আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭
প্রবন্ধ
কোভিডবিশ্বের স্বাস্থ্য রাজনীতি ও রাশিয়ার স্পুটনিক টিকা
স্বপন ভট্টাচার্য
অতিমারি আমাদের জীবনকে যে ‘নিউ নর্ম্যাল’-এর ছাঁচে ঢেলে সাজাতে চলেছে তার ছাপ পড়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিতে। একটা বৃত্ত পরিপূর্ণ করার মত আমরা বিশ্বায়নের ধারণা থেকে নেশনের ধারণায়, আন্তর্জাতিকতা থেকে জাতীয়তাবাদের ধারণায়, মুক্ত বিশ্ব থেকে স্বতন্ত্রতার ধারণায় ফিরে যেতে চাইছি। অথচ সময়টা এরকম যে উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ, উন্নত থেকে উন্নতিশীল বিশ্ব, ধনী থেকে দরিদ্র বিশ্ব, সকলকেই একসূত্রে বেঁধে দিয়েছে একটা অসুখ যার কারণ হল একটা অতি-আণুবীক্ষণিক জীবাণু, করোনাভাইরাস।
বিশ্বের স্বাস্থ্য রাজনীতির সর্বাধিক আলোচিত উপাদান হল টিকা। সংক্রমণ প্রতিহত করবার উপায় হিসাবে টিকার ব্যবহার স্বীকৃত হয়েছে সেই ১৭৯৫ সালে যখন এডওয়ার্ড জেনার গরুর বসন্তক্ষতের পুঁজ ব্যবহার করে নয় বছর বয়সী বালক যোশেফ মেইস্টারের ছোট্ট শরীরটাকে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী করে তোলেন। তবুও গুটিবসন্ত মুক্ত হতে মানুষের লেগে গিয়েছে আরো পৌনে দু’শো বছর কেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সংক্রামক রোগ-বালাইয়ের বিরূদ্ধে তেমন কোনো আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ছিল না। টিকার ব্যবহার উন্নত রাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং তা ছিল স্বতন্ত্রতার সমার্থক। শুধু তাই নয় তারা এ ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখতো এতটাই যে টিকাকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল উপনিবেশবাদের প্রতীক। ১৮৯৮ তে কিউবাতে আমেরিকানদের পীত জ্বরের (Yellow Fever) প্রতিষেধক কর্মসূচিকে স্যানিটারি ইম্পিরিয়ালিজম বা স্বাস্থ্য-ঔপনিবেশিকতার নজির হিসাবে দেখা হত। ১৯৫০ এর আগে পর্যন্ত ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে টিকাকরণ কর্মসূচির তেমন কোনো উল্লেখ করার মত তথ্য নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গোটা বিশ্ব প্রভাবিত হল তিনটে বড় ঘটনায় - ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ, ভারত-সহ অন্যান্য উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা লাভ এবং জাতিসংঘের পত্তন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO হয়ে দাঁড়ালো টিকাকরণ কর্মসূচির সেই সেতু যা পশ্চিমের বাইরে নিয়ে এল সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য আবশ্যিক এই আয়ুধটিকে। সেই তখন থেকেই বিশ্বের স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রচারে ও অনুমোদনে WHO এই নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পালন করে আসছে। টিকা আবিষ্কার ও টিকার প্রয়োগে WHO-এর এই অনুমোদক ভূমিকা অনভিপ্রেত হয়ে যাবে কোনোদিন এমনটা ভাবা যায়নি এই কুড়ি কুড়ির অতিমারির আগে। অবশ্য বিশ্বায়নের প্রভাব থেকে টিকা উৎপাদনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগলে রাখতে পারেনি। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই পশ্চিমে টিকা তৈরির জন্য গবেষণা থেকে পুঁজির যোগান - সব কিছু থেকেই স্বতন্ত্রতার চিহ্ন মুছে যেতে শুরু করে। স্বতন্ত্রতা বলতে sovereignty’র কথা বলতে চাইছি আমরা।(১) টিকা উৎপাদন ছিল জাতীয় কর্তব্য, জাতীয় উন্নয়নের গোত্রচিহ্ন । সেই জায়গা থেকে বাণিজ্যকরণ ঘটল তার । টিকাকরণ কর্মসূচির সর্বজনীনতায় যে বিপুল লাভের গন্ধ আছে তার থেকে কর্পোরেট জগতকে বিচ্ছিন্ন রাখার কথা বিশ্বায়ণের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই ধীরে ধীরে তা চলে গেল ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত সংস্থাগুলির হাতে। বস্তুত অচিরেই ব্রাজিলে পীত জ্বরের টিকা উৎপাদন ছাড়া আর কোথাও সরকারি স্তরে টিকা তৈরি হচ্ছিল না ষাটের দশক থেকেই।
