আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ড


লাল কেল্লার প্রাকার থেকে পনেরোই আগস্ট নতুন বাণী ধ্বনিত হল। সরাসরি সামান্য সংখ্যক অতিথি দেশের প্রধান সেবকের নতুন প্রস্তাব শোনার সুযোগ পেলেও ভার্চুয়াল জগতে তা নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ে। নতুন স্বপ্ন অথবা ধাপ্পা বিপণনের জন্য বেশ কিছুক্ষণ নাটকীয় ভঙ্গিতে মনের কথা শোনানো হল। ভক্তগণ উল্লসিত। সংক্রমণের ত্রাসে জনজীবন অবরুদ্ধ। নিজেকে রক্ষা করার জন্য সকলের মুখে আঁটা আছে মুখবন্ধনী। কাজেই ভক্তদের বাইরে অন্যদের মতামত বিবেচনার অবকাশ নেই।

আপনার কি হাই ব্লাড প্রেসার? শরীরে খারাপ? কোলেস্টরেলের মাত্রা কত? রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি? হৃদযন্ত্রে কোনো সমস্যা আছে? ফুসফুসের সমস্যা নেই তো? বদহজম অম্বল কোষ্ঠকাঠিন্য কি নিত্যসঙ্গী? এর আগে কোন কোন অসুখে ভুগেছেন? সেই সময় কোন ডাক্তার চিকিৎসা করেছিলেন? কী কী পরীক্ষা করানো হয়েছিল? ওষুধ খেয়ে সেরে গেছিল? কী কী ওষুধ খেতে হয়েছিল? কখনও অপারেশন করাতে হয়েছিল? কী জন্য? পরীক্ষার রিপোর্টগুলো যত্ন করে রাখা আছে তো? প্রেসক্রিপশন হারিয়ে গেছে? এখন থেকে খুঁজতে শুরু করুন। জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ড করানোর জন্য এইসব কাগজপত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পনেরোই আগস্টের প্রস্তাব অনুসারে দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ডের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হবে। জন্মের সময় থেকে শুরু করে কার্ড বানানোর আগে পর্যন্ত সমস্ত তথ্য একটা মাইক্রোচিপের মধ্যে ভরে রাখলে ডাক্তারের পক্ষে কাজ করতে সুবিধা হয়। অসুস্থ হয়ে পড়লে শুধু নিজের জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ডটা সঙ্গে করে ডাক্তারের কাছে চলে যাবেন। কম্পিউটারে কার্ডটি গুঁজে দিলেই ডাক্তারবাবু এক ঝলকে বুঝতে পারবেন আপনার কী কী অসুখ হতে পারে। সেই অনুযায়ী তিনি আপনার চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন। দেশের যে কোনো প্রান্তেই আপনার অবস্থান হোক না কেন কার্ডের তথ্য বলে দেবে আপনার শরীর স্বাস্থ্যের ইতিহাস ভূগোল।

এখানেই শেষ নয়। জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ড তৈরি করার দায়িত্ব পালন করবে ন্যাশনাল ডিজিটাল হেল্থ মিশন সংক্ষেপে এনডিএইচএম। পনেরোই আগস্ট লাল কেল্লার প্রাকার থেকে শব্দ উচ্চারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এনডিএইচএম ‘স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ব্যবস্থাপনা নীতি’-র একটা খসড়া প্রণয়ন করে ফেলেছে। ২৬ আগস্ট ২০২০তে প্রকাশিত এই খসড়ায় দেখা যাচ্ছে যে জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ডের জন্য ভারতবাসীকে এমন কিছু ব্যক্তিগত তথ্য জানাতে হবে যা চিন্তার উদ্রেক করে। জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ডের জন্য আপনার জাতি ধর্ম এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস রাষ্ট্রকে জানাতে হবে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিস্তারিত বিবরণের সঙ্গে আপনার যৌনজীবন এবং যৌনচিন্তা সম্পর্কে খবর নিতে চাইছে এনডিএইচএম। এই খসড়া প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে সাতদিনের মধ্যে অর্থাৎ ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২০-র আগে এনডিএইচএম-কে জানাতে পারেন। তবে সেইসব মন্তব্য পড়া হবে নাকি বাতিল জঞ্জালে পরিণত হবে তা বলা হয়নি। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এবার নীতি অনুসারে জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ড তৈরির কাজ শুরু হয়ে যাবে।

নিঃসন্দেহে একটি জনহিতকর প্রস্তাব। একটি ছোট্ট কার্ড নিমেষের মধ্যে বলে দেবে আপনার রক্তের গ্রুপ থেকে শরীরের সব খবর। প্রয়োজনে ডিএনএ ম্যাপিং হবে। আপনার হাঁড়ির খবর মানে আপনার খাদ্যাভ্যাস, নাড়ির খবর অর্থাৎ স্বাস্থ্যের হাল-হকিকত সবই এখন রাষ্ট্রের তথ্য ভাণ্ডারে রাখা থাকবে। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের কাছে এসব তথ্য থাকলে তা নিঃসন্দেহে মানুষের উপকার করতে পারে। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য পরিষেবা বলে স্বীকৃত ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেল্থ স্কীমও এমন সহজ সরল প্রক্রিয়া চালু করতে পারেনি। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তো পয়সা দিয়ে চিকিৎসা কিনতে হয়।

দেশের নাগরিকদের মতো পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের জন্য এটি একটি আনন্দবার্তা। কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে কোন কোন রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয় তার একটা সাধারণ রূপরেখা সহজেই পাওয়া যাবে। ওষুধও সেই ভাবেই তৈরি হবে। যেসব নাগরিকের শরীর স্বাস্থ্যের কোনো পরীক্ষা এখনও পর্যন্ত হয়নি সেইসব প্যাথলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক পরীক্ষাগুলো এক ঝটকায় করিয়ে নেওয়া যাবে। কোটি কোটি মানুষের শরীরের যাবতীয় পরীক্ষা। চাট্টিখানি কথা! কোটি কোটি টাকার ব্যবসার ধারাবাহিক বন্দোবস্ত! তবুও দেশের স্বার্থে জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তনের জন্য এই দুরূহ কাজটা করতেই হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা নিয়ে বাণিজ্য করতে গেলে দিনরাত এক করে এই কাজটা যে না করলেই নয়।

ভাষণ মিশন ভিশন সম্পর্কে তো আন্দাজ পাওয়া গেল। কিন্তু জানা যায়নি দেশব্যাপী যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হতে যাওয়া এই কর্মকান্ডের জন্য অর্থ কে জোগাবে? রাজকোষ বাড়ন্ত। তাহলে কি দেশের স্বার্থে জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ড তৈরির খরচ নাগরিককেই বহন করতে হবে? নাকি অন্য কোনোভাবে নতুন কোনো কর অথবা সেস বসিয়ে জনগণের কাছ থেকেই পয়সা আদায় করা হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর নেই।

বিভিন্ন ধরনের কার্ডের মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরেই তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন তালিকা, সংগ্রহ করা হয়েছে অথবা হচ্ছে নাগরিকের প্রতিটা ব্যক্তিগত তথ্য। আধার কার্ড দিয়ে যাত্রা শুরু। নাম ঠিকানা থেকে শুরু করে আঙুলের ছাপ থেকে রেটিনার ম্যাপ সরকারের হাতে নাগরিক সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় তুলে দিলেই ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এক অনবদ্য সংখ্যাযুক্ত (unique number) ঝকঝকে প্লাস্টিক কার্ড। সরকারের নথিতে নাগরিকের পরিচয় হয়ে গেল একটি নির্দিষ্ট নম্বর। এই নম্বর গোটা জীবন আপনার পরিচয় তো বটেই মরণের পরেও কাজে লাগবে। এ যেন জীবনবিমার বিজ্ঞাপন। ব্যাঙ্কে খাতা খুলতে গেলে আবার নতুন করে নিজের, পরিবার পরিজনের নাম ঠিকানা ইত্যাদি লিখে দিতে হবে। এবং আপনি পাবেন ব্যাঙ্কের কার্ড। ফলাফল, - আপনার কার্ডে গাঁথা মাইক্রোচিপ প্রতিটি খরচ, প্রত্যেকটা বেচা কেনার ওপর নজরদারি চালিয়ে যাবে। আপনি মাসে কটা সিনেমা দেখলেন কতবার হোটেল রেস্তরাঁয় খাওয়াদাওয়া সারলেন থেকে শুরু করে কোন বিমানে চড়ছেন, কোন ট্রেনের টিকিট কাটছেন, কোন ব্যাঙ্কে টাকা রাখছেন, সোনা কিনছেন না অন্য কোনো বাসনা পূরণের জন্য দেদার খরচ করছেন সব কিন্তু ব্যাঙ্কের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আপনি আমিষ খাওয়া পছন্দ করেন না কি নিরামিষাশী তার খবরও রাষ্ট্রের তথ্যাগারে জমা থাকছে। কীভাবে? কেন, আপনিই তো বিমানের বা ট্রেনের টিকিট কাটার সময় এইসব খবর দিয়েছেন। এছাড়াও রাষ্ট্র আপনাকে ভোটার কার্ড দিয়েছে। এইসব কার্ডের জন্য আপনি যেসব তথ্য জমা দিয়েছেন তাতে কোনো গরমিল হলে তার দায় রাষ্ট্রের নয়, আপনার। তথ্য সংগ্রাহক ভুল করে ‘কমলাকান্ত’-র নাম লিখতে গিয়ে ‘করোনাআক্রান্ত’ লিখে ফেললে কমলাকান্ত-কেই সংশোধনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রয়োজনে একশোবার অথবা তারও বেশি হানা দিতে হবে। কারণ কোনোদিন দপ্তরের করণিক অনুপস্থিত। কোনোদিন আবার নির্ধারিত আধিকারিক অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় স্বাক্ষর করতে পারছেন না। আর সার্ভার ডাউনের অজুহাত তো এখন নিত্যসঙ্গী।

