আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭
সমসাময়িক
জীবন বিমার জীবন বিপন্ন
অজানা অণুজীবের দাপটে জনজীবন বিপর্যস্ত। গণপরিবহণ অবিন্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে অকস্মাৎ অনেকেই কাজহারা হয়ে যাওয়ায় কাজছাড়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। জোরজবরদস্তি করে বাজার খুলিয়েও লাভ হয়নি। পণ্য আছে। চাহিদা নেই। উৎপাদন কমে যাচ্ছে। নিশ্চয়তা নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলি ক্রমশ অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে।
রাষ্ট্র কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পদ বিক্রি করে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে ২ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা রাজকোষে জমা দেওয়ার যে প্রস্তাব বাজেট ভাষণের সময় উচ্চারিত হয়েছিল তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্র নির্বিকার ভঙ্গিতে নৈর্ব্যক্তিক আচরণ করে চলেছে। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করতে রাষ্ট্র মোটেই আগ্রহী নয়।
রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিলেও কিনবার ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্র নাছোড়বান্দার মতো সম্ভাব্য ক্রেতার দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকছে। প্রয়োজনে ক্রেতার শর্ত পূরণের জন্য দরাদরি হচ্ছে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে শাসকের দর্শন; উৎপাদন ও পরিষেবার দায়িত্ব পালনের কাজ সরকারের নয়। কয়লা খনি, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমস্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা যে কোনো মূল্যে বেসরকারি বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করে দিতে রাষ্ট্র স্থিরপ্রতিজ্ঞ।
তবুও কাজের কাজ হচ্ছে না। চাহিদার অভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের কোনো সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত বেছে নেওয়া হয়েছে অগতির গতি ভারতীয় জীবন বিমা করপোরেশন বা এলআইসি-কে।
দ্বিশতাধিক বেসরকারি বিমা সংস্থাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এনে ১৯৫৬-র পয়লা সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরুর সময় ভারত সরকার এলআইসি-তে ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল sovereign guarantee বা রাষ্ট্রের সার্বভৌম নিশ্চয়তা। বছর শেষে এলআইসি-র গ্রাহক অর্থাৎ বিমাকারীদের মধ্যে বন্টন করা হয় বাৎসরিক মুনাফার ৯৫ শতাংশ। বাকি ৫ শতাংশ লভ্যাংশ জমা দেওয়া হয় সরকারের কোষাগারে। এইভাবেই দীর্ঘ ৬৪ বছর ধরে লাভজনক বিমা ব্যাবসা চলার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে এলআইসি।
একবিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে এলআইসি-কে নিয়ে নানানরকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা। ২০০০-০১ অর্থবর্ষে রাষ্ট্র বিমা ব্যাবসা উন্মুক্ত করে দেয়। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে বিমা ব্যাবসায় প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা চালু হলে এলআইসি-র পরিষেবার মান উন্নত হবে। সংস্থার শ্রীবৃদ্ধি হবে। রাতারাতি একগুচ্ছ দেশি-বিদেশি বিমা সংস্থা বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এলআইসি-র একচেটিয়া ব্যাবসায় একটা সাময়িক ধাক্কা এলেও সামলিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি। দেশে ২৩টি বেসরকারি বিমা কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করে বর্তমানে এলআইসি এক নম্বরে রয়েছে। জীবন বিমার ক্ষেত্রে তাদের দখলে রয়েছে বিমা বাজারের ৭৪ শতাংশ। মার্চ, ২০১৯-এর হিসেবে এলআইসি-র মূলধনের পরিমাণ ৩ কোটি ১১ লক্ষ ১২০০ কোটি টাকা। ২৯ কোটি বিমাকারীর দায়দায়িত্ব সামলাতে কর্মরত রয়েছেন ১ লক্ষ ১২ হাজার কর্মী। এছাড়া এলআইসি-র ব্যাবসা সম্প্রসারণের জন্য নিযুক্ত আছেন প্রায় ১২ লক্ষ এজেন্ট। নতুন বিমা করাতে পারলে তাঁরা আকর্ষণীয় কমিশন পেয়ে থাকেন। সারা দেশে ছড়িয়ে আছে এলআইসি-র দপ্তর। এইসব মিলিয়ে সরকারের অনুমান, বাজারে এলআইসির মূল্য অন্তত ১৩ থেকে ১৫ লক্ষ কোটি টাকা। যার অর্থ, প্রথম দফায় এলআইসির ১০ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়া হলেও ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অর্থ রাজকোষে জমা করা সম্ভব।
বাজেট পেশ করার সময় মাত্র এক লাইনের ঘোষণা মারফত অর্থমন্ত্রী জানিয়ে ছিলেন, জীবন বিমা নিগমে (এলআইসি) কেন্দ্রের হাতে থাকা অংশীদারির (১০০%) একটি অংশ বিক্রি করার পথে পা বাড়াবে সরকার। এই প্রথম বাজারে আসবে রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বিমা সংস্থাটির শেয়ার।
সরকার নীরব থাকলেও সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরুর প্রাক-মুহূর্তে সংবাদ মাধ্যমে আলোচনা চলছে যে ধাপে ধাপে এলআইসি-র ২৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়া হবে। সরকারের তরফে এইসব মতামতের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই। তবে বিধিবদ্ধভাবে এলআইসি-র শেয়ার প্রথমবার বাজারে ছাড়ার আগে এলআইসি আইনে সংশোধন করতে হবে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে আসলে বেসরকারি কোম্পানিগুলির হাত শক্ত করতে চাইছে কেন্দ্র। এলআইসি-র শেয়ার বাজারে এলে সাধারণ মানুষের কত জন তা কিনতে পারবেন? বড়ো বড়ো বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনে নেওয়ার পর এলআইসি-র নিয়ন্ত্রণ কি সরকারের হাতে থাকবে?
