আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩২

প্রবন্ধ

পুনর্মূষিক? এক একান্ত ব্যক্তিগত ঠাট্টা

অমিয় দেব


।। ১ ।।

পঁচাত্তর বছর মতো আগে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পড়বার সময় এই মহানগরের এক কলেজ-সংলগ্ন যে-ছাত্রাবাসে ছিলাম সেখানে এক-এক ঘরে চার জনকে থাকতে হতো। চার জনের চারটে তক্তাপোশ - মাত্র এই আসবাব, কোনো টেবিল-চেয়ারের বালাই নেই। বইপত্র যা তা তক্তাপোশেই থাকত, শোবার সময় মেঝেয় নামিয়ে রাখতাম। সকালে বিছানা গুটিয়ে নিয়ে তাদের তুলে দিলেই হল। আর কলেজে বেরোবার আগে-পরে যা লেখাপড়া তাও ওতে বসেই। আমার যে তাতে বিশেষ অসুবিধে হতো তা নয়। কেননা, সিলেট থাকতে, বাড়িতে টেবিল-চেয়ার জুটেছিল বোধহয় স্কুল-জীবনের একেবারে শেষদিকে। যে-দুই বা তিন কোঠার বাড়ি আমাদের পারিবারিকভাবে জুটেছে, তাতে শোবার আগে-পরে বিছানামাত্রেই গোটানো থাকত। তক্তায় বড়োজোর বিছানো থাকত মাদুর। স্কুলের লেখাপড়া করেছি তাতে বসেই। খাড়া পিঠ কখনো সখনো গোটানো বিছানায় হেলান দিতে চাইত। ব্যস, ওইটুকুই বিলাসিতা।

বিরানব্বইতে পা দিয়েছি। যে-বাড়িতে এখন আছি, তাতে নিজের একটা ছোটো ঘর আমার আছে। শুই এক নিচু ডিভানে। বিছানা পাতাই থাকে। দিনের বেলা এক ঢাকা বিছিয়ে দিই তার উপর। লেখাপড়ার টেবিল মোটামুটি প্রশস্তই। তা মুখ্যত জুড়ে রেখেছে এক ল্যাপটপ ও তৎসংলগ্ন প্রিন্টার (প্রিন্টারটি আগে ছিল না, ছিল তিন-চারটে নিত্যব্যবহার্য বই; বছরসাতেক আগে দুই বন্ধু - প্রণব বিশ্বাস ও স্বপ্না রায় - এটা কিনে নিয়ে আসেন আমার জন্য; এবং বইক'টা এ-ঘরের তিনটে র‍্যাকের একটার উপরিস্থিত এক স্তূপে অন্তরিত হয়)। কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ বসে না থেকে তো এখন ল্যাপটপ খুলে চুপচাপ বসে থাকি - লেখা, তা সে যত হতকুচ্ছিতই হোক, আসে না। দিনের পর দিন আর কাঁহাতক থ্রিলার দেখা যায়, এমনকী একদা-দেখা ক্লাসিকও কতবার পুনরায়? আর 'ডকুমেন্টারি' তো সবজান্তা বক্তৃতা-বোঝাই, কটা আর বেঠোফেন কর্তৃক এক সিম্ফনি-অর্কেস্ট্রাকে দিয়ে তাঁর 'এরোয়িকা' প্রথম বাজিয়ে শোনানোর মতো যথার্থ ঐতিহাসিক হয়, যেখানে পূর্বসূরি হাইডেনও আসেন শেষ পর্যন্ত শ্রোতা হয়ে? বা 'দস্তইয়েভস্কির জীবনে ছাব্বিশ দিন', যাতে তরুণী আন্না গ্রিগোরিয়েভনার শর্টহ্যান্ডে তাঁর, প্রকাশকের সঙ্গে এক নির্মম চুক্তি সত্ত্বেও, এতদিন শুরু না করতে পারা উপন্যাস ('জুয়াড়ি') যথাসময়েই লেখা হয়ে ওঠে, এবং পরিণামে আন্নাও হয়ে ওঠেন বিপত্নীক দস্তইয়েভস্কির পত্নী?

