আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ভারতের ‘কঠিনতম’ লকডাউনের ইতিকথা

গোপাল বিশ্বাস


কোভিড-১৯ সংক্রমণ আজ বিশ্বের প্রায় বেশির ভাগ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। ২৫ আগস্ট ২০২০ অবধি তথ্য অনুযায়ী এই রোগে এখনও পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে সংক্রমিত হয়েছেন ২ কোটি ৩৫ লক্ষের বেশি মানুষ ও মারা গেছেন প্রায় আট লক্ষের ও বেশি মানুষ। গত বছর ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে চিনের উহান প্রদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব হলেও, জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই রোগ দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। প্রথমে থাইল্যান্ড ও পরে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র ও একে একে অন্যান্য দেশে। এদেশে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩০ জানুয়ারি, কেরল রাজ্যে। যেহেতু কেরলের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী উহানে পড়াশোনা করে, তাদের ফিরে আসার সম্ভাবনার কথা ভেবে কেরল সরকার আগে থেকেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

২২ মার্চ একদিনের জনতা কারফিউ পালন করা, মাত্র চার ঘণ্টা নোটিস দিয়েই ২৫ মার্চ থেকে দেশব্যাপী সম্পূর্ণ লকডাউনের ঘোষণা করা, তিন তিন বার সেই লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো ও দেশে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ থাকা অবস্থাতেই লকডাউন তুলে নেওয়া - এসবই বহু আলোচিত বিষয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড-১৯ গভর্নমেন্ট রেসপন্স ট্র্যাকার ভারতের এই লকডাউনকে বিশ্বের কঠোরতম লকডাউনের তকমা দিলেও, প্রয়োজনের বহু আগে প্রস্তুতিহীন অবস্থাতে ঘোষণা করা এই লকডাউনের প্রয়োগনীতি ও কার্যকারিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকে গেছে। ২৫ মার্চ মোট করোনা সংক্রমিতের সংখ্যার নিরিখে ভারত ৪০-তম স্থানে ছিল কিন্তু প্রায় ৭০ দিন ‘কঠোর’ লকডাউনের পর প্রায় এক মাসের মধ্যেই ভারত মোট সংক্রমণের নিরিখে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যায়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে করোনার সংক্রমণ রোধে ‘বিশ্বের কঠোরতম’ এই লকডাউন তবে কতটা সফল? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর খোঁজার জন্য, লকডাউনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

এই মুহূর্তে (২৫ আগস্ট) মোট কোভিড-১৯ সংক্রমণের নিরিখে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (মোট সংক্রমণ প্রায় ৫৭ লক্ষ)। তার পর যথাক্রমে ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। লেখচিত্র ১-এ এই মুহূর্তে সর্বাধিক কোভিড-১৯ সংক্রমিত বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশের শুরু থেকে দৈনিক বিস্তারের অবস্থা দেখানো হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বের ১৯৫টি দেশের রোগ প্রতিরোধ, সনাক্তকরণ, প্রশমন ও নিরাময় করার ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচক (Global Health Security Index or GHS Index) প্রকাশিত হয়, তার থেকে পরিষ্কার যে এই সূচক অনুযায়ী কোনো দেশই সম্পূর্ণ রূপে অতিমারী বা মহামারীর মোকাবিলায় প্রস্তুত নয়। মহামারীর মোকাবিলায় কোন দেশ কতটা প্রস্তুত তার নিরিখে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র দ্বিতীয়, ব্রাজিল নবম, দক্ষিণ আফ্রিকা ২৫-তম, ভারত ৩২-তম ও রাশিয়া ৪৩-তম স্থানে রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সামগ্রিক সূচক অনুযায়ী ভারত ৫৭-তম স্থানে রয়েছে।

জনসংখ্যা ও মহামারী মোকাবিলার সূচকের তুলনায়, ভারতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম এবং তা সম্ভব হয়েছে লকডাউনের কারণে - এই বলে সরকার লকডাউনের কৃতিত্ব দাবি করেছে। বিভিন্ন সরকারি মহল ও সরকার সমর্থক গবেষণা সংস্থাও এই তত্ত্বের সমর্থন করে বিভিন্ন সংখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে, লকডাউন করে আমরা ১৪ লক্ষ থেকে ২৯ লক্ষ সংক্রমণ আর ৩৭ হাজার থেকে ৭৮ হাজার ভারতীয়ের মৃত্যু এড়াতে পেরেছি। যদিও অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, ভারতে সংক্রমণের সংখ্যা কম থাকার অন্যতম কারণ হল কম সংখ্যক পরীক্ষা। Our World in Data-র তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতি দশ লক্ষ জনে কোভিড-১৯ পরীক্ষার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। যেমন, ৩০ জুন পর্যন্ত ভারতে প্রতি দশ লক্ষে কোভিড-১৯ পরীক্ষা হয়েছিল মাত্র ৬২৩৮ জনের, যেখানে রাশিয়ায় ১৩৪০৪৯ জনের, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯৭৫৭৮ জনের, দক্ষিণ আফ্রিকাতে ২৭৪৮৩ জনের এবং ব্রাজিলে ৬৯৫৭ জনের পরীক্ষা হয়েছিল। তবে এই তুলনা কতটা কাজের সেই প্রশ্নও অনেকে তুলতে পারেন। এপ্রিল মাসেই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR) জানায় যে “not everyone is vulnerable”, কাজেই ভারতে শুধুমাত্র সংকটাপন্ন রোগীদের টেস্ট করা হচ্ছিল।