সংস্থার মালিকানা পুরোপুরি সরকারের হাতে থাকায় তা ডুবে যাওয়া কিংবা টাকা মার যাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে বিমাকারী কোনোদিন ভুলেও কোনো প্রশ্ন তোলেনি। সংস্থার উপর কতটা বিশ্বাস থাকলে এমন আস্থা অর্জন করা যায়! গত ছয় মাসে অবরুদ্ধ জীবনে তৈরি হওয়া নিত্যদিনের আশঙ্কা-আতঙ্ক-উদ্বেগের আবহে এলআইসি-র বি-রাষ্ট্রীয়করণের প্রস্তাব মারফত নাগরিকদের মনে গেঁথে দেওয়া হল নতুন দুশ্চিন্তার উপকরণ। আশঙ্কা হয়, এর পরে এলআইসি-র উপর এতদিনের ভরসা-নির্ভরতা চিড় খাবে না তো? এলআইসি-তে কারা টাকা জমা রাখেন? স্বল্প সঞ্চয় নিশ্চিন্তে গচ্ছিত রাখার সেরা আশ্রয় বলে এলআইসি জনপ্রিয়। যাঁরা শেয়ারবাজারের ফাটকাবাজি বোঝেন না বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লগ্নিতে সড়গড় নন তাঁরাও এলআইসি-র গ্রাহক। অর্থাৎ এলআইসি-তে বিমা করিয়ে মোটামুটি সকলেই নিশ্চিন্ত। সরকার কত শতাংশ শেয়ার বেচল, তার খুঁটিনাটি সাধারণ বিমাকারী না-ই জানতে পারেন। শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, এলআইসি-তে গ্রাহকদের পুঁজি নিরাপদ তো?
গ্রাহকদের প্রিমিয়াম বাবদ এলআইসি-র বছরে আয় প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকা। এলআইসি টাকা সরকারি ঋণপত্রে খাটায়। গত দশ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় এলআইসি-র লগ্নি চার গুণ বেড়েছে। ২০১৯-এর মার্চ পর্যন্ত সরকারি নির্দেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় এলআইসি প্রায় সাড়ে বাইশ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। বেসরকারি ক্ষেত্রেও চার লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। গ্রাহককে অন্ধকারে রেখেই এইসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আবার এটাও ঠিক যে সাধারণ গ্রাহক অতশত খুঁটিনাটি নিয়ে চিন্তিত নয়। এমনিতেই নিজের নিত্যদিনের হাজার সমস্যা নিয়ে সাধারণ গ্রাহক জেরবার। তার উপরে গত কয়েক মাস যেভাবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে তার মধ্যে এলআইসি-র ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ কোথায়?
যাঁরা সঞ্চয় সুরক্ষিত রাখতে এলআইসি-র শরণাপন্ন হন, তাঁদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনো যুক্তিতেই সঙ্গত নয়। সারা জীবন ধরে তিল তিল করে জমানো টাকা এলআইসি-তে রাখাই সবচেয়ে নিরাপদ বলে পরিচিত। সাধারণ গ্রাহকের আস্থা-ভরসা-বিশ্বাসে গড়ে ওঠা এলআইসি-কে বি-রাষ্ট্ৰীয়করণের অর্থ অবরোধের অন্তরালে দিনের আলোয় জাতীয় লুট।