আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

পুনঃপাঠ

আমার বাবা

সুকুমারী ভট্টাচার্য


(দ্বিতীয় পর্ব)

স্কুলে বাবা পড়াতেন নবম ও দশম শ্রেণিতে। কিন্তু স্কুলের নিচের শ্রেণিতে শিক্ষক না এলে ছেলেদের প্রচণ্ড কোলাহল বন্ধ করার জন্য অন্য যে-কোনো শিক্ষককে সেই ছোটো ক্লাসে পাঠানো হত। এমনই এক নিচের ক্লাসে গিয়ে বাবা দেখেন দুটি ছেলের মধ্যে প্রবল মারামারি হচ্ছে। তার মধ্যে ছ-সাত বছরের একটি ছেলে বাবা ঢোকামাত্রই আদেশ দিল, - ‘ওকে মারো, ও আমার পেনসিল নিয়েছে।’ বাবা কিছুই করছেন না দেখে বাবার হাত ধরে টানতে টানতে হেডমাস্টারের ঘরে নিয়ে গিয়ে বাবাকে দেখিয়ে হুকুম দিল, - ‘একে মারো’। হেডমাস্টার ও বাবা যুগপৎ হেসে ফেললেন। মৌচাকে ঢিল পড়ল। ছেলেটি পরম বিরক্তি ও অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, - ‘তোমরা কেউ কোনো কাজের নয়’, বলে দু-জনকে দুটি চড় মেরে বেরিয়ে গেল।

আর একদিন বড়োদের ক্লাসে ডেঁপো ছেলেদের এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে এবং প্রত্যেকটার ভুল উত্তর পেয়ে শেষে জিজ্ঞাসা করলেন, বলো তো life is not a bed of roses মানে কী? ক্লাস চুপ। এক মিনিট পরে শেষ বেঞ্চির একটি অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ছেলে বলল, ‘আমি বলব স্যার?’ সে পরম বিজ্ঞতা ও পরিতুষ্টির সঙ্গে বলল, - ‘জীবন ফুলশয্যা নয়’।

এমন একাধিকবার ঘটেছে, বাবা না হেসে শুনেছেন। আবার অনেকে বলে যাদের মধ্যে সূক্ষ্ম বুদ্ধির চিহ্ন দেখতেন স্কুলের পরেও তাদের বহু জিজ্ঞাসার সমাধান করতেন। বাবার জীবৎকালে ওঁর কথায় কখনো জানতে পারিনি শিক্ষক হিসেবে কী বিপুল পরিমাণ শ্রদ্ধা ওঁকে ঘিরে জমে উঠেছিল। নিজের থেকে এসব কথা বলবার লোক তিনি ছিলেন না। তাই আমি ওগুলি দশক কয়েক পর বিখ্যাত কিছু ছাত্র ও তাঁর সহকর্মীদের কাছে শুনে অবাক হই।

আবশ্য সেটা আমার অজ্ঞানতা। কারণ আমাকেও তো বাবা ভারতীয় দর্শন ইতিহাস সাহিত্য কত প্রাঞ্জলভাবে কত কিছু বুঝিয়েছিলেন, সে কথা ভুলবার নয়, তখন ভাবতাম বুঝি সব শিক্ষকই এত সমৃদ্ধভাবে পড়ান। বাবার কাছে ছেলেবেলায় পড়া বোঝানোর সময় তিনি যেভাবে সহজে বোঝাতেন তার তুলনা নেই। কিন্তু অধ্যাপক বাবাকে ভালো করে চিনলাম কলেজে উঠে। জটিল কঠিন প্রশ্নের যেমন সহজে উত্তর দিতেন, যুক্তির পরম্পরা দিয়ে, তার তুলনা নেই। আজ বুঝি, বাবার ইচ্ছে ছিল আমি দর্শন ভালো করে বুঝে শেষ পর্য়ন্ত দার্শনিক হই। তিনি দর্শন অত ভালো করে পড়বার সুযোগ পাননি, পড়াতেন ইংরেজি, বাংলা ও ইতিহাস। পাশ করে যখন বললাম সংস্কৃত পড়ব তখন বাবার মুখটা বিষাদে মলিন হয়ে উঠল। দু-তিন মিনিট চুপ করে থেকে বললেন, - ‘কেন, সংস্কৃত পড়তে চাস?’ বললাম, - ‘প্রাচীন ভারত কীভাবে চিন্তা করত, যে আদর্শের নিরিখ তাঁরা রেখে গেছেন সেটা কেন কোন প্রয়োজনে বা উদ্দেশ্যে, তা জানবার জন্য সংস্কৃত পড়তে চাই। অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের চিত্তের বিবর্তন শিখতে চাই। তুমি কিন্তু আমাকে কিছু কিছু দর্শন পড়িয়ো, কারণ দর্শনও প্রাচীন ভারতের চিন্তাকে পুষ্ট করেছিল।’ শর্ত হয়ে গেল। বাবা খানিকটা খুশি হলেন।

বাবা পড়তেন খুব খুঁটিয়ে, পড়ে পুরো আয়ত্ত করতেন। ফলে আমরা তাঁর কাছ থেকে যা পেতাম সেটা এক পরিলক্ষিত সিদ্ধান্ত। পড়াতে বাবা ভালোবাসতেন। এবং পড়তেও। বাবার যুক্তিপরম্পরা গঠন থেকে শিখেছিলাম অনেক, যদিও কাজে লাগাতে পারিনি বিশেষ। কিন্তু বাবার কাছে পড়া একটা আনন্দময় প্রক্রিয়া। তার মধ্যে যুক্তির একটা সতেজ মেরুদন্ড ছিল যা কখনো কেবলমাত্র বিলাসিতা হয়ে ওঠেনি। সে মূলধন কি আজও ফুরিয়েছে? মনেও হয় না। এখনও কথা বা আলোচনার ফাঁকে মনে হয় এই ধরনের প্রসঙ্গে বাবা তো এই কথা বলতেন। ওই স্মৃতিটুকুর মূল্য অনেক। এরই মধ্যে একসময়ে বেশ খেটেখুটে হোমিওপ্যাথিক বই আনিয়ে পড়ে পরীক্ষা দিয়ে এম. ডি. হলেন এবং মাস দুয়েকের মধ্যে মানিকতলার শেষ প্রান্তে বড়ো রাস্তার ওপরে একখানি ঘর ভাড়া করে দুটি বইয়ের আলমারি কিনলেন। রোগীর আগমন প্রথম দিন থেকেই; কিছু নাম ও পরিচিতি হল; কিছু কিছু রোগও সারতে লাগল।