সূত্রঃ WHO Coronavirus Disease (COVID-19) Dashboard (https://covid19.who.int)

ভারতের লকডাউন - এক নজরে

খুব সঙ্গত কারণে ভারতে লকডাউন শুরু করা ও তুলে নেওয়ার সময় বেশ বিতর্কিত। ভারতে প্রথম সংক্রমণের খোঁজ মেলে ৩০ জানুয়ারী। ভারতে লকডাউন শুরু হয় যখন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৫১৯ ও মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৯ জনের। এই মুহূর্তে (২৫ আগস্ট) ভারতে মোট সংক্রমিতের সংখ্যা ৩২ লক্ষ ছুঁতে চলেছে এবং মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫৮ হাজারেও বেশি মানুষের। সংক্রমণের পরিণতি নিয়ে যে সমস্ত রোগীর সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য জানা গেছে (অর্থাৎ যে সমস্ত সংক্রমিত ব্যক্তি হয় সুস্থ হয়ে উঠেছেন অথবা মারা গেছেন) তার ভিত্তিতে বলা যায় যে করোনা সংক্রমণে ভারতে মৃত্যুর হার ২.৩৭ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ২২ মার্চ দেশব্যাপী ‘জনতা কারফিউ’ (স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি) পালন করার পর ২৫-শে মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল দেশব্যাপী সম্পূর্ণ লকডাউন। টানা ১০ সপ্তাহ ধরে চারটি পর্যায়ে লকডাউন চলার পর তা শিথিল হয় ১ জুন। শুরু হল আনলক পর্যায়। হঠাৎ ঘোষণা করা এই লকডাউনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে পড়েন বহু মানুষ। মে মাস থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে জনগণকে চলাচল করার অনুমতি দেওয়া শুরু হয়। বিভিন্ন রাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিক, তীর্থযাত্রী, পর্যটক, ছাত্র-ছাত্রী ও অন্যান্যদের বাড়ি ফেরানোর জন্য ১ মে থেকে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালু করা হয়। তবে বেশ কিছু রাজ্য আটকে পড়া মানুষজনের জন্য বাসেরও আয়োজন করে। শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনকে ঘিরে তৈরি হয় নানা বিতর্ক। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এই ট্রেন অনেক আগেই চালানোর প্রয়োজন ছিল। তাহলে এড়ানো যেত অনেক মর্মান্তিক ঘটনা। প্রথম দিকে সংক্রমণের সংখ্যাও ছিল কম ও তা ছিল শহরকেন্দ্রিক। সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবার পর যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত শহরে, আটকে থাকা মানুষেরা ফিরতে শুরু করেন সংক্রমণ তখন ধীরে ধীরে ছড়াতে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে। স্টেশনে স্টেশনে ব্যবহৃত থার্মাল স্ক্রিনিং যেহেতু উপসর্গবিহীন কোভিড রোগী সনাক্ত করতে অক্ষম, তাই অনেক সংক্রমিত ব্যক্তিই হয়তো ফিরে গেছেন তাদের নিজেদের গ্রাম ও শহরে আর এদের সংস্পর্শে মানুষ নিজেদের অজান্তেই সংক্রমিত হয়েছেন। এই তত্ত্ব একদম উড়িয়ে দেবার নয়। কারণ দেখা গেছে যে বেশিরভাগ পরিযায়ী শ্রমিকেরা যখন নিজেদের রাজ্যে (যেমন উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং আসাম) ফিরেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই তারপর থেকে এই সব রাজ্যের বিশেষ বিশেষ জেলাতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, শোনা যায় যে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমবঙ্গের নতুন সংক্রমিতদের অর্ধেকেরও বেশি ছিলেন রাজ্যে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকরা।

শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন নিয়ে বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়, বিশেষত কেরলগামী ও পশ্চিমবঙ্গগামী ট্রেনগুলো নিয়ে। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন যে রাজ্যকে না জানিয়েই অতি সংক্রমিত অঞ্চল থেকে ট্রেন যাত্রা শুরু করে দেয়, যার ফলে রাজ্য অনেক ক্ষেত্রে প্রস্তুত হওয়ার প্রয়োজনীয় সময় পায়নি। আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও আভিযোগ করে বলেন যে কেন্দ্রীয় সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি করছে এবং রাজ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে পাল্টা অভিযোগ করা হয় যে বিরোধীদল শাসিত রাজ্যগুলি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনকে তাদের রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন নিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক তরজা নয়, ট্রেনের ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ও জলের যোগান নিয়েও অনেক অভিযোগ শোনা গেছে। নিচের সারণীতে ভারতের প্রথম করোনা সংক্রমণের পর থেকে সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সময়সূচী দেখান হয়েছে।

সারণী ১: ভারতের প্রথম করোনা সংক্রমণের পর থেকে সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সময়সূচী ও অন্যান্য বিবরণ

তথ্য উৎসঃ https://www.mygov.in/covid-19 ও বিভিন্ন সংবাদপত্র।

ভারতে লকডাউন কতখানি কার্যকর?

একটানা ১০ সপ্তাহ লকডাউন, যা নাকি বিশ্বের ‘কঠোরতম’ লকডাউন, চলা সত্বেও ভারতে এখনও দৈনিক সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, অর্থাৎ প্রতিদিনের নতুন সংক্রমণের সংখ্যা তার আগের দিনের থেকে বেশি। ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ এখনো যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সংক্রমণ এখনো সর্বাধিক সীমার ধারে কাছেও পৌঁছয়নি। নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যুর র হার কমতে দেখে ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি এবং স্পেনের মত দেশ লকডাউন শিথিল করতে শুরু করেছিল। সেখানে ভারতে লকডাউন তুলে নেয় এমন একটি সময়ে যখন নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা দুই-ই ঊর্ধ্বমুখী। তবে ভারতে সংক্রমণের বেশিরভাগই কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মোট সংক্রমিতের প্রায় ৮০ শতাংশই ১০টি রাজ্য থেকে। শুধুমাত্র মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশেই রয়েছেন ৪৫ শতাংশ সংক্রমিত। ভারতের লকডাউনে প্রথম পাঁচ সপ্তাহ বিধি নিষেধ ছিল সব থেকে বেশি। মে মাসে কিছুটা বিধিনিষেধ শিথিল করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে থাকা মানুষদের ফিরিয়ে আনা শুরু হল। তবে সামগ্রিক ভাবে লকডাউনের প্রতিটি পর্যায়ে সংক্রমণের বৃদ্ধির হার উত্তরোত্তর কমতে থেকেছে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। একই সঙ্গে এটাও লক্ষ্য করা যায় যে লকডাউনের শুরুর দিকে যেসব রাজ্যগুলোতে সংক্রমণ খুবই কম ছিল, সেখানেও লকডাউনের তৃতীয় পর্যায় থেকে সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে এবং কয়েকটি রাজ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধির হারও বাড়তে থাকে। লেখচিত্র ২ লকডাউনের আগে ও লকডাউনের চারটি পর্যায়ে সর্বাধিক কোভিড-১৯ সংক্রমিত কিছু রাজ্যের দৈনিক সংক্রমণ বৃদ্ধির হার দেখায়।

তথ্য উৎসঃ https://www.mygov.in/covid-19

বিশেষজ্ঞরা ভারতের লকডাউনকে বিভিন্নভাবে সমালোচনা করেছেন। সম্প্রতি কেরল সরকার আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে (Kerala Dialogue) নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন যে ভারত সরকার এই লকডাউন “অপরিকল্পিত ও কাঠামোবিহীন” ভাবে “কর্তৃত্বমূলক পদ্ধতিতে” বাস্তবায়ন করেছে। তিনি আরও বলেছেন, এভাবে লকডাউন বাস্তবায়িত করার ফলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে দিনমজুর ও শ্রমিকরা, কষ্ট ও দুর্দশার শিকার হয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকরা ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রের মেরুদণ্ড, কিন্তু হঠাৎ লকডাউনে কাজ হারানোর ফলে তারা গুরুতরভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।

অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর মতে ভারতে লকডাউন পুরোপুরি সফল হতে না পারার কারণ অবৈজ্ঞানিকভাবে বাস্তবায়ন। সাধারণত লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণের গতি কমিয়ে দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে সরকারের হাতে কিছুটা বাড়তি সময় দিয়ে দেওয়া যা সদ্ব্যবহার করে সরকার মহামারীর সঙ্গে লড়ার জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো তৈরি করতে পারে। চতুর্থ লকডাউনের পর, ৩-রা জুন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানায় যে ৯৫২-টি কোভিড হাসপাতাল এবং ২৩৯১-টি কোভিড স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মোট ৩ লক্ষ আইসোলেশন শয্যা, ৩২৪২০-টি আইসিইউ শয্যা এবং ১.২০ লক্ষ অক্সিজেন-যুক্ত শয্যা কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু এই সংখ্যাগুলোর বিস্তারিত ভাবে রাজ্যভিত্তিক বিন্যাস বা কতগুলো পরিকাঠামো নতুন সংযোজন হয়েছে আর কতগুলি পুরনো কাঠামোকেই পরিবর্তিত করা হয়েছে সেই বিষয়ে সরকার নিশ্চুপ থেকেছে।

