আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দুই শাসকের দাদাগিরিঃ অশান্ত শান্তিনিকেতন

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


এ রাজ্যে নৈরাজ্যের পরিস্থিতি নিত্যদিন নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে দুই শাসকের শাসানিতে। এই বিষয়ে কেন্দ্রের শাসক আর রাজ্যের শাসককে ছাঁকনি লাগিয়ে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। এমন নৈরাজ্যের সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেলার মাঠ ঘেরাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বেনজির অশান্তি।

এমন অশান্তির মাত্রা এবার শুধু মামুলি বিশৃঙ্খলার নজির নয় বরং তৈরি করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আতঙ্কের বাতাবরণ। আর সেই অশান্তির আবহে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক জীবন। রাজ্যের শাসক দলের বিধায়ক কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে শ’য়ে শ’য়ে বহিরাগতের উপস্থিতিতে জেসিবি, পে-লোডার দিয়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে ভাঙা হল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট। বলাই বাহুল্য প্রতিবাদ আন্দোলনের নামে এমন নির্লজ্জ হিংসার ঘটনায় স্তম্ভিত রাজ্যের মানুষ! লজ্জার এই বিবরণ ক্যাম্পাস তথা রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ভর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল ভুবনডাঙ্গা থেকে ভিয়েতনাম সর্বত্র। কলেজ স্ট্রিটের বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে বিশ্বভারতীর গেট ভাঙা, এই সব ক্ষেত্র জুড়েই রয়েছে দুই শাসকের নৈরাজ্যের প্রতিযোগিতা। আর সেই নৈরাজ্যের ধাক্কায় কুপোকাত হয়ে পড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠন গবেষণার পরিবেশ। আসলে মূর্তি ভাঙ্গাই হোক কিংবা গেট ভাঙা, এগুলো প্রতীকী ঢঙেই তুলে ধরছে হাল আমলে রাজ্যে ভেঙে পড়া শিক্ষার ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির স্তম্ভকে।

বাঙালির প্রবাদ আছে ‘এক হাতে তালি বাজে না’। একদম সেই আঙ্গিকেই সাম্প্রতিক বিবাদ বিশ্লেষণ করা যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বনাম রাজ্যের শাসকের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মাধ্যমে। কিন্তু মতের অমিল হলেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কায়দায় প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে সশস্ত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্যাম্পাস দখলে তাণ্ডব চালাতে হবে এটা যেমন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় তেমনই গ্রহণযোগ্য নয় স্বৈরশাসকের ঢঙে আমলাতান্ত্রিক কায়দায় বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ঝোঁক যা শান্তিনিকেতনের শিক্ষা আদর্শের ঘোর পরিপন্থী। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান গোটা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় সমাজ স্বীকৃত পথ। কিন্তু এদেশে আলাপ আলোচনার পথ পরিহার করে দেশের শাসক যেমন দেশ চালানোর রীতি আয়ত্ত করেছে ঠিক তেমনই কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত শিক্ষাবিদেরাও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে আলাপ আলোচনার পথ এড়িয়ে তুঘলকি ঢঙে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পথ আয়ত্ত করেছেন। সেদিক থেকে দেখলে জেএনএউ থেকে বিশ্বভারতী সর্বত্রই এমন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ঝোঁক স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার মূলমন্ত্র স্বশাসনের জন্য প্রয়োজন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু এর উলটো পথে হেঁটে এমন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তারা স্বশাসনের পথ জলাঞ্জলি দিয়ে কার্যত প্রতিষ্ঠানের সুশাসনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছেন। শাসকের দ্বারা মনোনীত হয়ে শাসকের মন রক্ষার প্রাথমিক দায় মেটাতে গিয়ে এমন কর্তাব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়িত্ব পালনের চেয়ে শাসকের নিয়ন্ত্রণের রাজনীতিকে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রসারের দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সংকটের মূলে অন্যতম কারণ এমন অশাসন এবং অব্যবস্থাও।