মাঝে মাঝে রবিবারে ছুটির দিনে আমরা ওই ডিসপেনসারিতে বসে থাকতাম। দেখতাম মাঝে মাঝেই বাবার স্থানীয় এক আজ্ঞাবহ অনুচর ছোটো ছোটো চিরকুট ও কোনো রোগীকে নিয়ে আমাদের বাড়ি যেত এবং দু-তিন কিলো চাল বা একখানি কাপড়, চাদর বা শীতবস্ত্র নিয়ে ফিরত। বাবার স্কুলের পারিশ্রমিক এমন ছিল না যে এইভাবে খয়রাতি করা যায়। মা-র এই প্রশ্নে বাবার উত্তর ছিল রোগী অনাহারে বা অপুষ্টিতে ভুগছে সে তো শুধু ওষুধে সারবে না। খাদ্যও দিতে হবে, শীতার্ত রোগীকে বস্ত্রও দিতে হবে। দিল্লির ভবানী সেনগুপ্ত (যে চাণক্য সেন নামে লিখত) বাবাকে মেসোমশাই বলত; বিশেষ সম্মান করত। এইসব কাজকে সে বিশেষ সম্ভ্রমের চোখে দেখত। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বাবার কম্পাউন্ডারের কাজ করল বেশ কয়েকমাস। অবশেষে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করল ডাক্তারখানা থেকে এ পর্যন্ত ক-পয়সা বাড়িতে এসেছে। সেই সঙ্গে মাকে পরামর্শ দিল, - ‘ও ডাক্তারখানা তুলে দিন মাসিমা, নইলে অচিরেই আপনার পরিবার দেউলে হয়ে যাবে।’ কথাটা রূঢ় বাস্তবের হলেও ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে একেবারে সত্যি। উঠে গেল ডাক্তারখানা। দুটো বইয়ের আলমারি বিক্রি করা গেল। তৃতীয়টাতে বাবার দামি ওষুধের বইগুলো রাখা হল। ডাক্তারখানা উঠে যাওয়ার পর বাবাকে মাঝে মাঝে করুণ চোখে আলমারিটার দিকে তাকাতে দেখেছি। যদিও সারা জীবন লোককে ওষুধ দিয়েছিলেন। অধিকাংশই বিনামূল্যে।

বেশ কিছু দুরারোগ্য রোগ সারাতে দেখেছি, সেগুলি সব বলবার সময় নেই। একটির কথাই বলব। যতদিন ডিসপেনসারি ছিল, আমার ছুটির দিনে প্রায়ই ওখানে বসতাম। একবার সকাল নটা নাগাদ বসে আছি, এমন সময়ে প্রকাণ্ড এক বিলিতি লিমোজিন গাড়ি সামনে এসে দাঁড়াল। একজন প্রায়-প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা নামলেন, সঙ্গে এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী। দুজনেই মুখ বিষণ্ণ। ভদ্রমহিলা নেমে এসেই বাবার পা জড়িয়ে ধরলেন, - ‘আমার একটা উপায় করো বাবা। এই মেয়েকে সাত মাসের পেটে নিয়ে বিধবা হয়েছি। ও বড়ো হতে আমাদেরই সমান মানের এক জমিদারের ছেলে ওকে বিয়ে করে। কিন্তু আড়াই বছরেও ছেলেপুলে হল না বলে ওর বাবা বলছেন এত বড়ো জমিদারবংশ শেষ হয়ে যেতে দেব না, ছেলের আবার বিয়ে দেব। আমার মেয়ের কী অবস্থা হবে, বাবা? অনেক শুনেছি তুমি বাবা ধন্বন্তরি। একটা উপায় করো বাবা। জামাই ডাক্তার দেখিয়েছে, তার নাকি কোনো দোষ নেই।’

বাবা বললেন, ‘অনেকটা দেরি হবে আপনার। কিছু খেয়ে আসুন।’ ঘন্টাখানেক পরে ফিরলেন। আমাকে দিয়ে বাবা বাড়িতে বলে পাঠালেন উনি মিষ্টি কলা খাবেন, ফিরতে অনেক দেরি হবে। বিস্তর বই নামিয়ে দেখে নোট করে অবশেষে ছটায় ওদের ওষুধ দিয়ে তিনমাস পরে খবর দিতে বললেন। তিন মাস গেল। ছ-মাস ন-মাস হল কোনো খবর এল না। বাবা খুব হতাশ হয়ে পড়লেন।

অবশেষে এক বছর দু-মাস পরে সেই লিমোজিন গাড়ি ও অন্য একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। একমাসের একটি বাচ্চা, দেবশিশুর মতো দেখতে, কোলে নিয়ে সোজা বাবার পায়ের কাছে নামিয়ে বললেন, - ‘এ হল তোমার আশীর্বাদ বাবা। তবে আশীর্বাদ করো, যেন মানুষ হয়।’ বলতে বলতে অন্য গাড়িটা থেকে বিশাল আকৃতির ছটা পিতলের বারকোশ নামল, সেগুলো থেকে নামল সোনারূপার বস্তু, দামি রেশমি বস্ত্র এবং নানান মিষ্টান্ন, পায়েস, ফল।

বাবা বললেন, - ‘মা, আমাদের পেশায় উপহার নেওয়া বারণ’। অনেক জবরদস্তির পর শুধু এক বারকোশ মিষ্টি ও পায়েস নিলেন। সে বারকোশটি এখনও আমার কাছে আছে। কিছুক্ষণ কথা বলে ওঁরা চলে গেলেন। বাবা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, - ‘যাক, ওই ওষুধটা কাজ করেছে।’

