আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

নাগরিকত্বের খুড়োর কল


করোনা-কালে এখন মনে হবে বহুযুগ আগের কথা। কিন্তু মাত্র ৫-৬ মাস আগে আসমুদ্রহিমাচল উত্তাল হয়েছিল আন্দোলনের ঢেউ-এ। কলকাতা শহরে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত, পার্ক সার্কাস, রাজাবাজারে চলেছে দীর্ঘমেয়াদী ধর্না। নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি, এনপিআর বাতিল করার দাবিতে মুখরিত রাজপথ। এমতাবস্থায় করোনার হামলা। মানুষের মনে আতঙ্ক, সরকারের কাছে সুযোগ। স্থগিত হল এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী গণআন্দোলন। জনস্বাস্থ্যের খাতিরে, স্রেফ বাঁচার তাগিদে মোদী সরকারের নিদ্রাহরণকারী আন্দোলনে ছেদ পড়ল।

২৫ মার্চ লকডাউন পর্বের সূচনার সময় কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি এনে ঘোষণা করল যে করোনার প্রেক্ষাপটে জনগণনার কাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হচ্ছে। জনগণনার সঙ্গেই এনপিআর-এর কাজ হওয়ার কথা ছিল, যা এনআরসি তৈরি করার প্রথম ধাপ। তাই জনগণনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হলে এনআরসি-ও স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু এই আন্দোলনকারীদের আন্দোলন স্থগিত রাখা অথবা সরকারের নীতি প্রণয়ন স্থগিত করার ঘোষণা কোনো ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে হয়নি। এই ঘোষণা করতে দুই পক্ষই বাধ্য হয়েছিল করোনার প্রকোপে। সরকার এনপিআর-এনআরসি-সিএএ বিষয়ে কোনো মৌলিক নীতিগত পরিবর্তন আনেনি এবং আন্দোলনকারীরাও এই প্রশ্নে লড়াই ছেড়ে দেননি। তাই করোনার মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল।

কিন্তু সময় সময়ের নিয়মে এগিয়ে চলে। বিহারে নির্বাচন আসন্ন। তারপরেই পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। অতএব বিজেপি-কে ফিরতেই হবে তাদের বিদ্বেষমূলক রাজনীতির মূলে। সংবাদপত্রে তাই হঠাৎ খবর ছাপা হল পুজোর আগেই পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজ শুরু হবে। স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে প্রশ্ন এই করোনার মধ্যে যদি আবার ভিটে মাটি হারানোর ভয় মানুষকে তাড়া করে তবে বেঁচে থাকাই বড়ো দায় হয়ে উঠবে! কিন্তু বিজেপি-র তরফ থেকে যেই কথাগুলি বলা হচ্ছে তা রাজনীতির রুটি সেঁকতে কাজে লাগলেও লাগতে পারে। কিন্তু আসলে তা আবারও কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটি ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়।

যে-কোনো কেন্দ্রীয় আইন বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য তার বিধিসমূহ সংসদে নির্ধারিত করতে হয়। সিএএ আইনটি সংসদে পাশ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার কোনো বিধিসমূহ এখনও অবধি সংসদে পাশ করা হয়নি। তাই রাতারাতি পুজোর আগে এই আইনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কথাটি সত্যি নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আগেই বলেছেন এই রাজ্যে সিএএ-এনআরসি বলবত করা হবে না। শুধু তাই নয়, সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর বিরুদ্ধে রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে যা বিজেপি ব্যতিরেকে সমস্ত রাজনৈতিক দলের সমর্থন আদায় করেছে। এহেন পরিস্থিতিতে যদি সরকার পশ্চিমবঙ্গে করোনা-র আবহে সিএএ আইনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে তবে তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ হবে।

সিএএ আইন এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে অন্তত ১৫০টি মামলা সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত সুপ্রিম কোর্ট এই সমস্ত মামলার শুনানি পর্যন্ত শুরু করেনি। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধেও সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা দাখিল করা হয়েছে যার শুনানিও সুপ্রিম কোর্ট শুরু করেনি। মানুষের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার, নাগরিকত্বের মতন সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট মামলার শুনানি করছে না কেন এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে। বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে একজন ব্যক্তির দুটি টুইট নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট দ্রুত শুনানি করে রায় দিচ্ছেন, সেখানে ভারতের কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত সিএএ-এনআরসি মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের শ্লথতা গণতান্ত্রিক মানুষকে বেদনাহত করেছে। কিন্তু আজ নয় কাল এই মামলার শুনানি সুপ্রিম কোর্টে হবে। আজ যাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে বিজেপি উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে, সুপ্রিম কোর্ট যদি সিএএকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে তবে তাদের কী উপায় হবে? সমস্ত আইনি প্রশ্নের মীমাংসা না করে এই ধরনের বিভেদপূর্ণ কর্মসূচীর অবতারণা রাজ্যে অশান্তির সৃষ্টি করবে।

এছাড়াও কিছু ব্যবহারিক প্রশ্ন তোলা জরুরি। কোন পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে বিজেপি ভাবছে? মানুষকে কী করতে হবে? এখন অবধি যা পরিস্থিতি আপনার কাছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাসপোর্টের মতন পরিচয়পত্র থাকলে নতুন করে নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ দাখিল করতে হবে না। কিন্তু সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্ব চাইলে কোন পদ্ধতিতে যেতে হবে? মানুষ কি একটি ফর্মে লিখবেন যে তিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, এবং তাঁকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়েছে তাই তিনি ভারতের নাগরিকত্ব চান? তাহলে তো প্রাকান্তরে স্বীকার করতে হবে যে দীর্ঘদিন ভারতে থাকলেও তিনি আসলে এখানে বেআইনিভাবে ছিলেন। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধুমাত্র নাগরিকত্বের খুড়োর কল দেখিয়ে লাভ নেই। এতে আখেরে মানুষের ক্ষতি হবে। আসলে সিএএ আইনের বিধি তৈরি না করে কোনো ফর্ম মানুষকে দেওয়া যাবে না। বিজেপি এই কথাটি চেপে যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী নমঃশূদ্র তথা মতুয়া সম্প্রদায়ের উদ্‌বাস্তু মানুষদের বিভ্রান্ত করার জন্যই বিজেপি এই প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু কোনোরকম বিধিসমূহ ছাড়া এই নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, এই আইনে নাগরিকত্ব চাইতে হলে মানুষকে আগে মেনে নিতে হবে যে তিনি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ভারতে বসবাস করছেন। এই কথাটি বিজেপি মানুষকে বলছে না। শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতির স্বার্থে তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

মৌলিক বিষয়টি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। সিএএ আইনটি সংসদে আনা হয়েছে অসমের এনআরসিকে কেন্দ্র করে যেই সমস্যা দেখা যায় তারপরে। অসমে এনআরসি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার পরে দেখা যায় যে অধিকাংশ মানুষ যাদের নাম এনআরসি তালিকা থেকে বাদ গেছে, অর্থাৎ যারা আর ভারতের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন না, তারা হিন্দু। শুধু তাই নয়, এনআরসি তালিকা প্রকাশিত হওয়ার এক বছর সম্পূর্ণ হল। কিন্তু যাদের নাম বাদ গেছে তাদের নতুন আবেদন বা অসমের আসু যেমন এখন এই তালিকার বৈধতাই অস্বীকার করছে, কোনো প্রশ্নেরই মীমাংসা হয়নি। মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। শুধু ভোটের বাক্সে লক্ষ্মীলাভ ঘটেছে বিজেপি-র।

বিজেপি ভেবেছিল এনআরসি-র মাধ্যমে অসম থেকে লাখো মুসলমানকে বিদেশী চিহ্নিত করে দেশান্তরিত করবে। কিন্তু ঘটে ঠিক উলটো। এর থেকে বেরোনোর উপায় হিসেবে সিএএ আইন পাশ করানো হয়, যেখানে লেখা আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান আফগানিস্তানের মতন দেশ থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ যারা ভারতে বেআইনি নাগরিক হিসেবে রয়েছেন তারা আবেদন করলে ৬ বছরের মধ্যে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ মুসলমান হলে দেওয়া হবে না। আক্ষরিক অর্থে যাদের নাম এনআরসি থেকে বাদ গেল তাদের মধ্যে অ-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাবেন। কিন্তু মুসলমান মানুষ পাবেন না। আইনটি যে সম্পূর্ণরূপে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর মূলে আঘাত করে সেই কথা বলা বাহুল্য।

কিন্তু আপাতত এনআরসি হচ্ছে না। আগামীদিনে এনআরসি করতে হলে ব্যাপক আন্দোলনের সম্মুখীণ হতে হবে সরকারকে। বলা হচ্ছে সিএএ-র মাধ্যমে কিছু মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই দেশেই রয়েছেন। তাহলে হঠাৎ করে তারাই বা নতুন করে নাগরিকত্ব চাইতে যাবেন কেন? বিজেপি-র কাছে এই সব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের জঠরে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ত্রিফলার জন্ম। এই নীতিকে ভারতে প্রবর্তন করার জন্য তারা বদ্ধপরিকর। যখনই করোনা-র প্রভাব কমবে বিজেপি আবার ঝাঁপাবে এই নীতি বাস্তবায়িত করতে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিকেও তৈরি থাকতে হবে। এনআরসি-এনপিআর-সিএএ কোনো অবস্থাতেই ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে বলবত করা যাবে না, এই সংকল্প যেন আমাদের থাকে।