সুতরাং টিকাকরণ কর্মসূচি, যা ছিল জাত্যাভিমানের প্রতীক, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনক্রমেই বাজারের অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল মসৃণভাবেই। এই করোনাভাইরাসের হঠাৎ প্রকোপ স্বাস্থ্য রাজনীতিকে আবার যেন রাষ্ট্রীয় সতন্ত্রতার বা state sovereignty‘র ময়দানে ডুয়েল লড়তে পাঠিয়ে দিল। কোভিডের টিকা আবিষ্কারকে, শুধু টিকা কেন বলি, কোভিডের সাথে মোকাবিলার নীতি-নির্দেশিকাগুলিকে যতরকমভাবে বিজ্ঞান-অবিজ্ঞানের মোড়কে মুড়ে পাবলিককে গেলানোর চেষ্টা হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্তরে তাতে বেচারার সৌরমণ্ডলের বাইরে চলে যাবার কথা এতদিনে। গোমূত্র, গোময় থেকে শুরু করে ট্রাম্পের দু’শো কোটি ডোজ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কিনে ফেলা এক লপ্তে - সবই নজরুলের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলতে হয় ‘আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ’ প্রতিক্রিয়ায় কে কতটা দেশপ্রেমিক প্রমাণ করবার প্রয়াস। কোভিডের টিকার জন্য দৌড় এই প্রতিক্রিয়ার বাইরে নয়। রাশিয়ার কোভিড টিকা পেয়ে যাওয়ার ঘোষণাকে এই প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে বলেই এই উপক্রমণিকাটুকুর দরকার হল।
রাশিয়ার স্পুটনিক টিকা
ইতিপূর্বে এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত একটি নিবন্ধে(২) নতুন যে কোনো টিকা আবিষ্কারের পর জনস্বাস্থ্যের পরিসরে সেটার ব্যবহারযোগ্যতা সুনিশ্চিত করবার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত শর্তগুলি নিয়ে আলোচনা করবার অবকাশ হয়েছিল। যে কোনো নতুন টিকা নিয়ে গবেষনায় যে দুটো জিনিষ সব সময়েই মাথায় রাখতে হয়। এর প্রথমটা হল কার্যকারিতা, অর্থাৎ টিকা প্রয়োগের যা উদ্দেশ্য জীবাণুটাকে রোগসৃষ্টির আগেই প্রতিহত করা, সেটা যে সে পারছে সে সম্পর্কে একশো শতাংশ নিশ্চিত হওয়া, আর দ্বিতীয়টা হল নিরাপত্তা অর্থাৎ সংক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলেও টিকা অন্তত টিকাপ্রাপ্তের সুস্থ শরীরে সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না এ সম্পর্কে দু’শো শতাংশ নিশ্চিত হওয়া।
একটা জীবাণুর নখ দাঁত ভাঙা যে নমুনাকে টিকাকরণের কাজে ব্যবহার করা হয় সেটি এই দুই ধর্মের নিরিখে প্রায় সব সময়েই ব্যাস্তানুপাতিক, প্রায় দ্বিফলা ছুরির মত। নিরাপত্তা বাড়াতে গেলে প্রায়ই কার্যকারিতা বিসর্জন দিতে হয়। এবং নীতিগতভাবে পাল্লা সব সময়েই নিরাপত্তার অনুকূলে হবার কারণে, ক্ষতি হবার ঝুঁকি নিয়েও বাজারে একটা ভ্যাকসিন ছেড়ে দিলাম-এটা হয় না সাধারণভাবে । একটা টিকা কীভাবে শরীরকে প্রতিরোধক্ষমতা দেয়? যে কোনো সংক্রামক জীবাণু যখন শরীরে ঢোকে তখন শরীর সেটার বিরুদ্ধে নিজেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে যদি এ শত্রু তার ইতিপূর্বে চেনা হয়ে থাকে। মারক জীবাণুর ক্ষেত্রে শরীরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের ধাক্কাই মরণের বার্তাবাহী হতে পারে, তাই সত্যিকারের জীবাণুর মুখোমুখি হবার আগে শরীরকে ওই জীবাণুর অস্ত্রসস্ত্রের সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়ে দেবার কাজটাই করে টিকা। জীবাণুর এই অস্ত্রকে বলা হয় অ্যান্টিজেন। আমরা যে অপরিমেয় জীবাণুজগতের শরিক হয়ে আছি প্রতিদিন রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা তাদের বেশির ভাগকে শরীর চিনে নিয়েছে বা চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন টিকার মাধ্যমে। টিটেনাস, মাম্পস, হাম, রুবেলা, পোলিও, যক্ষ্মা-এসবের জীবাণু অভিজ্ঞতা শরীরের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে বলেই টিকার মাধ্যমে তাদের অস্ত্রশস্ত্র বা অ্যান্টিজেনের সঙ্গে শরীরকে পরিচিত করে তোলা হয় যাতে যে কোনো পরবর্তী সংক্রমণে সেসব জীবাণু মারক চেহারা নেবার আগেই শরীর ঢাল তরোয়াল নিয়ে তৈরি থাকতে পারে। শরীরের এই ঢাল তরোয়াল হল অ্যান্টিবডি যা থাকে রক্তের জলীয় অংশ প্লাজমায় আর T-কোষ নামের এক ধরণের শ্বেত রক্তকণিকায়। নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সমস্যা হল সেটা নভেল বা নতুন বলেই। যা প্রকৃতিতেই নতুন অতিথি তার অভিজ্ঞতা শরীরের থাকবে কী করে? অভিজ্ঞতা যা হল তা ভয়াবহ। গত বছরের শেষে তার আবির্ভাব আর আজ আট ন’মাস পরেও মনুষ্যসমাজ তার সঙ্গে স্বাভাবিক ক্ষমতায় খুব শিগগির যুঝে উঠতে পারবে এমন লক্ষণও নেই। কোনো ওষুধ যখন নেই তখন এই অতিথির অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে একখানা টিকার মাধ্যমে পরোক্ষ পরিচয় ঘটিয়ে শরীরকে মোকাবিলায় তৈরি রাখা এখন মানবতার চাহিদা। যদি বলা যেতে পারতো বিশ্বমানবতার চাহিদা তাহলে একটা অন্যরকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেও পারতাম আমরা ভবিষ্যতে, কিন্তু নব-বিশ্বের টিকা জাতীয়তাবাদ সে গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে।
গত ১১ আগস্ট রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বকে জানিয়ে দেন যে তাঁর দেশের টিকাকরণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোভিডের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি টিকা সাধারণের মধ্যে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের ভ্যাকসিন বিজ্ঞানীদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। বলা হয়, একটি অসম্পূর্ণভাবে ট্রায়ালে থাকা টিকাকে ব্যবহারযোগ্য বলে অনুমোদন দেওয়া হল সেটির নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ছেলেখেলা করা। পুতিনের ঘোষণা থেকেই জানা যাচ্ছে মস্কোর গামালেয়া মহামারি ও মাইক্রোবায়োলজি সংক্রান্ত গবেষণাগার (Gamaleya Research Institute of Epidemiology and Microbiology in Moscow) থেকে বাজারে এসে পড়া এই টিকা এখনও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে যায়নি। টিকার বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে Gam-Covid-Vac (৩) এবং বাজারি নাম দেওয়া হয়েছে স্পুটনিক-ভি। যে-কোনো টিকার তৃতীয় তথা চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতের, বর্ণের, বয়সের মানুষের উপর করা হয়ে থাকে। সেটাই রীতি। রাশিয়ার কোভিড টিকা সংক্রান্ত যেটুকু ফলাফল হাতে এসেছে, পুতিনের মেয়ের উপর তা প্রয়োগ করা হয়েছে এটুকু ছাড়া, তা নির্দিষ্ট কোনো প্রকাশিত গবেষণার আকারে নয় যেমনটা অক্সফোর্ড টিকার ক্ষেত্রে হয়েছে। মনে পড়ে গেল ব্রিটেনের MMR টিকা বিতর্কের কথা। ব্রিটেনে সর্বজনীনভাবে চালু করবার আগে টনি ব্লেয়ারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর নিজের শিশুসন্তানের জন্য সেটা তিনি অনুমোদন করেছেন কি না? টনি ব্লেয়ার উত্তর দেননি আর পুতিন প্রশ্ন তোলার অবকাশই দেননি, আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে প্রথম স্বেচ্ছাগ্রাহী হলেন তাঁর কন্যা। কিন্তু এ খবরে বিজ্ঞান গবেষণাকে প্রভাবিত করতে পারার মত কিছু নেই কেন না রাশিয়ার ফলাফল peer reviewed নয়, কোনো জার্নালে তা প্রকাশিতও হয়নি, যা অক্সফোর্ডের দ্বিতীয় ট্রায়ালের পর সারা গিলবার্টরা করেছিলেন। একটু তুলনা করে নেওয়া যাক অক্সফোর্ডের টিকার সঙ্গে।(৪)
ক। ব্রিটেনের টিকার ট্রায়াল হয়েছে সিঙ্গল ব্লাইন্ড র্যান্ডমাইজড পদ্ধতিতে, অর্থাৎ গবেষকরা জানতেন কে আসল টিকা পাচ্ছেন, কে নকল, ভলান্টিয়াররা জানতেন না। রাশিয়ার টিকার ট্রায়াল হয়েছে নন-র্যান্ডম পদ্ধতিতে, অর্থাৎ সবাই জানতেন কে কোনটা পাচ্ছেন।
খ। ব্রিটেনের টিকায় ব্যবহৃত হয়েছে শিম্পাঞ্জির শরীর থেকে আহৃত অ্যাডেনোভাইরাস যেটিকে জিন বদলে বংশবৃদ্ধিতে অক্ষম করে দেওয়া হয়েছে এবং যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে করোনাভাইরাসের স্পাইক অ্যান্টিজেন তৈরির জিন। স্পাইক হল ছবিতে দেখা করোনার গোলাকৃতি আবরণীর গায়ে কাঁটার মত বহিঃবৃদ্ধিগুলো। সেখানে প্রথম ডোজ ও বুস্টার ডোজে এই একই উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। রাশিয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে মানুষের দেহ থেকে আহৃত অ্যাডেনোভাইরাস যাকে একই ভাবে অকেজো ও করোনার জিন বহনে বাধ্য করে দেওয়া হয়েছে। এই অপরের জিনবাহক উপাদানগুলিকে জিন প্রযুক্তিতে বলা হয় ভেক্টর। রাশিয়ার অবশ্য প্রথম ও বুস্টারে আলাদা আলাদা অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টর ব্যবহার করা হয়েছে।
গ। দ্বিতীয় পর্যায়ে অক্সফোর্ড টিকা প্রযুক্ত হয়েছিল ব্রিটেনের পাঁচ জায়গার ১০৭৭ জন স্বেচ্ছাগ্রাহীর শরীরে। এদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৫৫’র ভিতরে। মস্কোয় দেওয়া হয়েছে মাত্র ৭৬ জনের শরীরে। এদের মধ্যে ৩৮ জনের ফলাফল প্রকাশ করেছে তারা। এদের গড় বয়স ১৮ থেকে ৬০ এর ভিতরে।
ঘ। অক্সফোর্ডের ফলাফল এসেছে ২৩ এপ্রিল থেকে ২০ মে ২০২০ পর্যন্ত পরীক্ষার পরে। রাশিয়ার এসেছে ১৭ জুন থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত পরীক্ষার পরে। অক্সফোর্ডের টিকার উপযোগিতা মাপা হয়েছিল গ্রাহকের শরীরে টিকা নেবার পরে যথাক্রমে ৩,৭,১৪,২৮ ও ৫৬ দিনের পরেও প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি মেপে এবং বলা হচ্ছে ১৮০ দিন ও ৩৬৪ দিনের পরেও তা মাপা হবে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায়। রাশিয়ান টিকার পরীক্ষায় অ্যান্টিবডির আয়ু মাপার কাজ হয়েছে টিকা নেবার পরে যথাক্রমে ৭,১৪, ২৮ এবং ৪২ দিন পরে অ্যান্টিবডি মেপে। বলা হয়েছে ৯০ এবং ১৮০ দিন পরেও তার উপযোগিতা মাপার ব্যবস্থা রেখেছে তারা।
ঙ। অ্যান্টিবডি ছাড়াও মানুষের দেহে অনাক্রম্যতার আর একটা বাহু আছে - সেটাকে বলে সেল মিডিয়েটেড ইমিউনিটি বা T-লিম্ফোসাইট নামক কোষনির্ভর প্রতিরোধক্ষমতা। এই দুই ব্যবস্থা একটা আর একটার উপর নির্ভরশীল। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এই দুই দিক দিয়েই কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে তবে টিকা নেবার ৫৬ দিন পরে সে প্রতিক্রিয়া ক্ষীণ হয়ে এসেছে। রাশিয়ান ভ্যাকসিনও তা মেপেছে ০.১৪ এবং ৪২ দিন পরে। প্রতিক্রিয়া সন্তোষজনক বলা ছাড়া আর খুব একটা কিছু বোঝবার উপায় নেই তাদের ক্ষেত্রে।
