আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

জ্ঞানচোরের দল ও আমরা

অনিন্দ্য ভুক্ত


যদি প্রশ্ন করি, কে প্রথম আগুন আবিষ্কার করেছিল কিংবা কে আবিষ্কার করেছিল চাকা, আমরা কেউই সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। কেন পারব না, সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বর্তমান সভ্যতার ভিতটি। আজকে সভ্যতার যে পর্বে আমরা বাস করছি তার পিছনে বিজ্ঞানচর্চার অবদানটি অনস্বীকার্য। কিন্তু তার চেয়েও বেশি অনস্বীকার্য বোধহয় বিজ্ঞানচর্চার প্রতি সভ্যতার আদিপর্বের মানুষজনের সেই দৃষ্টিভঙ্গি, যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এইসব আবিষ্কারের মালিকানা কেউ দাবি করেনি। আজকের পৃথিবীতে কেউ কিছু আবিষ্কার করলে বা সৃষ্টি করলে কাঞ্চনমূল্যের বিনিময় ছাড়া তার অধিকার ছাড়তে সে রাজি হবে না। শুধু বিজ্ঞান কেন, জ্ঞানচর্চার যেকোনো শাখার অগ্রগতির ক্ষেত্রেই কিন্তু এই মানসিকতা একটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে আবিষ্কারটি যখন জনস্বার্থে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে গণ্য করা হয়।

১৭৮৩ সালের প্যারিস কনভেনশন তাই সব ধরনের আবিষ্কারকেই পেটেন্ট আইনের সুরক্ষা দেবার কথা বললেও সেটি যে সঠিক ছিল না, স্বাধীন ভারতবর্ষের ১৯৭০ সালের পেটেন্ট আইন তা প্রমাণ করেছিল। প্যারিস কনভেনশনের যুক্তি ছিল আবিষ্কারককে তার আবিষ্কারের জন্য উপযুক্ত মর্যাদা এবং আর্থিক মূল্য না দিলে নিত্যনতুন আবিষ্কারের প্রতি মানুষ তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু ১৯৭০ সালে ভারত যখন তার পেটেন্ট আইনটি প্রবর্তন করে তখন প্যারিস কনভেনশনের এই যুক্তি সে মেনে নিলেও খাদ্য ও ওষুধের মত পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থের থেকে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিল বেশি। তাই অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে পেটেন্টের সময়সীমা ১৪ বছর রাখা হলেও খাদ্য ও ওষুধের ক্ষেত্রে এই সময়সীমাটি ছিল পাঁচ বছর। আরেকটা জিনিস ১৯৭০ সালের ভারতীয় পেটেন্ট আইন করেছিল। খাদ্য ও ওষুধের ক্ষেত্রে চালু করেছিল কেবলমাত্র প্রক্রিয়া পেটেন্ট, পণ্য পেটেন্ট নয়। মানে কেউ কোনো ওষুধের পেটেন্টের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে কেবলমাত্র যে পদ্ধতিতে ওষুধটি আবিষ্কার করা হয়েছে সেই পদ্ধতিটির জন্যই সে পেটেন্ট পাওয়ার অধিকারী। এর পেছনে যুক্তি ছিল এই যে, কোন‌ো ওষুধকে দীর্ঘমেয়াদী পেটেন্ট অধিকার দেওয়া হলে নিত্যনতুন ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যাবে, তার ফল ভোগ করতে হবে সমগ্র মানবজাতিকেই। ১৯৭০ সালের এই ভারতীয় পেটেন্ট আইন একটা আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয় বিশ্বব্যাপী ওষুধ শিল্পের বাজারটির। চিরকালই আমাদের দেশে মেধার কোনো অভাব নেই। আমাদের দেশের মেধাবী বিজ্ঞানীরা এই আইনটির সাহায্য নিয়ে বিদেশের বাজারে তৈরি বিভিন্ন ওষুধকে গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করে দ্রুতই সে সমস্ত ওষুধের বিকল্প উৎপাদন পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেললেন এবং এই বিকল্প উৎপাদন পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরির খরচ‌ও গেল বহুগুণ কমে। একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। ১৯৯৫ সাল থেকে গ‍্যাট চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় নতুন পেটেন্ট আইন প্রবর্তনের তোড়জোড়। তার আগে ১৯৯৪ সালে র‍্যানিটিডিনের 10টি ট্যাবলেটের একটি প্যাকেটের দাম ছিল ভারতে সাড়ে ১৮ টাকা, আর আমেরিকায় ওষুধটি কিনতে গেলে খরচ হত প্রায় ৫৭ গুণ বেশি। র‍্যানিটিডিনের এই বিকল্প উৎপাদন পদ্ধতিটি আবিষ্কার করতে আমাদের বিজ্ঞানীরা সময় নিয়েছিলেন মাত্র চার বছর।

