আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি ২০২০ - দিশাহীন বেসরকারিকরণ

দেবর্ষি চক্রবর্তী ও সৌভিক রায়


কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট তাদের জাতীয় শিক্ষানীতিকে অনুমোদন দেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন মহলে এই নীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০, ভারতবর্ষের বিদ্যালয় শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনার কথা বলছে। যে পরিবর্তনগুলি শিক্ষাক্ষেত্রে অনুসারিত হলে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য, কাঠামো এবং সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্কে মূলগত পরিবর্তন দেখা দেবে। নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে, কেন্দ্রীয় সরকার উচ্চশিক্ষায় একতরফাভাবে বেশ কিছু পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা করছে, যে পরিবর্তনগুলির মধ্য দিয়ে আরও বেশি করে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিক্ষায় বাড়ানোর পথ সুগম করা হচ্ছে। বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, এই নতুন শিক্ষানীতিতেও এই প্রচেষ্টার ছাপ সুস্পষ্ট। শিক্ষা সংবিধানের সংযুক্ত তালিকাভুক্ত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও কোনো রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে, সংসদে কোনো বিতর্কের সুযোগ না দিয়ে মন্ত্রীসভা নতুন নীতি অনুমোদন করল। ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি যে এই সরকারের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই, তার প্রমাণ আমরা এর আগেও পেয়েছি, শিক্ষানীতির ক্ষেত্রেও পেলাম। ইতিমধ্যে তামিলনাডু এবং পশ্চিমবাংলার সরকার জানিয়ে দিয়েছে তারা এই শিক্ষানীতি প্রয়োগ করবে না।

এই শিক্ষানীতির সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল, এর মধ্যে যে যে নতুন দিশার কথা বলা হয়েছে, তা ভালো হোক বা খারাপ, তার প্রয়োগ কীভাবে হবে তার কোনো কথাই প্রায় নেই। আমরা বারবার করে লক্ষ্য করেছি গোলপোস্ট পিছিয়ে দেওয়া এই সরকারের একরকমের অভ্যেস। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে তারা বারবার করে ২০২২ সালের কথা বলত - যেন বা ২০২২ সালে দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এখন আর ২০২২ সালের কথা শোনা যায় না। তেমনি শিক্ষানীতিতে ২০৩৫-৪০ সালের কথা এসেছে, যার মধ্যে এই সরকার পরিবর্তনগুলি আনতে চান। অর্থাৎ, যে শিশুর বয়স আজকে পাঁচ বছর, যে সবে স্কুলশিক্ষায় প্রবেশ করতে চলেছে, তার স্নাতকোত্তর পড়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই পরিবর্তনগুলিকে আনতে এই সরকার সক্ষম হবে বলে তারা নিজেরাই মনে করছে। কেন এই বিলম্ব? তার প্রধানতম কারণ এই সরকার শিক্ষার পিছনে অর্থব্যয় করতে নারাজ। শিক্ষানীতিতে জিডিপি’র ছয় শতাংশ খরচ করার কথা বলা হচ্ছে, যে কথা সেই ষাটের দশকের খোসলা কমিশনের সময় থেকেই বলে আসা হচ্ছিল, বামপন্থী বহু ছাত্র এবং শিক্ষক সংগঠন দশকের পর দশক এই দাবি তুলেছে, কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত সরকার আইনসভায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ততক্ষণ যতই শিক্ষানীতিতে এই কথা থাক তার কোনো মূল্য আদতে নেই। এই শিক্ষানীতি যেখানে প্রয়োজনীয়, যেমন উচ্চশিক্ষায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশের প্রশ্নে কিন্তু জানিয়েছে যে আইন করেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি খরচ বাড়ানো নিয়ে গালভরা কিছু কথা আছে অথচ আইন বানানোর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অন্যদিকে তারা কিন্তু একই সঙ্গে ‘বেসরকারি বদান্যতা’র কথা বলছে এই শিক্ষানীতিতে এবং বেসরকারি ‘অনুদান’কে উৎসাহিত করছে। আমরা এই বেসরকারি অনুদান বা বদান্যতার চরিত্র জানি - ব্যাঙ-এর ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চড়া ফি থেকে শুরু করে সেখানকার তথৈবচ শিক্ষার মান, দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে।

