আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ একান্তই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ

শুভঙ্কর দে


‘জেকব দুই দুই ও ফনাধর দন্তপাটি মুখোমুখি’ একটি বইয়ের নাম। বাবা মানব জেঠুকে বলেছিলেন বইটির নাম শুধু ‘জেকব দুই দুই’ রাখলে হয় না? উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘তাহলে তো বইয়ের নামটা সম্পূর্ণ হবে না’’। মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। বাবা মানবদা বলে ডাকেন আর আমি মানব জেঠু। কবে থেকে এই সম্পর্ক এখন আমি মনেও করতে পারবো না। বাবার কাছে শুনেছি, ‘যাদবপুর ইউনিভার্সিটি যেতাম স্বপনদা’র (স্বপন মজুমদার) কাছে। যেদিন যেতাম পাঁচ-ছ’য় ঘন্টার আগে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোতে পারতাম না। সারাদিন কেটে যেত সকলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে। সুবীর রায়চৌধুরী, যশোধরা বাগচী, নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।’ সকলের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার স্বপন জেঠু।

ছোটদের বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। আমি তখন স্কুলে পড়ি। বাবা একটা বই আমায় দিলেন। ডালা উল্টে দেখলাম ভেতরের পাতায় মানব জেঠুর সই। বইটি ‘জিয়নকাঠি’। এই বই পড়ার আগে বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় বলতে তখন কিছু রাশিয়ান অনুবাদ মাত্র। আমার তখনও ষোলো পেরোয়নি। বয়সের কথা এই কারণেই বললাম এই বইটির ভূমিকার জন্যে। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন ‘জিয়নকাঠি’ তৈরি হয়েছে কিশোর-কিশোরীদের জন্যে - এই কথাটি প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো। অর্থাৎ একেবারে ছোটোরা হয়তো এর কোনও-কোনও লেখা উপভোগ করতে পারবে, তবু যাদের বয়েস আট-নয় থেকে ষোলোর মধ্যে, যারা শৈশব পেরিয়েছে অথচ বড়দের জগতেও পুরোপুরি ঢুকে পড়েনি, তাদের কথা ভেবেই ‘জিয়নকাঠি’র পরিকল্পনা। তাই বলে অন্যরা যে এ-বই পড়তে পারবেন না, তা নয়। যে রূপকথাকে আমরা নিছকই ছোটদের বলে ভাবি, সেখান থেকেই একটি আশ্চর্যের প্রতীককে নিয়েই বইয়ের নাম - যে ‘‘জিয়নকাঠি’র ছোঁয়ায় মৃত্যু বা কালঘুম থেকেও জেগে ওঠা যায়। ‘মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে।’ সব শিল্পই এক অর্থে আমাদের জাগিয়ে দেয়।’’

আমাদের প্রকাশনার জন্যেও ছোটদের অনেক বই তিনি অনুবাদ করেছিলেন। যদিও অনুবাদ কথাটি তাঁর পছন্দ ছিল না, তাঁর পছন্দের ছিল তরজমা। একে একে ছোটদের জন্যে বহু অনুবাদ সাহিত্য প্রকাশিত হতে লাগলো। আর তখন আমার মজা লাগতো বইগুলোর নাম দেখে। নামগুলো ছিল বড়োই অদ্ভুত। একটা বইয়ে তো হাতি ছিল ইঁদুর ছিল পেঁচাও ছিল। বইয়ের নাম ছিল ‘হাতি ইঁদুর পেঁচার ছানা আজব তাদের কান্ড নানা’। এত বড় নাম মনে থাকতো না আমাদের কর্মীদের তারা যখন বিল করতো শুধু হাতি ইঁদুর লিখে ছেড়ে দিতো। জোর্জে আমাদু’র অসাধারণ একটি লেখা মানব জেঠু অনুবাদ করলেন ‘এক পাখি দোয়েলা আর এক বেড়াল হুলো’। মানব জেঠু জুল ভের্ন-এর লেখার নামগুলি ছাড়া বাকি সব নামই দেখেছি যথাযথ বাংলায় নামটি রাখতে। দুটি বই ছিল আমার ভীষণ প্রিয় প্রথমটি ‘ঘন্টা বাজে দূরে’ হ্যান্স আন্ডারসন-এর জীবনকথা, আর একটি ‘হরবোলা’ তৃতীয় বিশ্বের ছোট গল্পের সংগ্রহ।

