আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

করোনা ও কয়েকটি মৃত্যু


এ কথা এখন মেনে নেওয়াই ভাল যে করোনা মোকাবিলায় ভারত সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এই সম্পাদকীয় লেখার সময়কালে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, মোট মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৬ হাজার। গত পাঁচ দিন ধরে দৈনিক সংক্রমণের নিরিখে ভারত এখন এক নম্বরে, আমেরিকা কিংবা ব্রাজিলকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এই হারে চলতে থাকলে আর হয়ত পনেরো দিনের মধ্যেই ব্রাজিলকে টপকে দুই নম্বরে উঠে আসবে। সামনে থাকবে শুধুই আমেরিকা। রোজকার মৃতের সংখ্যা হাজার ছুঁই ছুঁই। কোনো লক্ষণই নেই রাশ টানার। আমরা জানি আমাদের দেশে সরকারী সংখ্যা বরাবরই এমন হয় যাতে তৎকালীন সরকারকে একটু হলেও কম অপদার্থ বলে মনে হয়। তাই নিশ্চিত যে প্রকৃত সংখ্যাটা কিছুটা হলেও বেশি। মোট মৃত্যুর ৫৫ শতাংশই হয়েছে গত এক মাসে। এই ট্রেন্ড ধরে রাখলে আরো এক মাস পর মৃতের সংখ্যা পৌঁছবে ৮০-৯০ হাজারে, এবং তারও এক মাস পর অন্তত ১ লক্ষ ৬০ হাজারে।

বস্তুত ভারত, আমেরিকা ও ব্রাজিল, এই তিনটি দেশেরই দক্ষিণপন্থী সরকার যেন একে ওপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যর্থতায় কে কতটা পাল্লা দিতে পারে। এই ব্যর্থতা সামগ্রিকভাবেই মুক্ত বাজারী পুঁজিবাদের মুখ থুবড়ে পড়া কী না, সেই প্রশ্ন উঠবেই। এ কথা ভুললে চলবে না যে নিউজিল্যান্ড, কানাডা বা স্ক্যান্দিনেভিয়ান দেশগুলির মত কিছুটা কল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে আছে, যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যের কিছুটা দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয়, চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি কেন্দ্রীভূত শক্তিশালী কাঠামো আছে, সেখানে কিছুটা হলেও করোনা বিপর্যয় সামাল দেওয়া গিয়েছে। অথবা ভারতবর্ষের কেরালা, যেখানে যথাযথ পরিকল্পনা এবং প্রথমদিন থেকেই রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা ও শ্রম দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে অরিমারির মোকাবিলা করা সম্ভব। সমাজতান্ত্রিক কিউবা অথবা ভিয়েতনামের সাফল্য তো বহুচর্চিত। অপরদিকে ভারত, ব্রাজিল বা আমেরিকা বাদ দিলেও যেসব দেশে করোনা বাড়ছে অধিকাংশই দক্ষিণপন্থী বাজার অর্থনীতিবাদী সরকার দ্বারা পরিচালিত। যেমন ব্রিটেন, বলিভিয়া অথবা রাশিয়া। কাজেই অতিমারীর সঙ্গে জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনার কতটা যোগ আছে, কোথায় গিয়ে মুক্ত বাজার আটকে যাচ্ছে কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিছুটা হলেও সাফল্য পাচ্ছে, এই দিকগুলো খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। সময় এসেছে পুঁজিবাদের আত্মবিশ্লেষণেরও। সেসব কতটা হবে জানা নেই। অন্তত ভারতবর্ষে যে দল রামমন্দির নির্মাণ করবার আনন্দে বিহ্বল তাদের কাছ থেকে সভ্যতা বা মানবিকতা সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর যে ঠিকভুল কোনো উত্তরই মিলবে এমন আশা করাও বাতুলতা মাত্র।

পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাটা একইরকম বেহাল, বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন কাগজ খুললে সরকারি হাসপাতালগুলোর করুণ অবস্থা, রোগীর চাপ এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আকাশছোঁয়া বিল, এই দুইয়ে মিলে আক্রান্ত মানুষ কেমন আছেন সহজেই বোঝা যায়। প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার করে আক্রান্ত হচ্ছেন, হু হু করে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলেও। মৃত্যুর সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী। আস্তে আস্তে আমরাও এগুলো দেখে দেখে অসংবেদী হয়ে যাচ্ছি। তাই নতুন করে কোনও মৃত্যুর খবর আর ধাক্কা দেয় না আজকাল, যেমন দিত লকডাউনের শুরুর দিনগুলোতে।