আপনার গাড়ির নাম্বার প্লেট ডিজিটাইজড, আপনি কোনখানে কবে গেছেন, কোন পেট্রোল পাম্পে কত তেল ভরেছেন, কোথায় টোল ট্যাক্স দিয়ে পার হয়েছেন, রাষ্ট্র সব জানে। এখন আবার ফাস্ট্যাগ হয়েছে, জাতীয় সড়কে সফর শুরু করলেই রাষ্ট্র জেনে যায় আপনার গন্তব্যস্থল। গত কয়েক বছরের মধ্যে এইসব বিষয়ে আপনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এবং আপনার আমার মতো প্রতিটি ভারতীয় এইসব কার্ডের গুরুত্ব মর্মে মর্মে বুঝে গেছেন। বন্যা বা ঝঞ্ঝার দাপটে অথবা বাড়িতে আগুন লাগলে ঘর ছেড়ে তড়িঘড়ি প্রাণ হাতে করে পালিয়ে যাওয়ার সময়ও কার্ডের গোছা সঙ্গে নিতে ভুল হয় না। সঙ্গে কার্ড না থাকলে প্রাণ চলে গেলেও যে পরিচয় প্রমাণিত হবে না। বেওয়ারিশ লাশ হয়ে মর্গে পড়ে থাকাটা কোনো কাজের কথা নয়।

জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ডের জন্য খরচখরচার বিষয়টি বাদ দিন। এবার একবার ভাবুন তো একটা কার্ড তৈরি করতে কত সময় লাগতে পারে। যার কাছে সব কাগজপত্র রয়েছে সেগুলো স্ক্যান করে রাষ্ট্রের তথ্যাগারে জমা করতে কত সময় লাগবে তার একটা ভাসাভাসা আন্দাজ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। যার নেই। তাকে তো দৌড়ঝাঁপ করে সব পরীক্ষানিরীক্ষা সেরে নিজের স্বার্থে জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ডের বন্দোবস্ত করতে হবে। শরীর বলে কথা!

এতকিছুর পর ১৩০ কোটি মানুষের কাছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে না হয় জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ড পৌঁছে দেওয়া হল। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে অধিকাংশ কাৰ্ড নির্ভুলভাবে তৈরি হয়েছে। কার্ডখানি হাতে নিয়ে কোনো অসুস্থ মানুষ কোনো ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারলেন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন। তখন কী করে চিকিৎসা হবে? অথবা ডাক্তারখানায় বিদ্যুৎ নেই। কার্ড হাতে অসুস্থ মানুষটি যন্ত্রণায় কাতরানো ছাড়া আর কী করতে পারে? কার্ডের তথ্য পড়তে না পারলে চিকিৎসা কীভাবে শুরু হবে? এইরকম হাজারো একটা বাস্তব সমস্যার সমাধান না করে স্বপ্নের ঘোরে দেশকে আচ্ছন্ন করে রাখা কোনো কাজের কথা নয়। দেশের প্রতিটি মানুষকে অদৃশ্য জালে বন্দি করে আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু সকলের বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। আর বিকাশ অথবা উন্নয়ন? সে তো ভোট কুড়োনোর মন্ত্র!

প্রশ্ন আরো মৌলিক। রাষ্ট্রকে মাই-বাপ ভেবে আপামর জনসাধারণ তাদের একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে তার গোপনীয়তা রক্ষিত হবে কীভাবে? ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে ঘোষণা করেন যে গোপনীয়তার অধিকার ব্যক্তিমানুষের মৌলিক অধিকার। সেই মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের দ্বারা বারংবার ভূলুন্ঠিত হতে দেখেছেন মানুষ। স্বাস্থ্য কার্ডের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো বাণী নেই। মানুষের চরম ব্যক্তিগত তথ্যকে রাষ্ট্র পাহারাদারীর জন্য ব্যবহার করতে পারে। তার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ ছাড়া এই ধরনের কার্ড ব্যক্তিমানুষের মৌলিক অধিকারের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ।