আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

বিভেদ বিভাজন বিচ্ছিন্নতা


পনেরোই আগস্ট মন্ত্রীরা ভাষণ দিয়ে থাকেন। এমনটাই বরাবরের রীতি। স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু হয় বিগত বছরের সরকারি কাজের খতিয়ান। পরিশেষে উচ্চারিত হয় আগত দিনের প্রতিশ্রুতি। এ বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্বাস্থ্য বিধি মোতাবেক কোথাও ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়া হয়েছে। কোথাও আবার সীমিত সংখ্যক অতিথিকে সরাসরি সরকারি বিবৃতি শোনানো হয়েছে। যথারীতি দেখানো হয়েছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ভারতবাসী বিষয়টায় এতটাই রপ্ত যে কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বিশেষত এই মুহূর্তে জনজীবন যখন সামগ্রিকভাবে বিপর্যস্ত, দেশের প্রতিটি মানুষ নিজের নিজের পরিবার পরিজনের স্বাস্থ্য খাদ্য রোজগার ইত্যাদি নিয়ে গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত, তখন সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচারের ধারাবাহিকতায় মানুষের মনোনিবেশের সুযোগ কোথায়? এই দুর্যোগের সুযোগে আরও হাজারো অপকর্মের সঙ্গে কোনো এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমন এক ভয়ঙ্কর মন্তব্য করেছেন যা জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী।

জাতীয় অবরোধ ঘোষিত হওয়ার প্রাক-মুহূর্তে বিধায়কদের দল বদল ঘটিয়ে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে আসীন হওয়ার পর তিনি খুব একটা মুখ খোলেননি। কিন্তু পনেরোই আগস্টের পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা বজায় রাখার অবসরে তিনি যে প্রতীতির প্রতি অঙ্গীকার করলেন তা প্রশাসনিকভাবে অসঙ্গত।

পনেরোই আগস্টের আনুষ্ঠানিক বার্তায় মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেন রাজ্যের সমস্ত সরকারি চাকরিতে ভূমিপুত্রদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তাঁর মতে কর্মসংস্থানের সুযোগ যখন কমে যাচ্ছে, সে সময় রাজ্যের যুবসম্প্রদায়ের জন্য ভাবনা-চিন্তা করাটা রাজ্য সরকারের কর্তব্য। মাত্র তিন দিনের মধ্যে ১৮ আগস্ট একটি ভিডিয়ো বার্তায় মুখ্যমন্ত্রী জানালেন তাঁর সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অবিলম্বে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যাতে মধ্যপ্রদেশের সমস্ত সরকারি চাকরিতে শুধুমাত্র রাজ্যের যুবসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাই সুযোগ পায়। একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “মধ্যপ্রদেশের সম্পদের উপরে কেবলমাত্র এ রাজ্যের ভূমিপুত্রদেরই অধিকার রয়েছে।”

সরকারি চাকরিতে স্থানীয়দের ১০০ শতাংশ কর্মসংস্থান ছাড়াও মধ্যপ্রদেশে ওবিসিদের জন্য ১৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৭ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণের চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর প্রতিশ্রুতি, এ নিয়ে আবার আদালতের দ্বারস্থ হবে রাজ্য সরকার। কারণ এই প্রস্তাব নাকচ করেছিল জব্বলপুর হাইকোর্ট।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে এর আগে একটানা ১৫ বছর ক্ষমতাসীন থাকার সময় কতজনকে তিনি সরকারি পদে নিয়োগ করতে পেরেছিলেন? অতি সামান্য যে কয়েকটি নিয়োগ হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছিল। তাঁর শাসনাধীন মধ্যপ্রদেশের ‘ব্যাপম’ দুর্নীতির ব্যাপক মাত্রা কিছুদিন আগেও সর্বত্র আলোচিত হত। অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যম এখন আর মুখরিত নয়।

মধ্যপ্রদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে আগেই অসম সরকারের সহযোগী সংগঠন নতুন করে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। সাংসদের সংখ্যা তিনশোর কোটা পেরিয়ে যাওয়ার পরে ২০১৯-এর জুলাই মাসের মাঝামাঝি ১৯৮৫-র অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার চোদ্দো সদস্যের এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করে দেয়। কমিটির শীর্ষে আসীন গুয়াহাটি উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বিপ্লব কুমার শর্মা।

২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে কমিটির প্রতিবেদন রাজ্য সরকারের কাছে জমা পড়ার পর আজ অবধি সরকারিভাবে এই প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু আসু গত ১১ আগস্ট সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে কমিটির সুপারিশ ফাঁস করে দেয়। ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনের নির্যাস অনুসারে অসমিয়া এবং আদি বাসিন্দা বা ‘খিলঞ্জিয়া’ না হলে অসমে কোনও ভারতীয় নাগরিকের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকারই থাকছে না।

গত ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে যখন অসম উত্তাল তখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, শর্মা কমিটির প্রতিবেদন হুবহু রূপায়িত হবে। প্রতিশ্রুতি শুনিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এই প্রতিবেদন তাই কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করতেই পারে। এতে আছে, অসমে বিধানসভা এবং লোকসভা আসনের ৮০ থেকে ১০০ শতাংশই অসমিয়াদের জন্য সংরক্ষিত রাখা দরকার। বিধান পরিষদ গঠন হলে সেখানে ১০০ শতাংশ অসমিয়া প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তাব এই প্রতিবেদনে নাকি করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্গের চাকরির বেলায়ও একইরকম সংরক্ষণ ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রস্তাবও নাকি এই সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত। জমির মালিকানায় অসমিয়াদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এবং সামগ্রিকভাবে এই ব্যবস্থাপত্রে সাংবিধানিক অনুমোদনও থাকবে বলে দাবি করা হয়েছে। বাদবাকিরা এইসব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ অসম রাজ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অসম সরকারের পক্ষ থেকে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করা হয়নি। অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশের সরকারি বয়ান এবং অসম সরকারের শরিক সংগঠনের বক্তব্যে কোনো পার্থক্য নেই।

নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাকামী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ইত্যবসরে দাবি করেছে যে ২০১৫-য় নাকি ভারত সরকারের সঙ্গে তাদের বৃহত্তর নাগালিম বা নাগভূমির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার রূপরেখা নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই রূপরেখায় নাকি বৃহত্তর নাগালিমের ভৌগোলিক সীমারেখায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বৃহত্তর নাগালিমের নিজস্ব জাতীয় পতাকার প্রস্তাবও নাকি সেই রূপরেখায় স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৫-র চুক্তিপত্র প্রকাশিত হয়নি। ভারত সরকারও এই প্রসঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি।

ভারত সরকারের জ্ঞাতসারেই এই ধরনের বিভাজন তথা বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া সক্রিয়। অথচ জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে মাত্র বছরখানেক আগে ভারত সরকার সম্পূর্ণ ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার সময় সংসদে সদর্পে উচ্চারিত হয়েছিল এতদিনে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ উপত্যকায় ভারতীয়ত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের প্রচলিত পতাকা বাতিল বলে গণ্য হল। কর্নাটক রাজ্যের স্বতন্ত্র পতাকায় কিন্তু আপত্তি নেই।

জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে দেওয়ার পর সেখানে উন্নয়নের জোয়ার কীভাবে আছড়ে পড়ছে সেদিকে সমগ্র বিশ্বের নজর রয়েছে। এখনও পর্যন্ত না সরকারি স্তরে কিংবা বিদেশ থেকে উড়িয়ে আনা ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের সাংসদদের তরফে নবগঠিত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। অথচ বলা হয়েছিল যে সমস্ত ভারতীয়র জন্য জম্মু ও কাশ্মীরের রুদ্ধদ্বার এইবার খুলে গেল। দেশের যে কোনো প্রান্তের মানুষ জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার যোগ্য। সংবিধানের একটি নির্দিষ্ট ধারার জন্য জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারি চাকরি বা সেখানে জমি বাড়ি ক্রয় অন্য রাজ্যের বাসিন্দাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল বলে নাকি রাজ্যের উন্নয়নে বাধা পড়ছিল। সেই তথাকথিত বিতর্কিত ধারা অবলুপ্তির পর আনন্দের জোয়ার ছড়িয়ে দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা হয়েছিল। মাত্র এক বছরেই সেই উৎসাহ উদ্দীপনা উধাও হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।

এরই পাশাপাশি হিন্দি ভাষার প্রসার ঘটানোর প্রবণতা বিভিন্ন অ-হিন্দিভাষী রাজ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। হিন্দিভাষী প্রশাসকদের আচরণে অন্য ভাষার প্রতি বৈষম্য ফুটে উঠছে। এককালে বিদেশি প্রশাসকবৃন্দ ইংরেজি না জানা ভারতীয়দের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করতেন। উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বহুদিন ধরেই এই মানসিকতা প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই রাজ্যগুলির প্রশাসনিক ভাষা একমাত্র হিন্দি। এমনকি সরকারি বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে যাবতীয় বিজ্ঞাপন কেবলমাত্র হিন্দি ভাষাতেই প্রকাশিত/প্রচারিত হয়। অন্য ভাষার সংবাদপত্রেও হিন্দিতেই সরকারের যাবতীয় বিজ্ঞপ্তি বিজ্ঞাপিত হয়। ইউপিএসসি-র পরীক্ষায় ইংরেজি আর হিন্দি ভাষা মান্যতা পায়। ডাক্তারি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষায় (নীট এবং জেইই) এই বছর আবার ইংরেজি এবং হিন্দির সঙ্গে গুজরাটি ভাষাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের অষ্টম তফসিল স্বীকৃত বাইশটি ভাষার মধ্যে থেকে মাত্র তিনটি ভাষাকে কী কারণে বেছে নেওয়া হয়েছে তার কোনো উত্তর নেই। হিন্দিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ঔপনিবেশিক আমলের মতো নতুন এক ধরনের শ্রেণি বিভাজন অর্থাৎ দেশের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক সৃষ্টির কাজ অতি সন্তর্পণে শুরু হয়ে গেছে। এই ধরনের বিভেদ ভাবনা অ-হিন্দিভাষী রাজ্যে বিভাজনের মানসিকতার প্রসার ঘটাতে পারে। একদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ অন্যদিকে বিভেদের নানানরকমের প্রক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং প্রকারান্তরে উৎসাহ প্রদান কিন্তু জাতীয় ঐক্যের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। বিভেদ থেকে বিভাজনের সূচনা। আর বিভাজনের মাত্রা তীব্র হলে স্বাভাবিকভাবেই বিচ্ছিন্নতার ঝোঁক মাথা চাড়া দেয়। এই ঝোঁক কিন্তু ভয়ঙ্কর। বিভিন্ন ভাষা জাতি সংস্কৃতি প্রভৃতি বৈচিত্র্যর সমাহার নিয়ে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র কঠোরভাবে এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে দমন করার বদলে সচেতনভাবে ক্রমাগত প্রশ্রয় দিয়ে গেলে তা প্রকারান্তরে আগুন নিয়ে খেলায় পর্যবসিত হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে সেই প্রাচীন প্রবাদ মনে পড়ে, - অগ্নিশিখায় নগরী আক্রান্ত হলে দেবালয়ও অক্ষত থাকে না।