এই শিক্ষানীতির আসল সুরটা এই বেসরকারিকরণ, বেসরকারি অনুদান, বদান্যতা, লগ্নী এইসবের মধ্যেই বাঁধা। যেমন ধরা যাক, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রস্তাব। অত্যন্ত সাধু প্রস্তাব, সর্বান্তকরণে সমর্থনযোগ্য। কিন্তু আদতে কী হতে চলেছে? পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কেবল মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হল, পরবর্তী বা উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি নির্ভরতা হ্রাস করা, নচেৎ এই নীতি গ্রহণ মূল্যহীন, এবং বিভাজন প্রকটকারী। যদি না উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির গুরত্ব কমে, যদি না ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষায় স্নাতক থেকে গবেষণার স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারেন, তাহলে এদের একটা বড় অংশ বেসরকারি স্কুলমুখী হবে। শুধু তাই নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির উপর এই চাপ তৈরি হবে যে, একবেলা খেয়েও যাতে সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পাঠানো যায়। সরকার একদিকে ডাক্তারি, ইনজিনিয়ারিং-এর পরীক্ষাগুলিকে রাজ্যস্তর থেকে তুলে দেবে এবং কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলি হবে ইংরেজি আর হিন্দিতে, আর অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীদের বলবে ইংরেজি শিখতে হবে না, দুটোই একসঙ্গে হতে পারে না।

অর্থাৎ, এই ধরণের নীতি নিতে গেলে, প্রথমে এর কার্যকারণ সম্পর্কগুলিকে অনুধাবন করতে হয় এবং সেই মোতাবেক কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হয়, নইলে তার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। ঠিক যেমন, স্কুলশিক্ষার আরও একটি বড় সংস্কারকে নিয়ে উঠছে। স্কুলশিক্ষাকে (১০+২) ভেঙে একটি ৫+৩+৩+৪ ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য বোঝা দায়। প্রথম ৫ বছর কেজি, ক্লাস ওয়ান ও টু মিলিয়ে, তারপর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি নিয়ে একটা গ্রুপ, তারপর তিনটে ক্লাস, শেষে নবম, দশম, এগারো, বারো একসঙ্গে। কেন এই সংস্কার করা হচ্ছে এবং কীভাবে এই সংস্কার লাগু হবে তার কোনো স্বচ্ছ ধারণা শিক্ষানীতিতে নেই। বরং শিক্ষানীতিতে বারবার করে স্কুলছুটের সংখ্যা নিয়ে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে ইস্কুলে প্রায় সব শিশু নাম লেখালেও সপ্তম শ্রেণি বা তারপরে বিদ্যালয়ছুটের সংখ্যা প্রচুর। এই বিদ্যালয়ছুট হয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে কী করে আটকানো যায় তার কোনো দিশা না দিয়ে, সরকার বরং বিদ্যালয়ছুট হওয়াটাকেই যেন প্রাতিষ্ঠানিকতা দিলেন। আমাদের এরই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে মিড-ডে মিলের মতো প্রকল্পের কথা, যে প্রকল্পের কারণে বহু শিশুর ইস্কুলে আসা নিয়মিতকরণ হয়েছে, বিদ্যালয়ছুট হওয়ার প্রবণতা কমেছে, তাতে গত সরকারি বাজেটে সামান্য টাকা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষানীতিতে ফলাও করে লেখা হয়েছে, শুধু মিড-ডে মিল নয় তার সঙ্গে প্রাতরাশ দেওয়ার কথা, পুষ্টিকর খাওয়ার দেওয়ার কথা। এখনকার বাজেটে সপ্তাহে একদিন করে শিশুদের ডিম জোটে, কাজেই এই সব কথা শিক্ষানীতিতে শুনতে ভালো, এর আদতে সাধারণ মানুষের কাছে কোনো মূল্যই নেই।

স্কুলশিক্ষায় আরেকটি অদ্ভুত নীতি হল, অযথা ভাষাশিক্ষার উপরে জোর। এই শিক্ষানীতিতে তিনভাষা নীতির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই তিনভাষা নীতিতে সংস্কৃতকে নিয়ে সরকার আবেগমথিত হয়ে অনেক কিছু লিখে ফেলেছে। গ্রীক, ল্যাটিন ভাষার সঙ্গে তুলনা টেনে (সঙ্গতভাবেই), সংস্কৃত শেখার গুরুত্বের কথা তারা বলেছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সংস্কৃত একটি মৃত ভাষা, এই ভাষা শিখে অবশ্যই কালিদাসের লেখা পড়া যাবে, কিন্তু এর ব্যবহারিক প্রয়োগ উচ্চশিক্ষার দু-তিনটি বিষয় বাদ দিয়ে জীবনের কোথাও নেই বললেই চলে। বরং এর বদলে কোনো একটি আধুনিক ভাষা (ভারতীয় অথবা বিদেশি), যেটি ভবিষ্যতে যোগাযোগকারি ভাষা হিসেবে কাজে দেবে, সেটি শেখার দিকেই জোর রাখা উচিত।

