন্ধ অনুনয় সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর একবারও দক্ষিণেশ্বরে ‘রাসমণির বাগানে’ যাননি। কথামৃত-র সাক্ষ্য অনুযায়ী, ১৮৮২ থেকে ১৮৮৬, যে-বছর রামকৃষ্ণ মারা যান, এই চার বছরে রামকৃষ্ণ অন্তত কুড়িবার বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ তুলেছেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর জীবনে একবারও রামকৃষ্ণর কথা তোলেননি, যদিও রামকৃষ্ণর মৃত্যুর পর তিনি আরও পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন। ‘১৮৮২ থেকে ১৮৮৮ সালের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার কার্মাটাড়ে গিয়েছেন; কলকাতার নিকটবর্তী চন্দননগর, ফরাসডাঙ্গা ইত্যাদি জায়গাতেও যাতায়াত করেছেন, কিন্তু রাসমণির বাগান তাঁর কাছে অগম্য এবং অপরিচিতই রয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিদ্যাসাগরের অবশিষ্ট জীবনের ধারাও রামকৃষ্ণের ধর্মালোচনার দ্বারা সামান্যভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। এই সাক্ষাৎ সম্পর্কে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়াও কারুর কাছে ব্যক্ত করেননি। রামকৃষ্ণ সম্পর্কে তাঁর কোনো মন্তব্যও পাওয়া যায়নি’। এ দুজনের জগৎ যে দুই আলাদা ধাতুতে তৈরি, তা বোঝাবার জন্য মাত্র একটি উদাহরণ দেব।
৫ আগস্ট ১৮৮২ তাঁদের প্রথম ও শেষ সাক্ষাতে বিদ্যাসাগর খুব কম কথা বলেছিলেন। ব্রায়ান হ্যাচার-এর কথায়, ‘বিদ্যাসাগরকে কখনোই কোনো আলোচনার শেষ কথা বলতে দেওয়া হয়নি’ কথামৃত-য়। ‘তবু, তাঁর মূল অবস্থানটি বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।’
তারই মধ্যে রামকৃষ্ণকে তিনি একটি প্রশ্ন করেনঃ ‘তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?’ তাঁর মনের কথাটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঈশ্বরের চোখে সবাই যদি সমান হয়, তাহলে এক এক জন মানুষের শক্তি এক এক রকম কেন? অর্থাৎ ঈশ্বর কি সমদর্শী? রামকৃষ্ণর উত্তরঃ তিনি বিভুরূপে সর্বভূতে আছেন, পিঁপড়েতে পর্যন্ত। কিন্তু শক্তিবিশেষ। তা না হলে একজন লোকে দশজন লোককে হারিয়ে দেয়, আবার কেউ একজনের কাছ থেকে পালায়, আর তা না হলে তোমাকেই বা সবাই মানে কেন? তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো? (হাস্য) তোমার দয়া, তোমার বিদ্যা আছে - অন্যের চেয়ে, তাই তোমাকে লোকে মানে, দেখতে আসে। তুমি এ-কথা মানো কি না?
রামকৃষ্ণ আসলে বিদ্যাসাগরের প্রশ্নটিকেই উত্তর হিসেবে হাজির করলেন, কোনো ব্যাখ্যা দিলেন না। শুনে বিদ্যাসাগর কোনো উত্তর না দিয়ে ‘মৃদু মৃদু’ হাসতে লাগলেন।
সুমিত সরকারের পথ অনুসরণ করে ব্রায়ান হ্যাচার নির্ভুলভাবেই ধরেছেন, এখানে আলোচ্য প্রশ্নটি ‘অধিকারভেদে’র, যা হিন্দু বিশ্বাসের একটি প্রধান স্তম্ভ। গীতায় অধিকারভেদের পক্ষে সবিস্তার যুক্তিজাল বিছানো হয়েছে। বিদ্যাসাগর অধিকার-ভেদ তত্ত্বে অবিশ্বাসী; সারা জীবনে গীতা সম্বন্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। পক্ষান্তরে শ্রীরামকৃষ্ণর মতে, কেউ বিদ্যাসাগর হয়, কেউ ‘কুইন’ ভিক্টোরিয়া হয়, কেউ-বা শ্রীরামকৃষ্ণ, এসবই যে-যার পূর্বনির্দিষ্ট ‘অধিকার’-বলে। শ্রীরামকৃষ্ণর এই বিশ্বাসের মধ্যে অভিনবত্ব কিছু নেই; কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগরের অবস্থানের মধ্যে অবশ্যই নতুনত্ব আছে। বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদী দর্শন-চর্চা ছাড়াও হ্যাচার এর মূল অনুসন্ধান করেছেন বিদ্যাসাগরের জীবনের মধ্যে - বিদ্যাসাগরের মা, কুলীন ব্রাহ্মণকন্যা ভগবতী দেবী নাকি ছোটোবেলায় অস্পৃশ্য জাতির মেয়েদের সঙ্গে খেলা করতেন।
সমাজ সংস্কার, মঙ্গল-অমঙ্গল, মানুষের অসাম্য, দুঃখ-যন্ত্রণা এগুলো রামকৃষ্ণর আলোচ্য বিষয়ই নয়। তিনি সগর্বে জানান, ব্রহ্মলাভই তাঁর অ্যাজেন্ডার একমাত্র পদ। ভালো কাজ, মানবমঙ্গল, জনসেবা, এসবের কোনো মূল্য নেই, কেননা এসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ‘আমি’। তাই অধিকারভেদের প্রশ্ন তুলে, বিদ্যাসাগরকে একটু ঠেস দিয়ে রামকৃষ্ণ শুধালেনঃ ‘আচ্ছা, তোমার কি ভাব?’ ততক্ষণে বিদ্যাসাগর বুঝে গেছেন, তাঁর ও রামকৃষ্ণর জগৎ আলাদা, এ দুই জগতের মধ্যে ভাবের, চিন্তার কোনো আদানপ্রদান সম্ভব নয়, যুক্তিতর্কর তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই বিদ্যাসাগর রঙ্গচ্ছলে, ‘মৃদু মৃদু’ হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, সে-কথা আপনাকে একলা-একলা একদিন বলব’। যেন শিশু ভোলালেন।
মাস চারেক পর, ১৮৮২-র ১৪ ডিসেম্বর মহেন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়ে আলোচনা হতে হতে বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ উঠে এল। বেশ তীব্র আকারে। মহেন্দ্রনাথ বলেন - বিদ্যাসাগর অভিমান করে বলেন, ঈশ্বরকে ডাকবার আর কী দরকার! দেখ চেঙ্গিস খাঁ যখন লুটপাঠ আরম্ভ করলে তখন অনেক লোককে বন্দী করলে; ক্রমে প্রায় এক লক্ষ বন্দী জমে গেল। তখন সেনাপতিরা এসে বললে মহাশয়, এদের খাওয়াবে কে? সঙ্গে এদের রাখলে আমাদের বিপদ। কি করা যায়? ছেড়ে দিলেও বিপদ। তখন চেঙ্গিস খাঁ বললেন, তাহলে কি করা যায়; ওদের সব বধ কর। তাই কচাকচ করে কাটবার হুকুম হয়ে গেল! এই হত্যাকাণ্ড তো ঈশ্বর দেখলেন? কই একটু নিবারণ তো করলেন না। তা তিনি থাকেন থাকুন, আমার দরকার বোধ হচ্ছে না। আমার তো উপকার হল না।
সর্ব অর্থে অমানুষিক এই বর্বরতা রামকৃষ্ণকে একটুও বিচলিত, এমনকী অপ্রতিভও করল না। তিনি এই ভয়ংকরতাকে ঈশ্বরের লীলা বলে মেনে নেবার পরামর্শ দিলেনঃ ঈশ্বরের কার্য কি বুঝা যায়, কি উদ্দেশ্যে তিনি কি করেন? তিনি সৃষ্টি, পালন, সংহার সবই করছেন। তিনি কেন সংহার করছেন আমরা কি বুঝতে পারি? আমি বলি, মা, আমার বোঝবারও দরকার নাই, তোমার পাদপদ্মে ভক্তি দিও।
