আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

সামাজিক সেতুর রেডিও

কস্তুরী বসু


আশির দশকে জন্ম নেওয়া আমাদের প্রজন্ম রেডিও-র সঙ্গে বড়ো হয়েছে। আমাদের যৌথ রান্নাঘরের মধ্য আয়ের পরিবারে এক জেঠু ছিলেন, যাকে বাড়ির সকলে তো বটেই, পাড়ার আত্মীয়রাও বয়েস অনুসারে সেজজেঠু, সেজদাদু বা সেজদা বলে ডাকত। আমাদের ছোটবেলার শুরুর কিছু বছর কেটেছে টালিগঞ্জ পাড়ার এক সরকারি আবাসন আর নানুবাবুর বাজারের পাশের একটি ব্লাইন্ড লেনের ভাড়াবাড়িতে। রেডিও-র গল্প তখন থেকে শুরু। সঙ্গীতপ্রিয় সেজজেঠু ব্যাচেলর ছিলেন, এবং দশটা-পাঁচটার চাকরির বালাই কোনওকালেই রাখেননি। তাঁর একান্ত নিজস্ব খরচার জন্য হ্যানিম্যানের মোটা বইখান পড়ে অনিয়মিত ভাবে হোমিওপ্যাথি চর্চা করতেন। বাকি সময়টা গানবাজনা নিয়ে থাকতেন। গানবাজনা আর আড্ডার সন্ধানেই কখনও টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়া, কখনও সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমি, কখনও ডোভার লেনে ঘুরে বেড়াতেন। আর বাকি সময়টা তাঁর সঙ্গী ছিল একটি রেডিও সেট। যতক্ষণ জেগে থাকতেন সেই রেডিও কখনও বন্ধ হত না। বেশি ঝড়জল হলে ট্রান্সমিশন বিগড়ে যেত। তখন চড়থাপ্পড় মেরে রেডিও চালানো নিয়ে আমাদের কিছু ঠাট্টা চালু ছিল। রেডিও নিয়ে এই গল্প মোটেই আমাদের বাড়ির খুব কিছু আলাদা গল্প ছিল না। সে দশকে যারা বড়ো হয়েছে, সকলের বাড়িতেই এমন কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে, যাদের রেডিও-র নেশা ছিল। নেশা যদি বা নাও থেকে থাকে, প্রয়োজন তো ছিলই। খবর থেকে বিনোদন, আবহাওয়া রিপোর্ট থেকে "চাষিভাই"-দের প্রতি সরকারি উপদেশবাণী বা খেলার কমেন্টারি। এমন কোনও বাড়ি পাওয়া যাবে না যেখানে একটি রেডিও সেটের অস্তিত্ব মিলবে না। কাজেই, আকাশবাণী (এ-এম) রেডিও-র শব্দ আমাদের বেড়ে ওঠার সাউন্ডস্কেপ আর কর্ণকুহরের মাসল মেমরি জুড়ে স্বাভাবিক ভাবেই ছিল। গল্প খানিক বদলাতে শুরু করে সাদা কালো টেলিভিশন মধ্য আয়ের ঘরে ঢোকার পর থেকে। ১৯৮৮-র সিওল অলিম্পিক, এবং যথাক্রমে রামানন্দ সাগর ও বি আর চোপরার রামায়ণ ও মহাভারত মেগাসিরিয়ালকে ঘিরে কালার টেলিভিশন সেটের বিক্রিতে একটা বুম আসে। গণমাধ্যম হিসেবে মধ্য আয় বর্গটির মধ্যে রেডিও’র জনপ্রিয়তা ভালোমত মার খায় নব্বইয়ের দশক জুড়ে। তবে সেজজেঠুর মত রেডিও প্রেমীদের জন্য আসল মারটা আসে উদারীকরণের এক দশক পরে এফ-এম রেডিও’র বেসরকারিকরণের পর। বেসরকারি এফ-এম রেডিও-র পালিশ করা সাউন্ড ও নবউদারবাদী ‘কন্টেন্ট’ (‘ঝিন্চ্যা‌ক ছাড়া কিছু থাকবে না!’) জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর অবশেষে আমাদের ছোটবেলার চেনা সাউন্ডস্কেপটির ইতি হয়।

কিন্তু ধান ভানতে শিবের গীত কেন? প্রাক-কথনের ধরতাইটায় ফিরে আসব। এখন যে গল্পটা বলতে বসেছি, সেটা এ লেখা পত্রিকায় যাওয়ার সময় মাত্র পাঁচ মাস বয়েসি একটি ইন্টারনেট-ভিত্তিক কমিউনিটি রেডিওকে নিয়ে। যার পোশাকি নাম, ‘রেডিও কোয়ারেন্টাইন কলকাতা’। এই রেডিও-র সূত্রপাতের কাহিনীটা বলে নেওয়া যাক। আমাদের রাজ্যে কোভিড মহামারীর প্রথম কিছু কেস ধরা পড়ার পর ২৩ মার্চ থেকে ঘোষণা হয় সার্বিক লকডাউন। যে সময় এই লকডাউনের সিদ্ধান্ত প্রথম জানানো হয়, সে সময়টাই আবার আমাদের সমাজে খুব টালমাটালের সময়। কাশ্মীরে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট থেকে লাগাতার সরকারি কার্ফু। বন্দুকের নলের মুখে টেলিফোন ও ইন্টারনেট বিপর্যস্ত, সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ। দিল্লিতে মুসলমান গণহত্যার আগুন নেভেনি। অসমে ১৯ লক্ষাধিক নাগরিককে কলমের খোঁচায় নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিটেনশন ক্যাম্পে বাড়ছে মৃত্যু। উত্তরপ্রদেশ জুড়ে নজিরবিহীন পুলিশি উগ্রতায় সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন। আমাদের রাজ্যের সর্বত্র নাগরিকত্ব বাঁচানোর গণ-আন্দোলন তুঙ্গে। এন-আর-সি, সি-এ-এ (ক্যা) ও এন-পি-আর এর ত্রিফলা আক্রমণের মুখে পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে ছোট বড়ো সংগঠন প্রস্তুত হচ্ছে বড়ো লড়াইয়ের জন্য। ১ এপ্রিল ২০২০ থেকে এন-পি-আর শুরু করার হুমকি ছিল। সেটা আটকানোর পালটা লড়াই। এই ছিল লকডাউন ঘোষণার আগের দিন পর্যন্ত ছবি। স্বাভাবিকভাবেই, এ সবের মাঝে যখন কয়েক ঘন্টার নোটিসে হঠাৎ নিদান আসে যে কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না; মিটিং, মিছিল, জমায়েত, প্রচার কর্মসূচি সব কিছু বন্ধ রাখতে হবে; নাগরিকত্ব বাঁচানোর ধর্ণামঞ্চগুলোকে খালি করে দিতে হবে। তখন সকলেরই বেশ একটা দিশেহারা অপ্রস্তুত অবস্থা হয়। আমরা কিছু বন্ধু মিলে ভাবতে শুরু করি এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়। কীভাবে শারীরিক দূরত্বের নিদানের মধ্যে থেকেও আন্দোলনের খবর দেওয়া নেওয়া, সামাজিক সংহতি বাড়িয়ে তোলা যায়। কীভাবে নাগরিকত্ব নিয়ে প্রচারের কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়। কীভাবে রাজনৈতিক যোগাযোগগুলি আরও বেশি ছড়ানো যায়। কীভাবে আমাদের অসমাপ্ত কথাবার্তাগুলোকে চালানো যায়। কীভাবেই বা মন ও মগজকে চাঙ্গা রাখা যায়। ভাবতে থাকি, যতদিন আমরা শারীরিক ভাবে এক জায়গায় জড়ো হতে না পারছি, ততদিন কি ‘জড়ো হওয়ার’ একটা বিকল্প জায়গা বানানো সম্ভব? আমাদের জীবদ্দশায় দেখা এই অস্বাভাবিক অদ্ভুত সময়টাকে কি শব্দমাধ্যমে নথিবদ্ধ করে রাখা সম্ভব? বলা দরকার যে যারা এসব ভাবছিলাম, সে বন্ধুরা বিভিন্ন সময়ে একসঙ্গে নানা রাজনৈতিক কাজ করেছি। কেউ কেউ একসঙ্গে