আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

রাম মন্দির ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম


নৃত্যগোপাল দাস করোনা আক্রান্ত। বাবরি মসজিদ ভেঙে যেই স্থানে রাম মন্দির গড়ে উঠছে, যেই মন্দিরের ভূমি পূজা করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, সেই মন্দির ট্রাস্টের প্রধান নৃত্যগোপাল দাস। ৫ আগস্ট মোদী যখন অযোধ্যায় ভূমিপূজা করছিলেন তখন এই ব্যক্তিকে মাস্ক ছাড়াই মঞ্চে উপবিষ্ট থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।

নৃত্যগোপাল দাস, শুধুমাত্র রাম মন্দির ট্রাস্টের প্রধান নন। বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় অভিযুক্ত ৩২ জনের মধ্যে একজন। এই ট্রাস্টের সচিব চম্পট রাই-ও একই মামলায় অভিযুক্ত। এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ১৪৭ (দাঙ্গা), ১৫৩ (সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি এবং জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করা), ২৯৫-এ (ধর্মস্থান নষ্ট করা) এবং ১২০-বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) সংক্রান্ত গুরুতর অভিযোগ আছে। বর্তমানে লখনৌ-এর সিবিআই আদালতে এই মামলার শুনানি চলছে। অথচ, রাম মন্দির ট্রাস্টের প্রধান হিসেবে নৃত্যগোপাল দাসকেই মনোনীত করেছেন মোদী। সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ মামলায়, বিতর্কিত জমি হিন্দুদের হাতে তুলে দিলেও দ্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস আইনের শাসনের বিরুদ্ধে ঘটা এক ভয়াবহ অপরাধ। সেই অপরাধে অভিযুক্ত যারা, যাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে তারাই মন্দির বানানোর দায়িত্বে, তাদের সঙ্গে একই মঞ্চে ভূমি পূজা সারলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার অভিযুক্তদের সঙ্গে যখন প্রধানমন্ত্রীকে কোলাকুলি করতে দেখা যায় তখন বোঝাই যায় যে এই ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে রাষ্ট্র কতটা আন্তরিক!

এই অভিযুক্তদের সঙ্গে ভূমি পূজা সেরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে রাম মন্দির আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের। তিনি বললেন, “যেরকমভাবে দেশের অসংখ্য মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খা এবং তাদের আত্মবলিদানের বার্তা বহন করে ১৫ আগস্ট, সেরকমই বহু শতাব্দী ধরে বহু প্রজন্ম আত্মত্যাগ করেছে রাম মন্দির তৈরি করার জন্য। ৫ আগস্ট সেই বহু প্রতীক্ষিত দাবি পূর্ণ হয়েছে”। ভারতে রাম মন্দির অজস্র আছে, আরও একটি রাম মন্দির তৈরি হওয়াতে কেউ কোনোদিন কোনো আপত্তি জানায়নি। কিন্তু অযোধ্যায় বর্তমানে যেই রাম মন্দিরটি তৈরি হচ্ছে তা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে তৈরি করা হচ্ছে। এই মন্দির-মসজিদ বিবাদকে কেন্দ্র করে দেশে দাঙ্গার স্রোত বয়ে গেছে। অগুনতি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাকা ইমারত, সেখানে ভারতের পরমতসহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের উপরে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এই ভ্রাতৃঘাতী রাম জন্মভূমি আন্দোলন আসলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল যে বাণী তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বহু ধারার মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। গান্ধীর মত মেনে লক্ষ লক্ষ মানুষ অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন করেছেন। আবার ভগৎ সিংহ, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, আশফাকুল্লাহ খানদের মতন বহু মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ সরাসরি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে নেমেছিল। এই প্রত্যেকটি ধারা ভিন্ন পথে প্রভাহিত হলেও, প্রত্যেকটি ধারায় যেই ভারতের কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষের ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এক ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো হবে এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামী ফাঁসি কাঠে হাসি মুখে উঠে যাননি বা শহিদ হননি। যারা ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল, যারা আজ উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামে দেশে এক বিষাক্ত রাজনীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস কোনোদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোনো সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। হেগডেওয়ার থেকে গোলওয়ালকার এরা কেউ ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে গুরুত্ব দেয়নি। এদের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে হিন্দু রাষ্ট্রের কল্পনা যেখানে সংখ্যালঘু মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে পদাতলে রাখা হবে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারবারি এবং আরএসএস-এর সদস্য নাথুরাম গডসে। আরএসএস-কে এই ঘটনার পরে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আজও বিজেপি-র সাংসদ, উগ্রপন্থী কার্যকলাপে অভিযুক্ত প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর, দেশের সংসদে বিবৃতি দেন যে নাথুরাম গডসে দেশপ্রেমিক ছিলেন। প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুরদের এই বক্তব্যই সংঘের আসল বক্তব্য।

