আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩২
প্রবন্ধ
শিক্ষা দুর্নীতি ও আগামী প্রজন্ম
পার্থপ্রতিম বিশ্বাস
"একটা গোটা জাতিকে ধ্বংস করতে পরমাণু বোমা কিংবা মিসাইলের মতো ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল দেশের শিক্ষার মানকে লঘু করে পরীক্ষায় অসাধু উপায়ের পথ বাতলে দেওয়া"। গত শতাব্দীর বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম মানুষ নেলসন ম্যান্ডেলার ঐ উক্তি আজও লেখা রয়েছে প্রিটোরিয়ায় ‘ইউনিভারসিটি অফ সাউথ আফ্রিকা'র প্রবেশদ্বারে। ম্যান্ডেলার সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক উক্তি এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে প্রিটোরিয়া থেকে আট হাজার চারশো কিলোমিটার দুরে ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও। দেশের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি খারিজের সুপ্রিম কোর্টের রায় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মতো পশ্চিমবঙ্গের সমাজে পরমাণু বোমার আঘাতের মতোই আছড়ে পড়েছে। সরকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এসএসসির মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতির প্রত্যাঘাত যে ভাবে যোগ্য শিক্ষকদের ওপরে পড়ল, এক কথায় স্বাধীনতা উত্তর এই রাজ্যের ইতিহাসে এক বেনজির ঘটনা।
পরমাণু বোমার আঘাত
শিক্ষার মানে ভেজাল ঢোকাতে পারলে যে শেষমেশ একটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া যায় সেটাও প্রমাণিত হচ্ছে এ রাজ্যের সাম্প্রতিক নিয়োগ কেলেঙ্কারির ঘটনায়। সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরকার পোষিত স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে এসএসসি যে পরিমাণ দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়েছিল, তাতে এই গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বেআইনি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে। ফলে যে শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারের রক্ষা করার প্রাথমিক দায় কার্যত সেই ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে সরকার পোষিত দুর্নীতির আবহে। এর চাইতে বড় লজ্জার ঘটনা আর কি হতে পারে এই সময়কালে? দুর্নীতি এ রাজ্যে নতুন নয়, রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর জীবনের নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি নতুন করে বাসা বেধেছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি শিক্ষায় কিংবা স্বাস্থ্য যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তার সাক্ষী থেকেছে রাজ্যের মানুষ। আর. জি. করে অভয়া হত্যার ঘটনা এবং রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি হল এই সময়কালের অন্যতম জঘন্য কেলেঙ্কারি। আর. জি. করের ঘটনায় গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে 'থ্রেট কালচার'-এর কথা উঠে এসেছিল মানুষের আলোচনায় ঠিক একই রকম ভাবে রাজ্যের স্কুলে স্কুলে নিয়োগের ক্ষেত্রে 'ঘুষের সংস্কৃতি'র ভিন্ন রূপ দেখল রাজ্যের মানুষ! শিক্ষায় এই ঘুষের কালচার, থ্রেট কালচারের মতোই বহাল থেকেছে রাজ্যের শাসকদলের বাহুবলি রাজনীতির দাপটে। মেধা থাকলেও চাকরি জুটবে না অথচ মেধাহীন প্রার্থীদের ঘুষের বিনিময়ে নিশ্চিন্তে ঘুরপথে চাকরি হবে এমনটাই ছিল এই ঘুষ কালচারের প্রতিপত্তি রাজ্য জুড়ে। ফলে এই প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় আদৌ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নয় বরং গত কয়েক বছর ধরে স্কুল শিক্ষায় নিয়োগ কেলেঙ্কারির যে সিঁদুরে মেঘ জমেছিল রাজ্যের ঈশান কোণে আজ তারই পরিণতি দেখছে বাংলার মানুষ। বলাই বাহুল্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিঘাত আশু হলেও শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। বিধ্বংসী পরমাণু বোমার আঘাতে যেমন আগামী কয়েক প্রজন্ম পঙ্গু হয়ে যেতে পারে ঠিক তেমনটাই ঘটতে পারে শিক্ষায় ভয়াবহ নিয়োগ দুর্নীতির অভিঘাতেও।
স্বশাসনের অন্তর্জলী যাত্রা
ইতিমধ্যে চাকরি-হারা যোগ্য শিক্ষকের দল রাজপথের আন্দোলনে নেমেছেন সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা এসএসসির এই নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে। শাসকদলের নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক এবং আমলাদের সম্মিলিত ও পরিকল্পিত প্রয়াসের মাধ্যমে এই বিপুল দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছে দিনের পর দিন। ফলে তাদের ওই প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধের যাবতীয় প্রমাণ লোপাটের লক্ষ্যে যোগ্য এবং অযোগ্য উভয়গোত্রের প্রার্থীদের OMR সিট থেকে শুরু করে নিয়োগের প্রাসঙ্গিক প্রতিটি তথ্য লোপাট করা হয়েছে। আর সেই প্রমাণ লোপাটের কারণেই যোগ্য-অযোগ্যের মাঝে চালে কাঁকড় বাছা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর এই সুযোগে যোগ্যপ্রার্থীদের ঢাল বানিয়ে রাজ্যের সরকার অযোগ্যদেরও চাকরি রক্ষায় সোচ্চার। কিন্তু আদালতের রায়ে গোটা নিয়োগ পদ্ধতি গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়ায়, যে বিপুল নিয়োগ খারিজ হয়েছে তার দায় রাজ্য সরকার এবং স্কুল শিক্ষা কমিশনের। ভূতের মুখে রাম নামের মতো এখন তীব্র সামাজিক চাপে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী স্বশাসিত সংস্থা এসএসসি থেকে সরকারের ভূমিকা আলাদা করতে চাইছেন। কিন্তু রাজ্যের আইন মেনে তৈরি হওয়া সংস্থা এসএসসির স্বশাসনের জলাঞ্জলি ঘটেছে শাসকদলের নিয়ন্ত্রণের রাজনীতিতেই। ফলে শুধু এসএসসি নয়, কলেজ সার্ভিস কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্যে মানবাধিকার কমিশন প্রতিটি স্বশাসিত সংস্থার মাথায় বসেছে সরকার মনোনীত বাছা বাছা কুশীলবেরা। আর এই মডেলেই এসএসসির মাথায় বাছাই করা প্রশাসক আর ঘুষের বিনিময়ে বাছাই করা অযোগ্যের তালিকা জুড়ে দিয়েছে সেই কমিশন ওই ছাব্বিশ হাজারের তালিকায়। ফলে এই বিপর্যয়ের দায় কেবল কমিশনের নয় উপরন্তু সেই দায় রাজ্যের গোটা মন্ত্রিসভার যারা এই নিয়োগ দুর্নীতি ঢাকতে অতিরিক্ত শিক্ষকের পদ তৈরির মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
চোরের মায়ের বড় গলা
ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার পর রাজ্যের শাসকদল আইনের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন অপরাধ অন্বেষণে ব্যর্থ হলে হাজার দোষী পার পেয়ে গেলেও যেন একজন নির্দোষও দোষী সাব্যস্ত না হন! এখানেই সরকার ও শাসকদলের ভূমিকা আতশকাঁচের তলায়। গত কয়েক বছরে হাইকোর্টের রায় থেকে শুরু করে বিচারপতি বাগ কমিটির রিপোর্টে শিক্ষক নিয়োগে বেনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে টাকার বিনিময়ে চাকরি। প্রাথমিকভাবে প্রমানিত রাজ্যের নেতা, মন্ত্রী, আমলা, বিধায়কদের সেই দুর্নীতিতে যুক্ত। কিন্তু সেই দুর্নীতির ব্যাপ্তিতে মোট শিক্ষকের মধ্যে থাকা যোগ্য-অযোগ্যের বিভাজন স্পষ্ট করা যায়নি উপযুক্ত তদন্তের অভাবে। এই তদন্তের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-এর দীর্ঘসূত্রীতার কারণে যেমন এই তদন্তে যোগ্য-অযোগ্যের বিভাজন স্পষ্ট হয়নি তেমনি রাজ্য সরকার ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের ভূমিকায় দুর্নীতি ও বেনিয়মের যাবতীয় তথ্য লোপাটের চেষ্টা হয়েছে। ফলে চিটফান্ড কেলেঙ্কারির মতো সিবিআই তদন্ত থমকে দাঁড়িয়েছে অপরাধ অন্বেষণ অধরা রেখেই। এই প্রেক্ষিতে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে চাল-কাঁকড়ের তফাৎ স্পষ্ট না হওয়ার কারণে যোগ্য-অযোগ্য উভয় গোত্রের শিক্ষকেরাই আদালতের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন। ফলে এই প্রেক্ষিতে রাজ্যের শাসকদলের গলায় যোগ্য-অযোগ্যের বিভাজন নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন কিংবা আইনের মূল ভিত্তি নিয়ে সরব হওয়াটা খানিক চোরের মায়ের বড় গলার মতোই!
