আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

প্রতিবাদের ভাষা, হন্যমান গায়ক, এবং মৃত্যুহীন গান...

স্বাগতম দাস


সময়টা ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসের এক বিকেল। আগেয়ান সমুদ্রের উপকূলে পশ্চিম তুরস্কের একটি সাজানো শহর ইজমির। এই শহরের আতাতুর্ক থিয়েটার হলের বাইরে তখন আস্তে আস্তে জমছে শ্রোতাদের ভিড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে একটি ব্যান্ডের গানের অনুষ্ঠান, থিয়েটার-এর ভেতরে চলছে মাইক টেস্টিং। হঠাৎ কয়েকটা মিলিটারি জীপ-এ হাজির হলো হেলমেট এবং শিল্ড-ধারী পুলিশবাহিনী। তাদের মধ্যে বেশ কিছু লেগে গেলো বাইরে জড়ো হওয়া শ্রোতাদের ছত্রভঙ্গ করার কাজে। গান শুনতে আসা মানুষের ওপর আছড়ে পড়লো জল কামান, তাঁদের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হলো লংকার গুঁড়োর স্প্রে। আর অবশিষ্ট পুলিশবাহিনী থিয়েটার-এর ভেতরে ঢুকে গিটারের বিরুদ্ধে উঁচিয়ে ধরলো বন্দুক। গ্রেপ্তার করা হলো ব্যান্ডের সদস্যদের, গড় বয়েস যাদের কারোরই তিরিশ পেরোয়নি।

যে ইতিহাসের সবটা পাঠ্য বইতে লেখা থাকে না, তার সাক্ষ্য মানলে দেখা যায়, দেশ কালের গণ্ডি পেরিয়ে, বার বার গান হয়ে উঠেছে বিরুদ্ধতার এক চাবুক। সেই চাবুক স্বৈরাচারী শাসকের উদ্দেশ্যে আন্দোলিত হয়েছে হিংসায় নয়, বরং সুরে, ছন্দে। তখন সেই সব গানকে আমরা বলেছি প্রতিবাদের গান। মুক্তিকামী মানুষের বুকে সেই গান জুগিয়েছে প্রতিরোধের আগুন। কিন্তু কতটা প্রতিরোধ ভরা থাকতে পারে ২-৩ মিনিটের কয়েকটা গানে? কতটা রাজনৈতিক হয়ে উঠলে সেই গান, তাকে থামাতে রাষ্ট্র করে সশস্ত্র পুলিশের আয়োজন?

একটু অবাক শোনালেও, তুরস্কের এই ফোক-রক ব্যান্ডটির সদস্যদের কাছে রাষ্ট্রের এই প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠেছিল বেশ স্বাভাবিক এবং পৌনঃপুনিক। গ্রূপ ইওরাম নামের এই ব্যান্ডটি তার জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিবাদের গান বানিয়ে তুরস্ক সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিল। ২০১৮-র ফেব্রুয়ারী থেকে এর সদস্যদের ওপর রাষ্ট্রের নিপীড়ন সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। শুধুমাত্র তুরস্কের সংখ্যালঘু কুর্দ সম্প্রদায়ের ওপর ঘটে চলা অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিবাদে গান বাঁধতেন বলে, ব্যান্ড-এর পাঁচজন সদস্য-কে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সরকার মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীদের তালিকায় তুলে ফেলেন। শান্তিপূর্ণভাবে গান গেয়ে প্রতিবাদ করার অধিকারটুকু হারাতে হারাতে, মার খেতে খেতে, গ্রেপ্তার হতে হতে, ২০১৯-এর মাঝামাঝি জেল-এ থাকাকালীন এই ব্যান্ডের অন্যতম ভোকালিস্ট হেলিন ব্যালেক শুরু করেছিলেন এক আমৃত্যু অনশন। খুব স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্র তাঁর মুখের কাছে তুলে ধরেনি কোনো কমলালেবুর রসভর্তি গ্লাস, এমনকি অনশনের ২৮৮ দিন অতিক্রান্ত হলেও। নাহ, তুরস্কের সাধারণ মানুষের তরফে মধ্যস্থতা করার বহু চেষ্টা সত্ত্বেও, সরকারি তরফে মানা হয়নি তাঁদের একটিও দাবি। গত ৩-রা এপ্রিল, সারা পৃথিবীতে বহু মানুষ যখন লড়াই চালাচ্ছেন এক প্রাণঘাতী ভাইরাল সংক্রমণের বিরুদ্ধে, তখন প্রায় অলক্ষিতেই চলে গেলেন হেলিন, মাত্র ২৮ বছর বয়েসে, শুধুমাত্র স্বাধীনভাবে গান গাইতে পারার অধিকারের স্বপক্ষে তাঁর নিজস্ব লড়াই জারি রেখে।