সাম্প্রতিক বিবাদে মুল সংঘাতের বিষয় ছিল মেলার মাঠকে ঘিরে বিশ্বভারতীর পাঁচিল তোলার কর্মসূচি। এটা আজ অধিকাংশ মানুষের জানা যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সময় থেকে চালু হওয়া এই মেলা শুধু শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য নয়, সামাজিক গুরুত্বের বিচারে এই মেলা এখন জাতীয় ঐতিহ্যের মর্যাদাবাহী। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার অন্যতম উপাদান ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমাজের যোগসূত্র গড়ে তোলা। বিকল্প সামাজিক চাহিদার বিকাশ ও পূরণে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে যেমন তৈরি হয়েছিল বিশ্বভারতী তেমনি সেই বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা দিবসকে কেন্দ্র করে এই পৌষমেলার ভাবনা ছিল গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ার লক্ষ্যে। গ্রামীণ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা, এক অর্থে বৃহত্তর সমাজ জীবনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগসূত্রের এক বিশেষ মাধ্যম হয়ে উঠেছে কালে কালে এই পৌষ মেলা। ফলে এমন মেলার সঙ্গে যেমন যুক্ত হয়ে রয়েছে অংশীদার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীবৃন্দ ঠিক তেমনই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের বাইরের গ্রামীণ মানুষ, প্রাক্তনি, আবাসিক, আশ্রমিকদের অংশীদারিত্বর প্রশ্নটিও।

দ্বিতীয়ত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্য ভাবনাতে বরাবর কাজ করেছে উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে ন্যূনতম নির্মাণ ভাবনা। ন্যূনতম নির্মাণের প্রয়োগে, প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উন্মুক্ত প্রান্তরের বিকাশের পথকেই তিনি শিক্ষার কাঙ্খিত পরিবেশ হিসেবে বিচার করেছেন মুক্ত চিন্তা, মুক্ত ভাবনার প্রসারের লক্ষ্যে। সে কারণে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে উঁচু বাড়ির দল কখনও জায়গা করতে পারেনি। সেই পরিবেশে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আর জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা ছিল মুখ্য ভাবনা প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে। সেখানকার প্রতিটি নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের দৈর্ঘ্য প্রস্থের তুলনায় সবসময়ই তার উচ্চতা ছিল খাটো। দুই নির্মাণের মাঝের দূরত্ব ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ঢের বেশি। বহুতলের বিকল্প হিসাবে এমন স্থাপত্য ভাবনার পেছনে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের মূল সুরকে প্রতিষ্ঠা করার তাগিদও। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯২১ সালে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যখন তৈরি হচ্ছে তখন শান্তিনিকেতনের নির্মাণ শুরু হলেও ভাবনার নিরিখে সেটির স্থাপত্য ভাবনায় তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক অভিজাত নির্মাণ ভাবনার প্রভাব ছিল গৌণ। প্রকৃত অর্থেই বিশ্বভারতীর স্থাপত্য ভাবনায় রবি ঠাকুরের বিশ্ববীক্ষণের প্রভাব ছিল অপরিসীম। এদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, মুঘল, সুলতানি স্থাপত্যের আত্মিকরণে বিশ্বভারতীতে ঘটেছিল স্থাপত্যের বিশ্বায়িত রূপ। কিন্তু কালের নিয়মে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার প্রয়োজনে বা পঠনপাঠন গবেষণার পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ক্যাম্পাসে নির্মাণের প্রভাব বেড়ে গেছে বহুগুন । ফলে উন্মুক্ত ক্যাম্পাস ভাবনার পথ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে। কিন্তু গত দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি রক্ষার নামে যত্রতত্র যথেচ্ছ দেওয়াল তোলা কোন স্থাপত্য ভাবনার অনুপ্রেরনায় ঘটে চলেছে তা বোঝা দুঃসাধ্য। ফলে শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়দের মত বিশ্বভারতীর আশ্রমিক, শিক্ষক, প্রাক্তনিদের বাড়ির সামনে তোলা জেলখানার মতো দেওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি রক্ষার প্রয়োজনকে ছাপিয়ে তুলে ধরেছে বিশ্বভারতীর সামন্ততান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ভাবনা। আর এমন যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ভাবনার পথে চলেই এখন শুরু হয়েছে পৌষ মেলার মাঠ পাঁচিল তুলে ঘিরে ফেলার ভাবনা।