তবে এই এত এত মৃত্যু, পরিচিত অপরিচিতের মৃত্যুর মধ্যেও কিছু কিছু ঘটনা দাগ কেটে যায়। বনগাঁয়ের সেই প্রৌঢ়র মৃত্যু, যিনি এমবুল্যান্স তুলতে কেউ সাহায্য করেনি বলে ফুটপাথে বসে বসেই মারা গেলেন। একনজরে পশ্চিমবঙ্গের তথা বাংলার স্বাস্থ্যব্যবস্থার করুণ হাল শুধু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল বলেই নয়, সেই ভদ্রলোকের স্ত্রী-র সাহায্য চেয়ে করুণ আর্তি, যেন মানবিকতার সংকট বলে মনে হচ্ছিল। জানা কথা যে সম্পাদকীয়কে হতে হয় নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু এই ধরণের কিছু কিছু মৃত্যু লেখাকেও যখন পার্সনাল করে তোলে, তখন কলম প্রত্যাহার করে নিতে ইচ্ছে করে না। বোধহয় ওই ভদ্রমহিলার আপ্রাণ লড়াইটার জন্যই এই মৃত্যুটা প্রভাব ফেলেছে। মানুষ লড়াই করে একটা আশা নিয়ে, সে আশা যত ক্ষীণই হোক। এবং আশাই হলো যে কোনো ট্র্যাজেডির মূল উপাদান। ওই লড়াইয়ের মধ্যে ওই ক্ষীণ আশাটুকু ছিল বলেই হয়ত মৃত্যুটা এত কাছের। পরিযায়ী শ্রমিকের কয়েক’শ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টাতেও এই আশাই থাকে। প্রতিনিয়ত আমরা, আমাদের সমাজ, আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আমাদের সরকার এই আশাগুলোকে হত্যা করছে। প্রৌঢ়কে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই ছিল, তারা আসেনি। মাস্ক পরে যাঁরা ছিলেন ওখানে তারা আসেনি। যে দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের পাড়া ছাড়া করা হয় নিজেকে বাঁচাতে, সে দেশে এটাই স্বাভাবিক। শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমরা নিজেরাই নিজেদেরটুকু বাদ দিয়ে আর ভাবতে ভুলে গেছি।

রোজ আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে, বাজার শেখাচ্ছে - যারা শক্তিশালী, যারা সফল, যারা ধনী, তারাই মহান, তাদের মত হতে না পারলে তুমি কেউ নও। আজ বিজেপি ভোটে জিতেছে তাই বিজেপি যা করবে সেটাই ঠিক। কাল কংগ্রেস ভোটে জিতলে তখন তারা ঠিক হয়ে যাবে। এই পরিবেশে তাই নিজেকে নিয়ে ভাবাটাই স্বাভাবিক। সবকিছুতেই হিসেব হলো নিজের কীসে ভালো। এমনকি গোষ্ঠীর মধ্যেও ভাগাভাগি করে নিতে নিতে মানুষ দিনের শেষে তখন নিজেরটুকুই ভাবতে শুরু করে। নিজের দেশের সেনা বা পুলিশ? ভালো হতেই হবে। নিজের ধর্ম? সর্বশ্রেষ্ঠ, কারণ তা অপর মতকে দমনে সক্ষম। নিজের রাজনীতি, সেটাও অন্য সবার থেকে সেরা। এই পরিস্থিতি যে সমাজের, সেখানে আশা আর সেই আশা থেকে জন্মানো লড়াইয়ের প্রতি কোনো সম্মান থাকে না, ভালোবাসা থাকে না।

প্রশ্নটা তাই হতেই পারত সামগ্রিকভাবে রাজ্য বা কেন্দ্রের অপদার্থতা। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের লড়াই, তার অসহায়তা, সেই আখ্যান তাহলে লিখবে কে বা কারা? হাসপাতালের আকাশচুম্বী বিল, বেড না মেলা, রাস্তায় বসে বসে মরে যাওয়া এবং তারপরেও কেউ এগিয়ে না আসা, করোনা সন্দেহে ব্রাত্য হয়ে যাওয়া, পাড়া থেকে বিতাড়িত হওয়া - একটা গোটা সমাজ যেখানে পচে যেতে শুরু করেছে এভাবে, সেখানে ব্যক্তির এই হেরে যাওয়া, এই আশা নিয়ে বেঁচে থাকা তার পরেও, ছোট ছোট লড়াইগুলো, এগুলো কি তাহলে ধরা থাকবে না? পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু, দিল্লির রায়টের মৃত্যু, ভূমি পুজোতে ধর্মনিরপেক্ষতার মৃত্যু, এবং এই প্রৌঢ়ের মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে কি আমাদের এখনো দেখাচ্ছে না, আসল ভাইরাস ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে?