আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’


তিনি বুঝতে পারেননি। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জো বাইডেন বুঝতে পারেননি যে তাঁর দেশে বর্ণবৈষম্য আজও এত রমরমা, এত নিদারুণ, এত ভয়ঙ্কর। “আমি ভেবেছিলাম আমাদের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, আমরা তো একজন আফ্রিকান-আমেরিকানকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ঘৃণাকে শুধু জয় নয়, খতম করে দিয়েছি; এখন দেখছি তা নয়।” এখন মানে গত ২৫ মে থেকে। যেদিন মিনিয়াপোলিস শহরের একজন পথচারী অপটু হাতে একটা সাত মিনিট ছেচল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিও তোলেন রাস্তার ওপর একটি গ্রেপ্তারির ঘটনার। এবং তোলপাড় করে দেন গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে।

হাড় হিম করা এই ভিডিওয় দেখা যায় এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ নির্বিকার চিত্তে এক নিরস্ত্র কৃষ্ণবর্ণ পুরুষের গলার ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে, বন্দীর “নিঃশ্বাস নিতে পারছি না” কাকুতিতেও কোনো হেলদোল নেই তার, এবং আরও তিনজন পুলিশ, সমানই শ্বেতাঙ্গ, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। আস্তে আস্তে, সবার সামনে, ৪৬ বছরের জর্জ ফ্লয়েডের দম সত্যিই বন্ধ হয়ে যায়, চিরকালের মত। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নাকি এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে একটা জাল নোট চালান করেছিলেন।

প্রতিবাদে ফেটে পড়ে গোটা আমেরিকা, কিন্তু এবার, তাদের কৃষ্ণাঙ্গ সতীর্থদের আশ্চর্য ও আনন্দিত করে, দলে দলে যোগ দেয় শ্বেতশুভ্র আবালবৃদ্ধবনিতারা। অতিমারি উপেক্ষা করে মানুষের ঢল নামে রাস্তায় রাস্তায়, এমন কী শ্বেতাঙ্গ প্রধান শহরেও। বর্ণবিদ্বেষ বিষয়ক বইয়ের বিক্রি বেড়েছে হু হু করে (সবচেয়ে বিকোচ্ছে ‘হাউ টু বি অ্যান অ্যান্টিরেসিস্ট’ বা বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী হবার সহজ পাঠ), সাদাদের বাগানে দেখা যাচ্ছে কালোদের সমর্থনে প্ল্যাকার্ড/পোস্টার, গায়ে ঐ জাতীয় বার্তাবহ জামা। বড় বড় কোম্পানিরা পর্যন্ত উঠে পড়ে লেগেছে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি তাদের সমবেদনা প্রকাশ করতে। বিভিন্ন জনমত সমীক্ষায় ৫২-৫৫ শতাংশ সাদারা স্বীকার করেছে যে তাদের তুলনায় কালোদের জীবন অনেক বেশি কঠিন এবং অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের হাতে হেনস্তা হতে হয় শুধুমাত্র তাদের চেহারার জন্যে। কিছুদিন আগেও এই সংখ্যাগুলি ৩৫ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করত।

যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম মর্মান্তিক ঘটনা নতুন কিছু নয়, বরং আকছারই ঘটছে। ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদের ১৫৫ বছর পরও আফ্রিকা থেকে হরণ করে আনা মানুষের উত্তরসূরিদের জীবন দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা, অবমাননা, নির্দয় নিষ্ঠুর অন্যায় অত্যাচারে ভরা, এক কথায় দুর্বিষহ। সমাজের বঞ্চনা, অবজ্ঞা, বিতৃষ্ণা বিকট রূপ নেয় পুলিশের আচারব্যবহারে। ২০১৮ সালে, এক নিউ ইয়র্ক শহরেই পুলিশ যাদের দেখতে সন্দেহজনক মনে করেছিল তাদের মধ্যে ৮৮ শতাংশের গায়ের রঙ ছিল ময়লা; পরে তাদের ৭০ শতাংশই নির্দোষ প্রমাণিত হয়। শিক্ষাদীক্ষা, সাফল্য কিছুতেই কিছু এসে যায় না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে পুলিশ তাঁর নিজের বাড়ির সামনে জেরা করেছিল এই সম্ভ্রান্ত পাড়ায় তিনি কী মতলবে, পরিচয়পত্র কই, ইত্যাদি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে এ সবের জন্য কারও কোনো শাস্তি হয় না, এমন কী খুনে পুলিশদেরও না।

