আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

সমসাময়িক

প্রশ্নময় অপছন্দ


ভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগে ভাতের গন্ধ
জেগে উঠতেই চারিদিকে দেখি, দুয়ার বন্ধ।


ভাতের গন্ধ পায়নি এক শিশু, উত্তরপ্রদেশে, তাওয়ায় মাকে সেঁকতে দেখেনি গরম রুটি ২১ দিন। কোনো খাবার যায়নি পেটে। ২১ দিন। ঘরেতে বিদ্যুৎ ছিল না ৩০ দিন। সরকারি লোক লাইন কেটে দিয়ে গিয়েছিল। না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায় মেয়েটি। প্রতিবেশীরা ২১ দিন আগে খাবার দিয়েছিল। সেই শেষ খাওয়া। প্রতিবেশীদেরও বড়ো অভাব। লক ডাউন। কোনো কাজ নেই। সরকারি সাহায্য নেই।

মেয়েটি মারা গেলে অল্প ঢেউ ওঠে সংবাদ মাধ্যমে। সরকারি লোক আসে। ৫০ কেজি আটা কিছু ডাল আর ৫০০ টাকা দিয়ে যায়। কেমন আছেন তাঁর বাবা মা। আর কেউ জানেন না। আধার কার্ড নেই বলে ঝাড়খণ্ডের মেয়েটির মায়ের রেশন মেলেনি। মেয়েটি না খেয়ে মরে যায়। একটু আধটু কথা হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়।

দুদিনের ট্রেন আট দিন ঘোরে। না খেয়ে মা মরে যায়। ছেলে টানে মায়ের বুকের দুধ। বেঁচে যায়। এদের জন্য কোনো প্রাইম টাইম নাই। ফলো আপ স্টোরি নাই। নাই ঘন্টাখানেক কোনো সবজান্তা সেলিব্রিটিময় কচকচানি।

ওরা থাকে ওধারে। ৪০ হাজার ঝুপড়ি উচ্ছেদ করতে হবে। আদেশ দিয়ে গেছেন মহামান্য বিচারপতি অরুণ মিশ্র। রেললাইনের ধারে থাকা দুই লাখ মানুষ পুনর্বাসন ছাড়াই উচ্ছেদ হয়ে যাবেন। কোনো উদ্বেগ নেই তেমন।

কৃত্রিম এক উদ্বেগ নির্মাণ প্রচেষ্টা চলছে। লক্ষ্য মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া। দেশের মূল সমস্যা এখন বেকারি, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, ১২ কোটি শ্রমিক ও ২ কোটি ১০ লাখ সাদা কলারের, মাসিক বেতনভোগীর কাজ চলে যাওয়া। সমস্যা, সরকারি মতে, - ২৩.৯% জিডিপি, বেসরকারি মতে আরো অনেক বেশি। জিডিপি কম হওয়া, ব্যাঙ্ক ও প্রভিডেন্ট ফান্ডে সুদ কমা, রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, তৈলক্ষেত্রে ব্যাপক ছাঁটাই। কিন্তু তা থেকে দৃষ্টি সরাতে সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যাকে হত্যাকাণ্ডের প্রচার দেওয়া, রিয়া চক্রবর্তী, কঙ্গনা রানাওয়াত ইত্যাদি বিষয়ে লাগাতার প্রচার। চীন বহু বর্গ কিলোমিটার জমি দখল করে আছে লাদাখে, অরুণাচল প্রদেশের ভিতরে চীনা সেনার আনাগোনা, ডোকলামে ঘাঁটি গাড়ছে - আলোচনা প্রায় উধাও।

দেশে প্রতিদিন ৯৭ হাজারের বেশি করোনা রোগী, রোজ ১১০০ র বেশি মৃত্যু। পাশে পাকিস্তান করোনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে। প্রশংসা করছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। কীভাবে? সেখানে তো তেমন দীর্ঘ লকডাউন হয়নি। আসলে পোলিও টিকা কর্মীরা প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গেছেন। সমীক্ষা করেছেন। কথা বলেছেন। নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। আমাদের এখানে শুধু ভাষণ ভাষণ ও ভাষণ।

মনুবাদ বাণীপ্রধান। শারীরিক শ্রমকে ঘৃণা করতে শেখায়। রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করে। দেশীয় রাজা, জমিদার ও বৃহৎ পুঁজির এক অংশ ছিল বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা আরএসএসের মূল সহায়ক। কংগ্রেসের রাজন্যভাতা বিলোপ, জমিদারি অধিগ্রহণ, ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, বিমান, তেল ও কয়লাখনি জাতীয়করণ তারা পছন্দ করেনি। হিন্দু কোড বিল, তপশিলি জাতি জনজাতির সংরক্ষণ ছিল তাদের না-পসন্দ। শিক্ষার প্রসার তারা চায় না। আজ ক্ষমতা পেয়ে তাই সরকারি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে উদগ্র আগ্রহে নেমেছে।

ওদের মনের কথা - গুজরাট মডেল। সেই মডেল কার্যকর করছে সারা দেশে। একদিকে হিন্দু মুসলমান বিভেদ অন্যদিকে দলিত নিপীড়ন। গত ১৫ দিনে দুজন মুসলিম ও একজন দলিতকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। একজনের হাত, হরিয়ানায়, করাত দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। কাজের সন্ধানে যাওয়া মানুষটির হাতে ৭৮৬ (এলাহি ভরসা) ট্যাটু করা ছিল - এই নাকি অপরাধ।