পিপল্‌স স্টাডি সার্কেল চালিয়েছি, কেউ কেউ পিপল্‌স ফিল্ম কালেকটিভে একসঙ্গে কাজ করেছি, আবার কেউ কেউ নিজেদের পাড়ার এনআরসি-বিরোধী সংগঠনে যুক্ত থেকেছি। ফলে আমাদের একসঙ্গে মিলে কিছু করার পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিলই। আমাদের চিন্তাভাবনার তরঙ্গদৈর্ঘ্যও কাছাকাছিই ছিল। আমরা ভাবি একটা রেডিও স্টেশন খুলব। ইন্টারনেটে। আমাদের শ্রমের দাম না ধরলে, জিরো বাজেট। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। লকডাউনের দ্বিতীয় দিন, ২৪শে মার্চ বিকেল থেকেই চালু। ‘রেডিও কোয়ারেন্টাইন কলকাতা’ নামক কমিউনিটি রেডিও স্টেশন। তারপর যেমন হয়ে থাকে তেমনটাই হল। যারা শুরু করেছিলাম, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ক’দিন বাদে একটু ঝিমিয়ে পড়ল। তার বদলে বন্ধুর বন্ধু, তস্য বন্ধু, উৎসাহী শ্রোতা এসে আবার রেডিও চালানোর দলে জুড়েও গেল।

প্রশ্ন হল, দূর থেকে কথা বলার জন্য ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস্যাপ, ইউটিউবের মত সোশ্যাল মিডিয়া থাকতে আলাদা করে রেডিও স্টেশন ভাবলাম কেন? তার থেকেও বড়ো কথা, দৃশ্যমাধ্যম থাকতে শ্রবণমাধ্যম ভাবলাম কেন? লকডাউনে ঘরের মধ্যে দীর্ঘদিন বন্দি হয়ে থাকার একটা মনস্তাত্বিক প্রভাব আছে। ভোর থেকে রাত, চোখ খোলা থেকে চোখ বোজা অবধি দৃশ্যে দৃশ্যে প্রতি সেকেন্ডে সম্পৃক্ত, ক্রমাগতই হিংস্র আর তেতো ছবির আগ্রাসনে জর্জরিত হয়ে যাওয়ার আমাদের যে অনিবার্যতা, তা একটা সময়ের পর দমবন্ধ ঘরে আরও ক্লান্তিকর। শ্রবণের অভ্যেস ফিরে পাওয়াটা এ সময় একটা রিলিফ বা প্রাণের আরাম বটে! যার মূল্য নেহাৎ ফেলনা নয়। ফেসবুক, ইউটিউবের পাঁচমেশালি ভিড়, নানা রকমের নজরদারি, ট্রোলদের খিস্তি খেউড়, আর আরেকদিকে বিজ্ঞাপনের আগ্রাসন আর রেকর্ড লেবেল কোম্পানিদের কপিরাইট দৌরাত্ম্য এড়িয়ে আলাদা প্ল্যাটফর্মে রেডিও স্টেশন খোলা হল। সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হল রেডিওটিকে জনপ্রিয় করার কাজে। এছাড়া আরেকটি দিকও ছিল। আমাদের মধ্যে যাদের চলচ্চিত্রমাধ্যমে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, তারা এও বুঝছিলাম, যে ধরনের গণমাধ্যমের কথা আমরা ভাবছিলাম তার জন্য ঘরে আটকে থেকে, একে ওপরের সঙ্গে দেখা না করে, দৃশ্যমাধ্যমের জন্য মনের মত অনুষ্ঠান তৈরি করা দুঃসাধ্য কাজ। দৃশ্যমাধ্যমের চিত্রগ্রহণ, শব্দগ্রহণ ও সম্পাদনা যে পরিমাণ সময়, যৌথ উপস্থিতি ও পারদর্শিতা দাবি করে, তা আমাদের বন্ধুদের সকলের পক্ষে এমন ‘গেরিলা কায়দায়’ করে ওঠা সম্ভব হত না। অতএব, ছোটবেলার রেডিও শ্রবণাভ্যাসের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে, আর শব্দ সম্পাদনার অ-আ-ক-খ টুকু জেনেবুঝে নিয়ে, চালাও পানসি রেডিও কোয়ারেন্টাইন!

