আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭
প্রবন্ধ
‘দেশহিতের নামে মিথ্যাকে পবিত্র’ করে তোলা বন্ধ হোক
বরুণ কর
বাঙালি মনে কবি সুকান্ত আজও কিশোর, কবি হিসাবে তাঁর সাবালকত্ব প্রাপ্তি অধরা রয়ে গেল। অথচ তাঁর একেকটা কবিতা পড়লে শিহরণ হয়। একবার ভাবুন তো, ‘আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়’ লাইনটার কথা। কী অসামান্য লাইন। সাত দশক অতিক্রান্ত, কবি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এই লাইন তার আগে লেখা। ইতিমধ্যে আমাদের স্বাধীনতা লাভ ও সাধারণতন্ত্রের বয়সসকাল সত্তর পেরিয়ে গেল, ছুঁয়ে ফেলল আমারই মতো, কথন অজান্তে।
গোটা বিশ্ব জুড়ে ‘করোনা’ থাবা বসিয়েছে বেশ জাঁকিয়ে। সংক্রমণের সূত্রপাত চীনে। আজ তা সর্বব্যাপী। ভারত ছাড় পায়নি। বর্তমান সময়ে গোটা দেশ তালাবন্দী অর্থাৎ ‘লক ডাউন’ । এ লেখা যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে, তখন হয়তো লক ডাউন উঠে যাবে এবং আশা করব সব কিছু স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টায় থাকবে। পরিস্থিতি, শুনেছি মানুষকে অভিজ্ঞ করে; অভিজ্ঞতা সমস্যা মোকাবিলার পথ দেখায়। দেশমাতা, দেশভক্তি জাতীয় শব্দের চর্চা ইদানীং খুব শোনা যায়। এটা কাঙ্খিত যে দেশের শাসনভার যাদের হাতে থাকে তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব দেশ ও দেশবাসীর প্রয়োজন গুরুত্ব সহ উপলব্ধি করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দেশবাসীর জীবনযআত্রার মানোন্নয়নে যথাসাধ্য যত্নবান হওয়া। স্বাধীনোত্তর ভারতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, সন্দেহ নেই। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের কৃতি সন্তানেরা যে স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, তা সারা পৃথিবীতে অভিনন্দন কুড়ালেও দেশের বৃহৎ অংশের মানুয জীবনযাপনের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটাতে আজও কার্যত নাজেহাল। ব্যাঙ্কে জমাখাতা খোলার সময়ে ‘কে ওয়াই সি’ নামে এক দীর্ঘ ও বিস্তারিত ফর্ম পূরণ করতে হয়। আমার মনে হয়, নির্বাচনের আগে শাসক আসনের দাবীদার দলসমূহের উচিত ওই রকম একটি ফর্ম পূরণ করে নির্বাচন করমিশনে জমা দেওয়া। সেক্ষেত্রে নো ইওর কাস্টমার নয়, নো ইওর কান্ট্রিমেন হবে প্রথম একটি সদর্থক পদক্ষেপ।
স্বাধীনতার বয়স সত্তর পেরিয়েছে। এখনও বাইশ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার (যাদের বার্ষিক আয়ের ঊর্দ্ধসীমা সাতাশ হাজার অর্থাৎ মাসে বাইশশো পঞ্চাশ টাকা) নিচে বসবাস করে। সংখ্যাগতভাবে বাইশ শব্দটি অল্প শোনালেও ব্যাপ্তিতে বড় - প্রায় ঊনত্রিশ কোটি। সাত কোটি মানুষের বাস বস্তিতে। সেখানে নিরাপদ পানীয় জল, স্বাস্থ্যকর শৌচ ব্যবস্থা শুধু বিলাসিতা নয়, তা পুরো মাত্রায় অস্থায়ী ও অনিশ্চিত। জনস্বাস্থ্য বলতে আমরা বুঝি মানুষ ও গোষ্ঠীর উন্নতি বিধান। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন, প্রতিনিয়ত সমীক্ষা ও গবেষণার সাহায্যে রোগ বিশেষত ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ বাঁচিয়ে চলার ধারাবাহিক চেষ্টা জনস্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ। এই কাজে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হল শিক্ষা বা জনশিক্ষা। দেশে শিক্ষিত মানুষের হার চুয়াত্তর শতাংশ, অর্থাৎ ছাব্বিশ শতাংশ মানুষ এখনও শিক্ষার আলোকবৃত্তের বাইরে। এ হেন পরিস্থিতিতে দেশে ‘করোনা’ ছোবল। গোটা দেশ ছন্নছাড়া যেন। বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের চকচকে মুখ টিভি’র পর্দায় ও কাগজের পাতায়। পরামর্শ - রুমালে