আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭
প্রবন্ধ
রাষ্ট্রিকতা ও ভারতীয় সমাজ
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
অর্থনীতির মূল সমস্যাটি হল সম্পদ বণ্টনের সমস্যা। বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে যোগানের চেয়ে চাহিদা বেশী হওয়ার সমস্যা। যেসব ক্ষেত্রে যোগানের চেয়ে চাহিদা কম, যেমন ধরুন সূর্যের আলো, সেসব নিয়ে অর্থনীতি আলোচনা করে না। আবার আজ যার যোগান চাহিদার চেয়ে বেশি, কালও তাই থাকবে এর কোন মানে নেই। যেমন ধরুন জল। কখনো যে পৃথিবীতে জলের যোগান নিয়ে বেজায় সমস্যা হতে পারে, এমনকি আমাদের মত নদীমাতৃক দেশে, সেটা পঞ্চাশ বছর আগেও কারও মনে হয় নি। আজ কিন্তু জলের সমস্যা মেটানোর জন্য বাজার বা রাষ্ট্রের ব্যবহার আমাদের গবেষণায়, পাঠ্যবইতে ঢুকে আসছে। এখন চাহিদা যোগানের এই সমস্যাটা মেটানোর জন্য আমরা মূলত তিনটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে পারি - রাষ্ট্র, গোষ্ঠী আর বাজার। এখন এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের যে আন্তঃসম্পর্ক সেটি যে খুব একমুখী এরকম নয়। অনেক ধরনের বণ্টন সমস্যার ক্ষেত্রে রাষ্ট, গোষ্ঠী আর বাজার পরপস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী - খাতায় কলমে যদিও রাষ্ট্রের হাতেই সব ক্ষমতা, রাষ্ট্রই নির্ধারণ করতে পারে যে কে, কীভাবে বণ্টন সমস্যার সমধান করবে, কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা প্রায়শই গোষ্ঠী বা বাজারের প্রশ্নের মুখে পড়ে। এই তিন প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত ক্ষমতার টানাপোড়েনের যে ইতিহাস, ভারতবর্ষের পটভূমিকায়, তাই আমার প্রবন্ধের আলোচ্য। রাষ্ট্র আর গোষ্ঠীর টানাপোড়েনের বহু উদাহরণ সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে পাওয়া যাবে। হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েত বা ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের পাতালগাড়ি আন্দোলন - দুইই রাষ্ট্রের সঙ্গে গোষ্ঠীর টানাপোড়েনের উদাহরণ। পাতালগাড়ি আন্দোলন, যেখানে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীরা সরাসরি ঘোষণা করেন যে তাঁরা ভারত রাষ্ট্র, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার, বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপালকে মানেন না, রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীর এই টানাপোড়েনকে একটা অন্য রাজনৈতিক মাত্রা দেয়। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল, আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাস অনুসারে আপনি খাপ পঞ্চায়েত এর বিরোধী এবং পাতালগাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মী হতে পারেন, অর্থাৎ একটি ক্ষেত্রে আপনি রাষ্ট্রের এবং অন্য ক্ষেত্রে গোষ্ঠীর সমর্থক হতে পারেন। কিন্তু তাত্ত্বিক দিক থেকে এই দুটিই রাষ্ট্রের সঙ্গে গোষ্ঠীর টানাপোড়েনের উদাহরণ। দুটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র আপনাকে যে অধিকার দেয় (পছন্দ মত বিয়ে করার বা রাষ্ট্রের মধ্যে যেকোন জায়গায় যাওয়ার), গোষ্ঠী তাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। বাজারের সঙ্গে রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীর সম্পর্কও একই ভাবে বহুমাত্রিক। কিন্তু রাষ্ট্র মানে কী? গোষ্ঠী বলতেই বা আমরা কী বুঝি? রাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন মানে আসলে কীসের সঙ্গে টানাপোড়েন? রাষ্ট্রকে যতক্ষণ না একটা অবয়ব দেওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ এই টানাপোড়েন নিয়ে কোনো সদর্থক আলোচনা সম্ভব নয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠান, তা রাষ্ট্রই হোক বা গোষ্ঠী, আসলে অনেকগুলি বিধির সমষ্টি। এর সঙ্গে থাকে বেশ কিছু সংগঠন যারা এই বিধিগুলি প্রয়োগ করবে (যেমন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আদালত আর গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সালিশি সভা) । রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই বিধিগুলিকে আমরা আইন (law) বলি আর গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেগুলিকেই নৈতিক বিধি (norm)। ভারতে রাষ্ট্র নতুন নয়, যুগ যুগ ধরে, বিভিন্ন শাসন কালে বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা আমরা দেখেছি। তবু আমি আলোচনা শুরু করছি ব্রিটিশ শাসনে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে। তার কারণ দুটি। প্রথমত, ভারতের আইন ব্যবস্থা ব্রিটিশ কমন ল’র অনুসারী এবং বর্তমান ভারতের বহু আইন আসলে ব্রিটিশ আমলের আইনের ধারাবাহিকতা মাত্র। দ্বিতীয়ত, ভারতের বর্তমান রাষ্ট্র সংগঠন ইউরোপীয় রাষ্ট্র সংগঠনের সঙ্গে তুলনীয়, বিশেষত আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে ব্রিটিশ কাঠামোর মিল অনেক। ১৯৪৭ এর পরে, নেহরু’র নেতৃত্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রিকতা ছিল পুরো মাত্রায়। কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মূলত ছিল অর্থনীতিতে। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কিন্তু তার ধাঁচটা ছিল বিকেন্দ্রীকৃত, ফেডারেল কাঠামোর অনুসারী। মোদীর নব্য-রাষ্ট্রিকতার ধারা ঠিক তার উলটো। সেখানে একদিকে বিলগ্নীকরণ আর বাজারের জোয়ার আর অন্য দিকে নাগরিকের প্রাত্যহিকতায় রাষ্ট্রকে তীব্র ভাবে আরোপের আয়োজন। নেহরু’র আদি-রাষ্ট্রিকতার একদিকে ছিল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নির্ভর, নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি আর অন্যদিকে হিন্দু-মুসলমানের জন্য ভিন্ন দেওয়ানি নীতি এবং ৩৭০ ধারার মত আইন যা একভাবে রাষ্ট্র আর গোষ্ঠীর এই টানাপোড়েনকে ধারণ করে। মোদীর নব্য-রাষ্ট্রিকতা এর ঠিক বিপরীত যেখানে বিলগ্নীকরণের পাশাপাশি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সম্ভাবনা উঁকি দেয়। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল। আমি এরকম কিছু বলতে চাইছি না যে গোষ্ঠী ভাল-রাষ্ট্র খারাপ বা উলটোটা। শাহবানু মামলায় গোষ্ঠীর বিজয় বা নর্মদা প্রকল্পে রাষ্ট্রের বিজয় দুই-ই আমাকে সমান ভাবে ব্যথিত করে। এই সমর্থন বা বিরোধিতা যার যার রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনুসারী। কিন্তু আমি বলতে চাইছি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস, স্বাধীনতার আগে ও পরে গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের টানাপড়েনের ইতিহাস ছিল যা, মোদী জমানায় এসে শুধুই রাষ্ট্র-আরোপের আখ্যানে পরিণত হয়েছে। যেটা ভাবার বিষয় সেটা হল এই নব্য-রাষ্ট্রিকতা সমাজের একটা বড় অংশের মধ্যে থেকে সমর্থনও পাচ্ছে। ● Berman, H. J. (2003). The Impact of the Protestant Reformations on the Western Legal Tradition. Belknap Press of Harvard University Press.প্রস্তাবনা
