আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ডেনমার্কের ডায়েরি

বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী


ছোট দেশ। জনসংখ্যা আটান্ন লক্ষ। গড়পড়তা বাৎসরিক আয় তেত্রিশ লক্ষ টাকা। ইনকাম ট্যাক্স গড়ে ৪৫ থেকে ৭০ শতাংশ। ২০১৯ সালে বেকারের সংখ্যা ছিল ৪১,৫০০ (পুরুষ) এবং ৪৪,০০০ (মহিলা)। সারা বছরে পুরো দেশে দিন নষ্ট হয়েছে ৯০০০ (সব সেক্টর মিলিয়ে; সতেরোটা সেক্টর - কিছু কিছু সেক্টরের সংখ্যাটা শূন্য)। কর্মীরা কাজে আসতে পারেনি সারা বছরে গড়পড়তা, ছেলেরা সাত দিন, মেয়েরা দশ দিন; কারণ? অসুস্থতা।

পৃথিবীর সব থেকে ধনাঢ্য দেশগুলির অন্যতম। ইউরোপের তো বটেই। স্কান্ডিনেভিয়াতে নরওয়ের পরেই ডেনমার্কের স্থান, তার প্রধান কারণ নরওয়ের নর্থ সী অয়েল। কিন্তু সে কথা থাক।

ডেনমার্ক হচ্ছে ওয়েলফেয়ার স্টেট। এর বঙ্গানুবাদ ঠিক কী হয় জানি না - সমাজতন্ত্র নয়, সামাজিক কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে যা হয়, তাই। তাত্ত্বিক আলোচনায় যেতে চাই না। অর্থনীতিবিদ আর সমাজবিজ্ঞানীরা করে নেবেন। আমি সাধারণ মানুষ, কোনোরকম লেবেল না সেঁটে, চোখের সামনে যা দেখছি,তাই লিখছি।

ডেনমার্কে এসে প্রথম যা আমার চোখে পড়েছে সেটা হল সামাজিক সমতা। এটা একটু বুঝিয়ে বলছি। যে দেশে সবারই আয় খুব বেশি, সেখানে আর্থিক বৈষম্য কম হওয়াই স্বাভাবিক। এখানেও তাই। তবুও, যা আছে, তাই নিয়েই লোকেরা চেঁচামেচি করে (কিছু একটা করতে হবে তো! নইলে ওই সব অর্থনীতিবিদ আর সমাজবিজ্ঞানীরা সময় কাটাবে কি করে?)।

সে যাক, সামাজিক স্তরে বৈষম্য প্রায় নেই বললেই চলে। ইংরেজদের বা ফরাসিদের মত এখানে ক্লাস ডিস্টিংশন নেই (আমাদের দেশের কথা আর তুললাম না, দুঃখ পেয়ে কি লাভ)। আমাদের খুব ভাল বন্ধু মারিয়া আর ড্যান। মারিয়া একটা কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চাদের দেখে, আর ড্যান পনেরো বছর কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টে ব্যাগেজ হান্ডলিং এর কাজ করত। এখন একটা অন্য একটা চাকরি করে, প্রায় একই গোত্রের। তিনতলা সুন্দর কটেজ, নিজেরাই সব দেখাশোনা করে, পরিষ্কার রাখে। আর সৌন্দর্য্য বোধটা যেহেতু ডেনদের রক্তে (পৃথিবীতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ডিজাইন বলে যা চলে, সেটা বেশিরভাগই ড্যানিশ), বাড়ি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

আমার স্ত্রী খুব সিনিয়র ডিপ্লম্যাট। এমনিতে ওর, যাকে বলে সোশ্যাল সার্কল, একেবারে আলাদা। কিন্তু বন্ধুত্বে কোন খাদ পড়েনি। পৃথিবীর আর কোন্‌ কোন্‌ দেশে এই বন্ধুত্ব সাধারণভাবে হতে পারত, আমি জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এটাই এদেশের দস্তুর। কে কি কাজ করে, সে নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই। সেজন্য সমাজটা অনেক মুক্তমনা, এবং সকলেই সকলের সঙ্গে খোলাখুলি মেশে।