লকডাউনের সাফল্য প্রমাণ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনের প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন রকম ইতিবাচক তথ্য প্রচার করতে শুরু করে দেয়। ১১ এপ্রিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব প্রেস ব্রিফিং-এ জানান যে সঠিক সময়ে লকডাউন শুরু করার ফলে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ৮.১ লক্ষেরও বেশি কোভিড-১৯ সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। ২৪ এপ্রিল, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রেস ব্রিফিং-এ নীতি আয়োগের সদস্য ড. ভি কে পাল জানান, তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সংক্রমণের রেখা নিম্নগামী হতে শুরু করেছে এবং মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। ২২ মে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফ থেকে আরও বিস্তারিত তথ্য প্রচার করে জানানো হয়, ১৫ মে-এর মধ্যে ১৪ থেকে ২৯ লক্ষ সংক্রমণ এবং ৩৭ থেকে ৭৮ হাজার মানুষের মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে ২৭ মে ইন্ডিয়ান সায়েন্টিস্টস রেসপন্স টু কোভিড-১৯ (Indian Scientists Response to CoViD-19) গ্রুপ একই তথ্যের মান্যতা দিয়ে বিবৃতি দেয়। এছাড়াও সরকারের তরফে প্রায়ই প্রচার করা হয় যে ভারতে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।

২৫ আগস্টের (সকাল ৮ টা) তথ্য অনুযায়ী ভারতে মোট সংক্রমণের সংখ্যা ৩১,৬৭,৩২৩, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫৮,৩৯০ জনের। বিগত কিছুদিন ধরে বিশ্বে মোট দৈনিক সংক্রমণের সর্বাধিক ভারতেই দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ গত একসপ্তাহে ভারতে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা বিশ্বের অন্যান্য সমস্ত দেশের থেকে বেশি। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে ভারতের লকডাউন কি আশা অনুযায়ী ফলপ্রসু হয়নি? সামগ্রিকভাবে ভারতে সংক্রমণের বৃদ্ধির দৈনিক হার লকডাউনের বিভিন্ন পর্যায়ে কমতে শুরু করলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া থামেনি। সরকার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ১০ এপ্রিল ভারতে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল শুধুমাত্র ৩৫৪-টি জেলায়, ১৭ এপ্রিল সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে ৪০৮-টি জেলায়, ২১ এপ্রিল ৪২৯-টি জেলায়। বর্তমানে দেশের প্রায় সব জেলাই করোনা সংক্রমণের আওতায়, যদিও জেলাভিত্তিক তথ্য এখনও অসম্পূর্ণ।

সম্প্রতি দিল্লী সরকার দ্বারা সংগঠিত ‘দ্বিতীয় সেরোলজিক্যাল সার্ভে’ অনুযায়ী দিল্লীর মোট বাসিন্দার এক-তৃতীয়াংশের (প্রায় ৫৮ লক্ষ) দেহে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে যার থেকে বোঝা যায় যে তাঁরা ইতিমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন। অন্যদিকে যে দেশে কোভিড-১৯ প্রথম দেখা যায় ও যেখানে থেকে এই সংক্রামক রোগ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, সেই চিনে ইদানিং প্রায় দিনই নতুন সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা যায় মাস্ক সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করে দিয়েছে বেজিংয়ের স্বাস্থ্য দফতর।

লকডাউন যে পুরোপুরি সফল নয় তা ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন। জুন মাসের ৮ তারিখ একটি অনলাইন রাজনৈতিক সমাবেশে লকডাউন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “…আমাদের ভুল হয়ে থাকতে পারে, আমরা হয়তো কোথাও কোথাও হয়তো যথেষ্ট কাজ করতে পারিনি...”। বোঝাই যাচ্ছে যে সরকার দেশের নিজস্ব বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করে বা গাণিতিক মডেলের পূর্বাভাস দেখে বা উন্নত দেশগুলিকে অনুসরণ করে বা অন্য কোনো রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক কারণে অনেক আগেই লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছিল। লকডাউন ভারতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির হারকে কমাতে সক্ষম হলেও, করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে ব্যর্থ। এখন এটাও খুব পরিষ্কার যে এই পরিকল্পনাবিহীন লকডাউন শুধু যে সাধারণ মানুষদের করোনার থাবা থেকে বাঁচাতে পারেনি তা নয়, দেশের অর্থনীতিকেও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে।