আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭
চিঠির বাক্সো
অধ্যাপক তাপস মিত্র, গুরুদাস কলেজ, কলকাতা।
'আরেক রকম' পত্রিকার অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যায় (১৬-৩১ অক্টোবর ২০২০) ঋক চট্টোপাধ্যায় লিখিত প্রবন্ধটিতে এই অংশটি ছাপা হয়েছেঃ
"পরবর্তী সময়ে পেনরোজ, স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে যৌথভাবে দেখান এই ইভেন্ট-হরাইজনের কাছে স্থান-কালের আচরণ খুব অদ্ভুত। সেই কারণে এই ইভেন্ট-হরাইজন থেকেও এক ধরণের বিকিরণ পাওয়া সম্ভব। একে হকিং বিকিরণ বলে। এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জ্যোতির্বিদরা আমাদের ছায়াপথের বাইরে যে উজ্জ্বল বিকিরণগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেগুলির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওই বিকিরণগুলি তৈরি হয়েছে অতিবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের থেকে। কিন্তু এই তত্ত্ব কি ঠিক? সত্যিই কি কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ করে? তাঁর উত্তরও মিলল ২০১৯ সালের ১০ই এপ্রিল। প্রকাশিত হল প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ছবি (চিত্র-৪)।"
অংশটি তাত্ত্বিকভাবে এবং তথ্যগতভাবেও ভুল । কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ করে, এটা স্টিফেন হকিং-এর দ্বারা প্রস্তাবিত হলেও এর সত্যতা এখনো প্রমাণিত নয়। এই প্রস্তাবিত বিকিরণকেই হকিং বিকিরণ বলে। প্রত্যাশিত ভরের কৃষ্ণগহ্বরের বেলায় এই বিকিরণের পরিমাণ এত কম হবার কথা যে এটিকে ডিটেক্ট করার কোন পন্থা এখনো বার করা যায়নি। তাই ছায়াপথের বাইরের যে বিকিরণের কথা লেখক উল্লেখ করেছেন তা হকিং বিকিরণ নয় আর তার উৎস সরাসরি কৃষ্ণগহ্বরও নয়। কৃষ্ণগহ্বরের বিপুল মহাকর্ষের টানে তার দিকে পড়তে থাকা ভরপুঞ্জের মধ্যে থাকা তড়িৎ-আধানের ত্বরণ এই বিকিরণের উৎস। প্রবন্ধটিতে কৃষ্ণগহ্বরের যে ফটোগ্রাফটি মুদ্রিত আছে সেটি এই পড়তে থাকা তড়িৎআধানপুঞ্জ থেকে উৎসারিত বিকিরণকে ব্যবহার করেই পাওয়া। হকিং বিকিরণের পেপারটিতে পেনরোজ কিন্তু সহলেখক ছিলেন না। পেনরোজ ঘূর্ণনশীল কৃষ্ণগহ্বরের ক্লাসিক্যাল বিকিরণ নিয়ে কাজ করেছিলেন। অন্যদিকে হকিং বিকিরণ বক্র দেশকালে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তাবিত।
আর একটা কথা। বিজ্ঞানের অনেক কিছুই বাকি অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। পেনরোজের যে কাজটিকে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছে নোবেল প্রাইজের জন্য, সেই পেপারটির রেফারেন্সে পেনরোজ কিন্তু অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীকে উল্লেখ করেননি।
তথ্যসূত্রঃ
1) Einstein Gravity in a nutshell by A. Zee, Princeton University Press, 2013, p. 409-424, 436-450.
2) https://www.nature.com/articles/d41586-019-01155-0
3) Press Release by Royal Swedish Academi of Sciences on 06.10.2020.
