আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা


‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য,
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’।


এই কবিতা রচিত হওয়ার বহু দশক পরে আজকের কবি যদি ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিকে কবিতার পংক্তিতে বর্ণনা করার কথা ভাবেন, তবে উপরোক্ত অমর শব্দগুলির আবেশ কাটিয়ে তিনি নতুন কোনো ভাবের অবতারণা ঘটাবেন এমন নাই হতে পারে। তার কারণ শুধুমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কলমের জোর নয়, বা এই লাইনগুলি বাংলা ভাষার প্রবাদে পরিণত হয়েছে তার জন্যও নয়। অন্যকোনো ভাব আনা সম্ভব নয়, বস্তুগত কারণে। ভারত বর্তমানে সত্যিই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

এই ধ্বংসলীলা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। দেশের অর্থব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন ২০২০), বিগত বছরের তুলনায় ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) হ্রাস পেয়েছে ২৩.৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে যদি ভারতের জিডিপি-র পরিমাণ হয়ে থাকে ১০০, তবে ২০২০-২১-এর সমসময়ে জিডিপি নেমে এসেছে ৭৬-এ। এহেন বিপুল উৎপাদন সংকোচন ভারতের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। শুধু তাই নয়, ১৯২৯ সাল থেকে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাপী মহামন্দার সময়েও এহেন বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সংকোচন দেখা যায়নি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে।

সরকার পক্ষ যথারীতি নির্বিকার। তাদের মতে, ‘ঘাবড়াও মত’। কোভিড মহামারীর প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে যেই লকডাউন করতে হয়েছিল, তার ফলে অর্থব্যবস্থা থমকে যায়। এরই ফলশ্রুতি জিডিপি-র এই বিপুল সংকোচন। জুন মাস থেকে যেহেতু লকডাউন প্রত্যাহার করা হয়েছে, অর্থব্যবস্থা সচল হয়েছে। তাই অচিরেই ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি আবার গগনচুম্বী হতে চলেছে। অতএব, হে ভারতবাসী, নিশ্চিন্তে থাকুন, সরকারের গুণগানে ব্যস্ত থাকুন।

এই দাবিগুলি সর্বৈব মিথ্যা। ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার কোডিড মহামারি শুরু হওয়ার দুই বছর আগে থেকেই লাগাতার নিম্নগামী। ২০১৮-১৯ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ভারতের বৃদ্ধির হার ছিল ৭ শতাংশ, যা লাগাতার কমতে কমতে কোভিড মহামারি ভারতে শুরু হওযার আগেই ২০১৯-২০ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে (মার্চ ২০২০) ৩ শতাংশে নেমে আসে। অর্থব্যবস্থার সর্বত্র মন্দার ছায়া ঘনিয়ে আসে। কিন্তু সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যার অভিঘাতে যখন কোভিড মহামারী আমাদের দেশে আছড়ে পড়ে এবং অপরিকল্পিত লকডাউন ঘোষিত হয়, তখন অর্থব্যবস্থার গঙ্গাপ্রাপ্তি অবশ্যম্ভাবী ছিল।

ভারতে লকডাউন ঘোষণা করা হয় যখন গোটা দেশে কোভিড রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬২। আজ দৈনিক এক লক্ষের কাছাকাছি কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আর সরকার লকডাউন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। একদিকে, কোভিড সংক্রমণের গতি কমাতে সরকার সর্বৈব ব্যর্থ। অন্যদিকে, ২০২০ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে বিশ্বের সমস্ত দেশের মধ্যে ভারতের জিডিপি সর্বাধিক সংকুচিত হয়েছে। চীনে এই সময়ে জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.২ শতাংশ, যেই দেশে কোভিডের জন্ম এবং যেখানে সরকার প্রবল গতিতে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ৯.১ শতাংশ, জাপানে, ৯.৯ শতাংশ, ইতালিতে ১৭.৭ শতাংশ, ব্রিটেনে ২১.৭ শতাংশ। আর ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লয়ে ২৩.৯ শতাংশ জিডিপি সংকুচিত করেছে। কেন ভারতের এই করুণ অবস্থা হল?