বলছিলাম নিয়মিত বই নীচে নামানো ও উপরে তুলে রাখার কথা। তখন আমি নবীন যুবক, এখন আমি একেবারেই বৃদ্ধ। মাঝখানে অতগুলো দশক পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস দুই গোছা বই রাত্তিরে বিছানা থেকে পাশের সোফায় সরিয়ে রাখি, আবার সকালে সোফা থেকে তুলে নিয়ে তাদের বিছানায় পুনঃস্থাপন করি। কিন্তু কেন? নিতান্তই কতিপয় বই। এঘরের বা এবাড়ির কোনো র‍্যাকেই কি তাদের সসম্মান অবস্থানের জায়গা নেই? না, জায়গা নেই। একতিলও। আর ঠাট্টাটা সেখানেই। নতুন বই এলে, এককালের প্রায় বই না থাকা আর এখনকার বইয়ে বোঝাই হয়ে থাকার, প্রভেদ ঘুচে যায়।

আর নতুন বই তো দুটো-একটা আসবেই। যথাসময়ে দু-চোখেরই ছানি কাটিয়ে নিয়েছিলাম বলেই হোক, বা বংশাণুগত কোনো কারণেই হোক, দৃষ্টি এখনো আছে। ধরা যাক, হিমানী ব্যানার্জির অনুরোধে যদি তাঁর প্রকাশক ২০২৪-এর গোড়ায় ছাপা 'Decolonization and Humanism: The Postcolonial Vision of Rabindranath Tagore'-এর এক খণ্ড পাঠিয়ে দেন, তা ফেরত দেব? আর, যদি তা পড়ে দু-তিন পাতা লিখেও উঠি - নিতান্তই এক ব্যক্তিগত নিবন্ধ - এবং ২০২৪-এর 'শারদীয় অনুষ্টুপ' যদি তা ছেপে নিয়ে তাদের সেই মহাভারতসদৃশ পত্রিকা আমায় যথারীতি পাঠিয়েও দেয়, তাহলে? অথচ, তার আগেই তো ডাকে এসে গেছে ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতাভ দেব চৌধুরীর কয়েকটি কবিতার বই, যার একটি আবার মার্কিন কবি মেরি অলিভার থেকে অনুবাদ? ইতিমধ্যে আমাকে খানিক কাফকায় পেল, তাঁর ছেঁড়াখোঁড়া এক প্যারাবল সংকলন - জর্মন - ইংরেজি - এঘরেরই এক তাক থেকে বের করে আনলাম (যদিও কিছুতেই খুঁজে পেলাম না কিঞ্চিৎ জর্মন শেখার অভিমানে একদা কিনে ফেলা তাঁর জগজ্জয়ী 'The Trial'-এর মূল, 'Der Prozess'), আর সেই ফাঁকটুকুন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভরে গেল অন্য কোনো এক ছেঁড়াখোঁড়ায়। অতএব?

অবশ্য কাজে দিল তা। কষ্টেসৃষ্টে তা থেকে তিন-চারটের বাংলা করে উঠলাম। আর, সম্প্রতি যখন মিউনিখ থেকে বন্ধু প্রভু মজুমদার কয়েকদিনের জন্য কলকাতা এলেন, এবং কথায় কথায় কাফকার বিশিষ্টতা উল্লেখ করলেন, তখন আমার আরেকবার সেই সংকলন ব্যবহারের সুযোগ হল (ভাগ্যিস তা আমার বিছানায় রাখা দু-গোছার একটায় থেকে গিয়েছিল)। কেননা প্রভু তাঁর এক নতুন লেখায় কাফকার 'Das Schweigen der Sirenen' প্যারাবলটির কথা বলছিলেন। 'সাইরেনদের নৈঃশব্দ্য' নাম দিয়ে তার বাংলা করবারও আমার ইচ্ছে হল। আবার, প্রভু তাঁর সদ্য ছাপা সুদৃশ্য বই, 'Gold und Goist', যখন আমায় উপহার দিলেন, তারও তো জায়গা হল আমার বিছানাতেই। যেমন হল এবারকার বইমেলায় শিলচর থেকে এসে অমিতাভর দেওয়া চার চারটে বইয়েরও, যার একটা আবার নোরাকে লেখা জয়েসের প্রেমপত্রাবলি। এবং এই কয়েকদিন আগে বিছানায় এসে শুল 'আমি বিনয় মজুমদার'। লেখক অংশুমান কর। আনয়ন করলেন শুভা দাশগুপ্ত। আর, কার কাছে যেন আছে আমার সেই আশ্চর্য বই 'একজন কমলালেবু'? তা ফিরে এলে তাকেও তো জায়গা দিতে হবে জীবনানন্দের উত্তরসূরি বিনয় মজুমদারের মাথায়। এর পর কী আসবে কে জানে!