বিষয়টা বোঝা গেছিল বিমুদ্রাকরণের সময়ই। আমার চারপাশের অনেক মানুষ, বিশেষত যাঁরা শিক্ষকতা, ব্যাংকিং বা সফটওয়ারের এর মতো পরিষেবা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা শুধুমাত্র এই ভাবনাতেই বিমুদ্রাকরণের মত একটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বিষয়কে সমর্থন করেন যে, অন্তত রাষ্ট্র কিছু করছে (অন্যান্য পেশার মানুষও নিশ্চয়ই করেছিলেন, নইলে বিজেপি বিগত লোকসভা নির্বাচনে এই বিপুল সংখ্যাধিক্যই বা পেল কি করে! কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ হয় নি।)! রাষ্ট্রিকতার (statism-এর প্রতিশব্দ হিসেবে এই শব্দটি ব্যবহার করছি) প্রতি এই বিপুল সমর্থনের বিষয়টি আরও বোঝা গেল লকডাউনের বিভিন্ন পর্যায়ে যখন সামাজিক মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নির্দয়তার সমর্থনে অনেক মতামত ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এই রাষ্ট্রিকতার নির্মাণ এবং একটা বড় অংশের মানুষের থেকে তার প্রতি সমর্থন আদায়, বর্তমান বিজেপি সরকারের একটি বড় সাফল্য। ভারতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নতুন কিছু নয়, ১৯৯০ পর্যন্ত ভারতীয় অর্থনীতি মূলত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু সেই রাষ্ট্রিকতার সঙ্গে, বর্তমান নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের রাষ্ট্রিকতার একটি পার্থক্য আছে আর আমার প্রবন্ধের উদ্দেশ্য সেই পার্থক্যটিকেই সামনে নিয়ে আসা। আলোচনার সুবিধের জন্য আমরা নেহরুর নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রিকতাকে আদি-রাষ্ট্রিকতা এবং মোদীর রাষ্ট্রিকতাকে নব্য-রাষ্ট্রিকতা বলে চিহ্নিত করব। আমার মূল বক্তব্য হল বর্তমান পৃথিবীতে রাষ্ট্রিকতার চাহিদা বাড়ছে, দেশে দেশে একনায়কধর্মী দেশনেতাদের উত্থান তারই সাক্ষ্য বহন করে। আমি ভারতে এই চাহিদারই একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপনা করব। কিন্তু আমার মূল আলোচনায় আসার আগে যে তত্ত্ব কাঠামোর ওপর আমার বক্তব্য দাঁড়িয়ে রয়েছে তার একটি সার সংক্ষেপ আলোচনা করব।
একটি তাত্ত্বিক কাঠামো
বণ্টনের সমস্যা সমাধানের জন্য কোথায় বাজার ব্যবহার করা যাবে আর কোথায় যাবে না, সেটি একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীর মূল্যবোধ দিয়ে নির্ধারিত হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় রাষ্ট্র বাজারকে আটকাতে চাইলেও, সে ঠিক পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে - যাকে আমরা দুর্নীতি বলে থাকি। একথা মনে রাখা ভাল যে বাজার ও ঘুষের মধ্যে মূলগত পার্থক্য কিছু নেই। রাষ্ট্রের অনুমোদন থাকলে যা বাজার, না থাকলে তাই দুর্নীতি। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। আমাদের ছোটবেলায় সব সিনেমা হল ছিল সিঙ্গল স্ক্রীন এবং তার টিকিটের দাম ছিল সরকার নির্ধারিত। তার মানে ধরুন খুব হিট সিনেমা এলে (ধরুন, শোলে বা টাইটানিক), চাহিদা-যোগানের মধ্যে যে ফাঁক তৈরি হত, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের কারণে দাম বাড়িয়ে তা পূরণ করা সম্ভব হত না। তাহলে এই ফাঁক পুরণের উপায় হল শারীরিক পরিশ্রম করে সকাল থেকে লাইনে দাঁড়ানো। কিন্তু সবার পক্ষে তো এই সময় বা পরিশ্রম