আসলে এই সংস্কৃতশিক্ষার জোরের পিছনে লুকিয়ে আছে প্রাচীন ভারতের প্রতি এক অবৈজ্ঞানিক অন্ধ আস্থা। যার প্রতিফলন শিক্ষানীতিতে বারবার করে পড়েছে। কোথাও, ভারতকে আবার ‘বিশ্বগুরু’র (কে এই উপাধি কবে ভারতকে দিয়েছিল জানা নেই) স্থান দখল করতে হবে তার কথা বলা আছে, আবার কোথাও আইভি লিগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে নালন্দা এবং তক্ষশীলার সম্মেলন ঘটিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কথা বলা হয়েছে। কখনো বলা হয়েছে, চৌষট্টি কলায় পারদর্শী হয়ে ওঠার কথা, অথবা সত্য, শান্তি, অহিংসা, ধর্ম, প্রেমের শিক্ষাদানের কথা। সবথেকে আশ্চর্য বিষয় হল, এই কথাগুলি বলা হয়েছে উচ্চশিক্ষায়, যেখানে চৌষট্টি কলা দূরে থাক, ছাত্রছাত্রীরা একটি কলারই ভগ্নাংশ শিখে ওঠেন। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হাজার হাজার কলা শেখা নয়, একটি কলাতে পারদর্শী হয়ে ওঠা - এই কথাটিই শিক্ষানীতি বুঝে উঠতে পারেনি। এই কথা বলার উদ্দেশ্য ভারতের শিক্ষার প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ নয়। বরং আমরা প্রাচীন ভারতের আর্যভট্টের গণিতচর্চা থেকে বৌদ্ধদর্শন শিক্ষার পক্ষে। এই কারণে নয় যে এগুলি ভারতীয়, বরং এই কারণে যে এগুলি প্রাসঙ্গিক। কিন্তু, আমরা কি দেখলাম, নীতিশিক্ষা ও দেশীয় সংস্কৃতি শেখানোর জন্য পঞ্চতন্ত্র, জাতক, হিতোপদেশ ইত্যাদি রূপকথা পড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কতটা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা দেয় এসব রূপকথা? এই প্রসঙ্গে আরো মনে রাখা প্রয়োজন, খসড়া নীতিতে অনেক মনীষীদের জীবন পড়ানোর কথা বলা হয়েছে, ভারতরত্ন প্রাপকদের নামও সেই তালিকায় আছে। কিন্তু সমাজ সংস্কারকদের কথা, বিশেষতঃ যাঁরা কুসংস্কার, অন্ধত্ব, জাতপাতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের কথা সেখানে নেই। প্রাচীন ভারতের প্রতি অন্ধ মোহত্বের কারণে এই সরকার তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আজকের শিক্ষাব্যবস্থার একটি মূলগত পার্থক্যকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ, বা তারা অনুধাবন করতেই চান না। প্রাচীন ভারতের শিক্ষা যতই অগ্রসর হোক না কেন, সেই শিক্ষা ছিল বদ্ধ, কুক্ষিগত। সমাজের সামান্য অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, জাতি-বর্ণ প্রথার দ্বারা জর্জরিত। আজকের শিক্ষার মূল নীতিই হচ্ছে সার্বজনীনতা - “জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী, বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি।“ কিন্তু উচ্চশিক্ষার যে নীতি এই সরকার গ্রহণ করছে, তাতে এই সার্বজনীনতাকে খর্ব করার প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

উচ্চশিক্ষার উন্নতি অর্থে আমরা উচ্চশিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্রের উন্নতির কথাকে বুঝি। কিন্তু এই সরকার প্রস্তাব দিচ্ছে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে তিনটি আলাদা কুঠুরিতে ভেঙে ফেলার। একদিকে থাকবে গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়, তার পাশে থাকবে শিক্ষাদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়, আর থাকবে সাধারণ উচ্চশিক্ষার কলেজ। সরকার বাহাদুর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে আরও বেশি স্বশাসন দিতে চায়। কিন্তু আমরা ২০১৮ সালের ইউজিসি’র প্রস্তাব ভুলে যাইনি। তখন থেকেই সরকার হায়ার এডুকেশান কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (হেচি) তৈরির মাধ্যমে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে স্বশাসন দিতে চাইছিল। এবং এই স্বশাসনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যায়গা ছিল আর্থিক স্বশাসন দেওয়া, যা বকলমে সরকারি বিস্ববিদ্যালয়গুলিতে আরও বেশি করে নতুন ‘সেলফ ফাইনান্সড’ কোর্স খোলাকে উৎসাহ প্রদান করা। আমরা জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য শুরু হওয়া কারিগরি বিভাগের সঙ্গে ওখানাকার পুরোনো বিজ্ঞান এবং কলা বিভাগের ফি’র তুলনা করলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারব যে এই নীতি কতটা মারাত্মক হতে চলেছে।