১৯৭০ সালের পেটেন্ট আইন প্রবর্তনের পর তাই দুটো জিনিস ঘটেছিল। এক তো আমাদের দেশ দ্রুতই ওষুধের ক্ষেত্রে তার আমদানি নির্ভরতা প্রায় ঝেড়ে ফেলে। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার এই সস্তার ওষুধগুলি রপ্তানি করতে শুরু করে। ১৯৮৬ শুরু হওয়া গ্যাটের অষ্টম পর্বের আলোচনায় যে বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ আইনের উপর খবরদারি চালানোর সুযোগ খুঁজতে শুরু করে উন্নত দেশগুলি তার একটি বড় কারণ ভারতের এই পেটেন্ট আইনটি। ভারতের মতো বিকাশশীল দেশগুলির আভ্যন্তরীণ আইনের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে যে বিশ্ব বাণিজ্যের লাগাম ধরে রাখা যাবেনা সে কথা বুঝেই গ্যাট চুক্তির আওতায় আনা হয় পেটেন্ট আইনকে। দীর্ঘ আট বছরের বাগবিতণ্ডার পর যে নতুন আইনটির খসড়া করা হয় বিপদের সূত্রপাত সেখান থেকেই।

২০০৫ সালে নতুন পেটেন্ট আইন প্রবর্তনের আগে থেকেই আমাদের দেশে যে আলোচনাটি শুরু হয় তার মুখ্য বিবেচ্য বিষয় ছিল এর ফলে ভারতে ওষুধের দাম কতটা বাড়বে। ২০০৪-এর আশেপাশের সময় এই নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, সেমিনার হয়েছে‌। কিন্তু এইসব আলোচনা আরেকটি বড় বিপদের সম্ভাবনার দিক থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭০-এর দশক থেকে জিন প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতি হয় বায়োটেকনোলজির হাত ধরে। এমনই উন্নতি যে এক জীবদেহের জিন অন্য জীবদেহে প্রতিস্থাপন করে তৈরি করে ফেলা যাচ্ছিল উন্নততর সব প্রজাতি। জিন প্রযুক্তির এই উন্নতি যে মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস, যেমন ওষুধ ও খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা নিতে চলেছে তা আন্দাজ করতে উন্নত দেশগুলির দেরি হয়নি। ওষুধ শিল্পে অধিকাংশ ওষুধের উপাদান হিসেবেই ব্যবহৃত হয় জীবদেহের বিভিন্ন অংশবিশেষ। তাই জৈবসম্পদের অধিকারটি অর্জন করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর জন্য তো সবার আগে প্রয়োজন জৈবসম্পদের উপর ব্যক্তিগত অথবা রাষ্ট্রীয় অধিকার। কিন্ত পেটেন্ট আইনে এই ধরনের কোনো অধিকারকে কখনোই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পরিবর্তে জৈবসম্পদটিকে মানবজাতির সাধারণ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অথচ জৈবসম্পদকে কোনো রাষ্ট্রের নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ‌ও ছিল। ঘটনাচক্রে এই পৃথিবীর জীববৈচিত্রের সিংহভাগ বিকাশশীল দেশগুলির দখলে। এইসব দেশের অগণিত কৃষিজীবী মানুষ নিরন্তর বনজঙ্গল ঘেঁটে খুঁজে খুঁজে বের করেছে কোনটি খাদ্য, কোনটি ওষধি-গুণসম্পন্ন। অর্থাৎ, জৈবসম্পদটি দেশের, তাকে মানুষের ব‍্যবহারযোগ‍্য হিসেবে খুঁজে বার করেছে দেশের মানুষই তাদের মেধা দিয়ে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তো সম্পত্তির উপর রাষ্ট্রের অধিকার বর্তায়। অথচ এই যুক্তি মানতে চায়নি উন্নত দেশগুলো। তাদের বক্তব্য, জৈবসম্পদ প্রকৃতির দান, অতএব তার উপর সমগ্র মানবজাতির সমান অধিকার। কিন্তু এই যুক্তি তো তারা প্রয়োগ করতে চায়নি খনিজ-সম্পদগুলির ক্ষেত্রে‌। খনিজ-সম্পদ‌ ও প্রাকৃতিক সম্পদ, কিন্তু সে ক্ষেত্রে বলবৎ রাষ্ট্রীয় অধিকারের নিয়মটি। এর কারণ উন্নত দেশগুলিতে খনিজ সম্পদের অপ্রাচুর্য বিশেষ নেই। আছে যেটি সেটি জৈবসম্পদের অপ্রাচুর্য। জীববৈচিত্রের অধিকারটি দখলে আনার জন্য এবং এই সম্পদভাণ্ডারকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদিত ওষুধ বা খাদ্যের উপর নিজেদের একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার জন্য দুটি জিনিসের দরকার ছিল – এক, জৈবসম্পদের উপর কোনোরকম রাষ্ট্রীয় অধিকারের দাবিটিকে নস্যাৎ করে দেওয়া, এবং দুই, জৈবসম্পদকেও পেটেন্টযোগ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া।

গ‍্যাটের অষ্টম পর্যায়ের বৈঠক শুরুর আগেই দ্বিতীয় কাজটি সেরে রাখে আমেরিকা। ১৯৮০ সালে একটি ব্যাকটেরিয়ার উপর পেটেন্ট প্রদান করে আমেরিকার পেটেন্ট কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছিল এই ব্যাকটেরিয়াটি পেট্রোলিয়াম ও আরও কিছু জটিল হাইড্রোকার্বন হজম করতে সক্ষম। ফলে একে কাজে লাগিয়ে সমুদ্রের বুকে যে তেল-দূষণ ঘটে সেই দূষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারটির মুনাফা-যোগ্যতা আন্দাজ করে সমস্ত ওজর-আপত্তি উড়িয়ে এই জৈবসম্পদকে পেটেন্ট দিয়ে দেয় আমেরিকা। দেবার উদ্দেশ্য ছিল গ‍্যাটের বৈঠকে জৈবসম্পদকে পেটেন্টযোগ্য করার দাবি তোলা। দ্বিতীয় কাজটি সম্পন্ন করা হয়, ট্রিপস (TRIPS) চুক্তির মাধ্যমে। ১৯৯২ সালে জীববৈচিত্র কনভেনশন জৈবসম্পদের উপর সমগ্র মানবজাতির সার্বজনীন অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু ট্রিপস চুক্তিতে এই স্বীকৃতিকে বাতিল করে জৈবসম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় অধিকারকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

সব মিলিয়ে এর ফলে যেটা হল তা হল এই যে, যে কোন‌ো দেশের জৈবসম্পদ যে কেউ অবাধে সংগ্রহ করতে পারবে, সেই সম্পদের সাহায্যে যখন কোনো নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ বা প্রাণীজাত ওষুধ তৈরি করা হবে তখন সেটির পেটেন্ট নিয়ে তাকে অর্থের বিনিময়ে বিক্রিও করা যাবে।

এইবার ঠিক এই জায়গাটিতে এসেই চিরায়ত জ্ঞান এবং তার সুরক্ষার বিষয়টি বিকাশশীল দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অবশ্য এই বিষয়টি যে বিকাশশীল দেশগুলির কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল আমেরিকান কোম্পানি ডব্লিউ আর গ্রেস। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে বলা যাক চিরায়ত জ্ঞান বলতে আমরা কি বলতে চাইছি আর কেনই বা তার সুরক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ।