দেওয়া সম্ভব না। ধরুন যিনি কাজে ব্যস্ত থাকেন, বা বয়স্ক মানুষ কেউ। সেখানে রাষ্ট্রের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই গোষ্ঠী বা বাজার এই সমস্যার সমাধান করতে লেগে যেত। যিনি লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনতে পারলেন না তাঁর জন্য থাকতো পাড়ার বেকার ছেলে (অর্থাৎ, গোষ্ঠী) বা টিকিট ব্ল্যাকার(অর্থাৎ, বাজার)। তখন সিনেমার টিকিটে বাজারের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই সেই বাজারকে বলা হত ব্ল্যাক। আজ মাল্টিপ্লেক্সে চাহিদা-যোগানের ফাঁক পূরণ করা হয় একই ভাবে দাম বাড়িয়ে, কিন্তু সেটা আইনসিদ্ধ। অর্থনীতির পদ্ধতিগত ভাবে বা নৈতিকতার দিক থেকে - যেভাবেই দেখুন না কেন, আজ মাল্টিপ্লেক্সের টিকিটের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি তিরিশ বছর আগের টিকিট ব্ল্যাকারদের থেকে আলাদা কিছু না। পার্থক্য শুধু আইনের অনুমোদনের। তাই দুর্নীতি আর বাজায়ের মধ্যে পার্থক্য শুধুই রাষ্ট্রের অনুমোদনের - এদের মধ্যে নৈতিক বা পদ্ধতিগত পার্থক্য নেই। এই অনুমোদন যে শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় তাই নয়, দেশে দেশেও আলাদা হয়। আবার রাষ্ট্রের অনুমোদন অনেক ক্ষেত্রেই গোষ্ঠীর নৈতিকতার সঙ্গে জড়িত থাকে। দেশে দেশে গর্ভপাত সংক্রান্ত আইনের পার্থক্য এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই টানাপোড়েনের ইতিহাস নিয়ে এবার আমরা আলোচনা করব।
ইতিহাসে ভারতীয় রাষ্ট্র
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম প্রত্যক্ষ ক্ষমতা লাভ করে ১৭৬৫তে, বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে। এর পরেই একটি স্থিতিশীল খাজনা ব্যবস্থা প্রচলন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পুরনো নবাবি ব্যবস্থার মধ্যে আঞ্চলিক পার্থক্য অনেক বেশী ছিল এবং খাজনার হিসেবও জটিল শুভঙ্করি পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ধারিত হত যা একমাত্র কিছু স্থানীয় আমিলের করায়ত্ত ছিল। এছাড়া জমির অধিকার সংক্রান্ত সনদ কিছু ক্ষেত্রে জটিল ফারসিতে, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অলিখিত ও স্থানীয় মানুষের স্মৃতি নির্ভর হওয়ায়, ব্রিটিশ অফিসারদের পক্ষে খাজনা নির্ধারণ দুঃসাধ্য ছিল (বিস্তারিত আলোচনার জন্য Guha (1982), পৃঃ ৪-৬ দ্রষ্টব্য)। এরকম একটি পরিস্থিতিতে আসে ১৭৭০ এর মন্বন্তর যাতে প্রাণ হারান বাংলার বহু মানুষ। তৎপরবর্তী সময়ে, একাধিক ব্রিটিশ রাজকর্মী একটি স্থিতিশীল খাজনা ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব রাখেন, যার মধ্যে ফিলিপ ফ্রান্সিস এবং অ্যালেকজান্ডার ডাও ছিলেন অগ্রগণ্য। ফ্রান্সিস এর ১৭৭৬ এর পরিকল্পনা প্রাথমিক ভাবে খারিজ হলেও সেই প্রস্তাবনার মূল ধারাগুলি ১৭৯৩ এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে স্থান পায় যে ব্যবস্থা বাংলার বুকে একটি মধ্যসত্বভোগী জমিদার শ্রেণি তৈরি করে। কিন্তু, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সৃষ্ট জমিদারি ব্যবস্থাই কলোনিয়াল ভারতের একমাত্র ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল তা নয়। এর পাশাপাশি ছিল রায়তওয়ারী এবং মহলওয়ারী ব্যবস্থাও যেখানে ব্রিটিশ সরকার ভূমি রাজস্বের চুক্তি জমিদারের পরিবর্তে কৃষক (রায়ত) বা গোষ্ঠীর (মহল্লা) সঙ্গে করত।