প্রথম পাঁচ মাসে কী কী ধরনের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়েছে রেডিও কোয়ারেন্টাইনে? রেডিও’র ‘প্রোগ্রামিং’ পরিকল্পনা করার সময়ে তিনটি ভাবনা আমাদের মাথায় থেকেছে। এক, রেডিও রাজনৈতিক হলেও সহজ হওয়া দরকার, তা যেন অহেতুক গোমড়া আর ভারাক্রান্ত না হয়ে পড়ে। দুই, শ্রোতারা যেন চাইলেই এতে সরাসরি অংশ নিতে পারেন, অর্থাৎ ভেতর-বাইরের বিশেষ কড়াকড়ি না রেখে শ্রোতা আর রেডিও-দলের দূরত্ব যতদূর সম্ভব কমাতে হবে। তিন, কমিউনিটি রেডিও-র ধারণা অনুযায়ী, আমাদের রেডিও মূলতঃ আমাদের পারিপার্শ্বিক, আঞ্চলিক, স্থানীয় পরিসর ও সামাজিক গোষ্ঠীর বিষয় ও ফর্ম্যাটকে ধারণ করবে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনা জারি রাখার পাশাপাশিই এই অভূতপূর্ব সময়কালটিকে শ্রবণমাধ্যমে ধরে রাখার, সময়টাকে টুকে রাখার আমাদের চেষ্টা থেকেছে।

রেডিও কোয়ারেন্টাইনের নিয়মিত বিভাগের মধ্যে এ যাবৎ থেকেছে ‘কোয়ারেন্টাইনের দিনলিপি’, ‘সমকালের ডায়েরি’, ‘মনের জানালা’ ও ‘শ্রমিকের ছবি’-র মত রাজনৈতিক আলোচনা, টেলিফোন সাক্ষাৎকার ও সংবাদ প্রতিবেদন-ধর্মী অনুষ্ঠান। এই বিভাগগুলির বিভিন্ন পর্বে এনআরসি থেকে শুরু করে ভুয়ো খবরের মহামারী, রাষ্ট্রীয় নজরদারি থেকে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি, রাজ্যের নানা অঞ্চল থেকে বিভিন্ন বর্গ, গোষ্ঠী ও পেশার মানুষের এই সময়ের রোজনামচা, শ্রমিকদের হাল হকিকত, গৃহহিংসার কথা, জেলবন্দিদের বিদ্রোহ, অর্থনৈতিক সংকট, পুলিশি দমন, শ্রমিক আন্দোলনের টুকরো টুকরো ছবি উঠে এসেছে। ‘যে জন আছে অন্তরে’ অনুষ্ঠানে বৃহত্তর বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর প্রাণের কাছাকাছি থাকা সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলন ও তার সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষদের অনুষঙ্গ এসেছে। আমফান পরবর্তী পরিস্থিতিতে ধারাবাহিকভাবে তেরটি পর্বে উঠে এসেছে রাজ্য জুড়ে বামপন্থী ছাত্রযুবদের উদ্যোগে গণ-হেঁশেল ও শ্রমিক সংহতি উদ্যোগগুলির জমিনি রিপোর্টাজ। ‘সকলের জন্য বিজ্ঞান’ বিভাগে আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার নানা শাখার তাত্ত্বিক ও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানকে সহজ, সাবলীল বাংলা ভাষায় সব বয়সের শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপনা করেছেন কর্মরত বিজ্ঞানীরা। করোনা ভাইরাস ও তার চিকিৎসা নিয়ে লাগাতার ভুয়ো বা পরস্পরবিরোধী তথ্যের বিপ্রতীপে এই বিভাগে যেমন উঠে এসেছে এই বিষয়ে বিজ্ঞানসমর্থিত আলোচনা আবার তার পাশাপাশি মহাকাশ গবেষণা, কণাবিদ্যার মত মৌলিক গবেষণার হদিশও উঠে এসেছে। শ্রোতাদের থেকে কৃষিবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, রাশিবিদ্যা, মেশিন লার্নিং প্রভৃতি পরিসরে আধুনিক বিজ্ঞানের যাত্রা নিয়েও পর্ব সম্প্রচার করার অনুরোধ এসেছে। ‘ছোটদের আসর’, ‘ঘরে ফেরার গান’, ‘গল্প ও লেখা পাঠ’, ‘কুইজ’, ‘ঘরবন্দি গান ও অন্যান্য হোম রেকর্ডিং’ ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলিতে কমিউনিটি রেডিও-র আরেক গোড়ার কথা অর্থাৎ শ্রোতাদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও আদানপ্রদান সম্ভব হয়েছে। শারীরিক ভাবে বহু দূরে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত থাকা চেনা-অচেনা মানুষজন তাদের ভাবনা, গান, কবিতা, লেখা, গল্প রেকর্ড করে পাঠিয়েছেন। এই সময়ের কোনও না কোনও অনুষঙ্গ তাতে জড়িয়ে থেকেছে। তারা একে অপরের সঙ্গে শ্রবণমাধ্যমে ‘পরিচিত’ হয়েছেন। এছাড়া থেকেছে সিনেমা ও সমাজ নিয়ে ‘ফিল্ম আড্ডা’, আর সর্বোপরি রেডিও জুড়ে থেকেছে - মিউজিক - সঙ্গীত ও শব্দজগৎ! নতুন, পুরনো, মনে থাকা, ভুলে যাওয়া, স-ব! গণসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, নাগরিক গান, হিপ-হপ, রক...। প্রতিরোধের সঙ্গীতের নানা সময়, নানা অধ্যায়, নানা ধারা, নানা দেশ, নানা চরিত্র।

বিগত পাঁচ মাসে রেডিওতে বেশ কিছু বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। লকডাউনের মধ্যে মে দিবসের সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল - অপার বাংলার দুই কবির জন্মদিনে তাঁদের স্বকীয় রাজনৈতিক ভাবনা, সমাজ ভাবনা, দর্শন ভাবনা, ভাবনার প্রয়োগ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের কাজকে অন্যভাবে (পড়ুন ন্যাকামিবর্জিত ক্রিটিকাল, কৌতূহলী দৃষ্টিতে) দেখার আয়োজন হয়েছে। অন্যভাবেই উদ্‌যাপিত হয়েছে বাইশে শ্রাবণ। উনিশে মে’র ভাষা শহীদ দিবস উদ্‌যাপিত হয়েছে, বরাক উপত্যকা, আসামের চর অঞ্চল, সিলেট ও পশ্চিমবঙ্গের বন্ধু কমরেডদের যৌথ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এই এনআরসি’র সময়ে দাঁড়িয়ে উনিশে মে’র মানে খোঁজার ক্ষেত্রে মিঞা কবিদের অংশগ্রহণ এই অনুষ্ঠানকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। মৌসুমী ভৌমিকের ‘অন্ন ভাষা, অন্য ভাষা’ অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষাগোষ্ঠীকে মনোলিথ হিসেবে ভাবার বিপরীতে অপার বাংলা জুড়ে নানা ভাষা, নানা শ্রেণী, নানা মানচিত্রের সমাহার উঠে এসেছে। বিশেষভাবে আয়োজন করা দীর্ঘ স্মরণ অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে আমরা ফিরে তাকিয়েছি দেবেশ রায়, বাদল সরকার, নবারুণ ভট্টাচার্য ও কামাল লোহানীর কাজের দিকে। উঠে এসেছে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন নিয়ে লন্ডননিবাসী দক্ষিণএশীয় বংশোদ্ভূত তরুণদের উপলব্ধির কথা। শুধু খ্যাতনামা ব্যক্তিরাই নন। আমাদের তরুণ বন্ধু, কলকাতার গণ আন্দোলনের কর্মী রায়া দেবনাথ আকস্মিকভাবে অকালে চলে গেলে, তাকেও ভালোবাসায় শ্রদ্ধায় স্মরণ করার পরিসর হয়ে উঠেছে এই রেডিওই। ১৫ই আগস্ট উপলক্ষে ‘দেশভাগ দিবস’-কে ধরে রাখার জন্য দুই বাংলার মানুষের দেশভাগকে ফিরে দেখা, দেশভাগের নানা প্রান্তিক আখ্যান ও সর্বোপরি বাংলার উদ্বাস্তুদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ নিয়ে আলোচনা ও স্মৃতিচারণের আয়োজন হয়েছে। রাষ্ট্রনির্মাণের কাজে উদ্বাস্তুদের বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করা, ক্যাম্প