বা টিস্যুতে হাঁচি, কাশি পর্ব চুকিয়ে তা ঢাকনা দেওয়া নোংরাদানিতে ফেলার। স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে নেতা মন্ত্রীদের আবেদন বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার। যে পরিবারে নুন বা পান্তা জোটানোই কষ্টসাধ্য সেখানে এ ধরণের পরামর্শ হাস্যকর ছাড়া আর কী হতে পারে? এই পরিস্থিতিতে রেশন দোকানের মাধ্যমে দুঃস্থ মানুষের জন্য সাবানের বন্দোবস্ত করা যেত না? বাজেট পেশের আগে কাগজে, টিভিতে জ্ঞানগর্ভ আলোচনার বিরাম নেই। বিত্তমন্ত্রীর হালুয়া রান্নার ছবিও আমাদের দেখানো হয়। হয় না যা, তা হল সেই হালুয়ার স্বাদ গ্রহণ। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ চেটে পুটে সব খেয়ে নেয়। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে ২০১৯-২০ সালের সংশোধিত বরাদ্দ ছিল একাত্তর হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালের জন্য উক্ত খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ধরা হয়েছে একষট্টি হাজার পঁচশো কোটি টাকা। সোজা সাপ্টা হিসাবে একশো দিনের কাজে বরাদ্দ ছাঁটাই। ২০১৯-২০ সালে যেখানে খাদ্যে ভরতুকির পরিমাণ ছিল এক লক্ষ চুরাশি হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১ সালে সেই বরাদ্দ কমে হয়েছে একলক্ষ ষোল হাজার কোটি টাকা। এর পাশাপাশি কর্পোরেট সংস্থায় কর ছাড়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার কোটি টাকা। নীরব মোদী, মেহুল চোকসী, বিজয় মালিয়া সহ পঞ্চাশজন ঋণখেলাপীর ঋণ মুকুবের পরিমাণ ৬৮,৬০৭ কোটি টাকা। এর পরেও নিন্দুকেরা যদি বাজেটে গরীব মানুষের কথা ভাবতে বলেন, সে ক্ষেত্রে বিত্তমন্ত্রীর হতবাক না হয়ে কী উপায়!
আর্থিক বিন্যাস নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য মতবিরোধ নতুন নয়। রাজ্যের পাওনাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের অসারতা রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত ডঃ অশোক মিত্র মশাই রাজনৈতিক পরিসরে তুলে এনে সোরগোল ফেলে দেন। সেই বিতর্কের সুফল আজ প্রতিটি রাজ্য পাচ্ছে। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে কেন্দ্রের সমালোচনায় সোচ্চার। তিনি বোধ হয় ভুলে গেছেন অতীতে বাম সরকারের আর্থিক দাবি নস্যাৎ করার কাজে তাঁর ভূমিকা নেহাত কম ছিল না। এই দোষ তাঁর নয়। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় কংগ্রেস বা বিজেপি যে দল থাকুক না কেন, তারা যখন কোন রাজ্য সরকারকে অর্থ বরাদ্দ করে, তাদের ভাবখানা হয় সংশ্লিষ্ট সরকারের ওই অর্থ যেন মোটে প্রাপ্য নয়, এ তাদের অনুকম্পা মাত্র। প্রকল্পের নামকরণের কেন্দ্রীয় প্রাধান্য। যে প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ বা বরাদ্দের প্রকৃত অংশীদার যারা, জনসাধারণের সেই গরিষ্ঠ অংশের বঞ্চনায় সুতরাং কোনো ছেদ নেই। মূর্ত্তির জন্য অর্থ বরাদ্দে কার্পণ্য নেই। রেল সম্প্রসারণে উচ্চকোটির মানুষের অগ্রাধিকার স্বীকৃত, এমনকী এই দুঃসময়েও লুটিয়েন্স দিল্লির সংস্কার স্থগিত রাখার কথা বা অর্থ বরাদ্দে কাটছাঁটের কোনো প্রস্তাব এখনও পর্যন্ত কানে আসেনি। ভবিষ্যত জানাবে সে কথা। অথচ কী আশ্চর্য, শিক্ষা খাতে দেশে মাথা পিছু বার্ষিক ব্যয় ছ’হাজার টাকার কম, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মাত্র এগারোশ টাকা। শিক্ষার অধিকার আইন মোতাবেক যদিও মাথাপিছু বার্ষিক বরাদ্দ আঠার হাজার টাকার কথা বলা হয়েছে। বললেই মানতে হবে এ আবার কেমনতর আব্দার।