নালিশ দমাতে সালিশি
ইতিমধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কলকাতার চাকরিহারা প্রার্থীদের সামনে সমস্যা সমাধানের বিচিত্র পন্থা সুপারিশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পুনর্বিবেচনার দাবি জানাবেন দিল্লির সর্বোচ্চ আদালতেই। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন যে দেশের বাঘা বাঘা আইনজীবীদের সরকারি টাকায় ভাড়া করে এতকাল যে যে তথ্য সরকার পেশ করেছেন আদালতের সামনে সেগুলি ধোপে টিকল না কেন? চোর পালালে যেমন বুদ্ধি বাড়ে, সরকার এখন তেমনি চাকরিহারাদের নিয়ে সালিশি বৈঠকে বসেছে। অথচ গত কয়েক বছর ধরে এই চাকরি চুরির অভিযোগ নিয়ে হাজারো প্রতিবাদের স্বর কানে তোলেনি সরকার সেই চুরি আড়াল করতেই। এখন আদালতের রায়ে এই বিপুল চাকরি হারানো শিক্ষকদের ঘিরে তীব্র সরকার বিরোধী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সেই প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে সামলানো এবং ধামাচাপা দিতেই যে এমন কৌশলী সালিশি সভার তোড়জোড় সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। যোগ্য-অযোগ্যের যে তালিকা এতদিনেও সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি চরম সরকারি অদক্ষতার কারণে সেই তালিকার সমাধান সালিশি বৈঠকে উঠে আসবে সেটা কি আদৌ বাস্তবসম্মত?
পুলিশের লাথিতে আক্রান্ত শিক্ষা
আসলে সরকারের আলোচনায় বসার কৌশলী উদ্যোগ চাকরিহারা শিক্ষকদের রাজপথের আন্দোলনকে স্তিমিত করার চেষ্টায়। তাই আলোচনার আবহকে ঢাল বানিয়ে সরকার বলেছে আলোচনা এবং আন্দোলন একত্রে বরদাস্ত নয়। ফলে রাজ্যজুড়ে ডি.আই. অফিসের সামনে প্রতীকি অবরোধের যে কর্মসূচি নিয়েছিল চাকরিহারা আন্দোলনরত শিক্ষক সমাজ তার বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিশোধ নিতে নেমে পড়েছে রাজ্যের পুলিশ বাহিনী। প্রতিশোধের স্পৃহায় পুলিশ প্রশাসন আন্দোলনরত শিক্ষকদের লাঠিপেটা করেই থামেনি। লজ্জা-ভয়-নিয়ম-কানুন লাটে তুলে শিক্ষকদের লাথি মারতেও পিছপা হয়নি রাজ্যের পুলিশ। আসলে পুলিশের লাথি শিক্ষকের দেহে পড়েনি, পড়েছে রাজ্যে সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। যে শিক্ষক নিয়োগ ইতিমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে সেই দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের সাথে পুলিশ প্রশাসনও জড়িয়ে গিয়েছে। ফলে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়িতে যখন ঘুষের কোটি কোটি টাকা জমতে থাকে তখন রাজ্যের পুলিশ, সিআইডি নিস্পৃহ থাকে। যখন চাকরিপ্রার্থীরা রাজপথে দাঁড়িয়ে whistle blower-এর মতো একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনে তখনও পুলিশ নীরব থাকে। যখন রাজ্যের জেলা জুড়ে রেট-চার্ট তৈরি করে চাকরি বিক্রি হয় তখনও পুলিশ নিরুত্তাপ থাকে! ফলে আজ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার এই বেনজির দুর্নীতি পিছনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে পুলিশ প্রশাসনের। তাই আজ চাকরিহারাদের ডি.আই. অফিস অভিযানে আতঙ্কে দিশেহারা রাজ্যের পুলিশ।
আতঙ্কে দিশেহারা পুলিশ যখন হাতে পেন, পিঠে ব্যাগ নেওয়া শিক্ষকদের লাথি মারছে তখন জঙ্গিপুরে বোমা গুলি হাতে দুষ্কৃতিদের নৈরাজ্যের আগুন ঠেকাতে ব্যর্থ পুলিশ ঝাঁপ বন্ধ দোকানে আশ্রয় নিচ্ছে। নৈরাজ্য যখন রাজনৈতিকভাবে শাসকের ভোট রাজনীতির পক্ষে যায় তখন রাজ্যের পুলিশ শাসকদলের স্বেচ্ছাসেবকের মতো নৈরাজ্যের আগুন জ্বালিয়ে রাখে। আর ঠিক সেই কারণেই ১৪ই আগস্ট রাতে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা যখন প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে আর. জি. কর হাসপাতালে ঢুকে তান্ডব চালায় তখন পুলিশ লুকিয়ে পড়ে হাসপাতালে স্নানঘরে। ফলে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে আর. জি. কর প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ প্রশাসনের বাঁকা শিরদাঁড়া আরও ঝুঁকে পড়ছে। তাই রুগ্ন মেরুদণ্ডের কারণে পুলিশকে বোম মারার নিদান দিয়েও ‘বীরভূমের বাঘ’ পার পেয়ে যাচ্ছে। পার পেয়ে যাচ্ছে সন্দেশখালীর বেতাজ বাদশা সরকারি জমি লুট করে জমির চরিত্র বদল করেও পুলিশের নজরদারিতে।