তুর্কিশ ভাষায় ‘ইওরাম’ শব্দটার মানে ব্যাখ্যা বা ইন্টারপ্রিটেশন। প্রাণচঞ্চল যে শহরটার অর্ধেকটা এশিয়াতে আর বাকি অর্ধেকটা ইউরোপ, সেই ইস্তানবুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৮৫ সালে, চার তরুণ বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন এই নামের একটা ব্যান্ড। ১৯৭০-৮০র দশকের ল্যাটিন আমেরিকাতে ‘‘নুয়েভা ক্যানসিওন’’ বা নতুন ধারার গানের আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেই আন্দোলনের আবর্তে গায়করা আর শুধু বিনোদনের জোগাড়ে থাকেন না, হয়ে ওঠেন সমাজকর্মী। গানের কথাকে হতেই হয় সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। এই আন্দোলনের ঢেউটিই তুরস্কে ইওরাম ব্যান্ডের স্রষ্টাদের সাহস জুগিয়েছিল এমন একটা উদ্যোগ নিতে। এঁরা তুর্কিশ এবং কুর্দ লোকসংগীতের আঙ্গিকে বিভিন্ন কন্সার্টে গাইতে শুরু করেন প্রতিবাদের গান। সেই গানে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, মার্কিন যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে এবং তুর্কি সরকারের বহু মানবাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রচিত হতে থাকে প্রতিবাদ। আর ছড়িয়ে পড়ে মূলত কমবয়েসী এবং বাম-মনস্ক তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। ক্রমশ এঁদের গানের বিষয় হয়ে ওঠে এমন অনেক কিছু যা ছিল সরকারের পক্ষে চরম অস্বস্তির। গান বাঁধা হয় দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্কের অধিবাসী কুর্দ জনজাতির অধিকারের লড়াই নিয়ে, যে কুর্দ-দের দীর্ঘদিন তাঁদেরই নিজভূমে পরবাসী করে রেখেছে তুরস্ক সরকার। কুর্দ সংস্কৃতি-তো বটেই, নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে তাঁদের নিজেদের ভাষাও। অনেক গান বাঁধা হয় এমনকি সেই নিষিদ্ধ কুর্দ ভাষাতে। ইওরামের গানের কেন্দ্রে বার বার উঠে আসে তুরস্ক সরকারের গরিব-বিরোধী নীতি। সেই গানে ধরা থাকে সরকারি উদ্যোগে, অর্থবানের নগরায়ণের নেপথ্যে গ্রামপতনের শব্দ, গরিব মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে নিজের দেশেই উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার আখ্যান। এর ফল-ও মিলে যায় হাতে হাতে। সরকার থেকে খুব চিরাচরিত পথেই ঘোষণা করা হয় এই প্রতিবাদী ব্যান্ডের ছেলেমেয়েরা সব সন্ত্রাসবাদী, তুরস্কের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন রেভলিউশনারী পিপলস লিবারেশন পার্টি-র মদতে সরকার-বিরোধী গান লিখে দেশের রাষ্ট্রনায়কদের উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। গত দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় ৪০০ বার গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন ইওরাম-এর সদস্যরা। কিন্তু থেমে যাননি কখনো। তাই ইওরাম-এর কন্সার্টগুলো আর শুধু তুরস্কে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইউরোপে। এখনো পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া ২৩-টি এলবামে সংকলিত সেই সব গান কখনও নব্য-নাজীদের বিরুদ্ধে বা কখনো ফ্রান্স, ইতালি কি পর্তুগালে সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা জুগিয়েছে সেসব দেশের ছাত্রছাত্রীদের।