আজ যখন মোদী রাম মন্দির আন্দোলনের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের তুলনা টানেন তখন তিনি দুটি কাজ এক সঙ্গে করতে চান। একদিকে, যেই সংগঠনের জঠরে তাঁর জন্ম সেই আরএসএস-এর কদর্য ব্রিটিশদের পদলেহনকারী ইতিহাসকে তিনি ভুলিয়ে দিতে চান। অন্যদিকে, তিনি উপস্থাপন করেন সংঘের আদি ও অকৃত্রিম হিন্দু ভারতের কল্পনা। জনগণের ঐক্যের ভিত্তিতে ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন নয়, হিংসার রাজনীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির গঠন আন্দোলনই সংঘের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি তাঁদের যে কোনো প্রেম নেই, সেই বার্তাই তাঁরা জোর গলায় বলতে চান। স্বাধীন ভারতে একটি মসজিদ ভেঙে যদি মন্দির তৈরি করা যায়, তবে আর ধর্মনিরপেক্ষতার রইলই বা কী!

এই প্রশ্নটি ভারতের বর্তমান রাজনীতি ও ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সত্যিই তো, তাহলে কি ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতে পরাজিত হল? ধর্মনিরপেক্ষতা যে বর্তমানে ভারতে পিছু হটেছে তা নিয়ে সংশয় নেই। হিন্দুত্ব আজ এক কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক আখ্যান হিসেবে বহু মানুষের মনে প্রোথিত রয়েছে। কিন্তু কেন এমন হল?আম্বেদকর সংবিধান পরিষদে, ভারতের সংবিধান প্রণয়নের সময় তাঁর শেষ ভাষণে বলেছিলেন, এই সংবিধানের মাধ্যমে আমরা মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সমতা তৈরি করছি। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্তরে প্রবল অসাম্য রয়েছে। এই অসাম্যের প্রতিকার না করতে পারলে ভারতের রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সামনে সমূহ বিপদ উপস্থিত হবে। আজ স্বাধীনতার ৭৩ বছরে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি বিশেষ করে কংগ্রেস কি বলতে পারবে তারা আম্বেদকরের এই সাবধান বাণী সম্পর্কে সচেতন ছিলেন? বর্তমানে ভারতে অসাম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। চাষির ছেলে চাষি হবে, রিক্সাওয়ালার ছেলে রিক্সা চালাবে আর ধনীর ছেলে ধনী হবে আর নেতার ছেলে নেতা, এই কথা দেশের মানুষ মানতে অস্বীকার করছে। এই অসাম্য নির্ভর রাজনৈতিক তন্ত্রের ভিত যে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির হাত ধরেই গড়ে উঠেছে এই সত্য স্বীকার না করলে ভারতের জনগণের যেই ক্রোধ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির উপর বর্ষিত হচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারব না।

