আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দেশ ও জাতি গঠনে নৃতত্ত্ব

অভিজিত গুহ


(দ্বিতীয় অংশ)

উদ্বাস্ত সমাজে সামাজিক উত্তেজনা

ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের পর্তিষ্ঠাতা পরিচালক বিরজাশঙ্কর গুহ (১৮৯৪-১৯৬১) আজও নৃতত্ত্বের পাঠক্রমে ভারতের জনগোষ্ঠীগুলির বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কিত গবেষণার একজন পথিকৃৎ হিসেবেই পরিচিত। গুহ আমেরিকার সুবিখ্যাত হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৪ সালে নৃতত্ত্বে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন (সিনহা ও কুন, ১৯৬৩)। দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত লক্ষাধিক উদ্বাস্ত জনগোষ্ঠীর সমাজ সম্পর্কে গুহর মৌলিক গবেষণা আজও ভারতীয় নৃবিজ্ঞানী মহলে প্রায় অজানা। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নৃবিজ্ঞানের পাঠক্রমেও উদ্বাস্ত পুনর্বাসন নিয়ে বিরজাশঙ্করের গবেষণা অনুপস্থিত। দেশ ভাগের পর পাঞ্জাব ও বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মত জনবহুল ও অধিক জনঘনত্ব বিশিষ্ট একটি রাজ্যে উদ্বাস্ত পুনর্বাসন ছিল সরকারে কাছে মস্ত বড় একটি সমস্যা। নৃতাত্ত্বিক হিসেবে বিরজাশঙ্কর গুহ দেশ তথা রাজ্যের এই জ্বলন্ত সমস্যা অনুধাবনে যে অক্লান্ত গবেষণা করেছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন। গুহ তৎকালীন নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের কয়েকজন সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্রশিক্ষিত গবেষক দল তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গের দুটি জায়গায় পুনর্বাসিত উদ্বাস্ত বসতির মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে ক্ষেত্র সমীক্ষা চালান। প্রশিক্ষিত দলটির ক্ষেত্র সমীক্ষার ফলাফল গুহর সম্পাদনায় ১৯৫৯ সালে একটি বই-এর আকারে ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইটিও আজ দুষ্প্রাপ্য। বইটির ভূমিকায় গুহ সমীক্ষক দলের তথ্যাবলীকে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেন। দেশভাগ ও সাম্পদায়িকতা যে আসলে পূর্বতন ব্রিটিশ সরকারের বিভাজনের মাধ্যমে শাসনের নীতি (Divide and Rule) এবং তদানীন্তন মুসলিম লীগের একপেশে নীতিরই (sectarian Policy) কুফল একথা বলতে গুহ বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান থেকে হিন্দুদের উদ্বাস্ত হয়ে পালিয়ে আসার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিরজাশঙ্কর কোনো পশ্চিমী সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের আশ্রয় নেননি। এব্যাপারে নিজস্ব ক্ষেত্র সমীক্ষালব্ধ তথ্যই ছিল গুহ-র প্রধান অবলম্বন। আমি সরাসরি গুহ-র লেখা থেকেই উদ্ধৃত করলাম।

‘‘পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দু গোষ্ঠীগুলির উদ্বাস্ত হয়ে পালিয়ে আসার পেছনে কাজ করছিল এক ভয়ঙ্কর হতাশা। এই হতাশা শুরু হয় তখনই যখন হিন্দুরা বুঝতে পারেন, যে সামাজিক অবস্থান ও সম্মান তারা এতদিন ভোগ করছিলেন তা আর নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে সেটি ফিরে পাবার আশাও বিলীন। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলাটা অনেক সময়েই হিন্দুদের উদ্বাস্ত হতে বাধ্য করেছিল’’ (গুহ ১৯৫৯)।