আপাতত এসে আছে দেখছি নবপর্যায়ে বেরোনো জ্যোতির্ময় দত্তের একদাখ্যাত 'কলকাতা' পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। অপেক্ষা দ্বিতীয় সংখ্যার যার লেখক-তালিকায় আমিও আছি। অনুরূপ সুবাদে, যখন হাঁসফাঁস করেও আমরা গরমে অভ্যস্ত হয়ে উঠব, 'অনুষ্টুপ' গ্রীষ্ম সংখ্যা? হয়তো অদূরবর্তী অন্য কোনো সংখ্যাও, যাতে প্রভু মজুমদারের উপরিউক্ত নতুন লেখার বাংলা অনুবাদের সঙ্গে চমৎকৃত সাম্প্রতিক কাফকা, মানে 'সাইরেনদের নৈঃশব্দ্য'ও থাকবে?একদিক থেকে রক্ষা অবশ্য এই যে আমার ছোটো ছোটো লেখাগুলি মুখ্যত যে-পাক্ষিক পত্রিকায় বেরোয়, তা সেই যে করোনাকালে 'অনলাইন' হল এখনো তা-ই। ব্যতিক্রম তার 'বার্ষিক যুগ্মসংখ্যা' যার নমুনা অবশ্য আমার বিছানায় থাকতে পারে।

সত্যিই যদি গতবছর নেওয়া পাঁচ বছরের নিউমোনিয়া ভ্যাক্সিন আমাকে আরো ক-বছর বাঁচিয়ে রাখে, তাহলে মাঝরাতে সরিয়ে রাখার ও সকালে পুনঃস্থাপনের এই গোছাদুটির চেহারা কী দাঁড়াবে কে জানে!

।। ২ ।।

কিন্তু পুনর্মূষিক না হই, পশ্চাদ্গমন যে করছি তার অভিজ্ঞান তো ছেলেবেলায় মুখস্থ করা কোনো কোনো পদ্য যে আমার স্মৃতি জবরদখল করে চলছে, তাতেও। আচ্ছা, বলুন তো নিবন্ধপাঠক, এমত পংক্তিনিচয় কার মাথায় ঘোরে?

"সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,
আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।

ওঠো শিশু মুখ ধোও পরো নিজবেশ,
আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ।

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে?

আপনারে লয়ে        বিব্রত রহিতে
    আসে নাই কেহ অবনী 'পরে,
সকলের তরে        সকলে আমরা
    প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।"

এমনকী

"উই আর ইঁদুরের দেখো ব্যবহার,
যাহা পায় তাহা কাটি করে ছারখার।
কাঠ কাটে বস্ত্র কাটে কাটে সমুদয়
সুন্দর সুন্দর দ্রব্য কেটে করে ক্ষয়।"

আবার, দস্তইয়েভস্কির ('দস্তইয়েভস্কির জীবনে ছাব্বিশ দিন' দেখতে গিয়েই ধরা যাক) মৃগীরোগ ছিল শুনেই আমার প্রেমময়ের কথা মনে পড়ে যায় - ছেলেবেলায় একবার আমাদের এক পাশের বাড়ির বিধবা রাঁধুনি প্রেমময়ের মা-র সেই ছেলে, যাকে দেখতাম চোখ উপরে তুলে তুলে এলোমেলো হেঁটে ফিরছে। কী গেরো হল বলুন তো, পাঠক-মশাই/মহাশয়া, দস্তইয়েভস্কি-সম সদা বর্তমানও ঢাকা পড়ে যাবে আমার ওই সুদূর অতীতে? এর চেয়ে কি প্রেয় নয় সেই শেক্সপিয়ার কথিত "নেই... নেই... নেই"? যদিও তাতে অন্তর্ধান হয়ে যাবে দস্তইয়েভস্কিরও?আহা, যদি এই মানবদেহে চৈতন্যের চিরনিদ্রা তথা বিশুদ্ধ জাড্য সম্ভব হতো! "আছে... আছে... আছে...", তবু আসলে 'নেই'। ফ্যালফ্যাল।


'আরেক রকম' সম্পাদক,

এই প্রায় নিয়মিত লেখক আপনাদের যে 'ব্যক্তিগত'-র অছিলায় প্রলাপও বকতে পারেন, তার এক অভিজ্ঞান না হয় রইলই!

মার্চ ২০২৫।

কৃতজ্ঞতা: সুব্রত সিনহা