সংকটে সরকার পোষিত শিক্ষা
এমন নিয়োগ দুর্নীতিতে কেবল বহু অযোগ্য মানুষ যোগ্যদের স্থানচ্যুত করে এমনটাই নয়। পাশাপাশি সেই অযোগ্য, অর্ধযোগ্যদের দল আগামী কয়েক প্রজন্মের পড়ুয়াদের শিক্ষার মানের অধোগতির কারণ হয়ে ওঠে। সরকারি নীতি পঙ্গুত্বের কারণে স্কুলে কলেজে এমনিতেই নিয়োগের করুণ হাল। সরকারের ভ্রান্ত বদলি নীতির কারণে গ্রামে, জেলার স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আর এসবের সাথে যদি দুর্নীতির ঘুরপথে ভেজাল শিক্ষক নিয়োগ ঘটতে থাকে তাহলে তা হবে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা'। রাজ্যের প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীদের এমন দুর্নীতি যোগ সামনে আসার পর সাম্প্রতিককালে স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির কথা লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। ফলে সরকারি স্কুলে এমন নিয়োগ দুর্নীতিতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ ক্লাসে ক্লাসে ছাত্র এবং শিক্ষকের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় পারস্পরিক আস্থার ওপর, বিশ্বাসের ওপর, শ্রদ্ধার ওপর। আর দুর্নীতির জাঁতাকলে পড়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে পড়ুয়াদের এই প্রাথমিক আস্থা, বিশ্বাস কিংবা শ্রদ্ধার জায়গাটা ভেঙে গেলে সেটা জোড়া দেওয়া বড় কঠিন। ফলে সেই কঠিন পরিস্থিতিতে শেষমেশ আক্রান্ত হয় স্কুলের কিংবা ক্লাসঘরের শিক্ষার পরিবেশ। যে পরিবেশ এক দিনে, কিংবা একটা সরকারের মেয়াদে তৈরি করা যায়না, যার জন্য প্রয়োজন হয় এক যত্নের সামাজিক এবং সরকারি প্রয়াস। আর এই প্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে সরকারের অপদার্থতায় সরকারি স্কুলে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ফলে সেই স্কুলের মানের অবনমন ঘটলে একসময় পড়ুয়ার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে সিংহভাগ সরকারি স্কুল। কারণ জেনে বুঝে আপন সন্তানকে এমন স্কুলে কোনো মা বাবা পাঠাবেন না যেখানে গেলে মিড ডে মিল জুটলেও উন্নত শিক্ষা জুটবে না। ফলে সমাজের যে বিপুল নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়ারা আজ সরকারি স্কুলের ভরসাতে লেখাপড়া শেখে, এমন নিয়োগ দুর্নীতিতে তাঁদেরই পড়তে হবে মহা বিপদে। আজ অবধি এরাজ্যের উচ্চশিক্ষার সাফল্যের অন্যতম বড় কারণ রাজ্যের সরকারি এবং সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে উন্নতমানের শিক্ষা। আর শিক্ষার মানের পেছনে শিক্ষকের মান সবচেয়ে জরুরী অথচ সেখানেই যদি আপোষ ঘটে নিয়োগ দুর্নীতির পথ ধরে তখন সরকারি ক্ষেত্রে সত্যি হবে ‘শিরে সংক্রান্তি’। আর সেই সংক্রান্তির পথ ধরেই ঘটবে উন্নত বিকল্প হিসেবে শিক্ষার বেসরকারিকরণ। আর সে পথে ব্রাত্য হয়ে উঠবে প্রান্তিক মানুষদের জীবনে শিক্ষার অধিকার। তাই শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির প্রভাব সমাজে ঘটে চলা বহুস্তরীয় দুর্নীতির থেকে অনেকটাই ভিন্ন এবং এটির অভিঘাত সমাজজীবনে বহুমাত্রিক।
এই প্রেক্ষিতে সরকারি স্কুলশিক্ষায় রাজ্যে ধারাবাহিক দুর্নীতির প্রভাবে সরকারি ব্যবস্থা যে আদপে অদক্ষ অযোগ্য এটাই প্রমাণের চেষ্টা চলবে নতুন উদার অর্থনীতির প্রচারের আবহে। যেভাবে কর্মী সংকোচন করে, আত্মঘাতী নীতি গ্রহণে বাধ্য করে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বীমা, রেল কিংবা স্বাস্থ্য পরিষেবায় বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করেছে স্বয়ং দেশের সরকার ঠিক সে পথেই এই নিয়োগ-নৈরাজ্য তুলে আনবে সরকারি স্কুল শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা এবং অস্তিত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন! বৃহত্তর বিপদের বীজ লুকিয়ে আছে এখানেই। এই বিপদ সম্পর্কে সরকারকে সচেতন করার দায়িত্ব আজ বৃহত্তর নাগরিক সমাজেরই।