তাই বলে মুড়ি-মিছরির কি এক দর? তা নয়। কিন্তু মুড়ির যে আলাদা স্বাদ, আর মিছরির আলা্দা, সেটা সবাই ঠিক জানে, আর মুড়িকে যে অবহেলা করা যায় না, সেটাও জানে।

এর এক চুড়ান্ত উদাহরণ পেলাম যখন জানলাম যে প্লেনের ইকনমি ক্লাসে আমাদের পাশে যিনি এসে বসলেন এবং গল্প জুড়ে দিলেন, তিনি একজন মন্ত্রী। আমি একটু লজ্জিত ভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনি তো মন্ত্রী... ইকনমি ক্লাসে?’

ভদ্রলোক একটু অবাকই হলেন, ‘তাহলে কিসে যাব? এই যে প্লেনভর্তি লোক, এরা আমাকে দেখে বলবে না, দেখো, লোকটা আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় বিজনেস ক্লাসে যাচ্ছে? তারপর আমাকে ভোট দেবে?’

সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীন আমি রাশিয়া যাইনি। গিয়েছি পরে। আর গিয়ে শুনেছি সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ছিল তখন কর্মকর্তাদের (এ্যাপারাট্চিক্) ব্যাপারই ছিল আলাদা। বড় বড় গাড়ি, মস্কোতে বিরাট ফ্ল্যাট, শহরের বাইরে ফার্মহাউস (দাশা), কোথাও যেতে হলে আলাদা সরকারি প্লেন, ইত্যাদি। ঠিক আমাদের দেশের মত।

তাহলে সমাজতান্ত্রিক দেশ কোনটা হল? আমার সীমিত বুদ্ধিতে আসেনি। আর গণতান্ত্রিক দেশ হলে তো কথাই নেই। সরকারে থাকুক আর না-ই থাকুক, নেতা হলেই টাকা। আমার এক রিয়াল এস্টেটের ব্যাবসায় যুক্ত বন্ধু বলতেন, ‘খাঁচা তুললেই টাকা’, আর নেতাদের তো ভোট তুললেই টাকা।

এই সামাজিক সমতার ব্যাপারটা কিন্তু সমগ্র ইউরোপের জন্য খাটে না। স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরা হল উত্তর ইউরোপের। ওরা বাকি ইউরোপিয়ানদের একটু অন্য চোখে দেখে, একমাত্র জার্মানদের ছাড়া। এর কারণ এই নর্দার্ণ ইউরপিয়ানদের ডিসিপ্লিন। যদি পেডেস্ট্রিয়ান লাল বাতি থাকে, রাত বারটার সময়ও - যখন কেউ কোথাও নেই - রাস্তা পার হবে না, কেননা ওটা বেআইনি। সারা দেশে বছরে কতদিন কাজ থেকে আ্যাবসেন্ট থাকে তার খতিয়ান তো শুরুতেই দিয়েছি। এই জিনিসটা ইউরোপের অন্যান্য দেশে দেখিনি, দক্ষিণ ইউরোপে তো নয়-ই।

এমন সংযম বা ডিসিপ্লিন, যাই বলুন, এল কোথা থেকে? আর ইউরোপের শুধু এই উত্তর প্রান্তেই কেন? এর একটা ছোট্ট জবাব হল - ক্যাল্‌ভিনিজ্‌ম থেকে। পাঠক জানেন, জন ক্যাল্‌ভিনন (ইয়েহাঁ কভঁ) জন্মেছিলেন ফ্রান্সে, ১৫০৯ সালে। উনি খ্রীস্টান চার্চ (তৎকালীন, অর্থাৎ‌ ক্যাথলিক চার্চ) এর বিরোধিতা করেছিলেন বলে ফ্রান্স থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে ক্যাল্‌ভিনের রাজনীতি এবং সামাজিক দর্শন।