এর পাশাপাশি সরকার মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছে, যা হবে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি। আমাদের ভারতবর্ষের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই মাল্টি ডিসিপ্লিনারি। তার জন্য আইআইটি বা আইআইএমগুলিকে নতুন করে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি করার প্রয়োজন পড়ে না। বরং আইআইটি, আইআইএম এর স্থাপনার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। এগুলি বিশেষ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, ঠিক যেমন মেডিকেল কলেজগুলি। এগুলিকে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি বানাতে গেলে এদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য খর্ব হয়। তার চেয়েও বড় কথা সরকার নিজেরা নতুন মডেল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার দায় না নিয়ে, দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাইছে। সরকার বারবার করে আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তুলছে, সেই ধাঁচাতে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চাইছে। আমেরিকান শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল পার্থক্যের জায়গা কিন্তু শিক্ষার খরচের বহরে। আইভি লিগের বিশ্ববিদ্যালয়ে গত শিক্ষাবর্ষে গড় টিউশন এবং আনুসাঙ্গিক ফি’ ছিল ৫৬০০০ ডলারের কাছাকাছি। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থার আজকে সবচেয়ে বড় বোঝা হল শিক্ষাঋণ - যা একজন আমেরিকান ছাত্রকে শিক্ষা সমাপনের পরেও অন্তত দশ থেকে কুড়ি বছর বয়ে নিয়ে যেতে হয়। আমাদের সরকার যার যেটা সবচেয়ে খারাপ, সেটাই শেখে সবসময়ে। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা নেই। বিপ্রতীপে, যদি আমরা জার্মানীর শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকাই, সেখানে উচ্চশিক্ষায় টিউশন ফি’ নেই এবং সরকারি অনুদান গবেষণা বা অন্যান্য শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট বেশি। কিন্তু মোদি সরকার ট্রাম্পের দেশ থেকেই শিখতে চান, যেখানে শিক্ষা ইতিমধ্যে একটি পণ্য।

সরকার এই শিক্ষানীতিতে একইসঙ্গে বলছে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাস যাতে এই দেশে খোলা যায় তার পথ সুগম করতে তারা আইন আনবে। শিক্ষা কোনো পণ্য নয় আর বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কারখানা নয় যে এক দেশের থেকে অন্য দেশে এসে তারা ক্যাম্পাস স্থাপনা করবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কেন পুণাতে এসে ক্যাম্পাস খুলতে চাইবে, তাতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের, সেই দেশের সরকারের কী লাভ? ব্রিটিশ সরকার নিশ্চয়ই পুণাতে অক্সফোর্ড চালাতে পয়সা দেবে না? তাহলে পয়সা কে দেবে? হয় ভারত সরকার দেবে নয়তো যে পড়বে তাকে পয়সা দিয়ে শিক্ষা কিনতে হবে সেখানে। ভারত সরকারই যদি পয়সা দেবে তাহলে সে অক্সফোর্ডকে কেন দিতে যাবে, তারা তাহলে পুণা বিশ্ববিদ্যালয়কেই দেবে! অর্থাৎ এই নীতির এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হল বিদেশি পুঁজিকে শিক্ষায় বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেওয়া। এখন যেমন আম্বানী জিও বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারে, তেমনি হয়তো বিল গেটস একদিন এখানে মাইক্রোসফট বিশ্ববিদ্যালয় খুলবেন - তারই পথ প্রশস্থ করা হচ্ছে।

এই শিক্ষানীতির তার ফলে না আছে কোনো দিশা, না আছে কোনো সৎ উদ্দেশ্য। কেবল কীভাবে আরও বেশি করে শিক্ষার বাণিজ্যকরণ করা যায়, কীভাবে আরও বেশি করে শিক্ষাকে কেন্দ্রীভূত একটি বিষয়ে পরিণত করা যায়, কীভাবে আরও আরও প্রাচীনের দিকে শিক্ষাকে ঠেলা যায় তার সব মালমশলাই উপস্থিত এই শিক্ষানীতিতে। যে সরকার যখন দেশের লাখ লাখ মানুষ মহামারীতে আক্রান্ত তখন মন্দিরের শিলান্যাসে ব্যস্ত থাকে, তাদের কাছে অন্য কিছু আশা করা বৃথা।