আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

ছেড়ে দে বাবা, কেঁদে বাঁচি


খাবার ঘর আর খবরের ঘরে আজকাল তফাৎ কম। খাবার এবং খবর দুটোই গিলি। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দেও খুব ভিন্ন ছিল না। ‘টাইম’ পত্রিকার বিচারে বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। এখন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ নরেন্দ্র দামোদর মোদী। ইন্দিরা জমানায় কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া একদা বলেছিলেন ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’, আর এখন বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা উচ্চারণ করেছেন, - ভগবান বিষ্ণুর অবতার মোদীজি। ইন্দিরার পতনের পর ইন্দিরা বিরোধী শিবিরের নেতা হয়েছিলেন দেবকান্ত বড়ুয়া। এ-সব ভবিষ্যৎ বলবে। তবে ২৭ আগস্ট একদা ‘সেলস-উওম্যান’ বর্তমানে দেশের অর্থমন্ত্রী অর্থবহ মন্তব্য করেছেন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দ কেন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, - এটা ভগবানের কাজ, অ্যাক্ট অফ গড। ভগবান সব জানেন। ভগবান ময়ূরের লীলায় ব্যস্ত, রামমন্দিরের দ্বিতীয় শিলান্যাসের পর। দেশের সমাজ অর্থনীতির যাই হোক, মোদীবাবুর মাথায় চুল গজিয়েছে ভেবে পুলক জেগেছিল, তাতে জল পড়েছে, ২৩ আগস্ট ময়ূরকে খাওয়ানো সময় মাথায় পরচুলা পরতে ভুলে গিয়েছিলেন নয়া ভগবান, বিষ্ণুর একাদশ অবতার; পরে সেটি মেক-আপ হয়েছে ২৫ আগস্ট। এক ফটোশ্যুটে। এবারে কেশ বিন্যস্ত ও অলকদাম বিরাজমান। দাড়িও ট্রিমড।

দিন পালটায়। কথাও। ২০১৪তে সুদিনের আশার কথা ছিল। আসেনি। বদলে আদানি এসেছেন। চাল ডাল গম তেল রেল বিদ্যুৎ সব বেচছেন। কিনছেন কেবল বিমানবন্দর ও সরকারি সম্পত্তি। আদানি বিমান বন্দর, আর আম্বানি তেল গ্যাস টেলিকম কিনছেন। বেচনেওয়ালা একজন-ই। ভগবান শ্রীশ্রী মোদী। তাঁর দক্ষিণহস্ত শাহ-সাব আপাতত নেহেরুর তৈরি এইমস হাসপাতালে। দেশের দ্বিতীয় শক্তিধর, কেমন আছেন - মোডিয়া নীরব। কোনো বুলেটিন পর্যন্ত নেই। উধাও জিজ্ঞাসাও। কেমন আছেন ছোটো কত্তা। দেশের প্রধান ৯৮টি সংবাদসংস্থা আম্বানির দখলে। পিটিআই একটু বেগড়বাই করেছিল, কড়কে দেওয়া গেছে। উচ্চ-বাচ্য নেই। কে আগে হ্যাঁ বলবে তার প্রতিযোগিতা। রিপোর্টার কম, পোর্টার বেশি। সাংবাদিক কম, জনসংযোগ আধিকারিক বেশি। ভয়, হুমকি, প্রলোভন, বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি উপঢৌকন এবং প্রবল সাম্প্রদায়িকতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে বিদ্বেষ বিষ-বাষ্পে। পুষ্প আর ফোটে না সংবাদকুসুমে। সেখানে চরণচিহ্ন ছড়ায়ে আছে ভগবানের।

কেরল এখন আর ঈশ্বরের আপন দেশ নেই, উত্তরপ্রদেশ এখন রামরাজ্য। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক রজনীপাম দত্ত একদা একটি বই লিখেছিলেন, ইন্ডিয়া টুডে। সেই নামাঙ্কিত একটি পত্রিকা বলছে, দেশের সেরা মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। অজয়কুমার বিস্ট তাঁর আসল নাম। নির্ভয়া কান্ডের মতো ভয়াবহ ছয়টি ধর্ষণ ঘটেছে গত দু মাসে। আট বছরের বালিকা থেকে ১৮ বছরের তরুণী গণধর্ষণের শিকার - তবু কোথাও যেন কিছু ঘটেনি ভাব। কেউ হায়দরাবাদের মতো এনকাউন্টার চাইছে না। তিনজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন তিন মাসে। ১৯ জুন খুন হয়েছেন রতনমণি ত্রিপাঠী। ২ জুলাই বিক্রম যোশি। ২৪ আগস্ট রতন সিংহ। প্রথম দুজন প্রকাশ্য দিবালোকে। তৃতীয় জন বিজেপির পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে। বিক্রম যোশির অপরাধ ছিল, তাঁর ভাইঝিদের কটূক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন। তার বদলা হিসেবে কদিন পর স্কুটার থেকে দুই ভাইঝিকে নামিয়ে গুলি করা হয় বিক্রম যোশিকে। কাশ্মীরে সাংবাদিক খুন হলে মোডিয়া নীরব থাকে। এ-বার উত্তরপ্রদেশ তালিকায় এল। এরাই বাম শাসিত কেরলের হাতি মৃত্যু নিয়ে শোর মাচায়ে ধূম লাগায়।

করোনা কালে ১৪ কোটি শ্রমিক এবং এক কোটি ৮০ লাখ বেতনভোগী সাদা কলারের চাকুরিরত মানুষ কাজ হারিয়েছেন - কোনো কথা নেই। যেন, কিছুই ঘটেনি। নব-ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না।

দেশে যখন করোনা রোগীর সংখ্যা খুবই কম তখন লক ডাউন, নিজামুদ্দিন নিয়ে কত শত টক শো। এখন ৩৪ লাখ পার - নীরব। রাম মন্দিরে দ্বিতীয় শিলান্যাস হল, তিরুপতি মন্দির, পুরী জগন্নাথ মন্দির - সব খোলা এবং এইসব জায়গায় বহু করোনা রোগী - সে নিয়ে মোডিয়ায় আলোচনা নেই। শ্রমিক কল্যাণে পি এম কেয়ার্সের টাকা খরচ হবে বলে রটানো হয়েছিল, কাজ না পেয়ে আবার ফিরছেন শ্রমিকরা - কথা নেই । এখন টক শো এক অভিনেতার আত্মহত্যা ঘিরে, বিহার নির্বাচন পর্যন্ত চলবে, ৯০টি টক শো হয়েছে, আত্মঘাতী হাজার হাজার কৃষক এনডিটিভি ছাড়া অন্যত্র অনুপস্থিত। কাফে কফি ডে-র মালিক সিদ্ধার্থ আত্মহত্যা করেছিলেন, ট্যাক্স-রাজের প্রতিবাদে কেউ কাউকে চেঁচাতে শোনেনি।

কথা ছিল, জিএসটি-তে কোনো ক্ষতি হলে কেন্দ্র সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে। এখন অ্যাডভোকেট জেনারেলকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, এ-রকম কথা নাকি ছিল না। জিএসটি ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০২০-২১ অর্থবর্ষে সেস আদায় হবে মাত্র ৬৫০০০ কোটি টাকা যেখানে রাজ্যগুলির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য ৩ লক্ষ কোটি টাকা। বাকি ২৩৫০০০ কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে? কেন্দ্র বলছে, বাজার থেকে ঋণ নাও।

দেশে ট্রেন বন্ধ হয়েছিল তিন-চারশো রোগীতে। এখন ৩৪ লাখ । বলছে রেল চলবে। ভালো। দরকার গণপরিবহণ। শুধু পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক হাওড়া ও শিয়ালদহ শাখায় যাতায়াত করে প্রায় ৪০ লক্ষ নিত্যযাত্রী। হাওড়া থেকে ছাড়ে ১৬৯ জোড়া লোকাল ট্রেন। হাওড়ার কাছাকাছি স্টেশন থেকে ছাড়ে ৪৯ জোড়া ট্রেন। শিয়ালদহ মেন সেকশনে যাতায়াত করে ২৫২ জোড়া ট্রেন। শিয়ালদহ দক্ষিণে ২৬৪ জোড়া এবং শিয়ালদহ উত্তর তথা বারাসত থেকে ১৮৮ জোড়া। অন্য স্টেশন থেকেও ৩২ জোড়া এবং চক্ররেল ৩২ জোড়া। হাওড়ায় ব্যস্ততম স্টেশন ১৯ টি শিয়ালদহে ৩২ টি। এখন শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে রেল চালাবে। ভালো। একটি কথা খুব ঘুরছে, বনগাঁ লোকালে দূরত্ব দেখব বলে বেঁচে আছি।

