আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

প্রসঙ্গ উলুবেড়িয়া


সম্প্রতি উলুবেড়িয়াতে তৃণমূল ও সিপিআই(এম)-এর সংঘর্ষের ঘটনা কয়েকটা সত্যিকে চোখের সামনে তুলে দিল। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে একটা ক্ষুদ্র শহরের সামান্য ঘটনা নিয়ে কেন লেখা হচ্ছে। কিন্তু এই ঘটনাটা আসলে প্রতীক, এটুকুই বোঝায় যে একটা নির্বাচিত রাজ্য সরকারের পেছনে জনসমর্থন কতটা কমে গেছে।

উলুবেড়িয়া থানার অন্তর্গত ধূলাশিমলা পশ্চিমপাড়া অঞ্চলে মিছিল করছিল সিপিআইএম, আমফানের ত্রাণের টাকা নিয়ে তৃণমূলের নয়ছয় করবার প্রতিবাদে মিছিল। সেই মিছিলে এক বামকর্মীকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়ে তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা। একজন গুরুতর আহত হন। এরপরেই পালটা রুখে দাঁড়ান বামকর্মীরা। বোমাবাজি চলে। এলাকাছাড়া হন পঞ্চায়েতের কয়েকজন নেতা। একজনের বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বিরাট পুলিশবাহিনী ও RAF। সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ করা হয় তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তৃণমূল যথারীতি তা অস্বীকার করে পালটা অভিযোগ তোলে যে এলাকা দখল করবার লক্ষ্যে সিপিআই(এম) বোমাবাজি করছে। এটুকুই ঘটনা। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যেটা, তা হল একটা নির্বাচিত পঞ্চায়েতের এতজন নেতা এলাকাছাড়া হলেন, অথচ কোনো মানুষ তাঁদের সমর্থনে এগিয়ে এলেন না। তাও আবার বামপন্থীদের হাতে মার খেয়ে, যারা নাকি গত ভোটেই হতমান, শক্তিহীন। এর থেকে দুটো ব্যাপার উঠে আসছে।

প্রথম যেটা, তা হল মূলত পঞ্চায়েত স্তরে তৃণমূলের কোনও জনভিত্তি অবশিষ্ট নেই আর। বিগত পঞ্চায়েত ভোটে যেভাবে লাগামহীন মারদাঙ্গা খুন করে ভোট করানো হয়েছিল, এমনকি বহু তৃণমূল সমর্থকই যেখানে ভোট দিতে পারেননি, সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নৈতিক ভিত্তি বা জনসমর্থন জাতীয় বস্তুগুলি পঞ্চায়েতব্যবস্থা থেকে অতীত হয়ে গেছে। সেই কারণেই জনপ্রতিনিধিদের এরকম সহজেই এলাকাছাড়া করা যায়, তাও আবার দোর্ডণ্ডপ্রতাপ তৃণমূলের রাজত্বেই। নাহলে দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষ এমন কিছু বড় ঘটনা হত না। কিন্তু জনসমর্থন পাশে থাকলে নেতৃত্ব যে এলাকাছাড়া হতে পারে না, বিশেষ করে যেখানে তারই দল সরকারে আছে, এটা একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝবে। আর উলুবেড়িয়ার ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেখানেই তৃণমূলের গুণ্ডামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হবে, দেখা যাবে যে তাদের সমর্থনের ভিত আসলে কতটা ফাঁপা।

দ্বিতীয় যে পয়েন্ট, সেটা আরও বেশি গুরূত্বপূর্ণ। তা হল, মানুষ কেন সমর্থন দিলেন না ! উত্তরটা খুবই সহজ - ব্যাপক দূর্নীতি এবং অর্থের নয়ছয় করবার যে প্রক্রিয়াটা তৃণমূল এতদিন ধরে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ফেলেছে, এই আমফানের ক্ষতিপূরণের জায়গায় এসে সেটা শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে। যেখানে অশান্তির সূত্রপাত, সেই উলুবেড়িয়াতেই অভিযোগ ছিল যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় স্ত্রী এবং ছেলের নাম ঢুকিয়ে তাঁদের ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দিয়েছেন তৃণমূল পরিচালিত উলুবেড়িয়া ২ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ। সেই টাকায় তিনি একটি দোতলা বাড়ি তৈরি করেছেন। ব্লকে অনেক গরিব মানুষের ঘরের ক্ষতি হয়েছে আমফানে। তাঁরা টাকা তো দূরের কথা, একটি ত্রিপলের জন্য পর্যন্ত হাহাকার করেছেন। এই ছবি রাজ্যের সর্বত্র। একটা দল যেখানে এরকম আপাদমস্তক দূর্নীতি, তোলাবাজি এবং গুণ্ডামির মধ্যে ডুবে থেকে অন্যায়ের রাজত্ব চালিয়ে যায়, মানুষ কেন তার পাশে থাকবে? উলুবেড়িয়া, আবারো, বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সুযোগ পেলে দিকে দিকে তৃণমূল নেতৃত্ব ঠিক এভাবেই এলাকাছাড়া হতে বাধ্য হবেন। সেটাও খুব ভাল প্রক্রিয়া, এমন দাবী করা হচ্ছে না। গণতন্ত্রে কাউকে এরকম এলাকাছাড়া হতে হবেই বা কেন ! কিন্তু শুরুটা যারা করেছিল, শেষটাও তারাই এভাবে নিজেদের জীবন দিয়ে দেখে যেতে বাধ্য হচ্ছে, এটাই পরিহাস।