এর মধ্যে কোনো দ্ব্যর্থকতা নেই। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, যাঁর অঙ্গুলিহেলন ছাড়া একটা গাছের একটি পাতাও নাকি নড়ে না, তিনি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মানুষ বিনা দোষে কষ্ট পাবে কেন, তা নিয়ে সংশয়হীন ভক্ত রামকৃষ্ণ ভাবতে রাজি নন, কিছু করা তো দূরের কথা। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মানবদরদি সংশয়বাদী মন মানুষের কষ্ট দেখার পর ঈশ্বর নামক কোনো মঙ্গলময় সত্তাকে মানতে অস্বীকার করে। রামকৃষ্ণ ভাবধারার সঙ্গে বিদ্যাসাগর ভাবধারার আসল সংঘাত এই জায়গায় - মানুষের নৈসর্গিক ও সামাজিক যাতনাকে ভগবানের লীলা বলে উড়িয়ে না দিয়ে তাকে বাস্তবসম্মতভাবে বোঝা এবং বিজ্ঞানসম্মত কর্মর মধ্যে দিয়ে তার মূল উৎপাটনের চেষ্টা করা।
১৮৮৩-র ১৫ এপ্রিল রামকৃষ্ণর পুনরায় খেদঃ কিছু কিছু মানুষকে ঈশ্বর শ্রেষ্ঠ করে গড়েছেন, অর্থাৎ অধিকারভেদ একটা প্রশ্নাতীত সত্য, এ-কথা বিদ্যাসাগর মানতে চাননি। ১৫ জুন ওই প্রসঙ্গ তুলে তাঁর নিজস্ব রায়দানের ভঙ্গিতে বলেন, বিদ্যাসাগরের এত বিদ্যা, এত নাম, কিন্তু এমন কাঁচা কথা বলে ফেললে...। ঈশ্বরকে না জানলে ক্রমশঃ ভিতরের চুনোপুঁটি বেরিয়ে পড়ে। শুধু পণ্ডিত হলে কি হবে?
একই কথা বলেন ১৮৮৩-র ২৮ নভেম্বর। এরপর নিজের ধারণা অনুযায়ী রামকৃষ্ণ এক মোক্ষম যুক্তি দিলেন। ১৮৮৪ সালের ৩০ জুন ‘কুইন ভিক্টোরিয়ার এত মান, নাম কেন’ এই যুক্তি দিয়ে তিনি পুনরপি বিদ্যাসাগরের ‘কাঁচা’ যুক্তি ‘খণ্ডন’ করেন! এটা নাকি অধিকারভেদের একটা অকাট্য প্রমাণ।
‘কুইন ভিক্টোরিয়ার এত মান’, এত নামের মূলে তো নিছক উচ্চশ্রেণির মানুষের তৈরি কতকগুলো কৃত্রিম রীতি, তাঁর কোনো বিশেষ কৃতিত্ব কিংবা গুণ নয়। কীভাবে তিনি ‘কুইন’ হলেন? ২০ জুন ১৮৩৭ আঠারো বৎসর বয়স্ক আলেকজান্ড্রিনা ভিক্টোরিয়া তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেনঃ ‘ভোর ছটায় মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানালেন, ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ আর লর্ড কনিংহ্যাম এসেছেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। বিছানা থেকে উঠে ড্রেসিং গাউন পরেই আমি আমার বসবার ঘরে গেলাম, একলা। কথা হল ওঁদের সঙ্গে। লর্ড কনিংহ্যাম তখন আমায় জানালেন, রাজা, মানে আমার বেচারী কাকা, আর নেই। রাত ২টো বেজে ১২ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাই আমি এখন রানি।’ সেই থেকে ১৯০১ সালে পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের রানি। পক্ষান্তরে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের এত মান, এত নামের মূলে আছে তাঁর সংগ্রাম, তাঁর গুণ, তাঁর অর্জিত কৃতিত্ব। দুটো কী করে এক মানদণ্ডে বিচার্য হল, এ প্রশ্ন তাঁর ভক্তরা কেউ তুললেন না। এরই রেশ চলে ১৮৮৪-র ১৯ অক্টোবরে, এমনকী ১৮৮৫-র ২৮ জুলাই-এও। এখানে মূল প্রশ্নটি আসলে অধিকারভেদের, যার ওপর ব্যক্তিমানুষের কোনো হাত নেই। বিদ্যাসাগর আর শ্রীরামকৃষ্ণর মধ্যে এটি একটি মৌলিক সংঘাতের জায়গা। এঁরা দুজনে মেলেন না; মেলেননি। এই দ্বিশতবর্ষে আসুন আমরা শপথ নিই, যাক ছিঁড়ে যাক এই মিথ্যার জাল।
______________________________
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য লেখকের ‘রামকৃষ্ণর আকুতি, বিদ্যাসাগরের উপেক্ষা’, দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক (সম্পা), জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০২০