কিন্তু এই প্রবন্ধ কলোনিয়াল ভারতের ভূমি রাজস্বের উপর নয়। তা সত্ত্বেও, কলোনিয়াল ভারতের ভূমি-রাজস্ব নিয়ে এতটা সময় ব্যয় করার কারণ অন্য একটি বিষয় এবং তাকে ঘিরে রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীর মধ্যে টানাপোড়েনের ওপর আলোকপাত করা। সেটি হল জমি বা যেকোনো সম্পদের মালিকানার অধিকার , ইংরিজিতে যাকে institutions of property right বলে। ফিলিপ ফ্রান্সিস যখন তাঁর ১৭৭৬ এর পরিকল্পনা পেশ করেন, তাঁর ধারণা ছিল যে প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে জমির ব্যক্তি মালিকানা ছিল না - মুঘল সম্রাটই ছিলেন সব জমির প্রকৃত মালিক। তিনি ভেবেছিলেন যে তাঁর পরিকল্পিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ভারতীয়দের ব্যক্তি মালিকানার অধিকার দিয়ে তাঁদের আনুগত্য অর্জন করবে। আধুনিক ঐতিহাসিকরা তো বটেই (যেমন, Grover (1963)), ফ্রান্সিসের সমসাময়িক রাজকর্মচারিরাও এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাঁরা অনেকেই ভাবতেন যে ব্রিটিশরা না বুঝলেও সম্পত্তির অধিকারের বিভিন্ন সূত্র প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে রয়েছে এবং প্রথাগতভাবে, সেই সূত্র অনুযায়ী ভারতে সম্পত্তি বিবাদের মীমাংসা হয়।
সুতরাং, সম্পত্তি বিবাদের মীমাংসার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসন প্রায়শই প্রচলিত নিয়ম ব্যবহার করত এবং সেগুলি জানার জন্য স্থানীয় শাস্ত্রজ্ঞদের পরামর্শ নিত। ১৮৬০ এর পরে (ততদিনে ভারত সরাসরি ইংল্যান্ডের মাহারানীর শাসনাধীন) এই ব্যবস্থার কিছুটা পরিবর্তন আসে এবং স্থানীয় শাস্ত্রজ্ঞদের মতামতের পরিবর্তে ধর্মগ্রন্থে লিখিত বিধিকে আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মুসলমানদের ক্ষেত্রে কোরান এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে, স্থানভেদে, মিতাক্ষরা বা দায়ভাগে বর্ণিত বিধিকেই আইনের রূপ দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ব্রিটিশ রাষ্ট্র, ধর্মীয় গোষ্ঠীর লিখিত, প্রথাগত বিধিকে স্বীকৃতি দেয়।
এই ব্যবস্থাতে হিন্দু এবং মুসলিম ব্যক্তি উত্তরাধিকার আইনের একটি মূলগত পার্থক্য প্রকট হয়ে দেখা দেয়। কোরান অনুসারী মুসলিম আইনে যেখানে পরিবারকে দেখা হতে থাকে কিছু ব্যক্তির সমষ্টি হিসেবে, হিন্দু পরিবারের মূল পরিচয় সেখানে তার যৌথতা। মুসলিম আইনে তাই ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার সিদ্ধ হলেও, হিন্দুদের ক্ষেত্রে সম্পত্তি অধিকারের একক হিসেবে উঠে আসে অবিভক্ত হিন্দু পরিবার।বেশীর ভাগ হিন্দুদের জন্য প্রযোজ্য মিতাক্ষরা আইন অনুযায়ী যৌথ পরিবার কে দেখা হয় চার প্রজন্মের, শুধুমাত্র পুরুষদের একটি যৌথ সংগঠন হিসেবে (এক্ষেত্রে আইনি প্রতিশব্দটি coparcenary)। এক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পত্তির কোন নির্দিষ্ট ভাগ কোন বিশেষ সদস্য-এর ওপর বর্তায় না। বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুরুষ সম্পত্তির দেখাশোনার বা সেই সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের অধিকারী কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে এর মালিক নন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই হিন্দু বা মুসলিমরা শ্রেণি নির্বিশেষে এতে খুশি বা অখুশি হয়েছিল। যৌথ সম্পত্তির ব্যবস্থায়, সম্পত্তি পরিবারের বাইরে যাওয়া কঠিন। তাই ভূস্বামী সম্প্রদায় এই ব্যবস্থায় খুশি