ও পুনর্বাসনের দুর্বিষহ নীতির উত্তরাধিকার বহন করছে আজকের ডিটেনশন ক্যাম্প। এছাড়া, এই ১৫ই আগস্টেই উপনিবেশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ও বাংলার মুসলমান সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে স্মরণ করা, তার বিপরীতে তুলে আনা হিন্দুত্ব-জাতীয়তাবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস - এই অনুষ্ঠানও পরিকল্পিত হয়েছে। রেডিওতে আর একটি নিয়মিত বিভাগ, ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছেন ওপার বাংলার সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও শ্রোতারা। নিয়মিত ভাবে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন আসাম, ত্রিপুরার বন্ধুরাও। যে ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মে আমাদের রেডিও স্টেশনটি হোস্ট করা আছে, তা থেকে শ্রোতাদের মানচিত্র দেখে আমরা জানতে পেরেছি আজকের তারিখ পর্যন্ত একশ’ কুড়িটি দেশ থেকে ষাট হাজার শ্রোতা কোনও না কোনও সময়ে রেডিওটি শুনেছেন; এর মধ্যে সাতচল্লিশ হাজার ভারতের বাসিন্দা!

জুন মাস থেকে লকডাউন ধাপে ধাপে শিথিল হতে শুরু করেছে। মহামারীর কমার কোনও লক্ষণ নেই, কিন্তু সরকার বাহাদুর যেহেতু বেতন, বাড়িভাড়া, খাদ্যযোগান, ঘরে ফেরার যানবাহন ইত্যাদির মত শ্রমিকদের কোনও মৌলিক চাহিদার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে, অতএব, ধাপে ধাপে লকডাউন উঠে যাওয়ার দিকেই আমরা এগোচ্ছি। আমাদের বহু শ্রোতা অনুরোধ জানিয়েছেন, লকডাউন উঠে গেলেও রেডিও যেন বন্ধ না করা হয়। তদেরই অনুরোধে আগস্ট মাস থেকে শুরু হয়েছে সরাসরি সম্প্রচারের পাশাপাশি রেডিও অনুষ্ঠানের পডকাস্ট। যাতে পুরনো অনুষ্ঠানগুলিকে ভবিষ্যতের জন্য আর্কাইভ করে রাখা যায়। শ্রোতারা চেয়েছেন দুই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের যৌথ উদ্যোগে এই রেডিও চলুক। সেক্ষেত্রে স্বপ্ন শুধু দুই বাংলাতেই থামবে কেন? টুকরো টুকরো অনেক বাংলা, ঈশান বাংলা, অপার বাংলা, অভিবাসীর বাংলা, প্রবাসীর বাংলা, পরিযায়ীর বাংলা, এমন অনেক ‘দেশ’কে জুড়তেও তো পারে রেডিও। হতে পারে নাগরিকত্বের বিভাজন, বাংলাদেশি/বাঙালি শ্রমিক বিতাড়নের বিরুদ্ধে একটি যোগাযোগের সেতু। আবার বাস্তব সমস্যা হল, করোনা পরিস্থিতি পেরিয়ে জীবন আবার স্বাভাবিক হলে আমাদের কর্মী এবং শ্রোতাদের রোজকার জীবনের ছন্দ আবার বদলাবে। সেই নতুন ছন্দের সঙ্গে নতুন করে টিউন করতে হবে রেডিওকে। অদূর ভবিষ্যতে রেডিও-র চেহারা যাই হোক না কেন, এই স্বল্প সময়ের মধ্যে নতুন মাধ্যম নিয়ে ছোট একটি পরীক্ষা নিরীক্ষা যে একটা বড়ো সম্ভাবনার আভাস দিয়ে গেল, এটুকু বলতে দ্বিধা নেই।

