আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

উজান পথের যাত্রী সুকুমারী ভট্টাচার্য

কণিষ্ক চৌধুরী


১.

কালিদাস চট্টোপাধ্যায় (১৮৪৬-১৯১১) নামান্তরে সত্যব্রত সামশ্রমী-কে অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন। তিনি ছিলেন বেদবিশেষজ্ঞ পণ্ডিত। শেষ জীবনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপক হন। ইনি ব্রাক্ষণ ছাড়া অন্য কারো হাতে অন্নপ্রহণ করতেন না। (চট্টোপাধ্যায়, অমরকুমার। ২০০৫:৩৩)। ১৮৭৩-এ বিদ্যাসাগর যখন বহুবিবাহ রদ করার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন, তখন সত্যব্রত তার বিরোধিতা করে দেখিয়েছিলেন যে, বহুবিবাহ শাস্ত্র-নিষিদ্ধ নয়। (পূর্বোক্ত:৬১)। ইনিই তিনি, যিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ড. শাহিদুল্লাহকে বেদের ক্লাসে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। কারণ ড. শাহিদুল্লাহ জন্মগত পরিচয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী।

সত্যব্রতর কীর্তির কথা এখানে উল্লেখ করা হলো এই জন্যই যে, ড. শাহিদুল্লাহর মতো ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য-র ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিলো। ১৯৪০-এর দশকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালযের সংষ্কৃত বিভাগটি ছিলো রক্ষণশীল ব্রাক্ষণ্যবাদী চিন্তার হেড কোয়ার্টার। একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দর্শন শাস্ত্রে অনার্স (১৯৩৯) ও এম.এ. (১৯৪২) প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ পাননি। কারণ তিনি বস্তুবাদী, তায় আবার কমিউনিস্ট। সুতরাং এখানে তাঁর চাকরি ‘নৈব নৈব চ।’

এবার আসা যাক্ সুকুমারী ভট্টাচার্যের কথায়। ভিক্টোরিযা কলেজ থেকে সংস্কৃত শাস্ত্রে অনার্স (১৯৩৯-১৯৪২) নিযে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম সুকুমারী দত্ত ভর্তি হলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. ক্লাসে। কিন্তু ব্রাক্ষণ্যতান্ত্রিক (এবং অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিক) অধ্যাপকদের দুর্ব্যবহারে সুকুমারী দত্তর স্বপ্নভঙ্গ হলে এক রকম বাধ্য হয়েই সংস্কৃত ভাষায় এম.এ. পড়ার ইচ্ছা ত্যাগ করতে হলো। ভর্তি হলেন ইংরাজী এম.এ. ক্লাসে। এখানে বলা দরকার যে, সুকুমারী ভট্টাচার্যকে সারাজীবন রক্ষণশীলদের অপপ্রচারের মুখে পড়তে হয়েছে। জন্ম শতবর্ষেও তিনি তার থেকে রেহাই পাননি। একটি সংবাদপত্রের উত্তর-সম্পাদকীয কলমে জনৈকা লিখেছেনঃ ‘‘শুধু ধর্মের কারণে ন্যায্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়ে সুকুমারীর নিদারুণ ক্ষোভ জন্মায় এবং তিনি সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর না পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর পড়তে তাঁকে কোথাও বাধা দেয়নি, তবু রটে যায় যে, তিনি খ্রিষ্টান ছিলেন বলে সংস্কৃতে এম.এ. পড়তে পারেন নি। জীবদ্দশায এভাবেই ‘মিথ’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।’’ (আ:বা: ১৯.৭.২০২০)। উদ্ধৃত অংশটি সত্য থেকে যে কতটা দূরে তা বোঝা যায় স্বয়ং সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখাতেইঃ

‘‘আমার শিক্ষা জীবনে প্রথম বাধা আসে এম.এ. পড়তে যাওয়ার সময়। যখন বি.এ. পরীক্ষা দিই তখন পণ্ডিতমশাইরা জানতেন না কে ফার্স্ট হচ্ছে। কারণ তখন পরীক্ষার খাতায় নামটাম থাকে না। রেজাল্ট বেরোনোর পর তাঁরা জানলেন যে একটি ক্রিশ্চান মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে - তখন তাঁদের সমস্ত রোষ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। ক্লাসে সেটা প্রকাশও করতেন। চণ্ডীর শ্লোক পড়াতে গিয়ে আমাকে কটাক্ষ করতেন। একবার একটা ডিবেট হবে আমাদের ক্লাসে। আমি দাঁড়িয়ে আছি একদিকে। জনৈক পণ্ডিতমশায় জানতে চাইলেন, তুমি এখানে কেন? আমি বললাম, স্যার আমি অংশ নিচ্ছি তাই অপেক্ষা করছি। তিনি অবাক হয়ে বললেন, তুমি ডিবেটে অংশ নিচ্ছ সংস্কৃততে। আমি বললাম, হ্যাঁ স্যার। তিনি বললেন, খুব মজাদার হত শুনলে তোমার সংস্কৃতটা। আসলে তো মজাদার ব্যাপার নয়, কেননা ঠিক আগের বছর আমি ফার্স্ট হযেছিলাম। আমি কিছু বলিনি। কিন্তু বুঝতে পারলাম কী গভীর অনমনীয় তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ছিল আমার প্রতি। তাঁরা ক্লাসে অনেক সময় বক্রোক্তি করতেন যে, অহিন্দুর কোনো অধিকার নেই সংস্কৃত পড়ার। যেটা অবশ্য নারী হিসেবে নয়। অন্য ধর্মাবলম্বী হিসেবে। তার সঙ্গে ছিল, একটা ক্রিশ্চানের মেয়ে সংস্কৃত পড়ছে। আবার মেয়ে মানুষ সংস্কৃত পড়ছে। সবগুলো মিলে আমাকে একেবারে অপাংক্তেয় করে তুলেছিল। মাঝে মাঝে এগুলো খুব বিঁধত। বাড়ি এসে একদিন আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। ...তারপর ইংরেজি পড়তে চলে গেলাম। কত কষ্টে যে আমি গিয়েছি তা আমিই জানি। ’’ (সাক্ষাৎকার। ২০১৪:৩৫)।

সুকুমারী ভট্টাচার্যের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রথমত, তিনি সংস্কৃত নিয়ে এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। দ্বিতীয়ত, প্রায় এক বছর সেখানে ক্লাস করেন। তৃতীয়ত, পণ্ডিতদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপে বাধ্য হন সংস্কৃত ছাড়তে। চতুর্থত, ঈশান স্কলারশিপ না পাওয়ায় তাঁর মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও, সংস্কৃতে এম.এ. পড়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিলোনা।
 

২.

সুকুমারী ভট্টাচার্যর জীবন ও জগতকে জানতে আমাদের একটু ততীতের দিকে তাকাতে হবে। ১২ জুলাই ১৯২১ তাঁর জন্ম। মা শান্তবালা ও বাবা সরসীকুমার দত্ত। চার সন্তানের মধ্যে সুকুমারী বড়। অন্য ভাই বোনেরা হলেন - মাধুরী দত্ত, বিজন বিহারী দত্ত ও মঞ্জরী দত্ত। তিন বছর বয়স থেকে পাঁচ বছর ছিলেন উড়িষ্যার গিডনিতে, একটা কৃষি খামারে। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে চলে যান মেদিনীপুর শহরে মামার বাড়িতে। ভর্তি হন মাসীমা ক্ষান্তবালার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে। সেখানে বছর দুই পড়ালেখার পর, আবার কলকাতায়। সময়টা আনুমানিক ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ। সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে মহামন্দা। ব্যতিক্রম কেবল স্ট্যালিন-নেত্বত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভর্তি হন ক্রাইস্টচার্চ স্কুলে। পরে ষষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হন সেন্ট মার্গারেট স্কুলে। ১৯৩৬-এ ম্যাট্রিক পাশ করে ভিক্টোরিয়া কলেজে আই.এ. (ইন্টারমিডিয়েট আর্টস)-তে। এই পরীক্ষাতেও ভালো ফল করেছিলেন। (ভট্টাচার্য। ২০১৫:৪:৩২)।