পুলিশের নজরদারি মুক্ত স্বাধীন গানের অনুষ্ঠান করা, দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার, দাগি অপরাধী-দের তালিকা থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া সহ পাঁচ দফা দাবিতে, ২০১৯ সালের মাঝামাঝি জেলে বসে অনশন শুরু করেন দুই ব্যান্ড সদস্য হেলিন এবং ইব্রাহিম গোকচেক। নভেম্বর মাসে জামিনে ছাড়া পেয়েও হেলিন ও ইব্রাহিম তাঁদের দাবিতে ছিলেন অনড়। ইস্তানবুলের একটি মহল্লায় নজরবন্দি থেকেও এঁরা অনশন চালিয়ে যান। তুরস্ক সরকার চাননি ব্যাপারটা সারা পৃথিবীর মিডিয়া-তে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিক। ২০২০ -র মার্চে তাই একটা হাসপাতালে বন্দি রেখে, জোর করে কঠিন খাদ্য খাইয়ে, সরকারি ডাক্তার-রা ভাঙতে চাইছিলেন এই অনশন। এবং বিফল হচ্ছিলেন বার বার। প্রসঙ্গত, তুর্কি-তে, অনশনকারী-রা সাধারণত কোনো কঠিন খাবার না খেলেও, তরল এবং ভিটামিন গ্রহণ করেন যাতে অনশন-রত অবস্থায় প্রতিবাদ হতে পারে দীর্ঘায়িত - হ্যাঁ, সেইসাথে মৃত্যুর জন্যে প্রতীক্ষাও হতে থাকে প্রলম্বিত। অনশনের ২৮৮তম দিনে থেমে গিয়েছে হেলিনের হৃদস্পন্দন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যান্ডের ব্যাস গিটারিস্ট ইব্রাহিম চলে গেলেন ৩২৩ দিনের অনশনের পর, মাত্র ৪১ বছর বয়েসে। তাঁর স্ত্রী, যিনি নিজেও ইওরাম-এরই অন্যতম সদস্য তখন জেলে।

হীরক রাজার দেশে ছবি-র চরণদাস বাউল-কে একবার মনে করে দেখতে পারেন। বাউল-এর গানে ‘‘দেখো ভালো জনে রইলো ভাঙা ঘরে/ মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে’’ ইত্যাদি শুনে, নিজের স্বরূপ জনসমক্ষে বেরিয়ে পড়ছে দেখে, ভয়ানক খেপে গিয়ে হীরক রাজা তাকে তো হাত-পা বেঁধে জঙ্গলে নিক্ষেপ করালেন। তারপর, অন্ধকার জঙ্গলে গুপী আর বাঘা যখন চরণদাসকে কুড়িয়ে পেলো, তখন সে মুখ বাঁধা অবস্থাতেও গুন্ গুন্ করে ভেঁজে নিচ্ছে একটা সুর। বাঘা যখন তাকে জিজ্ঞেস করে - ‘তবু তুমি গান গাইছো?’ তখন চরণ দাসের জবাব - ‘জান আছে তো তাই গানও আছে।’ রাষ্ট্রের নানা দমন-নীতির সমালোচনা করে, একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রনায়কদের ব্যঙ্গ করে গান/কবিতা বাঁধবেন যাঁরা, রাষ্ট্র বাগে পেলে কি তাঁদের মাথায় মৃদু হাত বুলিয়ে দেবে? বরং গোপনে চিরতরে সরিয়ে দিতে না পারলেও (মিডিয়ার ভয়ে), প্রকাশ্যেই তাঁদের জীবনকে করে তুলবে যাপনের অযোগ্য। কিন্তু এই ধরণের অত্যাচার-এ দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে কখনো থমকে যায়নি প্রতিবাদ। ইতিহাসের সরণি বেয়ে সেই প্রতিবাদের ধারায় জেল, ফাঁসি, অনশন, অনটনের প্রাচীর পেরিয়েই যুক্ত হয়ে যান কাজী নজরুল থেকে বেঞ্জামিন মোলাইজ, চেরাবান্ডারাজু থেকে ভারভরা রাও। একইভাবে ইওরাম কোনোকালেই কিছু নির্দিষ্ট সদস্যের ব্যান্ড ছিল না, বহু মানুষ বিভিন্ন সময় এতে যোগ দিয়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন, গৃহবন্দী থেকেছেন, ছেড়ে দিয়েছেন, আবার নতুন মুখেরা উঠে এসেছে প্রতিবাদের গান গলায় নিয়ে। ফলে হেলিন বা ইব্রাহিমের জন্যেও থেমে যাবে না ইওরাম। এঁদের শহীদত্ব বরং তার গানগুলোতে আরো বারুদ যোগাবে। আর সেই সব আগুন-রঙা গানের সামনে বড় বেচারা মনে হবে অগণতান্ত্রিক তুরস্কের স্বৈরাচারী সরকারকে, বেচারা মনে হবে পৃথিবীর সমস্ত সরকারকে।