এত কিছুর মধ্যে যে আশাব্যঞ্জক কোনো খবর নজরে আসে না তা নয়। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, কেরালার এক ডাক্তার দম্পতি শুধুমাত্র নিজেদের সুখের স্বর্গ গড়ার চেষ্টা না করে বৃহত্তর পরিধিতে কাজের জন্য খুঁজে নিয়েছেন সালেম থেকে একশ’ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম, নাম সিট্টিলিঙ্গি। রাজ্য তামিলনাড়ু। উপজাতি অধ্যুষিত সেই গ্রাম ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অশিক্ষা, অপুষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী। অপুষ্টি এতটাই যে গ্রামে জন্ম নেওয়া প্রতি সাতজনে একজন শিশু তাদের প্রথম জন্মবর্ষের সাক্ষী হতে পারত। ডাক্তার দম্পতি গ্রামবাসীদের নিয়ে স্বাস্থ্য উদ্যোগ গঠন করে কিছু আর্থিক অনুদান ও শুভানুধ্যায়ীদের আর্থিক আনুকুল্যে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন। এ সব গত শতকের নয়ের দশকের শেষের দিকের কথা। নানা সুবিধাসহ সেই হাসপাতালে এখন চব্বিশটি শয্যা। সারা বছরে ষোল হাজার রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসার সুবিধা পেয়ে থাকেন। গ্রামে স্বাস্থ্য সচেতনতা। যে কারণে এই প্রসঙ্গের অবতারণা তা হ’ল গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ডাক্তার দম্পতি করোনা নিয়ে গ্রামে সতর্কতার কাজ শুরু করে দেন। এ কাজে তাঁরা পঞ্চায়েত সহ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরকে সহযোগী করে নেন। আজ গ্রামটিকে সবাই মিলে শুধু করোনার থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে শুধু নয়, এ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই। অর্থাৎ সামান্য সদিচ্ছা ও নিষ্ঠা থাকলে মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া যায়।
আমাদের রাজ্যের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, এত বড় বিপর্যয়ে পঞ্চায়েত ভূমিকা শূন্য। অন্যান্য স্বশাসিত সংস্থায় একই অবস্থা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ডঃ রঘুরাম রাজন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সবাই এই দুঃসময়ে যৌথ উদ্যোগ, সর্বস্তরে আলোচনা ও পরামর্শের পক্ষপাতী। কিন্তু রাজ্য বা কেন্দ্র সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীভূত তৎপরতা নজর কেড়েছে। আশার কথা, দেরিতে হলেও পদ্ধতিতে বদল শুরু হয়েছে। আসলে, শাসকদলের মধ্যে নিদর্শনের তুলনায় প্রদর্শনের গুরুত্ব যেহেতু বেশি, বিপত্তি ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিপর্যয় থেকে মুখ ফেরানোর সুযোগ এখন নেই। সর্বস্তরে আলোচনা, পরামর্শ চলছে, চলবে। চিকিৎসকদের স্থান প্রথম সারিতে হওয়ার কথা, হয়েছেও তাই। এর সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত, সুপারিশ মেনে চললে সুদিনের মুখ অচিরে দেখা যাবে, এ বিশ্বাস রাখি। একবার শুধু মনে করার চেষ্টা করুন করোনার দু’একটা ঘটনা এ দেশে যখন সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিচ্ছে সেই সময়ের কথা। দেশজুড়ে গো-মূত্র, গো-ময় খাওয়া ও খাওয়ানোর সে কী হিড়িক! সাথে দেব-দেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন, ষাগযজ্ঞ কত কিছু। করোনার ভয়াল রূপ একটু একটু করে যেই প্রকাশ পেতে শুরু করল, সেই সব মাতব্বরদের সব আস্ফালন বন্ধ হয়ে গেল। মাস্ক পরে তারা কেমন যেন চুপসে গেলেন। বিজেপির সাংসদ জয়ন্ত সিনহা যিনি হাজারিবাগ কেন্দ্র থেকে লোকসভায় জয়ী হয়েছেন, তাঁর কথা একটু শুনে নিই বরং। তাঁর পরামর্শ-কুসংস্কার নয়, বিজ্ঞান গুরুত্ব পাক। শিশুরা বড় হয়ে উঠুক বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের যথাযোগ্য সম্মান জানানো হোক এবং সর্বোপরি সেলিব্রিটি বন্দনা বন্ধ হোক। সংসদের অর্থনীতি বিষয়ক স্থায়ী সমিতির চেয়ারম্যান শ্রী সিনহা সঠিক কথা বলেছেন। আসলে বিজেপি নেতারা জানেন এটাই পথ। কিন্তু তাতে যে বাড়া ভাতে ছাই পড়ার সম্ভাবনা। তাই জারি রাখা হয় নানা অছিলায় দেশবাসীকে অশিক্ষা, অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের পাঠ দেওয়ার কাজ।
