আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

সমসাময়িক

বিজেপি-র মাঠে খেলতে নামবেন না!


ভিন্নমতের টুঁটি টিপে ধরা, গণতন্ত্র হত্যা, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র - যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন ভারত সরকারের বর্তমান কার্যকলাপকে, একটা বিষয় পরিষ্কার। বিজেপি তাদের রাজনীতির জায়গায় আপোশহীন। সেটা নীতিগত দিক হোক অথবা কৌশলগত। তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল রামমন্দির নির্মাণ, হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ। সবকটিই তারা বাস্তবায়িত করেছে। প্রতিশ্রুতির তালিকায় ছিল এনআরসি-সিএএ। সেটাও করেছে তারা। এবং করবার পথে যেটুকু বাধা এসেছে, প্রতিবাদ এসেছে, তাকে নিষ্পেষ করতে দুইবার ভাবেনি। এমনকি জয়তী ঘোষের মত শিক্ষাবিদ হোন, বা যোগেন্দ্র যাদব, অথবা সুধা ভরদ্বাজ, এমনকি ভারভারা রাওয়ের মত কবি, যেই হোন না কেন, সামান্যতম বিরোধিতা এলেই তাঁদের কণ্ঠরোধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি, নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। বিজেপি তার রাজনীতির প্রতি সৎ থেকেছে, সে রাজনীতি যত দুর্গন্ধময়ই হোক না কেন। প্রশ্ন হল, বিজেপির বিরুদ্ধে যাঁরা, আপামর উদারনৈতিক অথবা বাম জনসাধারণ, তাঁরা কি নিজেদের রাজনীতির নিশানা অভ্রান্ত রাখতে পেরেছেন?

প্রশ্নটা উঠল কারণ দিল্লি পুলিশ গত ফেব্রুয়ারি মাসের দিল্লি দাঙ্গার চার্জশিটে নাম জুড়ে দিয়েছে জয়তী ঘোষ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ, তথ্যচিত্র নির্মাতা রাহুল রায় এবং সিপিআই(এম) সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির। দিল্লির দুই ছাত্রী দেবাংগনা কলিতা এবং নাতাশা নারওয়ালের ‘ডিসক্লোজার স্টেটমেন্টস’ বা স্বীকারোক্তি হিসেবে নাকি ওই নামগুলি উঠে এসেছে। এদিকে সেই স্বীকারোক্তির নিচে দেখা যাচ্ছে এই দুই ছাত্রী স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছেন। অর্থাৎ পুলিশের সাজানো বিবৃতিকে নিজেদের বয়ান মানতে রাজি নন তাঁরা। এদিকে সেই স্বাক্ষরহীন স্বীকারোক্তিই দিল্লি পুলিশ আদালতে পেশ করে দিয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেবাংগনা এবং নাতাশার বিবৃতি হুবহু একরকম। এমনকি বানান ভুল বা ব্যাকরণগত ত্রুটিও সম্পূর্ণ এক। বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে এই বয়ান পুলিশের সাজানো। দিল্লি দাঙ্গার ঘটনায় ছাত্রনেতা উমর খালিদকে ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নাকি ১১ লক্ষ পাতার প্রমাণ আছে! উমর খালিদকে যারা হত্যা করার চেষ্টা করেছিল প্রকাশ্য দিবালোকে, তারা কিন্তু কেউ গ্রেপ্তার হননি। বহুদিন আগেই দিল্লি পুলিশ বিজেপি-র দলদাসে পরিণত হয়েছিল। দাঙ্গার সময়ে তাদের সীমাহীন অপদার্থতা ইচ্ছাকৃত কী না সেই বিতর্কেও আমরা ঢুকব না। একটা ফ্যাসিস্ট দল কীভাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদান, পুলিশ হোক বা আদালত, তাদের দখল নিয়ে নেয়, সেগুলো আপাতত সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার অঙ্গ হিসেবেই থাকুক। আমাদের প্রশ্ন একটু অন্যরকম। এবং সেটা বিজেপি-কে নয়। ব্যারিকেডের এপারে যারা আছে, সেই উদারনৈতিক সমাজকে।

