আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে

মালবী গুপ্ত


সেই কবে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই রাজা রামমোহনের হাত ধরে বাংলায় সতীদাহপ্রথা রোধে আইন তৈরি করা হয়েছিল না? আর ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের মতো সামাজিক কু-প্রথাগুলিকে উপড়ে ফেলার চেষ্টায় অতন্দ্র ছিলেন না ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর? কিন্তু তবু প্রায় দেড়শো, দুশো বছর পেরিয়ে এসে আজও যে দেখছি সেইসব কু-প্রথা, কু-সংস্কারগুলি সমাজে বহাল তবিয়তেই রয়ে যাচ্ছে।

আমরা জানি সমাজের ওই সংস্কারের জন্য বিদ্যাসাগরকে সেদিন একটা কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, বহু সমাজপতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিরোধিতার কারণে। কিন্তু হেনস্তার শিকার হয়েও তাঁর যে অদম্য চেষ্টা, যে সাহসিকতা তাঁকে তাঁর সঙ্কল্পে দৃঢ় থাকার শক্তি জুগিয়েছিল, সন্দেহ নেই, তারই জোরে সেদিন স্ত্রী-শিক্ষা ও বিধবাবিবাহ প্রচলনে তিনি সাফল্যের দ্বারটি পেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।সত্য যে, সমাজে স্ত্রী শিক্ষার যতটা প্রসার হল, বিধবাবিবাহ যেন ততটা গতি পেল না। কিন্তু তাঁর ওইসব উদ্যোগের ধাক্কাতেই যেন তৎকালীন সমাজে বদলের একটা হাওয়া এসে লেগেছিল।

কিন্তু আজ দেখছি ঢাকঢোল পিটিয়ে কোনো মেয়েকে শ্মাশানে নিয়ে গিয়ে সতী হওয়ার উৎসাহ দিয়ে, তাকে মেরে ফেলা হয় না ঠিকই।তবে ঘরে ঘরে নানা অজুহাতে বধূ হত্যার নিত্য ব্যবস্থাটি যেন বেশ মান্যতা পেয়ে গেছে সমাজে। আর গোটা দেশে বাল্যবিবাহের প্রথাটি তো রীতিমত দৃঢ়মূল রয়ে গেছে। যদিও এইসব প্রতিরোধে এবং মেয়েদের অধিকার রক্ষায় সেই ঊনিশ শতক থেকেই এপর্যন্ত নানাবিধ আইন হয়েছে দেশে। কিন্তু তার সদ্ব্যবহারে কোথায় যেন বিরাট খামতি থেকে যাচ্ছে।

আমাদের সমাজও যেন এব্যাপারে বেশ উদাসীন। তা নাহলে ডাইনি অপবাদ ও তজ্জনিত হত্যার কুসংস্কার, কন্যাভ্রূণ, কন্যাসন্তান হত্যার নিষ্ঠুরতম ধারাবাহিকতা অন্যান্য কিছু রাজ্যের মত পশ্চিমবঙ্গেও দিব্যি অব্যাহত থাকত না। এ নিয়ে সমাজের গণ্যমান্যদের (ব্যতিক্রমী ছাড়া) কোথাও তেমন কোনো আওয়াজ শোনা যায় না। কোনো সামাজিক আন্দোলনও চোখে পড়ে না। যদিও আমাদের মধ্যে অনেকেই এখনও পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে বেশ গর্ব অনুভব করি ।এবং গোপাল কৃষ্ণ গোখলের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো’ আওড়ে বাঙালি হিসেবে এখনও বেশ শ্লাঘাও বোধ করি কেউ কেউ।

তবে যখন জানতে পারি কী বাল্যবিবাহ, কী নারী পাচার, কী নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিযোগিতায় আজ পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে কখনও তৃতীয়, দ্বিতীয় কখনও বা প্রথম স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। জানতে পারি, ভারতে মেয়েদের জন্য সব থেকে অনিরাপদ রাজ্যের তালিকায় উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের পরই তৃতীয় স্থানটি দখলে রেখেছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে তো একেবারে প্রথম স্থানে (এনসিআরবি ২০১৮ রিপোর্ট) জ্বলজ্বল করছে এই বাংলার নাম, তখনও কি আমাদের ওই গর্বের ফানুসটি চুপসে যায় না?