কেউ বলতেই পারেন, এর সঙ্গে হিন্দুত্বের কী সম্পর্ক? অসাম্যের সুরাহা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কী করে করতে পারে? অসাম্যের সুরাহা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে না। অসাম্যকে বাঁচিয়ে রাখাই তার কাজ। কিন্তু এই অসাম্য, বেকারত্ব, ও নানা না পাওয়ার যে গ্লানি ও ক্রোধ সাধারণ মানুষের মনে রয়েছে তার একটা সহজ সমাধান সেই রাজনীতি মানুষের সামনে হাজির করে - সংখ্যালঘু বিরোধী রাজনীতি। তুমি খারাপ আছ, কারণ মুসলমানদের তোষণ করা হচ্ছে। তোমার সব অধিকার মুসলমানরা কেড়ে নিয়েছে। এই জাতীয় কথার বিরুদ্ধে যখন প্রগতিশীলরা বক্তব্য রাখে তখন তারা সঠিকভাবেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধীতা করে। কিন্তু না পাওয়ার যে যন্ত্রণা সাধারণ মানুষের মনে রয়েছে তার উপশম করতে ভুলে যান বা অপারগ থাকেন। ক্ষমতাশীল রাজনীতিকরা স্বাভাবিক কারণেই এই অসাম্যকে মানতে চান না। কারণ তা মানলে তাদেরই ক্ষতি। তাই তারা এক আশ্চর্য কৌশলের সাহায্য নেন। তারা নেমে পড়েন কে কত বড় হিন্দু প্রেমী তা প্রমাণ করতে। যেমন কংগ্রেসের নেতাদের দেখা যায় হনুমান মন্দিরে যেতে, বা রাম মন্দিরের গুণগান গাইতে। কিন্তু সমস্যা হিন্দু নয়। সমস্যা হিন্দুত্ব। হিন্দুরা খারাপ আছেন কথাটির সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। হিন্দুরা খারাপ আছে কারণ মুসলমান তোষণ করা হচ্ছে - এই কথাটি রাজনৈতিক এক আখ্যানের জন্ম দেয় যেখানে হিন্দু ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এক অপরের নির্মাণ করা হয় মুসলমানদের মধ্য দিয়ে। আমরা খারাপ আছি, কারণ ওদের প্রতি সরকারের ভালোবাসা বেশি। এই মিথ ক্রমাগত নির্মিত হয়। এই মিথকে পোক্ত করার জন্যই কল্পিত ইতিহাসের নির্মাণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে যেখানে যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের বঞ্চনার কাহিনি বর্ণিত হয়।

মুসলমান বিদ্বেষ বাদ দিয়ে তাই হিন্দুত্বকে বোঝার উপায় নেই। অনেক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি মনে করছেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণায় আরো বেশি করে ধর্মের প্রতি মর্যাদা দেওয়া উচিত ছিল, হিন্দু ধর্মকে দূরছাই না করে তাকে বোঝার দরকার ছিল। হিন্দু ধর্মের নিন্দা করা ধর্মনিরপেক্ষতার কাজ নয়। কিন্তু ধর্মের কাছে কেন ধর্মনিরপেক্ষতা পৌঁছল না, এই সমালোচনা খাটে না। বর্তমান হিন্দুত্ব রাজনীতি মুসলমান বিদ্বেষের উপর ভর করে শক্তি সঞ্চয় করেছে। ধর্মের মোড়কে তাকে রোধ করা সম্ভব নয়। অনেকে মনে করছেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এবারে এগিয়ে যেতে হবে, অতীত ভুলে। এই জ্ঞানী ব্যক্তিরা ভুলে যান যে ইতিমধ্যেই কাশী ও মথুরার মসজিদ ভেঙে দেওয়ার ডাক উঠে গেছে। হিন্দুত্বের রাজনীতি ধর্মীয় উন্মাদনা ও মুসলমান বিরোধী জিগির ক্রমাগত না তুলে টিকতে পারে না। তাই ন্যায়ের পক্ষ না নিয়ে যদি মনে করা হয় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে মন্দির যখন হয়েই গেছে তখন আর তা নিয়ে কথা বলে লাভ কি, তবে তা ভুল হবে। বারবার বাবরি মসজিদের মতন ঘটনা ঘটাবে হিন্দুত্ববাদীরা।

তাহলে উপায়? ভারতের বুকে এক উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রবল জনসমর্থন লাভ করেছে, একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু তা বলে ধর্মনিরপেক্ষতা কোনো তামাদি বর্জ্য মতাদর্শ হয়ে যায়নি। সাধারণ মানুষের মনে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেই ক্রোধ রয়েছে, অসাম্য, বেকারত্ব, নেতাদের দুর্নীতি, স্বজন-পোষণ সংক্রান্ত যেই ক্ষোভ রয়েছে সবার আগে তাকে ভাষা দিতে হবে। জোড়াতালি দেওয়া চোর-জোচ্চোর ও ধান্দাবাজদের সমর্থন করতে হবে, কারণ তারা ধর্মনিরপেক্ষ, এই যুগ সমাপ্ত। নতুন আঙ্গিকে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে মানুষের সামনে নিয়ে আসতে হবে। অধিকাংশ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি ও বিশেষ করে তাদের নেতারা নিজেদের আখের গুছিয়েছে, এদের মানুষ আর মেনে নেবে না। নতুন ভাষা, নতুন মুখ ও নতুন আখ্যান চাই, যা হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে এক ইঞ্চি আপোষ করবে না, আবার মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে ধর্মের স্থানকে সম্মান করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরব হবে, এবং নিজেদের কথা ও কাজের মধ্যে ফারাক থাকবে না, এমন রাজনীতি ও নেতা চাই।