প্রশ্নটা হল, আপনারা কি বিজেপি-কে এতই বোকা মনে করেন যে ভাবছেন এরকম হাস্যকর চার্জশিট তারা অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য বানিয়েছে? যে কোনো আইনজীবী ধরে ধরে এই চার্জশিটকে ভুল প্রমাণিত করে দেবেন। সীতারাম ইয়েচুরির নাম থাকা তো আরওই হাস্যকর। এমন নয় যে কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারিকে জেলে যেতে হয়নি। অতীতে বহুবার হয়েছে, এবং কমিউনিস্ট পার্টি করবার আদি শর্ত এটাই ছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মদত যোগাবেন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা, এরকম অভিযোগ অমিত শাহ সম্ভবত নিজেও বিশ্বাস করেন না। একই কথা খাটে জয়তী ঘোষ, যোগেন্দ্র যাদব বা অপূর্বানন্দ সম্পর্কেও। এঁদের কেউ কমিউনিস্ট বা বামপন্থী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউ তা নন। কিন্তু বর্তমান বিজেপি সরকারের অগণতান্ত্রিক নীতির বিরুদ্ধে সকলেই। কিন্তু বিজেপি যদি আন্তরিক হত, যাকে আমরা বলি সিরিয়াস হওয়া, তাহলে এরকম ভুলে ভরা হাস্যকর চার্জশিট পেশ করত না। তাহলে বিজেপির এই সিরিয়াসনেসের অভাব কেন?

এর কারণ হল, আসল যে জ্বলন্ত ইস্যুগুলো আছে তার থেকে বারবার মুখ ঘুরিয়ে মানুষকে অন্যান্য ফাঁপা ইস্যুতে ব্যস্ত রাখা। জিডিপি পড়ে গেছে, করোনা সামলানোয় রেকর্ড পরিমাণ ব্যর্থতার কারণে মহামারীর প্রকোপ বেড়েই চলেছে, কাজ হারিয়েছেন ইতিমধ্যেই কয়েক কোটি মানুষ, সবজিমূল্য আগুনছোঁয়া, দাম বেড়েছে রান্নার গ্যাস ও পেট্রলের, তার মধ্যে বহু সংস্থার অবাধ বেসরকারীকরণ চলছে, এমনকি সরকারী সংস্থাতেও ঐচ্ছিক অবসরের প্রস্তাব চলে এসেছে - এই পুরো ছবিটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে ভারতবর্ষের আর ব্যানানা রিপাবলিক হতে বেশি দেরি নেই। যেমনটা হয়েছিল লাতিন আমেরিকার একনায়কদের অধীনে, যারা আমেরিকার তাঁবেদার হয়ে গোটা দেশটাকে ইয়াংকি চারণক্ষেত্রের অবাধ ভূমিতে পরিণত করেছিল, আর পরিবর্তে পেয়েছিল দারিদ্র্য, অনাহার, বেকারি, এবং অতি অবশ্যই জলের বদলে কোকাকোলা। এটাও বিজেপির অ্যাজেন্ডাতেই ছিল। তাদের হিন্দুরাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডা এই নিও-লিবারাল পদক্ষেপগুলিরই অন্য পিঠ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা সম্ভব নয়। আর এই অর্থনৈতিক পদক্ষেপ থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাবার জন্য বারবার অন্য ইস্যুর অবতারণা। কখনো সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু সম্পর্কিত কুনাট্য, কখনো বা এরকম ভুয়ো চার্জশিট। এই চার্জশিট কোর্টে দাঁড়াবে না বিজেপিও ভাল করেই জানে। সেটা তাদের উদ্দেশ্যও নয়। তারা এটাকে ততক্ষণই জিইয়ে রাখতে চায় যতক্ষণ না বাজারে অন্য কোনো নতুন ইস্যু আসে, যাতে মানুষ আবার সব ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তবে এই প্রসঙ্গেই বিজেপির ক্ষমতাপ্রদর্শনের মনস্তত্বটাকেও বুঝতে হবে। তারা সম্ভবত দেখাতে চাইছে যে তারা যদি চায়, চার্জশিট ভুয়ো না আসল সেসবের পরোয়াই করে না। পরোয়া করে না গণতান্ত্রিক রীতিনীতিরও। যে কোনো ব্যক্তিকেই ফাঁসিয়ে দিতে পারে, গ্রেপ্তার করতে পারে। চার্জশিটের অসংগতি হয়ত এই কারণেই ইচ্ছাকৃত যে বিজেপি একটা বার্তা দিতে চাইছে - তারা চাইলে এই ভুলে ভরা চার্জশিট দিয়েই বিরোধী স্বর রুদ্ধ করে দিতে পারে, এবং ভবিষ্যতে আর চার্জশিটও লাগবে না। ঠিক একই জিনিস আমরা দেখেছিলাম পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের মাথায় গজেন্দ্র চৌহানকে বসানো নিয়ে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ আরো সিনেমা ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যেমন অনুপম খের বা পরেশ রাওয়াল, যাঁদের যোগ্যতা নিয়ে কারোর সংশয় থাকা উচিত নয়। কিন্তু তাঁদের বাদ দিয়েই বিজেপি বসাল গজেন্দ্রর মত নিম্নমানের অভিনেতাকে। একই বার্তা দেওয়া সেখানেও - এটা তাদের শাসন, তারা চাইলে যা খুশি তাই করতে পারে, এমনকি একটা ল্যাম্পপোস্টকেও মহান অভিনেতা বানিয়ে দিতে পারে। এই ক্ষেত্রেও, বিজেপি চাইলেই হয়ত একটা শক্তপোক্ত বয়ান বানাতেই পারত, যার মধ্যেকার ফাঁকগুলো এমন দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠত না। কিন্তু তারা সেটা না করে যে অসংগতিকেই প্রমাণ বলে চালাচ্ছে, প্রায় গায়ের জোরেই, এই শীতল বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে যে আগামীতে বিজেপি যা খুশি তাই করবার বাসনা রাখে। পারবে কি না সেটা নির্ভর করছে অন্য অনেক ফ্যাক্টরের ওপর, কিন্তু ইচ্ছেটা এখন থেকেই স্পষ্ট।