এরপর গুহ তাঁর বইয়ের ভূমিকার পরবর্তী অংশে উদ্বাস্তদের মধ্যে সামাজিক উত্তেজনার বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলিকে একটি সচল প্রক্রিয়া হিসেবে তুলে ধরেন। উদ্বাস্ত পরিবারগুলির উপর গুহ-র সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার আর একটি উল্লেখয়োগ্য বিষয় হল হিন্দু যৌথ পরিবারে কর্তৃত্ত্বমূলক গঠনে পরিবর্তন। এ ব্যাপারেও গুহ তুলনামূলক পদ্ধতি অবলম্বন করে দেখান যে পুনর্বাসিত উদ্বাস্ত পরিবারগুলি যে জায়গায় সরকারী সাহায্যের উপর অধিক পরিমাণে নির্ভরশীল সেখানে হিন্দু যৌথ পরিবারের মধ্যে প্রথাগত কর্তৃত্ত্বের বাঁধন দৃঢ়তর। আর যেখানে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলিকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য অনেক বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছিল সে সমস্ত জায়গায় যৌথ পরিবারগুলির প্রথাগত বাঁধন ও নিয়মকানুন দ্রতগতিতে শিথিল হয়ে আসছিল। উদ্বাস্তদের মধ্যে সামাজিক উত্তেজনার কারণ অনুসন্ধানে গুহ কোনো পশ্চিমী নৃতাত্ত্বিক তত্ত্বের উপর নির্ভর করেননি। ওর মতে উদ্বাস্ত ও সরকারী প্রশাসনের দূরত্ব সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছিল। পশ্চিমবঙ্গের সরকারী প্রশাসন উদ্বাস্তদের ‘‘বহিরাগত’’ হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিল।

এমতাবস্থায় গুহ-র সুপারিশ ছিল উদ্বাস্ত পুনর্বাসনে ছিন্নমূল মানুষদের হাতে ওদের উন্নয়নের ভার দিতে হবে, যাতে করে ওরা নিজেদের আত্মসম্মানবোধ ফিরে পেতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিত অংশগ্রহণকারী উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সাহায্যকারী একটি সংস্থা হিসেবে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্ত পুনর্বাসন বিষয়ে বিরজাশঙ্কর গুহ ও তার গবেষকদলর অবদান দেশ ও জাতি গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন।
 

বৃহৎ শিল্পায়নজনিত উচ্ছেদ ও সামাজিক প্রক্রিয়া

এবার আমরা প্রয়াত দিকপাল নৃতাত্ত্বিক বিক্রম কেশরী রায় বর্মণের রৌরকেল্লায় বৃহৎ শিল্পায়ন সম্পর্কিত গবেষণার কথা সংক্ষেপে বর্ণনা করব। বিক্রম রায় বর্মণও (১৯২২-২০১২) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিভাগের কৃতী ছাত্র ছিলেন। উনিও ছিলেন তারক চন্দ্র দাশের ছাত্র। ১৯৬০ সালে রায় বর্মণ ভারত সরকারের তপশীলি জাতি ও আদিবাসী বিভাগের সহকারী কমিশনার ছিলেন। তদানীন্তনকালে ওঁরই পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত সরকারের জনগনণা বিভাগের সহায়তায় উড়িষ্যার রৌরকেল্লায় শিল্পায়ন ঘটিত সামাজিক প্রক্রিয়াগুলি সম্পর্কে সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সমীক্ষা ও গবেষণার জন্য তৈরী হয় একটি দল এবং রায় বর্মণ ছিলেন দলটির প্রধান পরিচালক। সমীক্ষার বৈজ্ঞানিক ফলাফলগুলি পরবর্তীকালে সরকারী জনগণনার গ্রন্থমালার একটি পুস্তক হিসেবে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। এর বহুকালবাদে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রবাদ প্রতিম নৃতাত্ত্বিক মাইকেল সারণা (Michael Cernea) তাঁর ১৯৯৫ সালে লিখিত একটি প্রবন্ধে রায় বমর্ণের উক্ত গবেষণাটিকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে উন্নয়ন জনিত উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত বিষয়ের প্রথম নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা হিসেবে অভিহিত করেন (সারণা ১৯৯৫)। রৌরকেল্লার দৈত্যাকার এই ষ্টীল প্রস্ততকারী কারখানাটি ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বৃহৎ শিল্প। এই বৃহৎ স্টীল কারখানা বছরে একলক্ষ টন স্টীল উৎপাদন করতে পারত। রায়বর্মণ তার বইয়ের শুরুতেই বলেছেনঃ ‘‘এই স্টীল প্রস্তুতকারী কারখানাটি দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে একটি পথ প্রদর্শক। কিন্তু একই সঙ্গে এই শিল্পায়ন বহু মানুষকে গৃহহারা করেছে এবং এইসব মানুষরা অধিকাংশই আদিবাসী। বাস্তচ্যূত মানুষরা স্টীল কারখানা প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই এখানকার অধিবাসী ছিলেন। এইসব গৃহহারা, ভূমিহারা মানুষরা অনেকেই তাঁদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন আবার অনেকেই চলে গেছেন দারিদ্র সীমার অনেক নিচে। বর্তমান গবেষণা রৌরকেল্লার দৈত্যাকার শিল্প প্রতিষ্ঠার, মানবিক দিক সম্পর্কে অধ্যয়নেরই একটি প্রস্তাব’’ (রায়বর্মণ ১৯৬১)।

শিল্পায়নের আর্থসামাজিক ও মানবিক দিক সম্পর্কে দিক নির্দেশকারী রায়বর্মণের এই মহাগ্রন্থ শুধু বিপুল পরিমাণ পরিসংখ্যানেরই সমাহার নয় একই সঙ্গে তদানীন্তন রাজনৈতিক ও সামাজিক বহু সুক্ষ্ম ও জটিল প্রক্রিয়ার এক বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ। বৃহৎ শিল্পায়নের আঘাতে ভেঙ্গে চুরে যাওয়া গ্রামসমাজের মধ্যেও রায়বর্মণ খুঁজে পেয়েছিলেন গ্রামের অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস। রামবর্মণের ক্ষুরধার বিশ্লেষণে গ্রামের এই অন্তর্নিহিত নৈতিক শক্তিই শেষ পর্যন্ত বাস্তচ্যূত পরিবারগুলিকে জমির বদলে জমি অথবা করাখানায় কর্মসংস্থান কিংবা অধিকতর ক্ষতি পূরণের দাবীর আন্দোলনে একজোট করতে সাহায্য করেছিল।

রায়বর্মণের গবেষণার সঙ্গে তুলনীয় আর একটি নৃতাত্ত্বিক গবেষণা প্রায় একই সঙ্গে করেছিলেন ভারতীয় নৃবিজ্ঞানিক সর্বেক্ষণের প্রণবকুমার দাশগুপ্ত। প্রণব বাবু ১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের চিত্তরঞ্জন শিল্পনগরীতে আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলির উপর ভারী শিল্পায়ণের আর্থ-সামাজিক প্রভাব ও কুফলগুলির উপর ক্ষেত্র সমীক্ষা ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা করেন। ভারতবর্ষের প্রথম এবং দ্বিতীয় জাতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার যুগে রাষ্ট্রায়ত্ত ভারী শিল্পায়ণের আর্থ-সামাজিক প্রভাব ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত গবেষণায় আজও রায়বর্মণ এবং দাশগুপ্তের জুড়ি মেলা ভার (রায়বর্মণ ১৯৬১; দাশগুপ্ত ১৯৬৪)।

আশ্চর্যের কথা হল দেশ গঠনের কাজে রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ শিল্পায়নের ভূমিকা নিয়েই অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাকারীরা আলোচনা করে এসেছেন। সরকারী সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় রায়বর্মণ ও দাশগুপ্তের মত মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব জ্ঞান সম্পন্ন গবেষণা কর্মগুলি আজও উপেক্ষিত। এরপর আমি বর্ণনা করব প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ইরাবতী কার্ভের বৃহৎ নদী-বাঁধ প্রকল্প ও তার আর্থ-সামাজিক প্রভাব সংক্রান্ত একটি গবেষণার কাহিনী।
 

কয়না নদী-বাঁধ প্রকল্প ও বাস্তচ্যূত মানুষের কাহিনি

ইরাবতী কার্ভে (১৯০৫-১৯৭০) ভারতীয় নৃতত্ত্বের স্বর্ণযুগের একমাত্র মহিলা নৃতাত্ত্বিক। কার্ভে পুণার সুবিখ্যাত ডেকান কলেজে নৃতত্ত্বের স্বনামধন্য অধ্যাপিকা ছিলেন। শারীরিক ও সামাজিক নৃবিজ্ঞানে কার্ভের অসামান্য অবদান নৃতাত্ত্বিক মহলে সুপরিচিত। মহাভারতের নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য সম্বলিত পুস্তক ‘যুগান্ত’ রচনা করে ইরাবতী কার্ভে ১৯৬৮ সালে সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কারে সম্মানিত হন। অনেকেই জানেন না যে ষাটের দশকে ইরাবতী কার্ভে ভারতের জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের গবেষণা সংক্রান্ত কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় মহারাষ্ট্রে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কয়না নদীর উপর নির্মিত বৃহৎ জলবাঁধ প্রকল্পের উপর সুপরিকল্পিত ক্ষেত্র সমীক্ষা চালিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করেছিলেন। এই মৌলিক এবং দিক নির্দেশকারী গবেষণার ফলাফল ইরাবতী কার্ভে ও জয় নিম্বকার রচিত অধুনা দুষ্প্রাপ্য একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ (কার্ভে এবং নিম্বকার ১৯৬৯)। প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক নন্দিনী সুন্দরের মতে বৃহৎ নদী-বাঁধ প্রকল্পে উচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয়ে কার্ভের এই ক্ষেত্র সমীক্ষাটিই প্রথম এবং আদর্শ (Model) গবেষণা।

