আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্রের বৃথা স্বপ্ন!


সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত ফেসবুক সংক্রান্ত একটি রিপোর্টের পর জাতীয় রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, বাণিজ্যিক কারণেই ফেসবুকে বিজেপি নেতাদের হিংসায় উসকানি বা বিদ্বেষমূলক মন্তব্য বাতিল করা হয় না। এ দেশে সংস্থার পাবলিক পলিসি এক্সিকিউটিভ কেন্দ্রের শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘বিদ্বেষ রোধ আইন’ প্রয়োগে বাধা দিয়েছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিংসায় অংশগ্রহণ বা তাতে উসকানির অভিযোগ রয়েছে ওইসব বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে।

প্রতিবেদনে প্রকাশ, ফেসবুক ইন্ডিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর আঁখি দাস সংস্থার কর্মীদের বলেছিলেন, বিজেপি নেতাদের আইন লঙ্ঘনকারী হিসাবে শাস্তি দিলে এ দেশে ফেসবুকের ব্যাবসায়িক ক্ষতি হতে পারে। অভিযোগ, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসায় মদত দিতে ফেসবুকে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছিলেন তেলেঙ্গানার বিজেপি বিধায়ক টি রাজা। তাঁকে যাতে নিষিদ্ধ ধোষণা করা হয় তার জন্য ফেসবুকের কর্মীরা সুপারিশ করেছিলেন। ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি এবং সংস্থা’ নীতির ভিত্তিতে এই সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সংস্থার বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মীদের বক্তব্য অনুযায়ী ফেসবুক ইন্ডিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর আঁখি দাসের হস্তক্ষেপেই ওই বিধায়কের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই বিষয়টিকে শাসক দলের প্রতি সংস্থার ‘পক্ষপাতিত্বমূলক পদক্ষেপ’ বলেই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবার বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র একটি বক্তৃতায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসার ডাক দিয়েছিলেন ফেব্রুয়ারি মাসে। এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই এইরকম উসকানিমূলক কথা ছিল, পরে সেই ভিডিওটি ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। এর পরেই দিল্লিতে দাঙ্গা শুরু হয়। ফেসবুক সেই ভিডিওটি সরিয়ে নিয়েছিল কিন্তু কপিল মিশ্র এখনো বহাল তবিয়তে ফেসবুকে আছেন। অথবা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনন্তকুমার হেগড়ে, যিনি এরকম বক্তব্য ছড়িয়েছিলেন যে মুসলিমদের থেকে করোনা সংক্রমণ হচ্ছে। তারপরেও হেগড়ে ফেসবুকে থেকে গেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এর আগেও ফেসবুকের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠেছে যে তারা বিজেপির নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি নির্মাণ হোক অথবা বিজেপি-র আইটি সেলের মাধ্যমে ভুয়ো খবর ছড়ানো, ফেসবুক এবং তার সহযোগী হোয়াটসঅ্যাপ এক্ষেত্রে সবথেকে বড় ভূমিকা রেখেছে বলা যায়। বিজেপি কয়েক লক্ষ হোয়াটসআপ গ্রুপ তৈরি করেছে গোটা দেশে, যার মাধ্যমে হিংসাত্মক, বিদ্বেষমূলক এবং ভুয়ো খবর ছড়িয়ে দিতে পারছে দেশের কোনায় কোনায়। অমিত শাহ দুই বছর আগে রাজস্থানে একটি সভায় বলেছিলেন যে তাঁরা চাইলে মানুষকে সত্যি মিথ্যে সাদা কালো যে-কোনো খবর গিলিয়ে দিতে সক্ষম। সেটা ফাঁকা আওয়াজ ছিল না। যাদের পকেটে ফেসবুকের মত আন্তর্জাতিক কোম্পানি, তারা রাজনীতির রং পালটে দেবার ক্ষমতা রাখে।