ক্যাল্‌ভিন বিশ্বাস করতেন যে শুধু কাজের মধ্য দিয়ে ইশ্বরকে পাওয়া যায়। এই জীবনটা শুধু কাজ করার জন্য। অন্য কিছু করা মানেই জীবন নষ্ট। জীবনকে সংযম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে, আর তার একটা প্রধান অংশ আইন মেনে চলা। জীবন একটা কঠোর সংগ্রাম, ইশ্বরের দয়া পাওয়ার জন্য। এখানে অলসতার কোনো জায়গা নেই। প্রত্যেক মানুষকে কাজ করতে হবে - ঘুরে বেড়ানো, ভিক্ষা করা নৈব নৈব চ। ক্যাল্‌ভিনের মতবাদ সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলেছিল উত্তর ইউরোপে কেননা,ওনার শিষ্যরা পালিয়ে এসে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিল। অর্থসম্পদ, যেটুকু কাজের মধ্য দিয়ে অর্জন করা যায়, তা হচ্ছে ভগবানের আশীর্বাদ—এটা ক্যাল্‌ভিনের মতবাদের বিবর্তনের ফল। এর ফলে যে সামাজিক পরিবর্তন হল তার ভিত্তিতেই ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর ক্যাপিটালিজ্‌মের থিওরি খাড়া করেছিলেন।

প্রসঙ্গত, ক্যাল্‌ভিন ধর্ম আর রাজনীতি এই দুটোর মধ্যের বিভাজনটা ভালই বুঝতেন কেননা, ওই একটা কারণেই ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশে এই বিভাজনটা না থাকায় চার্চ সমস্ত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত এবং তাতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাধারণ মানুষ।

নিজের রাজ্নৈতিক মতবাদে ক্যাল্‌ভিন সাধারণ মানুষের জীবন এবং রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, এই দুই দিকেই নজর রেখেছিলেন। সাধারণ মানুষের অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা যাতে রক্ষিত থাকে সেজন্য উনি অটোক্রেসি আর ডেমক্রেসির একটা মিল বার করলেন আর সেটা এই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে চালু হল। এইটুকু বলার দরকার ছিল, কেননা এছাড়া ডেনমার্কের মত দেশে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা সম্ভব নয়। আজ ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার মূলে হল ক্যাল্‌ভিনিজ্‌ম।

এই ক্যাল্‌ভিনিজ্‌ম-এর আরেকটা দিক হল, একটু অদ্ভুত ভাবেই, জামাকাপড়ের রঙ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে দেখবেন অন্তত সত্তর শতাংশ লোক -পুরুষ এবং মহিলা - জামাকাপড় পরে প্রধাণত কালো, গাড় লাল, আর নয়ত খয়েরির বিভিন্ন শেড। কাজের দিকে মন দেওয়া চাই, জামাকাপড়ের দিকে নয়, এটাও ক্যাল্ভিনিজ্‌ম। রক্তে ঢুকে গেছে। কি শীত, কি গ্রীষ্ম, জামা লম্বাই হোক বা খাটো, রঙের বিশেষ তফাৎ্‌ নেই। কখনো-সখনো নীল পরল তো পরল। তবে সময়ের সঙ্গে সবই বদলায়, এখন মানুষের পছন্দও বদলাচ্ছে। তবে বিশেষ কিছু নয়।

আরেকটা কথা। ডেনমার্কে দুর্নীতি নেই। এও ওই ক্যাল্‌ভিনিজমের দান। যেটা আমার দায়িত্ব, সেটা আমি পালন করব, এতে পয়সার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? এতে তো মানুষ ইশ্বরভ্রষ্ট হবে। আজকাল অবশ্য কেউ চার্চেও যায় না, রবিবারের স্যাবাথ ও মানে না। কিন্তু পাঁচশ বছরের মেন্টাল ট্রেনিং যাবে কোথায়? সুতরাং দুর্নীতি নেই। সরকারি দপ্তরে যখন লোকেরা হাসিমুখে আপনার কাজ করে দেবে, আপনি-বিশেষ করে ভারতীয় হলে তো বটেই - অবাকই হবেন। সরকারি দপ্তরে যা হয়, একদিনের কাজ কখনো একদিনে হয়, কখনো এক সপ্তাহ লাগে। আপনি গিয়ে (সাধারণতঃ ফোনেই) তাড়া লাগাতে পারেন, কিন্তু ঘুষ? প্রশ্নই ওঠে না।