ছিল কারণ যৌথ ব্যবস্থায় পারিবারিক জমি মহাজনদের হাতে চলে যাওয়া কঠিন। কিন্তু সেই একই কারণে যৌথ ব্যবস্থায় পারিবারিক জমি-সম্পত্তিকে শিল্প-পূঁজিতে রূপান্তর করাও কঠিন। তাই উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণি যৌথ সম্পত্তি ব্যবস্থায় অখুশি ছিল। মুসলিমদের মধ্যে যেহেতু ব্যক্তি মালিকানা চালু ছিল, তাই মুসলিম ভূস্বামীরা তাতে অখুশি হলে মুসলিমদের মধ্যে যারা উঠতি পুঁজিপতি, তারা এই ব্যবস্থায় খুশি ছিল। হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপারটা ছিল উলটো।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমে, উত্তর ভারতীয় প্রভাবশালীরা, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে, ছিল মূলত ভূ-স্বামী কিন্তু দক্ষিণ ভারতের প্রভাবশালীরা ছিল পুঁজিপতি। তাই হিন্দু পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধে মতামত মূলত আসতে থাকে দক্ষিণ ভারত থেকে। ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক মুসলিম সম্পত্তি আইনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো - সেখানে প্রতিরোধ আসে উত্তর ভারত থেকে। এ প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনা এই প্রবন্ধের আওতার বাইরে (বিশদ আলোচনার জন্য দেখতে পারেন Newbigin(2009); Sreenivas, (2004))। কিন্তু এই প্রসঙ্গের অবতারণা হল এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে কলোনিয়াল ভারতে রাষ্ট্রীয় আইন তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীর নিরন্তর টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে এবং এই টানাপোড়েন শুধু পরাধীন ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না - স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র ব্যবস্থাও সেই টানাপোড়েনেরই ফসল। একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীর এই টানাপোড়েন শুধুমাত্র উপনিবেশের চিহ্ন। আধুনিক ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রের আইনের ইতিহাসেও কিন্তু ধর্মগ্রন্থের ছাপ স্পষ্ট। আধুনিক জার্মান আইনের অন্যতম প্রণেতা যোহান ওল্ডেন্ড্রপ (১৪৮৬-১৫৬৭) রচিত সম্পত্তির অধিকার আইনের মূলে ছিল টেন কমান্ডমেন্টসের “Thou shalt Not steal”, ফৌজদারি আইনের মূলে ছিল “Thou shalt not kill,” পারিবারিক আইনের মূলে ছিল “Thou shalt not commit adultery,” আর চুক্তি-আইনের মূলে ছিল “Thou shalt not bear false witness” আর “Thou shalt not covet.” এগুলি যে শুধুমাত্র এই সব আইনের পরিচ্ছেদের নাম ছিল তাই নয়, এই সব সাধারণ নীতির ভিত্তিতেই জার্মান আইন রচিত হয়। একই ভাবে ব্রিটিশ আইনের মধ্যে ক্যালভিনের অনুসারী প্রটেস্টান্ট ধর্মের ছাপ স্পষ্ট, ফরাসি আইনে বৃহত্তর খৃষ্টীয় প্রথানুগ ডেইজিমের (p. 7-10, Berman, 2003)।
স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রিকতার সেকাল ও একাল