চ। উভয় দেশ থেকেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে জানানো হয়েছে জ্বর-জ্বারি, ব্যাথা, ফোলা ইত্যাদি মামুলি উপসর্গ যেগুলি সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ব্রিটেন বলেছে প্যারাসিটামল দিয়েই ম্যানেজ করা গেছে সেসব। রাশিয়া কীভাবে তা ম্যানেজ করেছে তা ভেঙে বলেনি।
ছ। একটা টিকার ট্রায়ালে সবাই যে বুস্টার ডোজ পায় তা কিন্তু নয়। যারা পায় তাদের বলে ‘প্রাইম বুস্ট গ্রুপ’। ব্রিটেনের প্রাইম বুস্ট গ্রুপে ছিল মাত্র ১০ জন ভলান্টিয়ার আর রাশিয়ার তা ২০ জন।
জ। অক্সফোর্ড টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল হবে গ্লোবাল। তা হবে ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ সব মহাদেশের মানুষের উপর। রাশিয়ান টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালও গ্লোবাল হবার কথা। বলা হয়েছে ভারত, ব্রাজিল, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর নাম।
এ পর্যন্ত যা জানানো হয়েছে তা বিশ্বের আর পাঁচটা দেশের প্রথম/দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের সঙ্গেই কেবল তুলনীয় মাত্র তার বেশি কিছু নয়। রাশিয়ান টিকা সম্পর্কে মূল অভিযোগ তথ্য সম্পর্কিত অসচ্ছতার। যেহেতু ফলাফল সম্পর্কিত প্রায় কোনো তথ্যই তারা সামনে আনেনি তাই বাকি বিশ্ব তাকে বালখিল্য এবং হাস্যকর বলতেও ছাড়েনি। বলবার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। টিকা নিয়ে টিকাপ্রাপ্ত শরীর যে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে তা কী ততক্ষণ পর্যন্ত বলা যায় যতক্ষণ না সংক্রামক জীবাণুটার একটা মারক ডোজ প্রয়োগ করার পরেও দেখা যায় শরীর মোটামুটি অবিচলিত? বরং অনেক সময়ই দেখা যায় টিকা নেবার পরবর্তী সংক্রমণের প্রতিক্রিয়া মারাত্মক। অ্যান্টিবডি প্রণোদিত প্রতিক্রিয়া বলে একে। টিকাকে এই পর্যায়ে পৌঁছানোর অবকাশই দেওয়া হয় নি, অথচ বলা হচ্ছে টিকা অনুমোদিত। টিকাকে হতে হবে স্থান কাল জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে কার্যকরী। দেশের মাত্র ৭৬ জন মানুষ, যারা নিজেরাই চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, তাদের উপর পরীক্ষা চালিয়ে এসবের নিরিখে সবুজ সংকেত দেওয়ার মধ্যে একটা নির্বাচিত বিবেচনা আছে বলেই মনে হয় প্রেসিডেন্ট পুতিনের। সেটাকে নির্বাচিত প্রতিক্রিয়াও বলা যেতে পারে। বলে রাখা ভাল, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া সহ বিশ্বের নানা জায়গার ২০ টা দেশ থেকে ১০০ কোটি ডোজের অর্ডার এখনই রাশিয়ার হস্তগত।
টিকা জাতীয়তাবাদ
করোনাপূর্ব পৃথিবীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ন্ত্রণে যে সাধারণ স্বাস্থ্যনীতি সব ক’টা দেশকে, মুখ্য সব গবষেণাগারগুলিকে বেঁধে বেঁধে রেখেছিল তা আজকের কোভিড পৃথিবীতে শতধা ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। মহামারির জন্য সক্রিয়তা সমস্ত দেশেই জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির অঙ্গ এবং এতাবৎকাল তা অঙ্গাঙ্গীভাবে সংযুক্ত ছিল আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে।(৫) তথ্য আদান প্রদান, পেটেন্ট ট্রান্সফার, এক দেশের উৎপাদন অন্য দেশের মানুষের কাজে লাগা-এগুলোই তো ছিল স্বাস্থ্য সহমর্মিতার লক্ষণ যা একসূত্রে বেঁধে রেখেছিল ধনী দরিদ্র সব দেশকেই। টিকা হল বিশ্বের স্বাস্থ্য রাজনীতির সেরা আয়ুধ। করোনার টিকার জন্য প্রয়াসে আজ যা দেখা যাচ্ছে তাকে টিকা জাতীয়তাবাদ বা ভ্যাক্সিন ন্যাশানালিজম বলাই ভাল। অথচ এই অতিমারির শুরুতে সব মুখ্য সরকারি ও বেসরকারি টিকা উৎপাদন প্রচেষ্টাকে বিশ্বমানবতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবার একটা প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। এই প্রচেষ্টার নাম ছিল, ছিল বলছি কেন, এখনো আছে COVID-19 Vaccines Global Access Facility সংক্ষেপে COVAX; এটির উদ্দেশ্য ছিল সহজ করে বলতে গেলে equitable access টিকা যে দেশই পাক না কেন বিশ্বজোড়া সমবন্টনের লক্ষ্যে কাজ করবে সবাই। কার্যত যা দেখা গেল কোনো মেজর প্লেয়ারই আর এর আওতায় থাকতে চায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্যের চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় রাজনীতি এবং অবশ্যই অর্থনীতি। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থার যুক্তিতে যা সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ালো তা হল নীতিনির্ধারক সংস্থাগুলির ভূমিকা ও গুরুত্ব। রাশিয়ার কোভিড টিকাকে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে বাধ্য হচ্ছি। টিকা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত যে কোনো রাম শ্যাম যদুই বুঝতে পারবেন যে পর্যায়ে তারা টিকার ব্যবহারযোগ্যতা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে সবুজ সংকেত দিয়েছে তা এক কথায় বলতে গেলে অপরিপক্ক, মানে প্রিম্যাচিওর। গ্লোবাল নিয়ন্ত্রক সংস্থার সম্মতি এই পর্যায়ে আসা অসম্ভব ছিল। কিন্তু সেটার তোয়াক্কা করার দরকার হচ্ছে না যদি বাকি বিশ্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাস্তা বেছে নেয়। টিকা রাজনীতিতে এই তোয়াক্কা না করার পথ কিন্তু সেইদিন খুলে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেদিন তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাশিয়ার টিকাকে আমরা এই প্রেক্ষাপটে দেখলে একটা পালটা জবাব বা প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখতে পারি। এখানে বিজ্ঞান কতটা আছে তা সম্পর্কে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না কেন না মন্তব্য করবার মত তথ্যপ্রমাণ সামনে আনার তাগিদই অনুভব করেনি তারা। এই গোপনীয়তাও আজকের বিশ্ব স্বাস্থ্য রাজনীতির বদলে যাওয়া চেহারা। কিন্তু যা বলা যায় নিশ্চিতভাবেই তা হল বিশ্বের স্বাস্থ্য রাজনীতির চেহারা আমূল বদলে দিয়েছে অতিমারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে তাতে বড়ো এবং নির্ণায়ক ভূমিকা আছে তা রাশিয়ার এই একক ঘোষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আন্তর্জাতিকতা থেকে জাতীয়তাবাদের দিকে পূর্ণবৃত্তে হাঁটছে আজকের স্বাস্থ্য রাজনীতি। রাশিয়ার টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা এই বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করল, এই যা। অবাক হব না যদি, বিশ্ব সংস্থার অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে আমাদের দেশও একখানা টিকা এনে ফেলে অচিরেই। পনেরই আগস্টের শুভক্ষণ পার হয়ে গেল অথচ তা যে হল না এতে বোঝা যায় কাণ্ডজ্ঞান সব বিসর্জিত হয়নি এখনও।
তথ্যসূত্রঃ