পাঠক বলবেন, শুরুতে তো খুব সামাজিক কল্যাণ- টল্যাণ বলেছিলেন, সেসব গেল কই? আসছি।বলেছিলাম আয়করের দর খুব বেশি। এত টাকা যায় কোথায়? সমাজ কল্যাণে। কীভাবে? ইউনিভার্সিটি অবধি পড়াশোনা ফ্রী। হাসপাতাল, ওষুধ, সব ফ্রী। সর্বজনীন যে-কোনো পরিষেবা হয় নিঃশুল্ক,নয় খুব সস্তা। সোশ্যাল বেনিফিট, অর্থাৎ বেকার ভাতা, পেনশন ইত্যাদি সব আছে। এক্সট্রা কিছু দিতে লাগে না। স্টেট পেনশন সবার জন্য। আপনি কোথায় চাকরি করেছেন বা করেননি, তার ওপর নির্ভর করে না। অবশ্যই ডেনমার্কের নাগরিক হতে হবে, আর অন্তত তিন বছর ডেনমার্কে কাটিয়েছেন নাগরিক হবার পর, সেটা দেখাতে হবে। বেকারভাতা পেতে গেলে আগে অন্তত একবছর কোথাও একটা চাকরি করেছেন, সেটা দেখাতে হয়। যারা উদ্‌বাস্তু হয়ে এসেছেন, তাঁদের জন্য আলাদা নিয়ম।

তবে এই নিয়ে এখন তর্ক চলছে। একদল বলছে, আমরা খেটে-খুটে রোজগার করব, আর রিফিউজিরা বসে বসে খাবে, এটা কিরকম ব্যাপার? আর অন্যদল বলছে, আমরা যে রাস্তা ধরে এত বছর এগিয়েছি, সেটা বদলাব কেন? এতে তো আমাদের দেশটাই অন্যরকম হয়ে যাবে। সেসব পরে একদিন হবে।

একটা কথা বলেই আজকে শেষ করব। সেটা হচ্ছে ড্যানিশ সমাজে মেয়েদের আধিপত্য। জেন্ডার-ইকুয়ালিটির (লিঙ্গ-সমতা কিরকম বিশ্রী শোনায় না?) দেশ এটা। চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে মেয়েদের সমান অধিকার তো আছেই, পুরুষ এবং মহিলাদের কর্মসংস্থানের হার একই রকম। এটা কী করে হল? ইউরোপের অন্য কোনো দেশে এতটা নেই। সুইডেনে অবশ্যই আছে। এই সামাজিক ব্যবস্থার উৎপত্তি বোধহয় ভাইকিং যুগে। আমরা জানি ভাইকিংরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিল, অষ্টম এবং নবম শতাব্দীতে সমগ্র ইউরোপের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই কথাটা সর্বতোভাবে সত্য নয়। ভাইকিংরা চাষ-আবাদ ইত্যাদিতেও অনেক দূর এগিয়েছিল। আর এই ক্ষেত-খামার, এসব দেখত কারা? মেয়েরা। ছেলেরা তো সারা বছর বাইরে থাকত - ভাইকিং রেইডে। জমি জায়গা, পরিবার, সব সামলাত মেয়েরা। যার ফলে মেয়েদের সমাজে ছেলেদের সমান স্থান তৈরি হয়েছিল। ভাইকিং ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, সেই সময় থেকেই মেয়েদের সম্মান করাটা ড্যানিশ সামাজিক প্রথা এবং আচরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই ফলস্বরুপ আজকের ডেনমার্কে মেয়েদের এত আধিপত্য।

আজ এখানেই শেষ করি। অনেক কথা বলা হল না। সে থাক। একদিনে, আর এক লেখায় কি একটা পুরো দেশকে ধরা যায়? আমি তো ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখছি না। পাঠক নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।