স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দলগুলি সরব হয়ে উঠেছে এবং সংসদীয় কমিটি ফেসবুককে তলব করেছে এ ব্যাপারে। কিন্তু সত্যিই কি এতে অবাক হবার মত কিছু আছে? এই পুঁজিবাদী দুনিয়াতে যেখানে বাজার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে গণতন্ত্র শুধুমাত্র তাদের জন্যে যাদের পকেট সেটা ক্রয় করতে পারবে, সেখানে ফেসবুক কি আলাদা কিছু হবে বলে আমরা ভেবেছিলাম? উদারনৈতিক সমাজ হয়ত উচ্ছ্বসিত ছিল এমন একটা মাধ্যম পেয়ে যেখানে সমস্ত মানুষ, ধনী গরীব নির্বিশেষে, জাত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন। এমনকি চাইলে অতি সাধারণ কেউ রাষ্ট্রপ্রধানের পেজ বা প্রোফাইলে গিয়ে তার বিরুদ্ধে গলা চড়িয়ে আসতে পারেন। এই আপাত গণতন্ত্রীকরণ, এই যে সোশাল মিডিয়ার নিরপেক্ষ অবস্থান, যেটা বাস্তব জীবনে সম্ভব ছিল না, সেটা এখন ভার্চুয়াল দুনিয়াতে করা যাচ্ছে, এ যেন এক বিপ্লব, ভেবেছিলেন অনেকে ! তাঁদের শিশুসুলভ সরলতা দেখে কষ্ট লাগে। যেটা আমরা ভুলে যাই যে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এসে যায় না । মতপ্রকাশ তো হল, সেটা শোনবার স্বাধীনতা আছে তো? এক সামান্য ব্যক্তি এবং একজন রাষ্ট্রপ্রধান, দুজনেই সমান স্বাধীনতায় মতপ্রকাশ করলেও, একজনের অডিয়েন্স কয়েক লক্ষ, অপরজনের কুড়ি। ঠিক এই বৈষম্যের জায়গাটাই ফেসবুকের শক্তি। তারা এই নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে সবাই স্বাধীনভাবে নিজের মতপ্রকাশ করতে পারবে। সেই ধোঁকার টাটি ঝুলিয়ে রেখে আসল বৈষম্যটা আনছে অন্য জায়গাতে। কোন পেজ কত রিচ পাবে, কার কত অডিয়েন্স হবে, কে ঘৃণা ছড়িয়েও থেকে যাবে আর কে যাবে না, সেগুলোই ফেসবুকের হাতে। ফাঁকা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ গলা ফাটিয়ে যাচ্ছেন, যা খুশি বলছেন, আর ভাবছেন এই তো গণতন্ত্র এসে গেল কারণ তাঁর বলার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু তাঁকে শোনার স্বাধীনতা কতজনের আছে? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে অবদমনমূলক ব্যবস্থাগুলি যেটা করত, গলা দাবিয়ে রাখত বিরুদ্ধ মতের। আজকাল ওসব মোটা দাগের কাজ করবার দরকার পড়ে না। যে যত পারে চেঁচাক, কেউ যাতে না শোনে, সেটা নিশ্চিত করা গেলেই তো হল! ফেসবুক ঠিক সেটাই করে।

আর এটায় অবাক হবার কিছু নেই। ভারতবর্ষের অধিকাংশ সংবাদপত্রগুলিও আজকাল বিজেপি-র দ্বারাই চালিত হয়। অন্যান্য গণমাধ্যমগুলিও, যেমন টিভি চ্যানেল। ফেসবুকও ব্যবসা করতেই এসেছে। মার্ক জুকারবার্গ বারবার বলেছেন তাঁদের আগামী দিনের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হবে দক্ষিণ এশিয়া, মূলত ভারতবর্ষ। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষ ফেসবুকের বৃহত্তম বাজার। চল্লিশ কোটি ভারতীয় ফেসবুক ব্যবহার করেন। কিছুদিন আগেই রিলায়েন্সের টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি জিও-তে ফেসবুক ৪৩,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। রিলায়েন্স এবং নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আর এই পুরোটাই ব্যাবসার খাতিরে। বিজেপি ফেসবুককে ভারতের বাজার ব্যবহার করবার সুযোগ দিচ্ছে, তার পরিবর্তে ফেসবুক সেটাই করছে, যা করার ছিল। বিজেপি বিরোধী পোস্ট উড়িয়ে দিচ্ছে, সরকারবিরোধী পেজের রিচ কমিয়ে দিচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে, এমনকি এই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনের অনেক আগেই কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তদন্তমূলক সাংবাদিকটা করেছিল, কীভাবে ফেসবুক ইন্ডিয়ার বড় কর্তারা ২০১১ সাল থেকে বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছেন। আঁখি দাসের বিজেপি যোগ এবং ফেসবুকের পলিসিতে নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে এর আগে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান সংবাদপত্র খবর করেছিল। যেটা বারবার বলার, এর পেছনে রাজনীতি নেই। এমন নয় যে ফেসবুক রাতারাতি দক্ষিণপন্থী হয়ে গেছে। কাল যদি কংগ্রেস বা অন্য কোনো দল ফেসবুককে এই সুযোগসুবিধা দেয়, তারা বিজেপির থেকে হাত ধুয়ে ফেলতে দুই মিনিটও ভাববে না।

যারা এতদিন দিবাস্বপ্ন দেখে এসেছেন যে নিরপেক্ষ গণতন্ত্রের খোলা উঠোন এনে দিল সোশাল মিডিয়া, তাঁরা মিথ্যে আশা করেছেন। এই পৃথিবীতে কোনো কিছু গণতন্ত্রীকৃত নয়। না খাদ্য, না শ্রম, না তথ্য, না জ্ঞান। সমস্তকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে কর্পোরেট। বিজেপির নিয়ন্তা তারাই। কংগ্রেস আসলেও ছবিটা খুব বেশি পালটাবে না। সাম্য ও সমানাধিকারের লড়াই লড়তে হলে রাস্তায় নেমেই লড়তে হবে। বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাকে ব্যবহার করা যেতেই পারে, কিন্তু সেটা সর্বস্ব হয়ে গেলে আশাভঙ্গ অবধারিত। ফেসবুক অথবা মার্ক জুকারবার্গ, কেউই শ্রেণি রাজনীতির বাইরে নয়। তারাও শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাতেই কাজ করেছে, এবং বিজেপি সেই বানিয়া শ্রেণির বিশ্বস্ততম মিত্র হবার কারণে এই মুহূর্তে বিজেপি আর ফেসবুক সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। তাই ভার্চুয়াল মিডিয়ার ভরসায় পুরোটা না থেকে, আসল লড়াই যে ক্ষেতে মাঠে কারখানাতেই লড়তে হবে, সেই সত্যিটা আমরা ভুলে না গেলেই মঙ্গল।