প্রসঙ্গত বলি বাবার হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। চশমার অনেক পাওয়ার ছিল। তা সত্ত্বেও একবার একটি চালে রবীন্দ্রনাথের পুরো একটি কবিতা আর একবার একটি পোস্টকার্ডে প্রকাণ্ড বড়ো এক কবিতা লিখে পুরস্কার পেয়েছিলেন।

সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ খ্রিষ্টান পরিবারে বেশ খানিকটা সাহেবিয়ানা অনুপ্রবিষ্ট ছিল। পোশাকে খাদ্যে কথাবার্তায় আচরণে এটা প্রকট হত। এই ব্যাপারটা বাবা একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। বলতেন, যে কথার বাংলা প্রতিশব্দ আছে তার জন্য ইংরেজি বলে নিজের ভাষার অপমান করব কেন? যেমন বলতেন বাঙালি বাংলা বলবে স্বাভাবিক বাংলা স্বরক্ষেপে। তার মধ্যে আগন্তুক ইংরেজি উচ্চারণের লেশমাত্র থাকবে না। বাংলা সাহিত্যের ওপরে তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল। ঊনবিংশ শতকের সাহিত্য ভালো জানতেন ও আমাদের পড়তে বলতেন, এমনকি যাদুগোপাল চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত। বলতেন এঁদের লেখা পড়লে বুঝতে পারবি মধুসূদন ও তাঁর সমসাময়িকরা কোথায় বড়ো, কেন বড়ো। বলতেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে কবিতা শোনা অদ্ভুত মোহসৃষ্টিকারী, প্রধানত তাঁর শব্দপ্রয়োগের জন্য বাবা পছন্দ করতেন কথ্য বাংলা, কিছু কিছু প্রচলিত বাগভঙ্গি সমেত। তার মধ্যে খনার বচন ইত্যাদি লোকচলিত ভাষা এক ধরনের সাবলীলতা আনে যাতে কথ্য ভাষার আকর্ষণ বাড়ে।

বাড়িতে পূজো-আচ্চা ছিল না বটে, কিন্তু তিনটি উৎসব - খ্রিস্ট জন্মদিন (বড়দিন), খ্রিস্টের পুনরুত্থানের কাহিনির দিন এবং বাড়ির সকলের জন্মদিন। এতে যার জন্মদিন সে নতুন জামাকাপড় পেত। একটু ভালো খাবার ও অনিবার্য ভাবে থাকত পায়েস কখনো চন্দনের ফোঁটাও দিতেন মা। কেক কখনো প্রাধান্য পেত না। প্রণামের চল ছিল, ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়। লোক নেমন্তন্ন করা কখনো, জন্মদিনটায় হলেও, সর্বদা নয়। সব মিলে পুজো-আচ্চা বাদে হিন্দু উৎসবের সঙ্গে মিল ছিল খানিকটা।

বাবার স্বাদেশিকতা কিন্তু অন্ধ ছিল না, বিদেশের যা কিছু ভালো, গ্রহণীয়, তার সম্বন্ধে মুক্ত দৃষ্টি ছিল। যা ভালো তা কেন ভালো বুঝিয়ে দিতেন এবং নিজেদের জীবনে তার স্থান করে দিতে শেখাতেন। সব যে পেরেছি তা নয়, কিন্তু বাবার উদ্দেশ্য ও মনোভাব বুঝে নিতে পারতাম।

এই কারণে ভালো বিদেশি সাহিত্যে আমাদের অনুরাগ জন্মায় তারও চেষ্টা করতেন। মা বাবা দু-জনেই বেহালা বাজাতেন। দু-জনেই দুটো বেহালা বিবাহের উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। দু-জনেই ছবি আঁকতেন। প্রতিকৃতিই শুধু, একটুও উঁচুদরের নয়, তবে ওই আগ্রহটা আমাদের আকৃষ্ট করত। দরিদ্র সংসারে সারা দিনের পর একটু সময় বের করে নিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে শিল্পজগতে একটুখানি পা রাখতে পেরে দু-জনেই কৃতার্থ বোধ করতেন। কোনো অর্থেই আমাদের বাড়িটা শিল্পচর্চায় লিপ্ত ছিল না। কিন্তু শিল্প যে জীবনবোধের মানকে খানিকটা উঁচুতে তোলে সেটা সম্বন্ধে আমরা যাতে অবহিত হই সেই চেষ্টাটুকু ছিল। মা আমাকে বড়ো শিল্পীদের প্রদর্শনীগুলিতে নিয়ে যেতেন এবং দু-তিনঘন্টা সময় ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে কাটাতেন। এতে আমি শিল্পানুরাগী হয়ে উঠিনি। কিন্তু আজ বুঝি যে জ্ঞান হয়ে অবধি এতে মুগ্ধ হতে শিখেছি। শিল্পী শম্ভুমামাকে (রবীন্দ্রনাথের ফোটোগ্রাফার শম্ভু সাহা) বলেছি সে কথা। ওঁর পরিচিত যন্ত্রশিল্পী কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এসে এসরাজ বাজিয়েছেন। শম্ভুমামাও বাঁশি বাজাতেন। ছবিও আঁকতেন। ওই সময়টা একটা উচ্চতর পরিবেশে চলে যেত মনটা। বাবা শান্তিনিকেতনের উচ্চতর পরিবেশের উচ্চতর স্তরে মনটাকে নিয়ে যেতে পারতেন, কবিতা নাটক আবৃত্তিগানের কিছু প্রভাব রয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনে। এটা টের পেতাম গান, কবিতা ইত্যাদি শোনার সময়ে তাঁর মুগ্ধ তন্ময় দৃষ্টিতে। অথচ গদগদ ভাবটা একেবারেই ছিল না। ছিল শ্রাদ্ধাপ্লুত তম্ময়তা। এই সময়টাই কেমন করে যেন ধীরে ধীরে অবচেতনে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে তা বুঝতে পরেছিলাম।

বছরে প্রায় আট-ন মাস প্রতি শনিবারে বাবা আমাকে জাদুঘর দেখাতে নিয়ে যেতেন। এমনিতেই বাবা ইতিহাসে আকৃষ্ট ছিলেন, স্কুলের ওপরের তিন ক্লাসে পড়াতেনও। আমাকে প্রাচীন গ্রিস, রোম ও আলেকজান্দ্রিয়া, চীন এসব দেশের প্রত্নবস্তু দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতেন সেগুলি কোন ঐতিহাসিক পরিবেশে নির্মিত হয়েছিল। আর একটি জিনিস আমি প্রায় প্রত্যেক বারই দেখতাম, সেটা হল পাথরের গায়ে লতাপাতার ছোপ। সে লতাপাতা ঝরে গেছে, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব ছাপ রেখে গেছে। সে যে কী সুন্দর দেখতে। এখনও মনে গাঁধা তাদের মনোহারিণী রূপরেখাগুলি। প্রাচীন ঐতিহাসিক বস্তু নিয়ে সারা সপ্তাহ পড়ে শনিবারে আমাকে তাদের উৎপত্তির বিবরণ শোনাতেন। জাদুঘরযাত্রাটা আমার কাছে তীর্থযাত্রার মতো ছিল। কী আগ্রহ নিয়েই না যেতাম এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতাম। অতি প্রাচীন ইতিহাসকে তাঁর বিবরণে কেমন যেন জীবন্ত করে তুলতেন, তার কিছু কিছু এখনও মনে আছে।

লেখাপড়ার ব্যাপারে বাবাকে তুষ্ট রাখা কঠিন ছিল। সামান্যতম ত্রুটিও শুধরে দিতেন। যেমন-তেমন করে কোনো কাজ করা একেবারেই পছন্দ করতেন না। একবার আমাকে বললেন, - ‘আমি কখনোই তোর কাছে এটা চাইব না যে তুই ক্লাসে প্রতিবার প্রথম হবি। আমি শুধু বলব যে পরীক্ষা দিয়ে তুই যেন নিজে বলতে পারিস এর চেয়ে ভালো করে আমি পড়া তৈরি করতে পারতাম না।’ দু-বছর পরে বাবাকে বললাম, - ‘তোমার দুষ্টুমি বুদ্ধি এবার টের পেয়েছি।’ ছোটো স্কুলে প্রত্যেকবার প্রথম হওয়ার চেয়ে অনেক কঠিন নিজের সাধনাশক্তির চরম উৎকর্ষ রাখতে পারা। পরে অবশ্য সেই চেষ্টাই করতাম।

পড়াশোনার চেয়ে অনেক বড়ো এক উচ্চমানের দাবি করতেন, যেন সব নৈতিক ও সামাজিক অর্থে পুরো মানুষ হয়ে উঠতে পারি। সেটা পারিনি। গ্লানি কোনোদিন যাবে না। আমার অভিজ্ঞতায় বাবা ছিলেন এক সম্পূর্ণ মানুষ। তাঁর কন্যা বলেই আমার যা কিছু গর্ব উচ্চাশা এবং অপূর্ণতার বোধ।

বাবার আর একটা অভ্যাস ছিল যা দেশের বাড়ি বা মামার বাড়িতে গেলে দেখা যেত। আমাদের নিয়ে সকালে বেড়াতে বেরিয়ে কামারের নেহাই, কুমোরের চাক বা পোয়ান, জেলের জাল আর তাঁতির তাঁত এগুলি দেখিয়ে নাম বলে ও কোন যন্ত্রে কীভাবে কাজ হয় তা বুঝিয়ে দিতেন। পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে টানা বেড়াজাল, খ্যাপলা জাল বা কুঁড়োলি, আরো কত রকমের জালের নাম ও কাজ বুঝিয়ে দিতেন। দীর্ঘ নগরজীবনের অভিজ্ঞতায় আজ সেসব বেশির ভাগই ভুলে গেছি। বাবা কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পেশার লোকদের ও তাঁদের পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দাদা কাকা বলে সম্বোধন করতেন। আমাদের বুঝিয়ে দিতেন এঁদের পেশাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে খাওযা পরার যোগান দিচ্ছে। বলতেন, সর্বদা এঁদের সম্মান করবি কারণ এঁরা যা তৈরি করছেন, তাই দিয়েই আমাদের দৈনন্দিন জীবযাত্রা চলছে। কত বিভিন্ন বিষয়ে যে বাবার সজাগ সশ্রদ্ধ কৌতূহল ছিল তা ভাবলে অবাক লাগে। পরে আর একটা জিনিস বুঝেছি - যাঁরা হাতে পায়ে খাটেন তাঁদের বাবা সম্মান করতেন এবং আমাদেরও তাঁদের সম্মান করতে শেখাতেন। কিছু শিক্ষা এখনও মনের মধ্যে প্রোথিত হয়ে রয়েছে।

লেখাপড়ার চেয়ে যেটাতে বাবা বেশি জোর দিতেন তা হল চরিত্র। এবং সেটাও সরাসরি উপদেশ দিয়ে নয়। নিজের আচরণ যেখানে নীতিবিচ্যুত হয়েছে মৃদুস্বরে তার একটা বিবরণ। এটা সরাসরি বকুনির চেয়ে অনেক অনেক বেশি মর্মভেদী। অনেক বাবা-মাকে দেখেছি অন্য ছেলেমেয়ের ভুলত্রুটি বিস্তারিত করে নিজের সন্তানদের শোনাতে। এতে ফল বড়ো খারাপ হত। নিজের ছেলেদের একটা আত্মতৃপ্তি যেমন জন্মাত তেমনি অন্যদের প্রতি অবজ্ঞাও বাড়ত। এইসব ক্ষতিকর উপায় ত্যাগ করে নিজের সন্তানদের আচরণটা স্পষ্ট বর্ণনা করলে ছেলেমেয়ে নিজেরাই দেখতে পায়, তাদের নিজেদের আচরণের সমালোচনা নিজেরাই করতে পারে। এটাই তাদের মনে থাকে এবং হয়তো কতকটা স্থায়ীভাবেই। বকাবকি করে মারধর করে যে সংশোধন বা শাসন তাতে গুরুজনদের ওপরে একটা প্রচ্ছন্ন ক্রোধ জন্মায়. তাতে শিক্ষাটা বঙ্কিম ও কষ্টকর অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়।

আমাদের বাড়িতে মারধর করে শাসন দেখিনি। মুখের কথায়, কখনো-বা গল্পচ্ছলে যা শাসন পেয়েছি তার অনেকটাই এখনও মনে আছে। বাবা স্বভাবে গম্ভীর ছিলেন কিন্তু হাসতে ও হাসাতে পারতেন। গল্পের মধ্যে হাসির উপাদান একটি স্নিগ্ধতা সঞ্চয় করত। স্কুলে শুনেছি বাবার পড়ানোর পদ্ধতিটা অনেকটা অন্য রকম ছিল, আগেই বলেছি সেকথা।

এমনিতেই মাঝে মাঝে অন্য কথার মাঝখানে প্রশ্ন করতেন, কেন এমন করে হল, না হলে কী হত? পদ্ধতিটা সুপ্রাচীন। প্লেটো এই পদ্ধতিতে পড়াতেন। আমাদের দেশে উপনিষদের আখ্যানগুলিতেও মাঝে মাঝে এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখতে পাই। গুরু-শিষ্য সংলাপে যখন এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখি তখন বুঝি আত্মবিশ্লেষণ ঠিক এইভাবেই হওয়া উচিত। গার্গী এই ধারায় বেশিদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন বলে যাজ্ঞবল্ক্য ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, - ‘তুমি আর প্রশ্ন কোরো না গার্গী, তা হলে তোমার মাথা খসে পড়বে।’ এটা প্রায় প্রত্যক্ষে নিজের অজ্ঞানের স্বীকৃতি। বাবা ততটুকুই ও পদ্ধতির অনুসরণ করতেন যতটায় শিক্ষার্থীর জ্ঞান বাড়ে, আত্মবিশ্বাস না কমে যায়। কখনো প্রাচীন সাহিত্যের কোনো উপাখ্যান থেকে বিশ্লেষণ করে তার যে অংশটা কাজে লাগবে তাই দিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞানের প্রসার বাড়াতেন, কখনোই তার আত্মবিশ্বাসে ঘা দিয়ে নিজের গৌরব বাড়াবার চেষ্টা করতেন না। আজ মনে হয় শিক্ষার্থীর কাছে যে শ্রদ্ধা ও ভক্তি তিনি পেতেন তাতে বেশ খানিকটা ভালোবাসাও মিশে থাকত। এই পিতাকে এত কম দিন পেয়েছি, তাঁর কাছে জ্ঞানের অনুশীলনের সময় এত কম বছর পেয়েছি যে এখনও একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে।

ধর্ম সম্বন্ধে আমাকে বিশেষ প্রশ্ন করতেন না। স্কুলের শেষের দিক থেকেই, বিশেষত কলেজের দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষ থেকে ধর্ম সম্বন্ধে নানারকম বই পড়তাম এবং নানা ধর্মের বক্তব্য এবং নানারকম দার্শনিক মতের সঙ্গে তাদের বিরোধ বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করত। এ বিষয়ে বাড়ির সকলের থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছিলাম, যদিও কাউকে না জানিয়ে। খুব কষ্ট হত, কারণ চিন্তাজগতে আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু বাবা; তাঁর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব বাড়ছিল। একদিন সাহসে ভর করে বাবাকে দুখানি বই পড়তে দিলাম। ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্বের ওপরে একটি ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে একটি। বিস্মিত হয়ে দেখলাম গভীর অভিনিবেশ নিয়ে বাবা দুটোই পড়ছেন। আমাকে শুধু বললেন, - ‘আগে এগুলো পড়তে দিসনি কেন?’ দার্শনিক গঠনের মনে ওগুলো থেকে যা পেতেন আমার পক্ষে ততটা বোঝা সম্ভব ছিল না। দেখতাম বাবা ভ্রূ কুঁচকে একমনে বই পড়ছেন, নোট নিচ্ছেন। নোটগুলো নিজেই ছিঁড়ে বা ফেলে দিয়েছিলেন। আমি রেখে দিলে আমারই লাভ হত। তা হল না। তার অল্প কিছুকালের মধ্যে বাবার মৃত্যু হয়। বুঝতে পারি, একেবারে শেষের দিকে কোনো সিদ্ধান্তের মনোভাব নিয়ে বই দুটো পড়তেন। দার্শনিক চিন্তাধারায় কৈশোরের শেষ দিক থেকেই তাঁর মনটা দীক্ষিত ছিল এবং বিজ্ঞানে তাঁর বরাবরের আগ্রহ। ফলে এই দুটো মনকে আমি যা পেয়েছিলাম বাবা নিঃসংশয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছিলেন। বাবা বাংলা ভাষার নির্ভুল প্রয়োগ সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিলেন। দুটি উপায়ে এটা নিশ্চিত করতেন। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের বাংলা প্রচুর পড়তেন, দুটো ভাষার পার্থক্য কোথায় তা দেখিয়ে দিয়ে আমাদের অবহিত করতেন। মান্য বাংলা ভাষার কাছাকাছি কথ্য ভাষা বলতে ও লিখতে শেখাতেন, কথাবার্তার মধ্যে ভুল প্রয়োগ দেখলে শুধরে দিতেন।

খ্রিস্টান সমাজ ছোটো সমাজ। ১৯৩৮ সালে তাদের যেসব ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় বিশেষ ভালো করেছিল তাদের সংবর্ধনার জন্য একটি সভার আয়োজন করেছিল। আমাদের বসিয়েছিল ঠিক মাঝখানে। প্রচন্ড ভিড়। সে ভিড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বাবা। একটি ছেলে বলল, - ‘ওই সাদা বুটিদার শাড়িপরা মহিলার সঙ্গে একবারটি দেখা করতে চাই। কী করা যায় বলুন তো।’ বাবা গম্ভীরভাবে বললেন, - ‘আমারও ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করা দরকার। দেখি ভিড়ের ওপাশ দিয়ে যদি কাছে হয়।’ বলে চলে গেলেন এবং আমাদের পরিবারের সকলকে নিয়ে বাড়ি এলেন। পথে গল্পটা বললেন। এমন বেশ কয়েকবার গম্ভীর মুখে পরিহাস করতে শুনেছি। ওঁর ছাত্ররাও তাঁর এই ধরনের কয়েকটি পরিহাসের কাহিনি মনে রেখেছেন।