4) Roger Penrose, Physical Review Letters, no.3, vol.14, p.57
অধ্যাপক তাপস মিত্র,
গুরুদাস কলেজ,
কলকাতা।
লেখকের উত্তর
প্রফেসর মিত্রকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার এবং তার ত্রুটির প্রতি দিকনির্দেশ করার জন্য। লেখার যে তত্ত্ব ও তথ্যগত ত্রুটির কথা উনি বলেছেন সেটি আদতে আমার বাক্য-বিন্যাসের ত্রুটি থেকে উদ্ভূত।
প্রথমেই বলি, উনি লেখার বিজ্ঞান সম্পর্কিত যে অংশটির কথা বলেছেন, মূল রচনায় সেটি এইরূপ,
“নক্ষত্র পরিণত হবে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরে। আর ওই কৃষ্ণগহ্বরকে ঘিরে তৈরী হয় একটি ঘটনা-দিগন্ত বা ইভেন্ট-হরাইজন। পরবর্তী সময়ে পেনরোজ, স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে যৌথভাবে দেখান এই ইভেন্ট-হরাইজনের কাছে স্থান-কালের আচরণ খুব অদ্ভুত। সেই কারণে এই ইভেন্ট-হরাইজন থেকেও এক ধরনের বিকিরণ পাওয়া সম্ভব। একে হকিং বিকিরণ বলে। এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জ্যোতির্বিদরা আমাদের ছায়াপথের বাইরে যে উজ্জ্বল বিকিরণগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেগুলির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওই বিকিরণগুলি তৈরি হয়েছে অতিবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের থেকে।”
এখানে ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায় কারণ অনুচ্ছেদের ব্যবহার আমি করিনি। আদতে এটি হত দুটি আলাদা তথ্য -
১. নক্ষত্র পরিণত হবে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরে। আর ওই কৃষ্ণগহ্বরকে ঘিরে তৈরি হয় একটি ঘটনা-দিগন্ত বা ইভেন্ট-হরাইজন। পরবর্তী সময়ে পেনরোজ, স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে যৌথভাবে দেখান এই ইভেন্ট-হরাইজনের কাছে স্থান-কালের আচরণ খুব অদ্ভুত। এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জ্যোতির্বিদরা আমাদের ছায়াপথের বাইরে যে উজ্জ্বল বিকিরণগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেগুলির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওই বিকিরণগুলি তৈরি হয়েছে অতিবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের থেকে।
এবং
২. পরবর্তী সময়ে পেনরোজ, স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে যৌথভাবে দেখান এই ইভেন্ট-হরাইজনের কাছে স্থান-কালের আচরণ খুব অদ্ভুত। সেই কারণে এই ইভেন্ট-হরাইজন থেকেও এক ধরনের বিকিরণ পাওয়া সম্ভব। একে হকিং বিকিরণ বলে।
হকিং বিকিরণ একান্তই হকিং এর নিজস্ব আবিস্কার। কিন্তু তার ভিত্তি অবশ্যই হকিং-পেনরোজের ‘সিঙ্গুলারিটি থিওরেম’। ১৯৭৫ সালে হকিং-এর ‘Particle creation in black hole’ নামক গবেষণাপত্রটি দ্রষ্টব্য। আমি এই যোগসূত্রটির কথাই লিখেছি।
এছাড়াও প্রফেসর মিত্র চিত্র-৪-এর যে কারণ উল্লেখ করেছেন তা সঠিক। আমার লেখায় বাক্য বিন্যাসের ত্রুটির কারণে যেন মনে হচ্ছে যে চিত্র-৪ হকিং বিকিরণের ছবি। তা একেবারেই নয়। আমার এই ত্রুটির জন্য আমি দুঃখিত এবং ভবিষ্যতে আরও যত্নবান হব যাতে এমন কোনো ভুল ধারণা আমার লেখা থেকে উৎপত্তি না হয়।
তবে একটি ক্ষেত্রে প্রফেসর মিত্র সম্ভবত আমার লেখাটি ঠিক করে পড়েননি। আমি কোথাও লিখিনি যে পেনরোজের নোবেল প্রাপ্তির কাজে সরাসরি অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর কাজের রেফারেন্স আছে। আমি পরিষ্কার লিখেছি, পেনরোজের তত্ত্বের ভিত্তির অন্যতম স্তম্ভ অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর সমীকরণ। আর একথা খোদ পেনরোজ সাহেবই যখন মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন একাধিকবার, তখন “বিজ্ঞানে অনেক কিছুরই অনেক কিছুর সাথে সম্পর্ক থাকে” বলে এড়িয়ে যাওয়া স্রেফ নিজেদের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার মতই লাগে। আমি অন্তত মনে করি না নিজেদের বিজ্ঞান গবেষণার ঐতিহ্যকে স্রেফ একটা সাধারণ ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়া বিবেচক কাজ। আমাদের আগের প্রজন্মের কাজের ইতিহাসই আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে উৎসাহিত করে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আর সেখানে যদি আমরা অন্য দেশের বিজ্ঞানীদের কথা বলি, তাহলে নিজের দেশের বৈজ্ঞানিকদের তাচ্ছিল্য করার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। আর আজকের সময়ে একথা আরও বেশী করে বলা উচিৎ, কারণ গনেশের মাথা অঙ্গপ্রতিস্থাপনের প্রথম ঘটনা, একথা আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস হতে পারে না।
পরিশেষে একথা আবার স্বীকার করতেই হয় যে আমার বাক্য-বিন্যাসের ত্রুটির কারণেই এই ভ্রান্তির উৎপত্তি। এর দায় একান্তই আমার। ভবিষ্যতে এই ধরনের ত্রুটি থেকে লেখাকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করব। আর আবারও প্রফেসর মিত্রকে ধন্যবাদ লেখাটি পড়ে ওঁনার মূল্যবান মতামত দেওয়ার জন্য।
ঋক চট্টোপাধ্যায়,
আইআইইএসটি,
শিবপুর, হাওড়া।