আদালতে গিয়েও লাভ নেই। জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ হলেও, জেলে কৃষ্ণাঙ্গ কয়েদী প্রায় ৪০ শতাংশ। একই অপরাধের জন্যে সাদাদের যদি সাজা হয় এক মাস তো কালোদের হয় ১৯.১ মাস, অর্থাৎ প্রায় বিশ গুণ বেশী। ভুল সময়ে ভুল স্থানে উপস্থিতির জন্যে একজন কৃষ্ণাঙ্গের সাজা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, অন্য দিকে স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণ-কেশী আহ্লাদী দুলালের ধর্ষণের জন্য হাজতবাস করতে হয় মাত্র ছয় মাস। আর মৃত্যুদণ্ড, সেখানেও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবল আধিপত্য। এতটাই যে অনেকে শুধু এই কারণেই প্রাণদণ্ড খারিজ করার দাবি জানিয়েছেন। আইনের দেশ বলে বড়াই করে যে আমেরিকা, অন্যদের তা নিয়ে জ্ঞান দেয় যে আমেরিকা, সেই আমেরিকাতেই সাদাদের জন্যে আইন চলে এক পথে, কালোদের জন্যে অন্য পথে।

কিন্তু সহ্যের সীমা আছে। সেই সীমার বাঁধ ভেঙেছে আগেই, নতুন মোড় নিতে শুরু করে সাত বছর আগে। এমনই আরেকটা মৃত্যুকে ঘিরে। শীতের সন্ধ্যা, সতের বছরের ট্রেভন মার্টিন হনহন করে বাড়ি ফিরছিল যখন এলাকার নিরাপত্তারক্ষী তার পথরোধ করে এবং, তার উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে, গুলি করে মেরে ফেলে। পুলিশ আসে, নিরাপত্তারক্ষীর বক্তব্যই ধার্য হয়। ট্রেভন মার্টিন কৃষ্ণাঙ্গ, নিরাপত্তারক্ষী শ্বেতাঙ্গ, অতএব আর কী বলার আছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সব জানাজানি হয়ে যায়, টগবগিয়ে ফুটে ওঠে সারা দেশ। অবশেষে, খুনের পঁয়তাল্লিশ দিন পরে, গ্রেপ্তার করা হয় নিরাপত্তারক্ষীকে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে, ২০১৩-র জুলাইয়ে, আদালত বেকসুর খালাস দেয় তাকে। সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে ভেসে ওঠে একটি টুইট, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার বুকফাটা আর্তনাদঃ ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। কালোরা ফেলনা নয়, তাদের জীবনের মূল্য আছে। জন্ম নেয় ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন।

জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস হত্যা নিয়ে আন্দোলনের যে ঢেউ উঠেছে তারও মূলে রয়েছে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। নতুন যুগের এই আন্দোলনের কোনো একজন অবিসংবাদিত নেতা নেই, কোনো একটি সংগঠন নেই, বরং টেনে এনেছে নানা সমভাবাপন্ন সংগঠনকে, সাবেকি সংবাদমাধ্যম নয়, তাদের প্রচারের হাতিয়ার হচ্ছে নয়া জমানার সোশাল মিডিয়া। আজকের আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষ বিরোধিতার, কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশের একটিই মন্ত্রঃ ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। এই তিনটি শব্দ, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, বারবার বলতে হয় কারণ আইনের চোখে, পুলিশ-প্রশাসনের চোখে, এমন কী সমাজের চোখে, কৃষ্ণাঙ্গ জীবনের কোনো মূল্য নেই বলেই মনে হয়। তাই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার শুধু যে জর্জ ফ্লয়েডের জন্য সুবিচার চায় তাই নয়, তারা চায় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশি জুলুম বন্ধ হোক, তারা চায় আইন আইনের পথে চলুক, অভিযুক্তের গায়ের রঙের ভিত্তিতে নয়।