মহারাষ্ট্রের কয়না নদী বাঁধ প্রকল্পে প্রায় শতাধিক গ্রাম ও তিরিশ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। প্রায় তিরিশ হাজার একর কৃষিজমি ডুবে যায় এবং বত্রিশ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও কৃষিযোগ্য এবং বাস্তজমি দেওয়া হবে। কার্ভে ও নিম্বকার ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি গ্রাম ও কিছু পরিবারের মধ্যে ক্ষেত্রসমীক্ষা ভিত্তিক গভীর নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে যা দেখতে পান তা হল এরকম।

‘‘প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ রাজত্বে ভারতবর্ষে যতগুলি বৃহৎ বাঁধ তৈরী হয়েছিল স্বাধীনতার পর তার চেয়ে বেশি সংখ্যক নদী বাঁধ নির্মিত হয়েছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালকরা এটাও বুঝতে পেরেছেন যে বাস্তচ্যূত মানুষদের যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিলেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির প্রকৃত পুনর্বাসনও রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমাদের এই রিপোর্টে দেখা যাবে যে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং সৎভাবে সেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টাগুলি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়’’ (কার্ভে ও নিম্বকার ১৯৬৯ পৃঃ১)।

দেশ গঠনের পথে বৃহৎ বাঁধ নির্মাণের ফলে যে আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল সে সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ সমৃদ্ধ যে দলিলটি কার্ভে ও নিম্বকার তৈরী করেছিলেন তা আজ দুষ্প্রাপ্য ও অনালোচিত। বইটিতে লেখকদ্বয় কয়না নদীর উপর বাঁধ নিমার্ণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ পরিবারগুলির ভূমিহীনতা, বাস্তচ্যূতি, শিক্ষা, জীবিকার পরিবর্তন এবং পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে বিপুল পরিমাণ তথ্যের একটি সুসংহত ও সার্বিক বিশ্লেষণ করেছেন। বইটির শেষ অংশে কার্ভে ও নিম্বকার বলছেন, ‘‘পুনর্বাসনের প্রধান ব্যর্থতা হল পরিকল্পনার অভাব। পুনর্বাসনের নামে আসলে যা ঘটেছিল তা হল মানুষগুলিকে তড়িঘড়ি তাদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে সরকার মানুষগুলির উপর দোষারোপ করেছেন। প্রশাসনের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির হাতে মোটা টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এত টাকা ওরা কোনোদিন একসাথে পায়নি। ফলত এইসব টাকা বেহিসেবী পথে খরচ হয়ে গেছিল। ক্ষতিপূরণের টাকার বড় অংশ পুনর্বাসিত এলাকায় বাড়ি তৈরির বদলে যাতায়াতের পেছনেই খরচ হয়ে গেছিল’’ (কার্ভে ও নিম্বকার, ১৯৬৯ পূঃ ১০৬)।

সবশেষে কার্ভে ও নিম্বকার তাঁদের গ্রন্থে স্বাধীন সরকারের অদূরদর্শিতার চূড়ান্ত রূপ তুলে ধরেছেন। লেখকদ্বয় বলেছেন কয়না বাঁধ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির হাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেশের সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে কয়েকশো করে টাকা তুলে দেওয়া হয়। কারণ সরকারের আশঙ্কা ছিল পুনর্বাসনের ব্যর্থতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলি ক্ষমতাসীন দলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। বলা বাহুল্য নৃতাত্ত্বিক ইরাবতী কার্ভে এইধরনের সরকারী নীতি ও কাজকর্মকে সমর্থন করতে পারেননি। সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত গবেষণায় সরকারী নীতির সমালোচনা করতে এতটুকু পিছপা হন নি ইরাবতী কার্ভে ও জয় নিম্বকার। দেশ গঠনের কাজে এরকম নৃতাত্ত্বিকদের কাজ থেকে আজও আমাদের অনেক কিছু শেখবার আছে বৈকি।
 