বাবা সহজে কাউকে তুচ্ছ করতেন না, কিন্তু যে অন্যায়কারী সে নিজের বাড়ির লোক হলেও ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিতেন অন্যায়টা কেন অন্যায়, এবং এর পরেও সেটা হতে দেখলে কঠোর ভাবে তার প্রতিবাদ ও প্রতিবিধান করতেন। বাল্যে কৈশোরে অনেক সুশিক্ষা পেয়েছি। সব যে কাজে লাগাতে পেরেছি তা নয়। তবে যুক্তিসহ কথা বললে সাধারণত তার একটা প্রভাব পড়ে চরিত্রে।

এরই মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হল, জিনিসপত্রের দাম বাড়ল। এক স্কুলশিক্ষকের পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে বাবা গৃহশিক্ষকরে কাজ নিলেন। সকালে উঠে গোহাটা থেকে আমাদের দুধ এনে চা খেয়ে বাজার যেতেন, পরে স্নান সেরে খেয়ে স্কুলে যেতেন। সাড়ে চারটে নাগাদ ফিরে কয়েক মিনিট বিশ্রাম করে চা খেয়ে তৈরি হয়ে ছাত্রটিকে পড়াতে যেতেন। একদিন ছাত্রটির অসুখ, সে পড়বে না, তাই আমার সঙ্গে হাঁটতে বেরোলেন। সেই দিনের কর্মক্লিষ্ট মুখটা দেখে আমার একটা যন্ত্রণা হতে লাগল। একটু ক্ষুণ্ণ উত্তেজিত স্বরে বাবাকে বললাম, - ‘যাই বলো বাবা, শিক্ষকদের পারিশ্রমিক বেশ খানিকটা বেশি হওয়া উচিত। বাড়িতেও তো তাঁরা পঠনপাঠনের জন্য প্রস্তুতি নেন? বিষয়টাকে আশপাশ থকে বোঝবার জন্য? এই মানুষটাকে যদি সারাক্ষণ অন্যান্য কাজে খাটতে হয়, ভালো করে পড়াবার জন্য, তা হলে পুরো শিক্ষক জগৎটারই অবমাননা ও তাঁদের ওপরে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়। তোমাদের মর্মান্তিক দাক্ষিণাটা নেহাত কম। এটা বেশ খানিকটা বাড়লে তোমাদের দক্ষতা ও পড়ানোর তৃপ্তিও বাড়ে।’ বাবা একটু থেমে বললেন, - ‘দেখ এই শিক্ষকরা বহুকাল ধরে প্রয়োজনের তুলনায় কম টাকা পাচ্ছেন, টাকার প্রয়োজন এঁদের সত্যিই আছে। ফলে তলে তলে এঁদের লোভও জমেছে খানিকটা। হঠাৎ অনেক বেশি টাকা পেলে এঁরা হয়তো নিচু হয়ে হরির লুট কুড়োবেন। সে জন্য এখন যা পাই তার চেয়ে ততটা বেশি মাইনে হওয়া উচিত, যাতে সংসারে মোটামুটি সচ্ছলতা থাকে, কিন্তু আতিশয্য না হয়।’ বাবা দেখে যাননি, কিন্তু পরে আমরা অনেক শিক্ষককে নিচু হয়ে হরির লুট কুড়োতে দেখেছি। বেশ কিছু শিক্ষক যাঁদের সৎ বলে জানতাম তাঁদের লোভী সঞ্চয়ে একনিষ্ঠ হতে দেখেছি।

শিক্ষকরা শিক্ষা দেন দু-ভাবে; পঠনপাঠনের মাধ্যমে আর আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও। সচ্ছলতা প্রয়োজন, প্রাচুর্য নয়। তাঁর নিজের আচরণ ও আদর্শ থেকে বেশ কিছু সহকর্মী ও ছাত্রজীবনে নীতির একটা উচ্চ আদর্শ লাভ করেছেন। এ বস্তু আজকের জগতে এত বিরল হয়েছে যে বাবার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। এ আদর্শে অনুপ্রাণিত কয়েকজন বাবার সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে এই নির্লোভ সংযমের কথা বলেছেন। পরে অবশ্য দেখেছি কেউ কেউ আদর্শ নিয়ে শুরু করেও পরে অর্থসন্ধানী লোভীতে পরিণত হয়েছেন। বাবা একা নন, তখনও দেশের নির্লোভ অর্থসঞ্চয়ে বিমুখ, বরং নতুন বই ও নতুন শিক্ষার দিকে একান্ত আগ্রহী অনেকে ছিলেন। এঁরা কেউ কেউ পরস্পরের সঙ্গে শিক্ষাভ্রাতৃত্ব বজায় রেখে চলেছিলেন। বাবার মত ছিল, বুনো রামনাথ আর বিলাসী শিক্ষাকর্মীর মাঝামাঝি একটা অবস্থান অনায়াসেই নেওয়া যায়।

শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন বলে রসহীন কঠোর শিক্ষাব্রতী ছিলেন, একথা কিন্তু সত্য নয়। বাবা যথেষ্ট হাসতে এবং হাসাতে পারতেন, হয়তো এটাও তাঁর জনপ্রিয়তার একটা কারণ ছিল। ছাত্রদের উত্তরপত্রে নম্বর বা উচ্চনীচ নম্বর দেওয়া সম্বন্ধে তখনই তাঁর নিজস্ব ভিন্ন মতামত ছিল যা আজকে আবার শিক্ষাজগতে আলোচনার বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। ভালো ছাত্রের ধীরে ধীরে শিক্ষাগত অবক্ষয় ও খারাপ ছাত্রের ধীরে ধীরে উন্নতি কীভাবে হয় তা অনুসন্ধান করতেন। ছাত্রদের ডেকে গল্পের বা আলাপের মধ্যে দিয়ে কোন মানসিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে তা খুঁজে বের করে আবার ওই গল্পের ছলে তাদের পথ দেখিয়ে দিতেন। বহুবার এর ফল পেয়েছেন। যাদের একেবারে পছন্দ করতেন না তারা হল যাদের ডেঁপো ছেলে বলে। প্রায়শই এরা ধনীগৃহের সন্তান। বাড়ি থেকে এরা প্রশ্রয় পেত, ‘হাতখরচ’ বলে অনেকটা টাকা পেত। হোটেলে খাওয়া, সিনেমা দেখা ইত্যাদিতে তাদের ‘পকেটমানি’ খরচ করে ফেলত। টাকা দিয়ে অনেক বিলাসব্যসনের বস্তু কেনা যায়, কিন্তু চরিত্রগঠনে টাকা সৎভাবেও খরচ করা যায় সেটা অনেকেই জানত না, আরো অনেকে জেনেও জানত না। এই শেষোক্তদের কাছে বাবা কথা বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন, তার কারণ এসব ছেলে পেত মা-বাবার আনুকূল্য। এ ছায়াটা এখনও বর্তমান।

বাবা বিশ্বাস করতেন প্রায় সব ছেলেই যথাকালে যথোপযুক্ত শাসন পেলে এবং বেশি কাঁচা টাকা হাতে না পেলে খানিকটা শুধরোবেই। এর পরীক্ষায় বরাবরই তিনি সাফল্য পেয়েছিলেন, এখনও তাঁর কিছু ছাত্র যথাসময়ে স্বভাব পরিবর্তন করে সমাজের উন্নতির জন্য অসাধ্য কল্যণব্রতে কৃতী হয়েছেন। সাংখ্য বাবার বহুপঠিত বিষয় ছিল। মনস্তত্ত্বের সঙ্গে এর বেশ কিছু মিল ছিল। অভিপ্রায় ছিল একটা বই লেখার, সময়ের অভাবে সেটা আর হল না। বাবার বিজ্ঞানমনস্কতা তাঁর কলেজের পাঠ্যতালিকায় বেশ কিছু বিজ্ঞানের বই পড়ার ফল।

বাহান্ন বছর বয়সে মৃত্যু কতকটা অকালমৃত্যুই বটে। কত কিছু বলতেন ভাবতেন হয়তো লিখতেনও। সে সবের সময় হল না। তবু দু-একটা ঘটনা মনে পড়ে। বি.এ পরীক্ষার অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য ঈশানবৃত্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু ওই বৃত্তি দেওয়ার মালিকের নির্দেশ ছিল বৃত্তিপ্রাপকের হিন্দু হতে হবে; আমার জন্ম খ্রিষ্টান পরিবারে, কাজেই ওটা আমার নাগালের বাইরে; অন্যটা অনার্সের প্রাপকদের মধ্যে উচ্চতম নম্বর যার, তার জন্য জুবিলি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বৃত্তি। সেটা পেলাম, কারণ তার ক্ষেত্রে জাতি বর্ণ নির্দেশ ছিল না। তখনকার দিনে তারও অর্থমূল্য বত্রিশ টাকা; সেটার জন্য খুশি ছিলাম বটে কিন্তু চল্লিশ টাকা - যা তখন একজন কেরানির মাসিক মাইনে, যেটা আমাদের গরিবের সংসারে সত্যকার - সাহায্য হত, তা পেলাম না বলে, বাড়ির সমস্যা আর্থিকভাবে আরো দূর করতে পারলাম না বলে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিলাম। আরো এইজন্যে যে, লেখাপড়ার জগতে জাতিবর্ণ বিভাগ দিয়ে মূল্যায়ন আমার কাছে অত্যন্ত অসংগত মনে হয়েছিল। দিনকতক বেশ মনমরা হয়ে ছিলাম। সন্ধেবেলা বাবা ছাত্র পড়াতে যেতেন, আমি একা ঘরে চুপ করে বসে থাকতাম। একদিন বাবার ছাত্র পড়বে না বলে তাঁর সঙ্গে হাঁটতে বেরোলাম। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘গয়া স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগে কী হয় মনে আছে তোর?’ গয়ায় আমার বড়োপিসিমা থাকতেন, আমরা মাঝে মধ্যে তাঁর কাছে যেতাম। তাই মনে ছিল, বললাম, ‘হ্যাঁ পরপর পাঁচটা টানেলে ট্রেন ঢোকে।’ ‘ঢোকার সময়ে কী হয়?’ বললাম, ‘বাইরের আলোগুলো নিভে যায়। আর ট্রেনের ভেতরের আলোগুলো জ্বলে ওঠে।’ প্রায়ান্ধকার রাস্তায় বাবা আমার সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, - ‘ওই আলোগুলো কখনো নিভতে দিসনে।’ বাবার কথাকটি আমার জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে আছে। জীবনের অন্ধকারের দিনে ওই কথাগুলো অবলম্বন করে আসন্ন হতাশার গুহা থেকে বহুবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছি।