জাতীয় শিক্ষানীতি এসে গেছে। আরএসএসের মনপসন্দ শিক্ষানীতি। ৫২ হাজার ৩০০ কলেজ কমে ১৫ হাজার হবে। এবং সেগুলো হবে স্বশাসিত। মানে ফেলো কড়ি মাখো তেল। নিজের পয়সায় পড়ো। কথা নেই কোথাও। একদিন আন্দোলন হল।

কেন্দ্রীয় সরকার এক বৃহৎ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা। সব কিছু সুপরিকল্পিত। রেল বিমান, ব্যাঙ্ক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা - সব বেচে দেওয়ার সুনিপুণ পরিকল্পনা। তাকে ঠেকাতে ঐক্য নেই। শুধু ক্ষমতার হিসেব।

কে কাকে জব্দ করতে পারবে? সোনিয়ার ডাকে সাত বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী সভা করলেন। কেরলের ডাক নেই। কেন? বামদের বাদ দিয়ে আন্দোলন হবে? হবে না। বামদেরও বুঝতে হবে - প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ফ্যাসিবাদ রুখতে সকলকে লড়াই করতে হবে।

কথা বললে তো ভারভারা রাও, গৌতম নওলাখা, সুধা ভরদ্বাজ, কাফিল খান, সঞ্জীব ভট্ট-দের পরিণতি হবে। যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট বিরুদ্ধ রায় দিলেও রামমন্দির হবে - তবু আদালত অবমাননা হয় না। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বলতে পারেন, - শবরীমালা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় মানি না। তা অবমাননা নয়। কিন্তু প্রশান্তভূষণের দুটি টুইটে সম্মান যায় যায়। তাই শাস্তির আয়োজন।

শান্তিকল্যাণ হয়ে নেই, দেশে, দেশ বেচে দিতে চাওয়া, সব প্রতিষ্ঠান কিনে নেওয়া ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়াই ছুঁৎমার্গী ইভেন্ট দিয়ে হবে কি? বৃহত্তর জোট চাই - তবে যদি ভগবানের নিদ্রা ভাঙ্গে। শেষ কথা - নির্বাচন কমিশনের একমাত্র প্রতিবাদী মুখ অশোক লাভাসাকে তদন্তের নাটক করে পদত্যাগ করে এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংকে চলে যেতে বাধ্য করা হল।

আমরা না লড়লে, আমাদেরও চলে যেতে হবে! ইতিহাস বড় নির্মম। লড়লে জয় অবশ্যম্ভাবী। না লড়লে বলতে হবে, ছেড়ে দে বাপ, কেঁদে বাঁচি।


পুনশ্চঃ কেঁদে বাঁচতে অবশ্য গরিব নিম্নবিত্তরা পারছেন না। সর্বভারতীয় জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দূরে দূরে আসন পড়েছে। এক তৃতীয়াংশ আসতে পারেনি। ২৬ লাখ ছাত্রছাত্রী জয়েন্ট নিট দেবে। মানে, দিতে বাধ্য হচ্ছে। কী করে ১০০-৫০০ কিমি দূরে যাবে রেল পরিবহণ ছাড়া কারও চিন্তায় নেই। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী অনলাইনে বৈঠক করেন, সুপ্রিম কোর্ট অনলাইনে আদালত বসিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ১৮/১৯ বছরের ছেলেমেয়েদের অফলাইনে পরীক্ষা দিতে হবে। হলে বসে। ভাবা যায়!