উপসংহার

দেশ ও জাতি গঠনে নৃতত্ত্বের অবদান সম্পর্কে শিক্ষিত পাঠকবর্গের সামনে তথ্য ও প্রমাণ সহযোগে একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন তুলে ধরা ছিল এই প্রবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে দেশ গঠনের মত বিশাল একটি বিষয়ে নৃতত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কথাও আলোচনা করেছি। কোনো বিষয়ের ইতিহাস চর্চা সমাজ ও ব্যক্তি নিরপেক্ষ নয়। আমার প্রতিবেদনও নিরপেক্ষ এরকম দাবি করব না। ভারতবর্ষের নৃতত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় এ পর্যন্ত দেশ ও জাতিগঠন প্রায় অনুল্লিখিত। এই প্রবন্ধে বর্ণিত তথ্যসমূহ আগে কারুর জানা ছিল না এমন দাবিও করব না। পুরনো তথ্যগুলিকেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। পাঠকবর্গের কাছে আমার ব্যাখ্যা নতুন মনে হলে নিজেকে ধন্য মনে করব।
 

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শুভনীলের ক্রমাগত তাগাদা না থাকলে এই প্রবন্ধ লেখা হত না। এ ছাড়া আছে বিধান ও গোর্কির উৎসাহ। আমি কৃতজ্ঞ ভারতীয় নৃবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের বিনয় শ্রীবাস্তব, শশীকুমার ও রামুজীর কাছে। ইরাবতী কার্ভের বইটি যোগাড় করে দেন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক গ্রেগ তাসিওলি। গ্রেগের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। বিরজাশঙ্করের বইটি যোগাড় করেছিলাম জার্মানির পুরনো বইয়ের দোকান আ্যান্তিকুইরিওতে হিসাসিগুর থেকে। তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। বন্ধু তপন মৌলিক, উত্তম ভট্টাচার্য ও প্রবীর দাশ এই লেখার প্রথম পর্ব পাঠ করে প্রভূত উৎসাহ জুগিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই ভারতীয় সমাজবিজ্ঞান সংস্থা (ICSSR) এবং ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা (IDSK)-কে। ICSSR-এর আর্থিক সহায়তা ও IDSK-এর লাইব্রেরীতে বসে পড়াশুনো করার সুযোগ না পেলে এ বিষয়ে গবেষণা করে উঠতে পারতাম না। আর আছে আমার স্ত্রী প্রীতি ও পুত্র অমি। এদের উৎসাহ আমার পাথেয়। সবশেষে কৃতজ্ঞতা জানাই ছাপাখানার কর্মীদের যাঁরা এই কঠিন সময়ে যত্ন সহকারে আমার লেখা টাইপ করেছেন।


তথ্যসূত্রঃ
 

● Bose, N.K. (1967). Researches in Indian anthropology. Man in India. 42(3):175-180.
● Bose, N.K. (1967). Problems of national integration. Simla: Indian Institute of Advanced Study.
● Bose, N.K. (1969).Problems of Indian nationalism. Bombay: Allied Publishers.
● Bose, N.K. (1974). Anthropology after fifty years. In Indian Anthropology Today. (Ed.) D.Sen. Calcutta: The University of Calcutta.
● Cernea, M.M. (1995). Social integration and population displacement: the contribution of social science. International Social Science Journal 143(1):91-112.
● Das, T.C. (1941). Cultural Anthropology in the Service of the Individual and the Nation.Pp.1-29.Presidential Address delivered in the Section of Anthropology in the Twenty-eighth Indian Science Congress. Benares.
● Dasgupta, P.K.(1964). Impact of industrialization on tribal life. Bulletin of the Anthropological Survey of India.13 (1&2):85-106.
● Kalla, A.K. & Singh, K.S. (Eds.), Anthropology Development and Nation Building. New Delhi: Concept Publishing Company.
● Sarana, G. (1974). The study of nation building processes. In Indian Anthropology Today. (Ed.) D.Sen. Calcutta: The University of Calcutta.
● Sarkar, S.S. (1951).The place of human biology in anthropology and its utility in the service of the nation. Man in India. 31(1): 1-22.
● Sinha, D.P. & Coon, C.S. (1963).Biraja Sankar Guha, 1961. American Anthropologist, New Series. 65(2): 382-387.
● Srinivas, M.N. (2009). (First published in 1986). On living in a revolution. In The Oxford India Srinivas. New Delhi: Oxford University Press.Pp.373-387.
● Srinivas, M.N. and Panini, M.N. (1973). The development of sociology and social anthropology in India. Sociological Bulletin 22(2): 179-215.


______________________________
এই প্রবন্ধের প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়েছে আরেক রকম, ১-১৫ আগস্ট ২০২০ সংখ্যায়।