এই আবহে দেশের উপরাষ্ট্রপতির অভিমত আপাতত রোগ নিরাময় প্রাধান্য পাক। অর্থনীতি পুরুদ্ধারের বিষয় নিয়ে পরে ভাবা যাবে। কথাটা যে একেবারে অমূলক তা নয়। তবে এটাও তো ভাবনায় রাখা দরকার যে অর্থনীতি যেহেতু সমাজ বিজ্ঞানের একটি শাখা, তা অবধারিতভাবে সমাজ-নিরপেক্ষ নয়। আর সমাজ যে বিদ্যার আলোচ্য বিষয় তা তো সমাজ বা দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থানের মতো বিষয়গুলোর সমস্যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে না। সেই সব ক্ষেত্রের যে রোগ তার প্রতিকার ছাড়া তো করোনা কেন কোনো রোগেরই যথার্থ মোকাবিলা সম্ভব নয়। মূল বিষয়, একাধিপত্যের জোরে দেশে এখন একদলীয় শাসন কায়েম রাখার চেষ্টা চলছে। বিরোধী মুখ দেখতে আগ্রহী নয় শাসকদল। বিরোধী দলের স্বীকৃতি শুধু কাগজে কলমে। বিরোধী বক্তব্য শোনার ধৈর্য শাসকদলের নেই। অথচ বিরোধী নেতাদের বক্তব্য শোনার জন্য অতীতে শাসকদের নেতৃবৃন্দের আগ্রহের কথা তো সংসদীয় কার্যবিবরণীর পাতা থেকে এখনও মুছে যায়নি। শাসক হতে গেলে অনুভবের প্রয়োজন হয়। অনুভবী হতে গেলে দর্শন ও শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ ও সতর্ক রাখতে হয়। ব্যক্তি সুখের তুলনায় তখন সমষ্টি কল্যাণ প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। ও সবে নানা ঝক্কি ঝামেলা। বরং নির্বাচনের নামে প্রহসন চালিয়ে ভোটদাতাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে কোনক্রমে মসনদে গিয়ে বসা বেশি সহজ। পবিত্র সংবিধানের নামে শপথ নেওয়ার পর নির্বাচনের প্রাক্কালে জনসাধারণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভুলতে আর কতদিন লাগে। হাতে সময় মাত্র পাঁচ বছর। এই অল্প সময়ে নিশ্চিন্ত জীবন নির্বাহের রসদ সংগ্রহ তো মুখের কথা নয়। সুতরাং জনতার দাবি যাদের কন্ঠে শোনা যাবে, তাদের গতিবিধি, কার্যকলাপ কোনো কিছুই যেন অভিমুখ খুঁজে না পায় সেদিকে রাখতে হবে কড়া নজর। ধরপাকড়, মিথ্যা মামলা ও দেশদ্রোহীর তকমা এঁটে নাস্তানাবুদ হওয়ার ভয় যেন সবাই পায়। দেশ ও উন্নয়নের প্রশ্নে আবার বিরোধ কীসের। উল্টো দিকে, এ ছবিও দুর্লভ নয় - ভোটে নির্বাচিত হয়ে আপনার জনপ্রতিনিধি হয়তো মহত্তর আরও কিছু পাওয়ার আশায় শাসকদলে নাম লেখানোর অপেক্ষায় উদগ্রীব। এ কাজে কখনো দেশপ্রেম বা স্থানভেদে উন্নয়ন তাকে অনুপ্রাণিত করে। দল বদলে কেউ কেউ ইতিমধ্যে তাক লাগানো দক্ষতা দেখিয়েছেন। পেটোয়া সংবাদমাধ্যম, কর্পোরেট শক্তির বড় অংশ, ধর্মীয় সংগঠনসহ স্বার্থান্বেষী মহল এই প্রক্রিয়ায় বড় ভূমিকা নেয়। সেলিব্রিটিকুলই বা পিছিয়ে থাকে কেন। পুরস্কার, লোভনীয় পদের মোহে তারা নিজেদের কথা বলে কম, শেখানো বুলি আওড়ায় বেশি। শাসকের দরজা বিরোধী শিবিরের সুযোগ সন্ধানীদের জন্য উন্মুক্তই থাকে। এ বেলার শাসক শিবিরের সংখ্যা ও বেলাতেই কী যাদুতে যেন বদলে যায়। দুশ্চিন্তা তবু পিছু ছাড়ে না। দলীয় বিধায়ক বা সাংসদদের সুরক্ষায় শাসক শিবিরকে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আগেকার দিনের রাজাদের মতো দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা নিতে হতে পারে। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে চুল ছেঁড়া যাদের স্বভাব তারা বরং মনে রাখুক, ব্যক্তির উন্নয়নেই সমষ্টির উন্নয়ন সম্ভব - চুঁইয়ে পড়া অর্থনৈতিক তত্ত্বের মূল কথা তো সেটাই এ কথা কে না জানে।