অথচ অনতি অতীত থেকে হালফিল বর্তমানের সামাজিক -রাজনৈতিক জীবন চর্যায় একবার নির্মোহ দৃষ্টিপাত করলেই এর বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। সেই বাস্তবতা বরং অন্য এক সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। বিশেষ করে যখন জানতে পারি, যে প্রতি ৩ জন নাবালিকা বধূর এক জনই ভারতীয়। জানতে পারি ভারতের বালিকা বধূদের অর্ধেকের বেশি উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র ও মধ্য প্রদেশের বাসিন্দা। তখন মনে হয় না, সেই ঊনবিংশ শতকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর সমাজ থেকে ওই কু-প্রথাগুলি দূর করার এবং মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই বাংলাকে যে পথ দেখিয়ে ছিলেন, সেই পথ যেন শেষাবধি কোন চোরাবালিতে গিয়ে আটকে গেল।

এই বিশ্বাস তো দৃঢ় হতে থাকে তখনই, যখন প্রতিদিনের সংবাদ মাধ্যম আমাদের জানিয়ে দেয় যে, পরপর কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে হ্যাঁ, এই পশ্চিমবঙ্গেও মা ও শিশুদের কীভাবে হত্যা করা হয়। জানিয়ে দেয় কন্যা পক্ষের কাছ থেকে পণের টাকা বা সামগ্রী না পেলে, কিম্বা কম পেলে অথবা আরও বেশি আদায়ের দাবিতে কি নির্মম বধূ নির্যাতন আমাদের চারপাশে হামেশাই ঘটতে থাকে। চলতেই থাকে তাকে মেরে কখনও দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া, কখনও পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংসতাও।

আসলে উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যগুলি যে বহুস্তরীয় জাতিবাদ ও ধর্মীয় মেরুকরণের পিঠে সওয়ার হয়ে মুহূর্মুহূ সর্বত্র বর্বর হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পশ্চিমবঙ্গের সমাজ মানসে হয়তো ঠিক ততটা উগ্র জাতিগত, গোষ্ঠীগত ঘৃণার (যা ছড়ানোর চেষ্টার অভাব থাকে না) সহিংসতা কাজ করে না। তবে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সহিংসতায় যে এই রাজ্য অনেক রাজ্যকেই ছাড়িয়ে যায়, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না বোধহয়। প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমে তো তার নিত্য প্রতিফলনও ঘটে।

আর যদি শুধু বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি সংঘটিত হিংসার কথা ওঠে, তবে তো বলতেই হয় এই ব্যাপারে প্রতিযোগিতায় সে বেশ সামনের সারিতেই রয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যদি বাল্য বিবাহের কথা বলি, যা বিয়ের নামে বালিকাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান আয়ুধ হয়ে তাদের চরম সহিংসতার মুখে ঠেলে দেয়। কারণ এই বিয়ের নামেই যে দেশে বিদেশে নিয়ত পাচার হয়ে যাচ্ছে কত বালিকা।

সম্প্রতি দেখলাম (আনন্দবাজার ১০ আগস্ট) মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থানার তরতিপুর গ্রামের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ১৩ বছরের বালিকার আর একটু হলেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। খবর পেয়ে পুলিশ যথাস্থানে পৌঁছে অভিভাবকদের বুঝিয়ে তাদের দিয়ে মুচলেখা লিখিয়ে বিয়ে বন্ধ করেছেন। কিন্তু সর্বত্র এমন সুযোগ থাকে না। এই বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে জুন পর্যন্ত শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ৫০০-এর বেশি নাবালিকার বিয়ের খবর সামনে এসেছে। বলা বাহুল্য আরও অগণিত বালিকার বিয়ে (যার বেশিরভাগই জোর করে) যে কোনো পরিসংখ্যানে জায়গা পায়নি, তা এক রকম নিশ্চিত।

যেমন দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বারুইপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘নিষ্ঠা’র (যারা মেয়েদের নিয়ে কাজ করে) সচিব মীনা দাসের কাছে শুনলাম, বিষ্ণুপুর ১, মগরাহাট ২, সোনারপুর ব্লকে বিগত কয়েক মাসে ১৫০ জন নাবালিকার বিয়ে হয়ে গেছে। এবং অ্যাকশান এইড’র হাসনাবাদ হিঙ্গলগঞ্জের মুসলিম মহিলা সংগঠনের কর্মী হালিমা খাতুনের কাছে জানতে পারি, গত চারমাসে উত্তর ২৪ পরগণায় হিঙ্গলগঞ্জের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম শুধু কাটাখালিতেই বিয়ে হয়ে গেছে নাবালিকা জুলেখা, নাজিরা, সালমা, বৃথি ও মারুফা খাতুনদের। যেহেতু সাম্প্রতিক অতিমারিতে লকডাউনে কেউই এই নাবালিকাদের বিয়ে আটকানোর সুযোগ পাননি, তাই থানা পুলিশও হয়নি। তাই সেইসব ঘটনা কোনোভাবে সংবাদমাধ্যমেও জায়গা পায়নি।

এবং এই সময়ে চাইল্ডলাইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন দেশের নানা প্রান্ত থেকে যে ৫৫৮৪ ফোন কল পায়, দেখা যাচ্ছে তার ৯১ শতাংশই ছিল অসহায় শিশু কন্যার কন্ঠ। জোর করে তাদের বিয়ে দেওয়ার হাত থেকে যারা রক্ষা পেতে চেয়েছিল। বস্তুত অতিমারির বিপর্যয় এই ধরনের অঘটনকে কিছুটা ত্বরান্বিত করেছে ঠিকই, কিন্তু বাংলার গ্রামে গ্রামে এমন সব মর্মান্তিক ঘটনা যুগ যুগ ধরেই ঘটে চলেছে।