শ্রবণমাধ্যম হোক বা দৃশ্যশ্রাব্যমাধ্যম, শ্রমিকের রাজনীতির পক্ষে থাকা জনপ্রিয় গণমাধ্যম এই সময়ের এক অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন। দক্ষিণপন্থী চিন্তাধারা কীভাবে নিউজ থেকে বিনোদন হয়ে রোজকার অবসরযাপনের সর্বত্র ঢুকে গেছে, তা আজ আমাদের চোখের সামনে। ‘লেফট পপুলিজম’ বা শ্রমিকপক্ষের চিন্তাকে কতগুলি বহুধাবিভক্ত চেনা বৃত্তের বাইরে বড়ো পরিসরে জনপ্রিয় করার কাজটি অনেকাংশেই অধরা। মাতৃভাষায় রোজকার রাজনীতি চর্চা, সমাজ নিয়ে, স্থানীয় দৈনন্দিন নিয়ে সহজ ভাব বিনিময়ের রাজনৈতিক মাধ্যমের প্রয়োজনও কেউ অস্বীকার করবেন না। এ নিয়ে সিরিয়াস ভাবনা ও দলীয় সংকীর্ণতার বাইরে দক্ষ, কার্যকরী, যৌথ পরিকল্পনা জরুরি। যদি রেডিও মাধ্যমের কথাই আলাদা করে ধরি। এ লেখার শুরুতে টেনে এনেছিলাম ছোটবেলার ব্যক্তিগত শ্রবণস্মৃতির কথা। তার বাইরে বেরিয়ে, কমিউনিটি রেডিও-কে ঘিরে আমাদের উপমহাদেশে গণমানুষের লড়াইয়ের বহু তুঙ্গমুহূর্তের কৌমস্মৃতির কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করব। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ মুক্তিকামী কৃষকদের বন্দুকের লড়াইয়ের পাশাপাশি লড়েছিল এক চাগিয়ে তোলা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। আমাদেরই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক-ছাত্ররা এখানেও গোপনে তার একটি স্টেশন চালানোর কাজ করেছিলেন। ‘আজাদ কাশ্মীর রেডিও’ নব্বইয়ের দশকে সরকারি রেডিও’র মুখোমুখি লড়েছিল অসম লড়াই। কীভাবে গ্রামের মানুষ সে রেডিও’য় কান পেতে লড়াই করতে চলে যাওয়া প্রিয়জনের বাঁচা-মরার খবর পেতেন সে সব কথা এখনো রয়ে গেছে গ্রামের মেয়েদের স্মৃতিতে। নকশালবাড়ি বিদ্রোহের সময়ে চীনের ‘পিকিং রেডিও’ তাকে ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ আখ্যা দেওয়ার পর সে রেডিওয় কান পাততেন উপমহাদেশের অনেক মুক্তিকামী মানুষ। চারু মজুমদার সে সময়ে আন্দোলনের নিজস্ব একটি রেডিও স্টেশন গড়ে তোলার প্রযুক্তি চেয়েছিলেন চীনের কাছে। নিরাপদ জায়গার অভাবে শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। শ্রীলঙ্কায় তামিল আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাদের নিজস্ব রেডিও’র বড়ো ভূমিকা ছিল। এ তো গেল বড়ো বড়ো লড়াইয়ের কথা। কিন্তু দৈনন্দিন মতাদর্শগত প্রচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের গণমাধ্যমের লড়াইগুলো কেমন হবে? শহরে বসে বিশ্বাস করা কঠিন হলেও মনে রাখতে হবে, এখনও দেশের বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে শ্রবণমাধ্যমে আকাশবাণী রেডিও আর দৃশ্যশ্রাব্যমাধ্যমে দূরদর্শনের সম্প্রচার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ঘরে পৌঁছয়। যখন আকাশবাণীর রেডিওতরঙ্গ বেয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’। যখন মালিকপক্ষের সংবাদপত্র থেকে টেলিভিশন সমস্তই বিক্রিত ও বিকৃত, হিংস্র, বীভৎস হয়ে উঠেছে। তখন এই মুহূর্তে ইন্টারনেটের সমস্ত সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েও, দূরপাল্লার পাল্টা লড়াইয়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকপক্ষের গণমাধ্যম গড়ার অংশ হিসেবে অপার বাংলা জোড়া একটি অন্য রকম বেতারের স্বপ্ন যদি দেখি, কার তাতে কী!


রেডিও কোয়ারেন্টাইনের সরাসরি সম্প্রচার ও পডকাস্টের হদিশ -
www.linktr.ee/RadioQuarantineKolkata