দাঙ্গা, দেশভাগ এই বিষয় নিয়ে বাংলায় অনেক গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। বাবরি মসজিদ ধংসের বছরেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সম্পাদনায় ‘ভেদ বিভেদ’। সলিল চৌধুরীর বিখ্যাত ‘ড্রেসিংটেবিল’ গল্পটি আমি এই ‘ভেদ বিভেদ’ প্রথম খণ্ডে পড়ি। মানব জেঠুর অসাধারণ কাজ ছিল এই ‘ভেদ বিভেদ’ এর সংকলন। ভারতবর্ষকে একজায়গায় বেঁধেছিলেন দ্বিতীয় খণ্ডে। সর্ব ভারতীয় ভাষায় লেখা এই বিষয়ের গল্পগুলোকে নিয়ে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করেছিলেন।

জাদু বাস্তবতার সঙ্গে আমার পরিচয় মানব জেঠুর অনুবাদে। মার্কেস্-এর প্রথম পাঠ আমার মানব জেঠুর অনুবাদে। লাতিন আমেরিকার অলিগলি ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন মানব জেঠু। মনে পড়ে ‘লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সংগ্রহ’ বইটির প্রকাশের সময়। এই বইয়ের একটি ছোট সংস্করণ প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশের শামীম ভাই। দে’জ থেকে যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি আরও কয়েকটি উপন্যাস যোগ করেন। প্রচ্ছদের জন্যে আমায় বলেছিলেন, ‘অজয় (গুপ্ত) এটার প্রচ্ছদ করলে ভালো হয়’। অজয় জেঠু একটা গ্রাফ পেপারের ওপর জল রং ঢেলে ছোটদের একটা ভাঙা সাইকেল চালিয়ে একটা নকশা তৈরি করেছিলেন। প্রচ্ছদটি মানব জেঠুর খুব পছন্দ হয়েছিল। ‘স্পেনের গৃহযুদ্ধ’ নিয়ে অসাধারণ মূল্যবান একটি সংকলন তৈরি করেছিলেন। এই বইটিতে জ্যোতি বসুর একটি লেখা নিয়েছিলেন। আমি ছবি দেখেছি রাইটার্স বিল্ডিংসে জ্যোতি বসু বইটির উদ্বোধন করছেন।

মানব জেঠুর বাড়িতে আমি প্রথম যাই আমাদের কার্তিকদার সঙ্গে। তারপরে কতবার গিয়েছি কতরকম কাজে তা আর মনে নেই। যখন চোখে দৃষ্টি কমে আসছে, মোটা আতস কাঁচের ওপর টর্চের আলো। এই যন্ত্রটি ছিল, তাঁর পড়ার সঙ্গী। নিঃসঙ্গ একাকী জীবনে বই-ই ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। সেই সঙ্গীর থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হলো এক সময়। দৃষ্টি শক্তি এই দুই বন্ধুত্বের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।

নবারুণদা (ভট্টাচার্য) তখন দিল্লি থেকে ফিরেছেন। এইমসে দেখিয়ে তখন কিছুটা সুস্থ। অজয় জেঠু (গুপ্ত), মানব জেঠু দুজনেই নবারুণদার ভীষণ বন্ধু। একদিন অজয় জেঠুকে গাড়িতে তুলে সোজা মানব জেঠুর বাড়ি। ওখান থেকে নবারুণদার বাড়ি। তিন বন্ধুর জমাটি আড্ডায় আমি ছিলাম নির্বাক শ্রোতা। চা খেতে খেতে তিন বন্ধুর নির্ভেজাল কথোপকথন, যা এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

অভীকদার (মজুমদার) ফোন, ‘তুমি জানো মানবদা খুব অসুস্থ। ফর্টিজ নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন।’ অসুস্থ জানতাম কিন্তু হসপিটালে ভর্তি হয়েছেন তা জানতাম না। সঠিক খবরটা জানতে ফোন করেছিলাম প্রণব জেঠুকে (বিশ্বাস) বললেন, ‘অসুস্থ ছিলেন। একটা ছোট্ট অপারেশন হয়েছে। এখন ঠিক আছেন। আজ এতক্ষণে তো বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার কথা।’ এই কথোপকথনের মধ্যেই সৌরীন জেঠুর (ভট্টাচার্য) দুটো মিসড কল। ফোন করতেই মানব জেঠুর অসুস্থতার খবর দিলেন। আমিও অবাক হয়ে বললাম এই মাত্র প্রণব জেঠুর সঙ্গে কথা হলো বললেন সুস্থ, আজ বাড়িতে ফেরার কথা। ‘প্রণবের কাছে এখনো খবর যায়নি, পুরোনো খবরে তেমনটাই ছিল।’

পরেরদিন খবর পেলাম অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। মানব জেঠুর ডায়বেটিজ ছিল তবু ছোট্ট অপারেশন সফল হয়েছিল, ডায়বেটিস কোনো বাধা তৈরি করেনি। সোমবার ফিরবেন সব ঠিকঠাক। বাড়ি ঘর গোছানো হয়ে গেছে এমন কি বাজারও সম্পূর্ণ। এমন সময় হাসপাতাল থেকে ফোন একটা ছোট্ট ইনফেকশন ধরা পড়েছে। তখনও মানব জেঠু সজ্ঞানে, অল্প কথাবার্তা বলছেন, হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে রাইলস টিউবে অল্প খাওয়ানো হয়েছে। হাসপাতাল চায় তাঁকে ভেন্টিলেশনে দিতে। মানব জেঠুর একমাত্র মেয়ে তিন্নিদি (কৌশল্যা) দেশ থেকে অনেক দূরে থেকে স্পষ্ট করেই জানিয়ে ছিলেন তাঁর কথা, ভেন্টিলেশন নয় স্বাভাবিক নিয়মেই চিকিৎসা চলতে থাকুক। সেদিনও কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ। যখন ভর্তি হয়েছিলেন তখন দুদিন ছিলেন আইসোলেশনে, তখনও কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছিল। মঙ্গলবার (৪ঠা আগস্ট ২০২০) বিকেলে আবার ফোন হাসপাতালের, জানা গেল কোভিড পজেটিভ। অবস্থা খারাপ। রাত আটটায় সব শেষ। মনে প্রশ্ন ওঠে এই সব হাসপাতালে গেলে রুগী সেরে ওঠার মুখে ইনফেকশন কোথা থেকে আসে। কোভিড প্রটোকল মেনে পরেরদিন অর্থাৎ বুধবার মধ্যরাতে মানব জেঠুর অন্তিম সৎকার হলো। মধ্যরাতে মানব জেঠু পঞ্চভূতে বিলীন হলেন। এইটুকুই খবর। সেই শেষ পর্বের সব খবর জেনেছি প্রণব জেঠুর কাছে। এই শেষ মুহূর্তের সাক্ষী আমরা কেউ নই।

বাংলা সাহিত্য দীন হলো। সাহিত্যের ছাত্ররা হারালেন তুলনারহিত এক মাস্টারমশাই। কতরকম বিষয়ে যে ছিল তাঁর মনের বিস্তার - সাহিত্য খেলাধুলো সিনেমা রাজনীতি ও আটপৌরে জীবনের নানান দিক। শব্দের কতরকম খেলাই না আসতো তাঁর মাথায়। যাঁরা তাঁকে দেখেছেন তাঁরা জানেন তিনি গুরুগম্ভীর একজন অধ্যাপক মাত্র নন আড্ডার মধ্যমণি, কথার জাদুতে ভুলিয়ে রাখা সদা হাস্যময় এক মানুষ।

মানব জেঠুকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো না, এটা মানতে মন চায় না।