বাবার দেশপ্রেম ছিল নীরব। একজন দরিদ্র শিক্ষকের পক্ষে কাজে যা করা সম্ভব ছিল তা বিনা দ্বিধায় করেছেন। একটি নিঃসম্বল ছাত্রকে মোটা খরচগুলি প্রত্যেক সপ্তাহে দিতেন। ছেলেটি বুদ্ধিমান ছিল এবং পরে পরীক্ষায় ভলো ফল করেছিল। এই ছেলেটির কৃতজ্ঞতার সীমা ছিল না। কত রকমের ছোটোখাটো জিনিসের - যেমন ছাতা, চটি, পাঠ্যপুস্তক, জল-খাবারের পয়সা বা ওষুধ কেনার পয়সা দিতে তাদের ছোটোবড়ো সংকচ থেকে উদ্ধার করছেন যে তার ইয়ত্তা নেই। নিজে থেকে কাউকে জানাতেন না, কখনো কখনো শুধু মাকে জানাতেন। স্কুলের নির্দেশে দুখানি বই লিখে দিয়েছিলেন। এবং একটি বেশ বড়ো অনুবাদকর্মও করেছিলেন। ওই টাকাটা ছাত্রহিতের জন্য মূলত ব্যবহার করতেন। তিনটি এই ধরেনের পারিশ্রমিকে স্কুল ওঁকে বেশ ঠকিয়েছিল। পরে আর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এরকমভাবে আত্মসম্মান খর্ব হতে দেননি। সংসারের খরচ থেকেও গরিব ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এক-এক সময় দরিদ্র ছাত্রদের পরীক্ষার আগে পড়িয়ে দিতেন পুরো পাঠ্যতালিকার সমস্ত অংশটা। বলা বাহুল্য, সবটাই বিনা পয়সায়। এমন কয়েকজন অনেক বড়ো পদ পেয়ে বড়ো পদের অধকারী হয়ে কখনো কিছু উপহার নিয়ে এসে প্রণাম করেছে। চলে যাবার পর আমি জিজ্ঞেস করেছি, - ‘ছেলেটি কে বাবা?’ বলতেন, - ‘কবে লেখাপড়ার সংকটে হয়তো কিছু বুঝিয়ে দিয়েছি ওকে, ছেলেটা তা ভোলেনি। তাই।’

এমন বহু লোককে সাধ্যমতো সাহায্য করতেন, কাউকে কিছু বলতেন না। না বলে নীরবে এই শিক্ষাটি দিতেন যে বাইবেলে যে শিক্ষা আছে তোমার ডান হাত কী করে তোমার বাঁ হাত যেন তা জানতে না পারে। একজন চীনা ফেরিওয়ালা জিনিস বেচতে এসে ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও ভাঙা ইংরেজি ও হিন্দিতে বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। ওঁদের মধ্যে একসঙ্গে চা-খাবার খাওয়া আর উপহার আদানপ্রদানে বছর তিনেক খুব বন্ধুত্ব হয়। বিদায় নেবার দিন দু-জনেরই চোখে জল। বলতেন, কত দূর দেশ থেকে ভাড়া করে, কতকটা ট্রেনে, এইভাবে মাথায় বেঁধে বোঝা নিয়ে আসে, কত টাকাই বা রোজগার। নিত্য নতুন দেশ দেখার আগ্রহ ওর প্রবল - এইখানটায় দু-জনের মিল।

একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের বাড়িতে একটা নীল এনামেল করা সাবানদানি ছিল। একদিন আমার হাত থেকে পড়ে গিয়ে তার একটা খুব ছোট টুকরো খসে যায়। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ স্বরে বাবা বললেন, - ‘ভাঙলি, তাও কার জিনিস? কবির।’ বললাম, ‘তা হলে তুমি ওটা পেলে কী করে?’ বললেন, ‘কবি আর আমি পাশাপাশি ঘরে থাকতুম। বাড়ি আসবার সময়ে আমি ওঁরটা নিয়ে এলুম। দুটো একই রকম দেখতে ছিল।’ কবির ব্যবহার্য একটা বস্তুর সম্বন্ধে এতটা মমতাবোধ।

কবির আসন্ন মৃত্যুর কথা জেনে বাবা যৎসামান্য খেয়ে স্কুলে গিয়ে কিছু পরে ফিরে এলেন। উদ্ভ্রান্তের মতো নয়। প্রশান্ত ভাবে চোখ না নামিয়ে মাকে বললেন, - ‘চলে গেলেন, taller than the tallest।’ আর কিছু না বলে কাচের পাত্রে জল ভরে সঙ্গে একটি গ্লাস নিয়ে উঠে গেলেন। তখন চারটে হবে। বললেন কেউ যেন না ডাকে। ছাদের ভেতর দিক থেকে তালা দিয়ে একা সারারাত রইলেন। সকালে থমথমে চেহারা ও জবাফুলের মতো লাল চোখ দেখে বুঝলাম কথা বলা যাবে না। পরদিন স্কুল বন্ধ। সেদিনও নীরবে একাকী, আমাদের সাহস হয়নি কথা বলার। তৃতীয় দিনে দরকারি দু-একটা কথা বললেন। কোথায় ব্যথা লেগেছিল সেটা ওরই মধ্যে একদিন কথায় কথায় বলেছিলেনঃ ইন্দ্রপাত। অদ্ভুত এক স্থৈর্যে নিজেকে প্রকাশ করে অযুক্তিকে সরিয়ে রেখেছিলেন। ওই গাম্ভীর্য আমরা কেউ পাইনি, কিন্তু মাঝে মাঝে যেন বাবাকে সম্মান করার জন্যই বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে গম্ভীর হয়ে যাই। এভেবে দেখেছি ওই পরিবেশে যে ধরনের আলাপ চলে, তার সঙ্গে সুর মেলালে বাবাকে, তাঁর আচরণকে, যেন নিচে নামিয়ে আনা হয়।

বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তেমন কেউ ছিলেন না। কিন্তু গুণী পন্ডিত কিছু লোক বাবাকে শ্রদ্ধা করতেন, যাঁদের সঙ্গে বাবার বন্ধুত্ব ছিল। বাবাও তাঁদের শ্রদ্ধা করতেন। সংস্কৃতজগতে সর্বজনশ্রদ্ধেয় পণ্ডিত দুর্গামোহন ভট্টাচার্যের (তাঁর বহু বিদ্যাবিদ পুত্র শ্রীমান দীপক ভট্টাচার্য পিতার আরদ্ধ অথর্ববেদের পৈপ্ললাদ সংহতির সংস্করণ সম্পন্ন করেছিলেন)। আরো দু-চারজন বাঙালি ও অবাঙালি পণ্ডিতের সঙ্গেও বাবার বন্ধুত্ব ছিল।

আমরা যখন বেশ ছোটো তখন এক পারিবারিক বন্ধুর সঙ্গে মা-বাবার বেশ উত্তেজিত আলোচনা শুনতাম, বলশেভিক তত্ত্ব নিয়ে। কোথাও কোনো সং