কে কেন এই রাষ্ট্রিকতা সমর্থন করছেন, তার কোনো বিশদ তথ্যপঞ্জি কারও কাছেই নেই। আমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, যা মূলত পরিষেবা ক্ষেত্রে যুক্ত বাঙালি, উচ্চবর্ণ, হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তার ভিত্তিতে দুএকটা কথা বলতে পারি। আমি দেখেছি উপরোক্ত শ্রেণির অনেকেই মনে করেন যে নব্য-রাষ্ট্রিকতা ভাল কারণ তা নৈর্ব্যক্তিক যুক্তিকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে - যা ব্যক্তির গোষ্ঠী পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। যাঁরা এটা বলেন তাঁদের মাথায় পশ্চিমি রাষ্ট্রের ধারণা থাকে। কিন্তু পশ্চিমি রাষ্ট্রের মূল্যবোধ সর্বজনীন কিছু নয়। এটা খানিকটা আমি পশ্চিমের আইন রচনার ইতিহাস থেকে উল্লেখ করে দেখানোর চেষ্টা করেছি। যদি বর্তমানের দিকেও তাকাই, পশ্চিমের রাষ্ট্র গঠন যদি সত্যি এত নৈর্ব্যক্তিক যুক্তিকাঠামোর ওপর তৈরি হত তাহলে আমারিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বারাক ওবামা’র বাবা’র ধর্ম পরিচয় নিয়ে এতো আলোচনা হত না বা সবিতা হালাপ্পানাভারকে গর্ভপাত করাতে না পেরে মরতে হত না বা সম-লিঙ্গের বিবাহের স্বীকৃতি নিয়ে এত সমস্যা হত না।
আসলে প্রত্যেক রাষ্ট্রের নীতির মধ্যে গোষ্ঠীগত মূল্যবোধের ছায়া থাকে। কোনো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই ছায়া দীর্ঘ, কোথাও হ্রস্ব। ভারতের নব্য-রাষ্ট্রিকতায় হিন্দুত্বের ছায়া ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। পরিষেবা ক্ষেত্রের, উচ্চ আয়সম্পন্ন মানুষের মধ্যে নব্য-রাষ্ট্রিকতাকে সমর্থনের যে প্রবণতা তার কারণ সম্ভবত এই যে বিশ্বায়নের ধাক্কায় এই সব মানুষের গোষ্ঠী পরিচয় মুছে গেছে। তাঁরা সবাই গেটেড-কমিউনিটির বাসিন্দা, সবাই মাঝে মধ্যেই ইউরোপ-আমেরিকা যান এবং উন্নত পৃথিবীকে তাঁদের মননে ধারণ করেন। যেহেতু গোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন, তাই তাঁদের জীবন এখন অনেক বেশী বাজার নির্ভর। কিন্তু এত সিকিউরিটি ক্যামেরা, বডি গার্ড ইত্যাদি বাজার নির্ভর নিরাপত্তা সত্ত্বেও, নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক তাঁর অধরাই থেকে যায় যা তিনি গোষ্ঠী থেকে পেতেন। আমার বিশ্বাস এই অভাব একধরণের টেনশন তৈরি করে যা থেকে রাষ্ট্র নির্ভরতা, যা থেকে নব্য-রাষ্ট্রিকতার সমর্থন। নব্য-রাষ্ট্রিকতা যেভাবে গোষ্ঠীর বিরোধী স্বরকে চুপ করিয়ে করে দেয়, তা হয়ত গোষ্ঠীপরিচয়হীন মানুষদের একধরনের আশ্বাস দেয়, হয়ত বা ধীরে ধীরে রাষ্ট্র পরিচয়ই গোষ্ঠী পরিচয়ের জায়গা করে নেয়। কিন্তু নব্য-রাষ্ট্রিকতায় আশ্রয় খোঁজার এই প্রয়াস যা সমস্ত গোষ্ঠী স্বরের বিরোধিতাকে মুছে দেয়, তা কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য খুব বিপজ্জনক। আরও আশঙ্কার কথা এই যে এই বিপজ্জনক প্রবণতাটি এখন পৃথিবীর বহু দেশেই উঠে আসছে। এই ধারা কতদিন স্থায়ী হবে তার উত্তর হয়ত একমাত্র সময়ই দিতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ
● Grover, B. R. (1963). The Indian Economic and Social History Review: Nature of Land-Rights in Mughal India. The Indian Economic & Social History Review, 1(1), 1-23. https://doi.org/10.1177/001946466400100101
● Guha, R. (1982). A rule of property for Bengal: An essay on the idea of permanent settlement. Orient Blackswan.
● Newbigin, E. (2009). The codification of personal law and secular citizenship. The Indian Economic & Social History Review, 46(1), 83-104. https://doi.org/10.1177/001946460804600105
● Sreenivas, M. (2004). Conjugality and Capital: Gender, Families, and Property under Colonial Law in India. Journal of Asian Studies, 63(4), 937-960. https://doi.org/10.1017/S0021911804002372