গত ১৫ দিনে ২৬ লাখ ছেলেকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেলের সর্বভারতীয় পরীক্ষায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় ৫০% পরীক্ষার্থী পরীক্ষা কেন্দ্রে হাজির হতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যা ৭৫%। কেউ ২৫ হাজার টাকা খরচ করে পরীক্ষা কেন্দ্রে হাজির হয়েছেন, কেউ ১৬ হাজার টাকা। সুবিধাবঞ্চিত স্বল্পবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাদ গেছে। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিকেল কলেজের মালিকদের স্বার্থে এই পরীক্ষা। ইঞ্জিনিয়ারিং ও নিট পরীক্ষা এখন হিন্দি, ইংরেজি ও গুজরাটি ভাষায় দেওয়া যায়। ভাষা আতঙ্কে গত বছর এক তামিল মেধাবিনী আত্মহত্যা করেছিলেন। এ-বছর নিট পরীক্ষা হয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর। ১২ সেপ্টেম্বর তামিলনাডুর তিন পরীক্ষার্থিনী আত্মঘাতিনী।

দেশের সরকার আত্মহত্যা করছে কার্যত আদানি আম্বানির স্বার্থে। সবার আয় কমেছে আদানি আম্বানি ও বিজেপির আয় বেড়েছে। ২০১৪ তে বিজেপি ক্ষমতায় আসার সময় পৃথিবীর ৪০ তম ধনী ব্যক্তি ছিল আম্বানি। লক ডাউন পর্বে চার নম্বর। আম্বানি এখন খেলনা ব্যবসায়। তাই মোদী মন কি বাতে খেলনা নিয়ে বাণী দিয়েছেন। তাতে ডিসলাইকের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন তরুণ প্রজন্ম। এখন পর্যন্ত ১২ লাখ। আই টি সেল সক্রিয় হয়েছে। ৫০ হাজারের বেশি লাইক তবু জোগাড় করতে পারেনি। মুছে দেওয়া হয়েছে ডিসলাইক। হাজারে হাজারে। তবু অপছন্দের বিশ্বরেকর্ড। কোনো রাজনৈতিক নেতার ভিডিওতে ডিসলাইকের বিশ্বরেকর্ড ছিল ছয় লাখ। এখন এটা দ্বিগুণ। পাঁচগুণ ও হতে পারতে। ৭৬ লাখের বেশি ভিডিওটি দেখেছেন। ডিসলাইক লাইক মিলিয়ে সাড়ে ১৬ লাখ। মন্তব্য হয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজারের বেশি। তার শতকরা ৯৯.৯৯ শতাংশ বিরুদ্ধে। সচেতন সুস্থ মন্তব্য সেখানে। বিজেপি ‘হিন্দু’ ‘মুসলমানে’ দেশ ভাগ করতে চায়। বিজেপির পক্ষে দুঃখের খবর, বিরূপ মন্তব্যকারীর ৯৯% এর বেশি জন্মসূত্রে ‘হিন্দু’ সম্প্রদায়ের। তাঁরা লিখছেনঃ

ক. আমি গতবার মোদীকে ভোট দিয়েছিলাম আর দেব না।
খ. ডিসলাইক উধাও করে দেওয়া ইভিএম কেলেঙ্কারির মতোই।
গ. আমার চাকরি চলে গেছে। আত্মহত্যা ছাড়া রাস্তা নেই।
ঘ. মন কি বাত নয়, জনতা কি বাত শোনো।
ঙ. আমি আইটি সেলের কর্মী। বেতন পাইনি তাই ডিসলাইক দিলাম।

হর্ষ আন্তিল নামে একজন লিখেছেন, আমরা চাই কাজ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং হিন্দু মুসলিম ঐক্য। তাতে লাইক পড়েছে ৬৭ হাজার।

আরেকজন লিখেছেন -

কথা বলো বেকারি নিয়ে,
কথা বলো শিক্ষা নিয়ে,
কথা বলো জিডিপি নিয়ে,
কথা বলো দারিদ্র্য নিয়ে,
কথা বলো বেসরকারিকরণ নিয়ে,
কথা বলো হিন্দু মুসলিম ঐক্য নিয়ে,
কথা বলো চীন নিয়ে,
কথা বলো পি এম কেয়ার্স ফান্ড নিয়ে,
কথা বলো অতিমারি মোকাবিলা নিয়ে।

কেউ কেউ ভাবতেই পারেন, এই ডিসলাইক নিয়ে এতো ভাববো কেন আমরা। যেখানে দেশের ৮৮% ছাত্রছাত্রীর কাছে নেট নেই। অনলাইনে শিক্ষা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। ভাববো, কারণ সামাজিক মাধ্যম আন্তর্জাল ব্যবহার করে জিতেছে। আজ আন্তর্জালে ওদের পরাজয় ঘটছে। নেহরুর নামে সব বিষয়ে দোষ দেওয়া মোদী শাহ জুটির এক খেলোয়াড় অমিত শাহ বলেছিলেন, যে-কোনো ঘটনাকে আমরা ভাইরাল করতে পারি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ভাইরাসে আক্রান্ত দেশ। সেই সময় ডিসলাইক ভাইরাল হওয়া একটা সঙ্কেত। তরুণ প্রজন্ম হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব নয়, ঐক্য চাইছে - চাইছে আসল সমস্যা নিয়ে কথা হোক। ওঁদের আসল শক্তির একটা জায়গা সামাজিক মাধ্যম সেখানে এত জোর প্রভাব ফেলেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ইউ টিউবে মন্তব্য বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আর আমেরিকার সঙ্গে একটা বৈঠক ছিল মোদীর। ঘোষণা হওয়া মাত্রই ৬৮ লাখ ডিসলাইক।

মন কি বাত দেওয়ার আগে ভাষণবাজ মোদীকে একবার অন্তত ভাবতে হবে।

সংসদ প্রশ্নহীন করে দিলেও জনতা কিন্তু প্রশ্নহীন নয়।