প্রধানত দুটি কারণে আজ ভারতের এই হাঁড়ির হাল হয়েছে। সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে লকডাউন ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ১৮ দিনের আর করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ২১ দিনের। ২৫ মার্চের পরে বহু একুশ দিন কেটে গেছে করোনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যুদ্ধ শেষ হয়নি। পৃথিবীর সমস্ত দেশে সংক্রমণ বেড়েছে, লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, তারপরে সংক্রমণের রেখা নিম্নগামী হয়েছে। ভারতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে যখন সংক্রমণ প্রায় নেই। আর যখন সব খুলে দেওয়া হচ্ছে তখন হুহু করে সংক্রমণের হার বাড়ছে। কিন্তু মোদীর ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতির জৌলুস বাড়াতে বিশ্বের কঠোরতম লকডাউন হয়েছে ভারতে। কিন্তু লকডাউন হলে যে অর্থব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে সবাই জানত। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ প্রায় সমস্ত দেশ বিপুল পরিমাণ সরকারী ব্যয় করে অর্থব্যবস্থার পতন সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাতেও অধিকাংশ দেশে শেষরক্ষা হয়নি। কিন্তু ভারতে ঘটা করে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও, আদতে সরকারী প্রত্যক্ষ খরচের পরিমাণ জিডিপি-র মাত্র ১ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের তথ্য অনুযায়ী প্রায় সর্বনিম্ন। তাই আশ্চর্যের হওয়ার কিছু নেই যে ভারতের জিডিপি পতনের হার সর্বাধিক।

জিডিপি-র যে সমস্ত ক্ষেত্র সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে উৎপাদন শিল্প বা ম্যানুফাকচারিং (৩৯.৩ শতাংশ হ্রাস), নির্মাণ শিল্প (৫০.৩ শতাংশ হ্রাস), খুচরো বা পাইকারি ব্যাবসা, হোটেল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি (৪৭ শতাংশ হ্রাস)। এই ক্ষেত্রগুলিতে কৃষির পরে সর্বাধিক কর্মসংস্থান হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলি যখন কার্যত ধসে গেছে তখন স্বাভাবিকভাবেই বলা যেতে পারে দেশে এক বৃহৎ বেকারত্বের সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে অসংগঠিত শিল্প বা দিনমজুরদের কাজ চলে গেছে। কিন্তু লকডাউন ওঠার পর থেকে তারা হয়ত নিম্নগোত্রীয় কিছু কাজে নিজেদের নিযুক্ত করতে বাধ্য হয়েছেন, পেটের তাগিদে। কিন্তু CMIE-র তথ্য থেকে পরিষ্কার যে বিপুল সংখ্যক চাকুরিজীবির কাজ চলে গিয়েছে। তাদের গণনা বলছে, ২.১ কোটি বেতনভোগী চাকুরিজীবি বিগত ৫-৬ মাসে কাজ হারিয়েছেন। শুধুমাত্র জুলাই মাসে চাকরি হারিয়েছেন ৪৮ লক্ষ মানুষ, আগস্টে আরো ৩৩ লক্ষ। মধ্যবিত্ত মানুষেরও বেতন কাটা হচ্ছে, বিনা নোটিশে কর্মস্থল থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, ড্রাইভার, শিক্ষক ইত্যাদি। কিন্তু দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা খবরের কাগজে নির্লজ্জের মতন নিবন্ধ লিখছেন যে অর্থব্যবস্থা নাকি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে!

অর্থব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গায় যে আছাড় খেয়ে পড়েছে, তার প্রমাণ দাখিল করতে হলে আমাদের আরো কিছু তথ্যের দিকে তাকাতে হবে। প্রথমত, দেখা যাক জিএসটি-র কর সংগ্রহের হাল। জুন মাস অবধি যে ভারতের অর্থব্যবস্থা গভীর মন্দায় পড়েছে, তা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। জুন মাসে জিএসটি বাবদ মোট কর আদায় হয়েছিল ৯০৯১৭ লক্ষ কোটি টাকা। জুলাই মাসে তা কমে হয়েছে ৮৭৪২২ কোটি টাকা, আগস্টে এই নিম্নগামীতা বজায় রেখে জিএসটি বাবদ কর আদায় হয়েছে ৮৬৪৪৯ কোটি টাকা। প্রত্যেক মাসে জিএসটি-র কর আদায় কমছে, অর্থাৎ পণ্যের বিক্রয় কমছে, কারণ মন্দাবস্থা বজায় আছে। দ্বিতীয়ত একটি অর্থব্যবস্থা যদি গতিশীল হয়, তবে পেট্রোল, ডিজেলের মতন জ্বালানির চাহিদা বাড়বে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দেশে মোট জ্বালানির চাহিদা কমছে। জুন মাসে ভারতে মোট জ্বালানি খরচ হয়েছিল ১.৬২ কোটি মেট্রিক টন, যা জুলাই মাসে কমে হয়েছে ১.৫৬ কোটি মেট্রিক টন এবং আগস্টে মাসে এই পরিমাণ আরো হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১.৪৪ কোটি মেট্রিক টন। অর্থাৎ অর্থব্যবস্থার চাকা আরো স্তব্ধ হয়ে আসছে। আগামীদিনে এই প্রবণতা বজায় থাকলে সরকারের ভাঁড়ার শূন্য হয়ে যাবে, বেকারত্বের হার আরো বাড়বে, বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাবেন, দেশে এক অভূতপূর্ব সংকট তৈরি হয়েছে।

কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, অর্থব্যবস্থার এই সংকটের জন্য কোভিড দায়ি। সরকারের নীতিকে দোষ দেওয়া পক্ষপাতদুষ্টতার পরিচয়। এই নালিশের কোনো সারবত্তা নেই। আমরা আগেই বলেছি, কোভিড মহামারী শুরু হওয়ার পূর্বেই দেশের অর্থব্যবস্থা সংকটাচ্ছন্ন ছিল, যার মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমনকি, এই ভয়াবহ মন্দার মধ্যেও সরকারের যেটা প্রধান কাজ হওয়া উচিত, সরকারী খরচ বাড়ানো, সেখানেও মোদী সরকার কৃপণ। ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুলাই মাসে মোট সরকারী খরচের পরিমাণ ছিল ৯.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা যা ২০২০ সালের সমসময়ে বেড়ে হয়েছে মাত্র ১০.৫৪ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এই বিপুল মন্দার মধ্যে, গত বছরের তুলনায়, সরকারী খরচ বেড়েছে মাত্র ১.০৭ লক্ষ কোটি টাকা, যার অধিকাংশই ব্যয় হয়েছে বেতন দিতে। নতুন লগ্নী, নতুন কর্মসংস্থান বা নতুন হাসপাতাল বানানোর জন্য সরকার প্রায় কোনো খরচ করেনি।

উলটে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেচে দেওয়াই এখন সরকারের প্রধান নীতি। রেল থেকে এয়ার ইণ্ডিয়া, বিমান বন্দর থেকে জীবন বিমা, খনি থেকে জঙ্গল, শিক্ষা থেকে চিকিৎসা, সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তিকে একে একে বেচে দিচ্ছে মোদী সরকার। কোভিড আতঙ্কে মানুষ সমবেতভাবে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। সরকার সেই সুযোগের সদ্‌ব্যবহার করছে। আত্মনির্ভর ভারতের নামে মোদী সরকার বর্তমানে আন্তর্জাতিক ও দেশী পুঁজির হয়ে নিলামকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। কিন্তু সমস্ত কিছু বেচে দিয়ে মোদী তাঁর মিত্রদের ধনসম্পত্তি বাড়ালেও যেই গভীর মন্দায় ভারতের অর্থব্যবস্থা পড়েছে, তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।

অর্থব্যবস্থার এই ধ্বংস সাধনের সঙ্গে সঙ্গে চলছে দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান, সাংবিধানিক কাঠামোকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। সিবিআই, ইডি, দিল্লি পুলিশের মতন সংস্থাগুলি বর্তমানে আরএসএসের দলদাসে পরিণত। দেশের বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলছেন প্রাক্তন বিচারপতি-সহ সাধারণ মানুষ। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সমস্ত বিরোধী কন্ঠকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে একের পর এক প্রতিবাদীকে জেলে পোরা হচ্ছে অথবা তদন্তকারী সংস্থার মাধ্যমে হেনস্থা করা হচ্ছে। দেশের সংবাদমাধ্যমের অধিকাংশ বর্তমানে এই গণতন্ত্র বিরোধী, স্বৈরাচারী, অপদার্থ সরকারের স্তবগানে ব্যস্ত। অর্থব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। সরকারেরও নেই। তাই অম্লানবদনে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে পারে যে কতজন শ্রমিক লকডাউনের সময় বাড়ি ফিরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, অতএব ক্ষতিপূরণেরও প্রশ্নও অবান্তর। সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্ব বাতিল হয়েছে। সংসদও যদি প্রশ্নহীন থাকে তবে গণতন্ত্রও যে ধ্বংসের মুখে সেই কথা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করতে হয় না।

এহেন পরিস্থিতিতে, মিছিলেই খুঁজতে হবে মানুষের মুক্তি। ভারতের গণতন্ত্র, অর্থব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাঁচাতে হলে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, বৃহত্তর মানুষের ঐক্যের মাধ্যমে লড়াই করতে হবে শাসকদল ও সরকারের বিরুদ্ধে। আপাতত, সেই লড়াই ও তার জন্য প্রয়োজনীয় বিকল্প রাজনৈতিক আখ্যান খুব বেশি চোখে পড়ছে না। বিরোধীরা কীসের অপেক্ষায় রয়েছেন?