যারা গ্রামেগঞ্জে থাকে তারা জানে ছেলেমেয়ে খেলতে গিয়ে পড়ে-টড়ে পা মচকে আনলে কি করতে হয়। ব্যথার জায়গায় চুন হলুদের প্রলেপ লাগানোর বিদ‍্যেটা কে শিখিয়েছিল তা অবশ্য কেউ বলতে পারবে না। আসলে এসব বিদ্যে তো বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না, এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের মানুষ কীভাবে যেন শিখে যায়। এই পশ্চিমবঙ্গেই এমন জায়গা আছে যেখানে একটি পরিবারের মানুষ ভাঙ্গা হাড়ের চিকিৎসা করে স্রেফ কিছু গাছপালা আর শিকড়বাকড় দিয়ে। ব্যাপারটা যে খুব একটা কিছু অবৈজ্ঞানিক, তাও কিন্তু নয়। হাড় ভাঙ্গার মূল চিকিৎসা যেটা সেটা হল, ভাঙ্গা হাড়টিকে ঠিকমত সেট করা। হাড়গোড় সম্বন্ধে জ্ঞান থাকলে সেটা করা খুব একটা শক্ত কিছু নয়। এর সঙ্গে গাছপালা, শিকড়ের বাঁধনটা দেওয়া হয় ভাঙ্গা হাড় যাতে তাড়াতাড়ি জোড়া লাগে আর রোগী যেন সহজে সে জায়গাটা নাড়াচাড়া করতে না পারে। যে পরিবারের মানুষজন এই কাজটা করে তারা কিন্তু কেউ পাশ করা ডাক্তার নয়। বংশানুক্রমিকভাবে এই কাজটা তারা শিখে এসেছে, এই যে কোন গাছপালার কি ওষধি গুন, কীভাবে তার প্রয়োগ করতে হয়, ইত্যাদি। এইসব জ্ঞান মানুষ একসময় নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে শিখেছিল, পরে সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান বংশানুক্রমিকভাবে সঞ্চালিত হয়েছে। এই জ্ঞানকেই চিরায়ত জ্ঞান বলে। একথা বুঝতে কোন‌ও অসুবিধা হয় না যে, যে সমস্ত দেশ জীববৈচিত্রে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একমাত্র সেই সব দেশের মানুষের পক্ষেই এই ধরনের জ্ঞান অর্জন সম্ভব। কেননা হাতের সামনে জীববৈচিত্রের প্রাচুর্য থাকলে তবেই তো সে সব ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই ধরনের জ্ঞান অর্জন করা যাবে।

বিকাশশীল দেশগুলির জীববৈচিত্রের পাশাপাশি তাদের এই চিরায়ত জ্ঞানভাণ্ডারের উপর‌ও নজর পড়েছে উন্নত দেশগুলির। জীববৈচিত্রের চুরি না হয় ঠেকানো যেতে পারে চৌকিদার দিয়ে, কিন্তু জ্ঞানভাণ্ডারের চুরি? তার জন্য চাই উপযুক্ত মেধাসম্পদ আইন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এমন কোন‌ো আইন এখন‌ও পর্যন্ত তৈরি করে উঠতে পারেনি ভারত। তাহলে কীভাবে চলছে এই বিষয়ে আইনি লড়াইগুলি? এই প্রসঙ্গে ফিরে আসি আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি ডব্লিউ আর গ্রেসের কথায়। ১৯৯২ সালে এই কোম্পানি নিম গাছের নির্যাস থেকে একটি কীটনাশক তৈরি করে তার উপর পেটেন্ট অধিকার আদায় করেছিল আমেরিকা ও ইউরোপীয় পেটেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। অথচ কীটনাশক এবং অন্যান্য ওষধি প্রয়োজনে ভারতে নিমের ব্যবহার চার হাজার বছরের‌ও পুরোনো এবং গাছটিও আদতে ভারতীয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা একদিকে জৈবসম্পদ এবং অন্যদিকে সেই সংক্রান্ত চিরায়ত জ্ঞানের চুরির একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। এই চুরির আবার দুটি দিক‌। প্রথমত, জৈবসম্পদ চুরি, যাকে আমরা বায়োপাইরেসি বলি। দ্বিতীয়ত, চিরায়ত জ্ঞানের চুরি।