তৃণমূল নেতৃত্বের মার খাবার ঘটনায় আবার একশ্রেণীর তথাকথিত বামপন্থীরা খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েন যে এর ফলে বিজেপির সুবিধে হয়ে যাচ্ছে। তাদের আসল এজেন্ডা কী, সেই প্রশ্নে না গিয়েও বিনীতভাবে বলা যায় যে বিজেপির নতুন করে সুবিধে হবার কিছু নেই। যা সুবিধে হবার ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে এবং সেটা করে দিয়েছে তৃণমূলই। আর দ্বিতীয়ত, কোথায় অযোধ্যাতে ভূমিপুজো হচ্ছে আর কবে ফ্যাসিবাদ আসবে, সেই ভাবনায় গ্রামাঞ্চলের দিন আনা দিন খাওয়া গরীব মানুষ, যাঁরা আমফানের পর গৃহহীন হয়ে একটা ত্রিপল অব্দি পাননি, তঁদের চলেনা। তাঁদের যদি এখন বলা হয় যে এই বঞ্চনার প্রতিবাদ করো না, করলেই বিজেপি চলে আসবে তাহলে তার থেকে বড় অসংবেদী কাজ আর হতে পারে না। ফ্যাসিবাদ নিয়ে আমরা শহুরে তাত্বিকরা ভাবিত হতে পারি, কিন্তু প্রতিদিনের মার যে মানুষটা খাচ্ছেন, তাঁর কাছে যে মারছে সেই ঘাতকই সেই মুহূর্তে প্রধান শত্রু হতে বাধ্য। সেই ঘাতকের বিরুদ্ধে লড়াইতে বামেরা নেতৃত্ব দিতে না পারলে বিজেপি সুকৌশলে সেই নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেবে, দুঃখের হলেও সত্যি। কিন্তু বিজেপির জুজু দেখিয়ে তৃণমূলের সমস্ত অন্যায় মেনে নিতে হবে এই ধুয়ো যারা তুলছেন তারাও এক হিসেবে এই অন্যায়কেই তাত্ত্বিক বৈধতা দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের বিরোধিতা না করা মানেই আরও বেশি করে বিজেপির সুবিধে করে দেওয়া, সেটা বুঝতে চাইছেন না। কারণ যখনই অন্যায়ের বিরোধিতা হবে না, মানুষ মরিয়া হয়ে হাতের কাছে যে বিকল্প পাবে, সে যতই দুর্গন্ধময় বিকল্প হোক না কেন, সেটাকেই বেছে নেবে। এটাই দ্বান্দিকতা, যে তৃণমূলের বিরোধিতা না করা হলে সেটাতেই বরং বিজেপির সুবিধে বেশি। যারা তত্ত্বের কচকচানি শুনতে বেশি পছন্দ করেন, তাঁরাও জেনে রাখুন স্বৈরাচার, দুর্নীতি, চৌর্যবৃত্তি যাদের পাথেয়, শুধুমাত্র সেকুলার সেজে তারা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদকে রুখতে পারবে না।

একবারও এই দাবি করা হচ্ছে না যে পঞ্চায়েত নেতাকে এলাকাছাড়া করিয়ে খুব ঠিক কাজ করা হয়েছে। হিংসার রাজনীতি, সে যে দিক থেকেই আসুক না কেন, সেটা ভুল। কিন্তু যারা এই রাজনীতি শুরু করেছিল, যারা একটার পর একটা অন্যায়কে দিনের পর দিন প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে, সেই অন্যায়গুলোকে আগে বিরোধিতা না করলে বর্তমানের এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে নিন্দা করা সম্ভব নয়। আসলে, মানুষ তৃণমূলের উপর তিতিবিরক্ত হয়ে পড়ছে। যেখানে যেমনভাবে পারছে মানুষ সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। সেই সংঘবদ্ধতা যদি বামপন্থী ও প্রগতিশীল শক্তির হাত ধরে হয়, তবেই ভালো। বাম গণতান্ত্রিক শক্তির অবশ্য আত্মতুষ্টির কোনো কারণ নেই। পথ বন্ধুর ও কঠিন। সেই পথে অগ্রসর হতে হলে তৃণমূলের স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি এবং বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।