সরসীকুমার দত্ত ছিলেন আদর্শবান শিক্ষক। পড়াতেন স্কটিশ চার্চ স্কুলে। বিষয় ছিলো ইংরাজি, বাংলা ও ইতিহাস । কিন্তু দর্শন ও রসায়নে তাঁর খুবই আগ্রহ ছিলো। তিনি চাইতেন সুকুমারী দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করুক। সুকুমারীর পছন্দের বিষয় ছিলো সংস্কৃত। তিনি বাবাকে জানান, ‘‘প্রাচীন ভারত কীভাবে চিন্তা করত, যে আদর্শের নিরিখ তাঁরা রেখে গেছেন সেটা কেন কোন প্রয়োজনে বা উদ্দেশ্যে, তা জানবার জন্য সংস্কৃত পড়তে চাই। অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের চিত্তের বিবর্তন শিখতে চাই।’’ (পূর্বোক্ত: ২৬)

১৯৪২-এ ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে সংস্কৃত শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেন। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। শুধু তাই নয় স্নাতক স্তরে আর্টস বিভাগে তাঁরই নম্বর ছিলো সর্বোচ্চ। প্রথমটির জন্য তিনি পান জুবিলি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বৃত্তি (৩২ টাকা)। কিন্তু দ্বিতীয়টির জন্য তাঁকে ঈশান স্কলারশিপ দেওয়া হয়নি, কারণ তিনি ছিলেন অহিন্দু। দ্বিতীয় স্কলারশিপটা (আর্থিক মূল্য ৪০ টাকা) পেলে বাড়ির আর্থিক সমস্যা কিছুটা দূর হতো। কিন্তু তা না হওয়ায় বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। (পূর্বোক্ত: ৩৪)।

যাই হোক ১৯৪৪-এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরাজিতে এম.এ. পাশ করেন। এম.এ. পড়াকালীন গৃহ শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন অমল ভট্টাচার্যকে। রক্ষণশীল পরিবারের সম্তান হলেও তিনি ছিলেন উদারমনা ও মার্কসবাদে আস্থাশীল পণ্ডিত। অমল ভট্টাচার্যের সংস্পর্শে সুকুমারী দত্তের জীবনে আসে বিরাট পরিবর্তন। একদা খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী মানুষটি যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও মার্কসবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিলেন সাদরে। যুক্ত হলেন কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সঙ্গে। অনুবাদ কর্মের পাশাপাশি, খবর দেওয়া-নেওয়ার কাজেও তিনি পার্টিকে সাহায্য করতেন।

১৯৪৫-এ সুকুমারী দত্ত ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। কয়েক দিনের মধ্যেই অমল ভট্টাচার্য কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এই সময়ই (অর্থাৎ ১৯৪৭-এর আশেপাশে) সুকুমারী বিয়ে করেন অমল ভট্টাচার্যকে। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেয় তাঁদের একমাত্র কন্যা মুনিয়া, যিনি ভবিষ্যতে পৃথিবী বিখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক তনিকা সরকার হবেন।

সংস্কৃত ছিলো সুকুমারীর first love। তাই ইংরেজি ভাষায় অধ্যাপনা করলেও, মনের মধ্যে প্রথম ভালোবাসার প্রদীপটাকে নিভে যেতে দেননি। ১৯৫৪-তে প্রাইভেটে সংস্কৃততে এম.এ. পরীক্ষা দেন। আবার প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। এরই তিন বছর বাদে ১৯৫৭-তে বুদ্ধদেব বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করলেন। ১৯৫৮-তে চলে যান সংস্কৃত বিভাগে। সেখানেও রক্ষণশীলরা তাঁকে কম জ্বালাতন করেনি। এর সঙ্গে শারীরিক নানা অসুখ তাঁর কাজের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু তাই বলে তিনি হাল ছেড়ে দেননি।