উত্তেজনা এমনই তুঙ্গে যে নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে মনে করা হচ্ছে একটি সন্ধিক্ষণ। এই ভোটেই ফয়সালা হয়ে যাবে আমেরিকার সংবিধানে “সৃষ্টিকালে সব মানুষ সমান” বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, সবাইকে নাকি শুধু শ্বেতাঙ্গদের ? অঙ্কটা সহজ। এক দিকে আছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্প যিনি দাবি করেন তাঁর মতো “বর্ণবৈষম্য-বিরোধী লোক সারা পৃথিবীতে আর একজন নেই” কিন্তু রাটি কাড়েন না যখন তাঁর সবর্ণ জাত্যাভিমানীরা সদর্পে, বন্দুক উঁচিয়ে, সরবে ন্যক্কারজনক বর্ণবিদ্বেষী বুলি আওড়ে দাপিয়ে বেড়ায়, প্রতিবাদীদের প্রাণনাশও করে। আর ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে যারা রাস্তায় নেমেছিল তাদের গাল দেন “গুণ্ডা, বদমাস, লুঠেরা” বলে, তাদের শক্ত হাতে দমন করা হচ্ছে না বলে ভর্ৎসনা করেন স্থানীয় নেতাদের এবং, সেই সুযোগে, নির্বাচনের মুখ্য ইস্যু হিসেবে আঁকড়ে ধরেন আইনি শাসনকে। অন্যদিকে বাইডেন, যিনি নিজেকে জাহির করছেন বর্ণবিদ্বেষের সংহারক হিসেবে, অঙ্গীকার করেছেন যে “জাতীয় চরিত্র থেকে বর্ণবিদ্বেষের কলঙ্ক” মুছে দেবেন, উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্যে বাছাই করেছেন শ্যামাঙ্গী কমলা হ্যারিসকে। এবং শোনা যাচ্ছে তাঁর জেতার সম্ভাবনা প্রবল।

দুশ্চিন্তা এখানেই। নির্বাচনকে এত দীর্ঘস্থায়ী, সুদূরপ্রসারিত, জটিল সমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে দেখা শুধু অবাস্তবই নয়, বিপজ্জনকও বটে। বাইডেন যদি জেতেন উদারমনা শ্বেতাঙ্গরা ভাববেন তাদের কর্তব্য শেষ, আর কিছু করার নেই। অন্তত ফের কয়েকটা ফ্লয়েড কাণ্ড না ঘটা পর্যন্ত। কারণ এরকম ঘটনা আবারও ঘটবে, বারবার ঘটবে। বর্ণবৈষম্য তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মজ্জাগত। তাই শুধু পুলিশকে দোষ দিয়ে, পুলিশ-প্রশাসনের সংস্কার করে সমস্যার সমাধান হবে না। পুলিশ তো সমাজের মানসিকতাই প্রতিফলিত করে। আর আমেরিকার সমাজ, মানে শাসককুল অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ সমাজ, এমন কী উদারমনা শ্বেতাঙ্গরাও মুখে সমতার কথা বললেও কাজে তা পরিণত করতে বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি। আমেরিকার সমাজ এখনও বর্ণের ভিত্তিতে খুবই বিভাজিত। সাদারা বাস করে মূলত সাদাদের অঞ্চলে, কালোরা কালোদের; সাদারা পড়ে মূলত সাদাদের ইস্কুলে, কালোরা কালোদের। ৭৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গদের আত্মীয়বন্ধুদের গায়ের রঙও তাদেরই মতন। ইস্কুলের পাঠ্যপুস্তকে লেখা আছে আফ্রিকা থেকে আগত মার্কিনিদের স্বাভাবিক পরিবেশ হচ্ছে ক্রীতদাস প্রথা যার দৌলতে তাদের আজন্ম লালনপালনের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিত দরদী মালিকরা। এ নিয়ে তেমন আপত্তি শোনা যায় না। দেশের মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘লগ ক্যাবিন টু হোয়াইট হাউস’, যে কোনো অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব, নিজের ভাগ্য নিজেই নির্ধারণ করা যায়। অতএব কৃষ্ণাঙ্গরা যদি পিছিয়ে পড়ে থাকে সেটা তাদের অপদার্থতা, অকর্মণ্যতার প্রমাণ।

এই সব ধ্যানধারণা বদলাতে হলে শ্বেতাঙ্গদের যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যেমন, নিজেদের পাড়ায় নিচুতলার মানুষদের জন্য স্বল্প দামের আবাসনকে স্বাগত জানাতে হবে যদিও তার ফলে তাদের জমির দাম পড়ে যাবে; সন্তানদের মিশ্র ইস্কুলে পাঠাতে হবে, রক্ষণশীলদের সঙ্গে নতুন পাঠ্যপুস্তকের জন্যে লড়াই করতে হবে, স্বীকার করতে হবে যে অনেকের ঐতিহাসিক কারণে, সামাজিক কারণে সাহায্যের হাত প্রয়োজন, সেটা তাদের অক্ষমতা নয়। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের জন্য এতটা দাম দিতে কজন রাজি হবে ? বিশেষ করে যখন শ্বেতাঙ্গ জাত্যাভিমানীরা কব্জির জোর দেখিয়ে ঘোষণা করে দিয়েছে সূচ্যাগ্র মেদিনী ছাড়তে রাজি নয় তারা। আর বাইডেন তো ঐ উদারমনা শ্বেতাঙ্গদেরই একজন যারা উদাত্ত কণ্ঠে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বলে কিন্তু কাজের বেলায় ঢুঁঢু।