এই চুরির বিরুদ্ধে ভারত লড়াই শুরু করে ১৯৯৭ সালে । শেষপর্যন্ত ২০০০ সালে ইউরোপীয় পেটেন্ট অফিস, তারা যে পেটেন্ট অধিকার গ্রেস কোম্পানিকে দিয়েছিল, সেটি প্রত্যাহার করে নেয়। নিম চুরির মত ঘটনা আরও অনেক আছে। হলুদ, করলা, বেগুন, বাসমতি চাল। তারপর সর্বক্ষেত্রেই সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মামলা, জলের মত অর্থ ব্যয়, জয় এবং পেটেণ্ট বাতিল। বলাবাহুল্য, এটা কোনো রাস্তা হতে পারেনা।

রাস্তা তাহলে কি? দুটো কাজ করতে হবে। প্রথমত, চুরিটা বন্ধ করতে হবে। তবে চুরি বন্ধ করলেই সবটা হবে না। চিরায়ত জ্ঞানের যারা অধিকারী, তাদের একটা প্রবণতা আছে, এই জ্ঞানকে নিজেদের গোষ্ঠী বা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। এই প্রবণতা থেকে এই জনগোষ্ঠীগুলিকে বার করে আনতে হবে। এর জন্য যেটা করতে হবে সেটা হল, এমন একটা ব্যবস্থা করা যার মাধ্যমে চিরায়ত জ্ঞানগুলির ব্যবহার থেকে যে আয় হবে তার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া যায়। শুধু জনগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিলেই হবে না, তা যেন গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিটি পরিবারের মধ্যে সমানভাবে বন্টিত হয় সেদিকেও নজর দিতে হবে। শুনতে অবাস্তব মনে হলেও ভারতেই এই নীতির সফল প্রয়োগের উদাহরণ আছে। ১৯৮৭ সালে কেরালার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অরণ্য-অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের সন্ধানে একটি অভিযান হয়েছিল ন্যাশনাল বোটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তরফে। এই অভিযানে বিজ্ঞানীদের সঙ্গী হয়েছিল স্থানীয় কানি সম্প্রদায়ের কয়েকজন যুবক। পাহাড়ি পথে চলতে চলতে সবাই যখন অল্পবিস্তর হাঁপিয়ে উঠছিল তখনই ওই যুবকেরা একটি পাহাড়ি গাছ থেকে কালো মত একটা ফল পেড়ে খেয়ে নিচ্ছিল বিজ্ঞানীরা বারবার লক্ষ্য করছিলেন ফলটি খাওয়ার পরই ছেলেগুলো বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে। কৌতুহলী হয়ে তারা যখন ফলটির খোঁজখবর করতে শুরু করলেন তখন কিন্তু ছেলেগুলি একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে দিল। তাদের বক্তব্য, এটা একেবারেই তাদের নিজস্ব গোপনীয়তা, যা তারা কোনোভাবেই, তাদের গোষ্ঠীর বাইরের কোনো মানুষের কাছে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়। অতঃপর বিজ্ঞানীরা যখন তাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, এই ফল থেকে যদি কোনও ওষুধ তৈরি করা যায়, তবে সেই ওষুধ বাজারে বিক্রি করে বিক্রিবাবদ যা আয় হবে তা তারা গোষ্ঠীর সঙ্গে ভাগ করে নিলে সবারই লাভ, তখন ছেলেগুলি সব কিছু খুলে বলে। শেষপর্যন্ত এই ফল থেকে বিজ্ঞানীরা যে ওষুধটি তৈরি করেছিলেন তা বাজারে ‘জীবনী’ নামে বিক্রি শুরু হয়। বিক্রিবাবদ অর্থ একটি ট্রাস্ট তৈরি করে ওই জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়াও শুরু হয়।

কিন্তু এটা গেল চিরায়ত জ্ঞানকে সুরক্ষা দেবার একেবারে শেষ ধাপের কাজ। এর আগের কাজটি কিন্তু আরো শক্ত। চিরায়ত জ্ঞানকে আইনি সুরক্ষা দেওয়া। কাজটি যে শক্ত তার অন্যতম প্রধান কারণ, চিরায়ত জ্ঞানের বৈচিত্র। কোন গাছের কোন অংশের কি গুণ, বা কোন জীবদেহের কোন অংশ খাদ্য আর কোন অংশই বা ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে, কেবল এটিই কিন্তু চিরায়ত জ্ঞানের নমুনা নয়। বাঁকুড়ার ঘোড়া বা বর্ধমানের মিহিদানা তৈরিতে স্থানীয় কারিগরদের বিশেষ পারদর্শিতাও চিরায়ত জ্ঞানের নমুনা। একইভাবে পাঞ্জাবের ভাংড়া নাচ বা বীরভূমের বাউল গান‌ও চিরায়ত জ্ঞানের নমুনা। এই বৈচিত্রের কারণে চিরায়ত জ্ঞানকে প্রচলিত কোনো একটি নির্দিষ্ট মেধাসম্পদ আইনের সাহায্যে সুরক্ষা দেওয়া অসম্ভব। দেওয়া যে অসম্ভব সেটা বুঝেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২৭(৩) ধারায় সদস্য দেশগুলিকে তাদের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী এই ব্যাপারে আইন তৈরি করে নিতে বলাও হয়েছিল। সেই কাজ কিন্তু এখনো সম্পন্ন হয়নি।

তবে একেবারে কিছু যে হয়নি তাও কিন্তু নয়। যেমন, কৃষি বীজের মত জৈব সম্পদকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে উদ্ভিদ আইন । কিন্তু সমস্যা এখানেও আছে। জৈব সম্পদকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য যে জীব বৈচিত্র আইন তৈরি করা হয়েছিল সেই আইন অনুযায়ীও কিন্তু কৃষিবীজকে সুরক্ষা দেওয়া যায়। আবার এই ব্যাপারে তৃতীয় একটি আইন তৈরির উদ্যোগ‌ও নেওয়া হয়েছিল। যে বিলটি এ ব্যাপারে তৈরি করা হয়েছিল সেই সিড বিলটি অবশ্য এখনো পর্যন্ত আইনে পরিণত হয়নি। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটিতেই এখনো পর্যন্ত একটা অপেশাদারিত্বের ছাপ রয়ে যাচ্ছে অথচ বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে দরকার ছিল একটি নতুন সুসংহত আইন তৈরির। তবে আইন তৈরি করে উঠতে না পারলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিন্তু ভারত সরকার করে ফেলেছে।

যারা জানেন কীভাবে বাসমতি চালের পেটেন্ট ভারত ফেরত পেয়েছিল তারা জানেন এই সংক্রান্ত আইনি লড়াইটি লড়তে গিয়ে ভারত তার দাবির সপক্ষে আদালতে যেটি জানিয়েছিল তা এই যে বাসমতি চালের উল্লেখ অনেক প্রাচীন কালের সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায়। এই উল্লেখই প্রমাণ করে যে আদি নিবাস ভারতবর্ষ। এই ঘটনাটি উল্লেখ করা হলো এটি বোঝাতে যে যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো আইন তৈরি করে ওঠা যাবে ততক্ষণ হাতিয়ার বলতে একটিই, প্রমাণ করা যে জৈববস্তুটি এবং তার ব্যবহার সংক্রান্ত যে জ্ঞান, দুটিই আদতে ভারতীয়দের কাছে অজ্ঞাত তো নয়ই, বরং তা বহুব্যবহৃত। আর এর জন্য যেটি দরকার তা হল এমন একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি যেখানে ধরা থাকবে ভারতের যাবতীয় জৈব সম্পদ এবং চিরায়ত জ্ঞানের তথ্য ও তালিকা‌‌‌।

আইন তৈরি করে উঠতে না পারলেও এমন একটি তথ্যভাণ্ডার কিন্তু ভারত সরকার ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন। ট্র‍্যাডিশনাল নলেজ ডিজিটাল লাইব্রেরী নামক এই তথ্যভাণ্ডারটিকে এই ব্যাপারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তথ্যভাণ্ডারের স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে চুরি আটকাতে না পারলেও চুরি যাওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করতে অন্তত এরপর ভারতের কোনো সমস্যা হবে না। আসল কাজ বাকি থাকলেও আপাতত আশার কথা এটুকুই। কথাতেই আছে না, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।