বলাই বাহুল্য, মেলার মাঠের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে, যার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ প্রাক্তনি, আবাসিক, আশ্রমিক, পড়ুয়াদের আবেগ জড়িয়ে তেমন একটা বিষয়ে যে-কোনো পরিবর্তনের পূর্বশর্ত হল এই মেলার অংশীদার যারা তাঁদের সঙ্গে আলোচনা। কিন্তু কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের এই পাঁচিল নির্মাণ কর্মসূচী পরিস্থিতিকে ঘোরালো হতে সাহায্য করেছে।

আর এই আবেগের ঘোলা জলে রাজনীতির মাছ ধরার এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেনি রাজ্যের শাসক দল। পেশী শক্তির প্রদর্শনী করে ক্যাম্পাস দখলের রাজনীতিতে নেমে পড়েছে তারা এমন সুযোগে। ‘মাঠ বাঁচাও’ সমিতির নাম দিয়ে যেমন রাজ্যের শাসক দল প্রতিদিন নিত্য নতুন কর্মসূচী নিয়েছিল মাঠে পাঁচিল তোলার বিরুদ্ধে। আশ্চর্যের বিষয় ঠিক তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে ক্যাম্পাসের মধ্যে এমন করোনা কালে পাঁচিলের পক্ষেও মিছিল সংগঠিত হয়েছিল। ‘মাঠ বাঁচাও’ সমিতির মিছিলে যেমন ছিল রাজ্যের শাসক দলের নেতা কর্মীরা, ঠিক তেমন উপাচার্যের মিছিলে দেখা গেছে কেন্দ্রের গেরুয়া শাসকের নেতা কর্মীদের। এমন উত্তেজক মিছিল পালটা মিছিলের উত্তেজনা খালি চোখে প্রতিদিন দেখা গেলেও স্থানীয় পুলিস প্রশাসন ছিল নির্বিকার। ফলে থানার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে জেসিবি, পে-লোডার দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট শ’য়ে শ’য়ে লোক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেও পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়। এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে পূর্বপরিকল্পিত ঢঙে রাজ্যের শাসক দল এই হিংসার পথে, মানুষকে ভয় দেখিয়ে শিক্ষাদানের পথ বেছে নিয়েছিল এলাকা দখলের রাজনীতির স্বার্থেই। এখানেই জরুরি প্রশ্ন তৈরি হয় যে রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও একটা জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হতে পারে জেনেও কেন রাজ্যের প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আগাম আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি? সবশেষে রাজ্য প্রশাসনের তরফে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হল পেশি শক্তি প্রদর্শনের পর নৈরাজ্যের পরিস্থিতি তৈরি করে! এলাকা দখলের রাজনীতির চেনা ছকে রাজ্যের শাসক দল প্রকাশ্যে দিবালোকে প্রমাণ করতে চেয়েছে ‘জো মুঝসে টকরায়েগা - চুর চুর হো জায়েগা’ এমন আপ্তবাক্যকেই। ফলে ‘উন্নয়নের’ কর্মযজ্ঞের যাবতীয় সাজসরঞ্জাম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সশস্ত্র আন্দোলনের নজির গড়ল রাজ্যের শাসক দল! আর প্রত্যাশিতভাবে গোটা ঘটনাকে স্থানীয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে চালাতে উদ্যত হল রাজ্যের সরকার।

পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের রেক্টর হিসাবে রাজ্যের মাননীয় রাজ্যপালের ভূমিকাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। রাজ্যপাল হিসাবে যিনি নিত্যদিন ফেসবুক, টুইটারে মুখর থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে মেলার মাঠ ঘেরা নিয়ে সমস্ত উত্তেজক পরিস্থিতির বিবরণ প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে প্রদর্শিত হলেও কেন রাজভবন সক্রিয় হয়নি রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে, সেই প্রশ্নও উঠবে? অথচ চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার ফর্মুলায় গেট ভাঙার পর দেখা গেলো তাঁর ঝুড়ি ঝুড়ি টুইট বার্তা! ফলে মোটের ওপর রাজ্যের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্যপাল প্রত্যেকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বলি হল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ।

পাঁচিল ভাঙার উদ্যোগের পর রাজ্যের নেতা মন্ত্রীরা আউড়ে চলেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মুক্ত চিন্তা, মুক্ত ভাবনার আদর্শের কথা। পাঁচিলের বিরুদ্ধে তাঁদের এমন আদর্শগত অবস্থানের মন্তব্যে ‘ঘোড়ায় হাসবে’ বললে কম বলা হয় । কারণ এরাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থেকে পড়ুয়া আধিকারিকদের পায়ে বেড়ি পরানোর লক্ষ্যে যতগুলো আইন পাশ হয়েছে তা ভূভারতে নজিরবিহীন! রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে রেজিস্ট্রার যাতে রাজভবনের বিকল্প শক্তির নিয়ন্ত্রণে না আসে সেটা নিশ্চিত করতে যেসব বিধি এই রাজ্যে চালু হয়েছে সেসব একুশে আইনের কিছু কম নয়। বিশ্বভারতীর সাম্প্রতিক বিতর্কের প্রেক্ষিতে রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি মেলার মাঠে পাঁচিল নির্মাণের বিরোধী। হয়তো মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন সেটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতও হতে পারে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত সংস্থার দায়িত্ব যখন আলোচনার ভিত্তিতে মতৈক্যে পৌঁছানো সেখানে বহুপাক্ষিক আলোচনার আগেই সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে পাঁচিল রাখা অথবা না রাখার কোনো নির্দেশই সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজতে সাহায্য করে না এমনকি তেমন বার্তা বিবদমান পক্ষের মধ্যে জটিলতা বাড়িয়ে তোলে। এমন সরকারি বার্তায় একদিকে যেমন পাঁচিল ভাঙার ঘটনা যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে তেমনই গেট ভাঙার নৈরাজ্যের কাণ্ডারিদের দোষ স্খালন হয়ে যায় জনরোষের ফর্মুলায়। ফলে শাসক দলের এলাকা দখলের পে-লোডারের রাজনীতি বৈধ হয়ে যায় এমন সরকারি সিলমোহরে।

লাল মাটির দেশে উন্মুক্ত প্রান্তরে দেওয়াল তোলার বিশ্ববিদ্যালয়ের চেষ্টা যদি সরকারি দৃষ্টিতে অবাঞ্ছিত হয় তবে মেলার মাঠের থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বোলপুরের ডাকবাংলোর বিরাট মাঠে সম্প্রতি নীল সাদা রঙের পাঁচিল তুলে ঘেরা হোল কেন সরকারের কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে এই প্রশ্নের উত্তর সরকারের থেকে জানতে চাইবে মানুষ। অতীতে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বিশ্ববঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ক্যাম্পাসে লেখাপড়া শুরু না হলেও ক্যাম্পাসের চারপাশ ঘিরে কংক্রিটের জঙ্গল নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সরকারি মদতপুস্ত এমন নজিরবিহীন নির্মাণ মেলার মাঠের পাঁচিলের চেয়েও ভয়াবহ। ফলে অন্তরের তাগিদে নয় বরং রাজনৈতিক প্রয়োজনে রবি ঠাকুরের উন্মুক্ত প্রান্তরের ভাবনাকে ঢাল বানিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি করতে চাইছে রাজ্যের শাসক এটাও পরিষ্কার হচ্ছে দিনের আলোর মতো মানুষের কাছে।

দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক লক্ষ্য তার ক্যাম্পাসে পঠনপাঠন এবং গবেষণার পরিবেশের মান উন্নয়ন। স্বাভাবিক কারণেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের পাখির চোখ হয় তেমন বিষয়গুলি। সাম্প্রতিককালে দেশের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রকাশিত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মেধা তালিকায় NIRF রাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ক্রমশ নিম্নগামী। গত বছরে মেধা তালিকায় তাদের স্থান ৩৭ থেকে নেমে এই বছর দাঁড়িয়েছে ৫০-এ। এক ধাক্কায় ১৩ স্থানের অধোগতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পঠনপাঠন এবং গবেষণার মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন জাতীয় মেধা তালিকা তৈরিতে পঠনপাঠন এবং গবেষণার পাশাপাশি জরুরি বিষয় হল সামাজিক যোগসূত্র গড়ে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সমাজের ধারনা। কিন্তু বিশ্বভারতীর এমন পদস্খলনের কারণ অনুসন্ধানে স্বয়ং উপাচার্য মশাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আন্দোলনকে দায়ী করে দায়িত্ব সেরেছেন, যেটাও এখন পড়েছে প্রশ্নের মুখে! ক্যাম্পাসে আন্দোলন যদি জাতীয় মেধা তালিকায় বিশ্বভারতীর পিছু হঠার কারণ হয় তবে ঢের বেশি ক্যাম্পাস আন্দোলনে আন্দোলিত যাদবপুর বা জেএনইউ কি করে ঐ মেধাতালিকার একেবারে ওপরের সারিতে স্থান পাচ্ছে? আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা চিনতে প্রয়োজন আত্মউপলব্ধির মানসিকতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীদারদের সঙ্গে নিয়েই। রোগের কারণ অনুসন্ধানের চেয়েও যখন বেশি জরুরি হয়ে ওঠে রোগীর পরিচয় তখন রোগ প্রতিকারের প্রশ্নটাই গৌণ হয়ে ওঠে। ফলে বেপরোয়া সবজান্তা মানসিকতার সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পক্ষে যার সাম্প্রতিকতম নজির বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় রেখে অনুশীলনের প্রয়োজন তার এগিয়ে চলার পথের খোঁজ। ‘রবীন্দ্রনাথ’ শান্তিনিকেতনে বহিরাগত হিসেবেই এসেছিলেন অতএব সকল বহিরাগত প্রশাসকেরা রবীন্দ্রনাথের মেধাতুল্য - এমন ভাবনায় দীক্ষিত মানুষদের হাতে পড়ে বিশ্বভারতী যে বিপদের প্রহর গুনছে এটা বুঝতে পারছে আজ সাধারণ মানুষ। অতিমারির এমন সংকটে যখন প্রয়োজন বিকল্প শিক্ষার ধরন অন্বেষণ, প্রান্তিক পড়ুয়াদের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত রাখার অভিনব প্রয়াসের খোঁজ তখন যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাখির চোখ হয়ে ওঠে মেলার মাঠের পাঁচিল, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের বোধবুদ্ধি নিয়েই তৈরি হয় গুরুতর প্রশ্ন। এমনকি এই বছর করোনার আবহে মেলা না করার সিদ্ধান্ত নিশ্চিত হওয়ার পরও কোন অজানা কারণে এমন দেওয়াল তোলার প্রশাসনিক তোড়জোড় শুরু হয়েছিল তা বোঝা দায়। পরিশেষে মেলার মাঠের পাঁচিল তোলার অন্যতম কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে মাঠের মধ্যে ঘটা অসামাজিক কাজের নিয়ন্ত্রণ ভাবনা। বিশ্বভারতীর এমন বিচিত্র যুক্তি যে একদম ঠুনকো সেটা দেশের রাজধানী দিল্লি থেকে শুরু করে রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় অবস্থিত বহু পাঁচতারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে থাকা সিসি টিভির নজরবন্দী ক্যাম্পাসেও নেশা, ভাঙ, শিশি, বোতলের উপদ্রবের চিত্র ধরা পড়ছে। এমন উপদ্রব এবং বেয়াদপির হাত থেকে ক্যাম্পাস রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষাকর্মীদের যৌথ উদ্যোগে নজরদারি, কাউন্সেলিং ও আইনি চাপের রাস্তা। দেওয়াল তুলে এই সামাজিক সমস্যার রেহাই কোথাও মেলেনি, এমনকি মিলবেও না বরং এমন দেওয়াল নির্ভরতা প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের মধ্যে, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমাজের মাঝে নতুন নতুন দেওয়াল তুলে দেবে যা আখেরে ডেকে আনতে পারে আরও অনেক বড় বিপর্যয় । সেই লক্ষ্যে সচেতন থাকাটাই আজ সময়ের ডাক।