১৯৬১-তে চোখের অসুখে তাঁকে প্রায় একমাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। দৃষ্টিশক্তি পূর্ণরূপে আবার ফিরে পাবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। শেষ পর্যন্ত তিনি সুস্থ্য হয়ে ওঠেন এবং গবেষণার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো ভারতীয় দেবতাদের উৎস ও বিকাশ নিয়ে। ১৯৬৪-তে তিনি তাঁর পি.এইচ.ডি. থিসিসটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন। ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৬৬তে। তখনো বোঝা যায়নি তাঁর ডক্টরাল থিসিসটি যে আরো বিকশিত হয়ে ‘ম্যাগনাম ওপাস’-এ পরিণত হবে। সে কথাতেই আসা যাক।

যশোধরা বাগচী তখন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে PhD করছেন। মূলতঃ তাঁর উদ্যোগেই সপরিবারে সুকুমারী ভট্টাচার্য আমন্ত্রিত হলেন যেখানে। অক্সফোর্ডে যশোধরা বাগচীর শিক্ষক মধ্যযুগের ল্যাটিন সাহিত্যে সুপণ্ডিত Peter Dronke সদ্য প্রতিষ্ঠিত গবেষকদের কলেজ Clare Hall-এ সুকুমারী ভট্টাচার্যকে Visiting Fellow হিসেবে এক বছরের জন্য আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করলেন, একা নয়, সপরিবারে। সময়টা ১৯৬৬/৬৭। এখানে তিনি য়ে গবেষণা করেছিলেন তা ছিলো তাঁর Ph.D সন্দর্ভের একটি বিকশিত রূপ। তিনি পৃথিবার বিভিন্ন সভ্যতার মিথগুলো নিয়ে গবেষণা চালালেন। তারই ফল হলো The Indian Theogony। প্রকাশক কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। প্রকাশিত হলো ১৯৭০-এ। তিনি তাঁর বই-এর মুখবন্ধে বলেছেন যে, বর্তমান গ্রন্থটি হলো তাঁর ১০ বছরের গবেষণার ফল। এখানে শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা গোষ্ঠীর দেবতাদের সংক্রান্ত আলোচনা মুখ্য বিষয়। গ্রন্থটির সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো দেব সংঘ সংক্রান্ত পরম্পরাগত আলোচনার গোটা ছকটিকে এখানে চূর্ণ করা হয়েছে। আর সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের আলোচনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, যা এত দিন প্রথাগত আলোচনায় একান্তভাবে অনুপস্থিত ছিলো।

ইতিমধ্যে মৃত্যু এসে উঁকিঝুকি দিতে শুরু করেছে। ১৯৬৭-তেই অধ্যাপক অমল ভট্টাচার্যের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আর তার পরিণতিতেই ১৯৭০-এ মাত্র ৫১ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন। সান্ত্বনা একটাই যাবার আগে দেখে যেতে পেরেছিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্যের দশ বছরের গবেষণার ফসল the Indian Theogony গ্রন্থটিকে। পরবর্তী ৪৪ বছরে হাজারো প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়লেও তিনি কখনই দুর্বল হননি, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। এর পিছনে হয়তো তাঁর নাতিদীর্ঘ দাম্পত্যের বৌদ্ধিক ও মানবিক অভিজ্ঞতার একটা ভূমিকা ছিলো। এই সংগ্রামের ইতিহাসে একটি ছেদ বিন্দু হলো ২৪ মে ২০১৪ - যে দিন সুকুমারী ভট্টাচার্য চলে গেলেন। তার ৯৪ তম জন্মদিনটি পালন না করেই। কিন্তু রেখে গেলেন মলাটবন্দী অস্ত্রগুলিকে - যারা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করবে-তাদের জন্য। আর এর মধ্য দিয়েই সুকুমারী ভট্টাচার্য বেঁচে থাকবেন যতদিন মানুষ থাকবে, মানুষ স্বপ্ন দেখবে-ততদিন।
 

৩.

ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিক, প্রশাসক ও তাদের দেশীয় সন্তানদের কল্যাণে ভারত পেয়েছে একটি খণ্ডিত, খর্বিত ও বিকৃত ইতিহাস-চর্চার ঐতিহ্য। যে উত্তরাধিকারের ভারে আজও অনেকে ঝিমোচ্ছেন, ঘুমোচ্ছেন বা ঘুমের ঘোরে হুঙ্কার দিচ্ছেন। সুকুমারী ভট্টাচার্য - তাদের দুঃস্বপ্ন। ১৯৭০-এর মৃত্যুর বিষাদকে অতিক্রম করে দ্রুত নিজের ছন্দে ফেরেন তিনি। তাঁর গবেষণা কর্মগুলি অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলে। আর তারই ফলশ্রুতিতে পাওয়া যায় ‘মৃচ্ছকটিক’-এর অনুবাদ (১৯৮০), Literature in the Vedic Age (vol-I-1984, vol-II-1986), প্রাচীন ভারতঃ সমাজ ও সাহিত্য (১৯৮৭), সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯৮৯), ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য (১৯৯১), History of Classical Sanskrit Literature (1993, বাংলা অনুবাদটি আগেই (১৯৯১ প্রকাশিত হয়), Fatalism in Ancient India (1995), Legends of Devi (1996), বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য (১৯৯৮), বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য (২০০০) সহ আরও বেশ কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ।

বইগুলির পাতা ওল্টালে পাওয়া যাবে ভারত-চিন্তার বিকল্প বয়ান আর অতীতের উজ্জ্বল উদ্ধার। আরো একটি কাজ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলো - তা হলো মানবী বিদ্যাচর্চার সঙ্গে অতীত ঐতিহ্যের যথার্থ সংযোগ সাধন। এ কাজে দ্বন্দ্বতত্ত্ব ছিলো তাঁর পথ প্রদর্শক। প্রথমে তিনি নস্যাৎ করেছেন বৈদিক সাহিত্যকে অবিমিশ্র ধর্ম সাহিত্য হিসেবে দেখার মোহাবিষ্ট চিন্তাকে। তারপর সেই সাহিত্যকে সামাজিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে সংযুক্ত করে তুলে ধরেছেন জন সমক্ষে। (ভট্টাচার্য। ১৯৯১:মুখবন্ধ)। তাঁর কৃতিত্ব এখানেই যে, নির্মোহ বেদচর্চার যে কাজ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী শুরু করেছিলেন, তাকে একটি পরিণতির দিকে নিয়ে গেলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বেদকে কোনো ধর্মশাস্ত্র হিসেবে দেখেন নিঃ ‘‘বেদ কী জিনিস? ভিন্ন ভিন্ন কালের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন কারণে ভিন্ন ভিন্ন মহাকবি প্রণীত, কতকগুলি কবিতা গান [এর] আদি সংগ্রহ মাত্র।’’ (হ.প.শ.। ২০০৬:৫:৫৭৮)। সুকুমারী ভট্টাচার্য দেখালেন, আর্য ভাষা-ভাষী মানুষের আগমনের পর প্রাগার্য/ অনার্য সভ্যতার সঙ্গে এর বিরোধ ও সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে যে বৈচিত্রময় ভারতবর্ষের আবির্ভাব ঘটে, সেই ১৫০০ বছরের ভারতীয় জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারার যে বিবর্তন ঘটেছিলো - তা-ই প্রতিফলিত হয় এই বৈদিক সাহিত্যে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সুবিধাভোগীদের চিন্তা ও স্বার্থের প্রতিফলন এখানে মুখ্য হলেও, সমাজের বাকি অংশের প্রতিচ্ছবিও এখানে পরোক্ষে প্রতিফলিত হয়েছে। (ভট্টাচার্য। ১৯৯১:২১)। এভাবেই তিনি সত্যব্রত সামশ্রমী, বিবেকানন্দ, তিলকের চূড়ান্ত রক্ষণশীল বেদভক্তির বিরুদ্ধে এক বিকল্প বয়ানকে উপস্থিত করলেন আর কুঠারাঘাত করলেন ব্রাক্ষণ্যবাদের মূল শিকড়ে।
 

৪.

আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করে এখানে থামতে হবে। সুকুমারী ভট্টাচার্য অনেকটা বিদ্যাসাগরের মতো। বিদ্যাসাগরের যেমন বহিরঙ্গ দেখে কিছুটি বোঝা যাবে না। সুকুমারী ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রেও তাই। দুজনের এই সাদামাটা পোশাকের আড়ালে ছিলো আগুন। বিদ্যাসাগর আজীবন অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন আর শেষ জীবনে ব্রিটিশ ঠ্যাঙানোর কথা বলতেন। (দত্ত। ১৯৮৩:৯৩)। সুকুমারী ভট্টাচার্য ছিলেন অনুতাপহীন মার্কসবাদী। রাজা-রানীর প্রতি আনুগত্যের বদলে মুক্ত চিন্তার প্রতি ছিলেন আস্থাশীল। তিনি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে বলতেন উজান পথের যাত্রী। (ভট্টাচার্য। ২০১১:৮৭)। তিনি নিজেও ছিলেন তাই-‘উজান পথের যাত্রী’।


তথ্যসূত্রঃ

● আচার্য, অনিল (সম্পাদিত)। ২০১৯, Vol-LIII, No.2 । অনুষ্টুপ-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা। কলকাতা।
● চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক অমরকুমার। ২০০৫। বেদচর্চায় বঙ্গভূমি ও সামশ্রমী। কলকাতাঃ সারস্বত সমাজ।
● দত্ত, ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ। ১৯৮৩। ভারতের দ্বিতীয স্বাধীনতা সংগ্রাম। কলিকাতাঃ নবভারত পাবলিশার্স।
● ভট্টাচার্য, সুকুমারী। ১৯৯১। ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য। কলিকাতাঃ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ।
● বাগচী, যশোধরা। ২০১৫। ‘আমার দিদি’। প্রকাশিত বসু, অরূপ (সম্পাদিত)। বারণরেখা। ২০১৫। চতুর্থবর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা।
● -------। ২০১৫। ‘আমার বাবা’। প্রকাশিত বসু, অরূপ (সম্পাদিত)। ২০১৫। বারণ রেখা। চতুর্থ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা। কলকাতা।
● -------। ২০১৫।‘নারী ও পুরুষের বন্ধনটাই আসল’। প্রকাশিত বসু, অরূপ (সম্পাদিত)। ২০১৫। পূর্বোক্ত।
● -------। ২০১৯। ‘উজানপথে’। প্রকাশিত আচার্য, অনিল (সম্পাদিত)। ২০১৯। অনুষ্টুপ।
● সাক্ষাৎকার। ২০১৪। ‘সুকুমারী ভট্টাচার্যঃ এক নিজৃত আলোকশিখা’। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী দে, বন্দনা। প্রকাশিত গুপ্ত, সমীর কুমার (সম্পাদিত)। ২০১৪। মিলেমিশে। দশমবর্ষ, সপ্তম সংখ্যা। কলকাতা।
● হ.শ.র.স. (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ)। ২০০৬। খন্ড ৫। কলকাতাঃ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।
● Bhattacharje, Sukumari. 2016. The Indian Theogony. Delhi: Motilal Banarsidass.

 

এছাড়াও যাঁদের কাজ থেকে সাহায্য পেয়েছিঃ
● অধ্যাপক তনিকা সরকার (সুকুমারী ভট্টাচার্যের কন্যা)
● অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য (সুকুমারী ভট্টাচার্যের ছাত্র)
● অধ্যাপক বিজয়া গোস্বামী (ছাত্রী ও সহকর্মী)
● শ্রীযুক্ত অরূপ বসু (কাছের মানুষ)