কিন্তু উদারনৈতিক এবং বামপন্থীদের কাছে যেটা প্রশ্ন - বিজেপি তার রাজনীতিতে সফল। এতটাই সফল যে একটার পর একটা ইস্যু তারা তৈরি করছে এবং সেই মত আপনারা প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। এ প্রায় বিজেপির তৈরি করা মাঠে তাদের নির্ণীত নিয়মে খেলতে নামা, যার ফলে হার নিশ্চিত। অন্যায়ভাবে দেশের অগ্রণী চিন্তাবিদ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের হেনস্থা করার বিরুদ্ধে মুখর হওয়া নিশ্চই জরুরি। কিন্তু কবে আপনাদের রাজনীতি রিঅ্যাকটিভ না হয়ে প্রোঅ্যাকটিভ হয়ে উঠবে? জিডিপি নিয়ে, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে, চিকিৎসা ব্যবস্থার ভেঙে পড়া নিয়ে কবে সংসদ অচল করবেন আপনারা? কবে নেমে আসবেন রাস্তায়, যেদিন এই ভুয়ো ইস্যুগুলি, সে বিজেপি যতই চেষ্টা করুক না কেন, সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে আর সক্ষম হবে না? যখন পরিযায়ী শ্রমিকেরা কয়েক হাজার কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, বাম নেতারা ফেসবুকে তাঁদের দুর্দশা নিয়ে লাইভ ভিডিও করে গেলেন। কিন্তু তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন না। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আইন অমান্য করে রাজপথে আগুন জ্বালালেন না। তাঁরা কেরল পশ্চিমবঙ্গে রিলিফের প্রশংসনীয় কাজ করলেন, কিন্তু সেটাকে গণ-অসন্তোষের স্তরে নিয়ে গেলেন না। সেই সময়টুকু তাঁরা বিজেপির সমালোচনায় নষ্ট করলেন। নিজেদের কর্মসূচী বিজেপির মুখ চেয়ে যতদিন স্থির করা হবে, ঠিক ততদিন বিজেপি একটার পর একটা গোল দিয়েই যাবে এবং প্রবল আত্মবিশ্বাসে বুঝে নেবে যে হাস্যকর চার্জশিটের মত ইস্যুতেও মানুষকে ভুলিয়ে রাখা সম্ভব। কারণ বিজেপির আর্ধেক কাজ তো বিরোধীরাই করে দিচ্ছেন ! বিজেপির প্রাণভোমরা কিন্তু ওখানেই লুকিয়ে আছে। যেদিন তাদের এক পা পিছু হটে রিঅ্যাকটিভ রাজনীতির জায়গায় যেতে হবে, যা বর্তমানে বিরোধীদের এলাকা, সেদিনকেই বিজেপির শেষ। সেটা কবে আসবে, তা নির্ভর করছে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির নিশানা কতটা আন্তরিক ও অভ্রান্ত, তার ওপর।