দেড়, দু’দশক আগের কথা। যখন কাজের সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, মালদা, পুরুলিয়া, ইত্যাদি জেলায় জেলায় গিয়ে বাল্য বিবাহের বলি (১২, ১৩, ১৪ বছরের কন্যা) এমন বেশ কিছু ভগ্ন স্বাস্থ্য, ৪/৫ সন্তানের রুগ্ন বিষাদ জননীর সাক্ষাৎ পেয়েছি। যাদের কথায় তাদের আশাহত জীবনের অসীম যন্ত্রণার ছবি ধরা পড়েছে। দেখেছি, শৈশব, কৈশোর হারানো ওই নাবালিকা বধূদের কতটা বিপন্ন, কতটা অনিরাপদ প্রাত্যহিকতার জোয়ালে তাদের জীবনকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তেমনি আবার ওই ঘোষিত বিয়ে আটকানো অসম সাহসী প্রতিবাদী নাবালিকাদের মুখোমুখি হয়ে তাদের লেখাপড়া শেখার অদম্য ইচ্ছা, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কাঙ্খিত স্বপ্নকেও প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটেছে।

আসলে কোনো নাবালিকার বিয়ে দেওয়া মানেই তো তার সমস্ত মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া। কারণ তার শরীর ও মন সদ্য বিকশিত হওয়ার সময়ই তাকে দখলদারের হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ তো শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে নানা ঝুঁকির দিকে তাকে ঠেলে দেওয়া। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, দেশের ২২ কোটি ৩০ লক্ষ নাবালিকা বধূর মধ্যে ১০ কোটি ২০ লক্ষ মেয়েরই বিয়ে হয়েছিল ১৫ বছর বয়সের আগেই। যদিও উত্তর প্রদেশেই নাবালিকা বধূর সংখ্যা সব থেকে বেশি, প্রায় ৩ কোটি ৬০ লক্ষ। তবু লক্ষণীয় যে, রাজ্যে রাজ্যে সে বাম, দক্ষিণ বা মধ্যপন্থী, যে শাসক দলই বিরাজমান থাকুক না কেন, শিশু কন্যাদের সামাজিক অবস্থানে তেমন কোনো রদবদল ঘটছে না।

ঘটছে না, কারণ মানসিকতাতেই যে বদল হচ্ছে না। আর এই বদলের অভাবেই মেয়েদের অধিকার রক্ষায় নানাবিধ আইনগুলিরও যথার্থ প্রয়োগ হচ্ছে না আমাদের দেশে। হলে হয়তো, কে জানে একটা অসাধারণ সমাজ তৈরির সুযোগ ঘটত। অবশ্য একথা সত্য যে, রাজ্যে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে কিছু সরকারি প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। নিশ্চয়ই তার কিছু সদর্থক ফলও মিলছে। কিন্তু তাতেও সামগ্রিক ভাবে সমাজে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির তেমন পরিবর্তন হচ্ছে কই? অথচ ২০৩০ - এর মধ্যে গোটা বিশ্ব থেকে বাল্যবিবাহ নির্মূল করার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে হলে যে ভারতে গত ১০ বছরে যেভাবে এই কাজ এগিয়েছে, তার তুলনায় ৪ গুন দ্রুততায় বাড়াতে হবে সেই কাজের গতি। কারণ হাতে আছে আর মাত্র দশটি বছর।

আসলে আমার কেন জানি না মনে হয়, এইসব কু-প্রথা ও কু-সংস্কারের নামাবলী চড়িয়ে আজও যে সামগ্রিক ভাবে মেয়েদের প্রতি ভয়ঙ্কর সহিংসতার ঘটনাগুলি ইতস্তত ঘটেই চলেছে, তা যেন আমাদের আর সেভাবে স্পর্শ করে না। তাই বেসরকারি সংগঠনগুলির কিছু উদ্যোগ থাকলেও এব্যাপারে বৃহত্তর সমাজ যেন সম্পূর্ণ উদাসীনই থাকে।

কারণ সত্যি যদি আমাদের এই সব নির্মূল করার তেমন তাগিদ থাকত, এই ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির ততটা সদিচ্ছা থাকত, আন্তরিক প্রয়াস বা উদ্যোগ থাকত, তাহলে ওই প্রায় বিগত দেড়’শ বছর কিন্তু খুব একটা কম সময় ছিল না। যে সময়ের হাত ধরে সেই ঊনিশ শতকে শুরু হওয়া বঙ্গ সমাজ বদলের হাওয়াটিকে ঝড়ে রূপান্তরিত করা যেত। এবং সেই ঝড়ে ওইসব কু-প্রথা, কু-সংস্কার, কু-আচরণগুলিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করাও যেত মনে হয় । এবং তাহলেই হয়তো আজও ওই শ্লাঘা অনুভবের সত্যই কোনো অবকাশ থাকত আমাদের।


ঋণ স্বীকারঃ https://www.unicef.org/india/media/1176/file/Ending-Child-Marriage.pdf