আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩২

প্রবন্ধ

শিবাজী এবং ইতিহাসের বিকৃতি

রঞ্জন রায়


মুখবন্ধ

আমাদের দেশে এখন ইতিহাসের পাতা থেকে নতুন নায়ক তৈরির খেলা চলছে। ঠারেঠোরে প্রতিদিন বোঝানো হচ্ছে যে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ হিন্দোস্তাঁ বা হিন্দুস্তান নয়, আসল নাম হিন্দুস্থান - যেখানে হিন্দুদের নিবাস। অন্যেরা, বিশেষ করে মুসলমানেরা বাইরে থেকে আসা আক্রমণকারী।

এর জন্য দরকার ইতিহাসের পাতা থেকে নতুন নতুন নায়ক খুঁজে বার করা এবং সেই প্রক্রিয়ায় তাদের মেটামরফোসিস করে হিন্দুত্বের জন্য সমর্পিত প্রাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এই কাজটি করতে গেলে ইতিহাসের তথ্যকে বিকৃত করতে হবে।

যেমন শিবাজী, রাণা সঙ্গা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে আমাদের নেতাজী সুভাষচন্দ্র এবং সাভারকর।

আজকে আমরা পশ্চিম ও উত্তর ভারতে শিবাজীর মিথ এবং ভাবমূর্তি নিয়ে কিছু কথা বলব।

শিবাজী কি ঈশ্বরের অবতার?

অনেকের বিশ্বাস যে শিবাজী শিবের অবতার, কেউ বলেন বিষ্ণুর অবতার। সত্যি কথা, আমাদের দেশে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপরে দেবত্ব আরোপ করতে বেশি সময় লাগে না। ফলে তাদের অনেক অলৌকিক ক্ষমতার গল্প তৈরি হয়। যেমন, শিবাজীর নাকি অদৃশ্য হওয়ার এবং নভচর হওয়ার ক্ষমতা ছিল।

শিবাজী নিঃসন্দেহে একজন সাহসী ও কুশলী যোদ্ধা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক ছিলেন। তিনি অবতার নন, বরং নীতিবোধ সম্পন্ন বড় মাপের মানুষ ছিলেন।

তবে শিবাজীকে অবতার বানালে অনেক সুবিধে। যদি বলি - শিবাজীর মতো হও। চাষিদের ফসল লুঠে নিও না। ধর্ষকদের আড়াল কোরো না। নিজের ধর্মকে ভালবাসো, কিন্তু অন্যের ধর্মকে ঘৃণা কোরো না।

ব্যস, অমনি শোনা যাবে - উনি তো ঈশ্বরের অবতার, আমরা হলাম সাধারণ মানুষ। আমরা কি করে ওঁনার মতো আচরণ করব?

শিবাজী প্রজা ও চাষিদের পক্ষ নিয়েছিলেন। তাঁর কর নির্ধারণ পদ্ধতি এবং সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে লেখা চিঠি এর প্রমাণ। কিন্তু শিবাজীর আজকালকার নকল ভক্তের দল?

ওরা শিবাজীর নাম নেয় অন্যদের ভয় দেখাতে। আমাদের বুঝতে হবে ইতিহাসের শিবাজীকে; চিনে নিতে হবে ওঁর সত্যিকারের অনুগামী ও নকল ভক্তদের।

শিবাজী এবং ভবানী তরবারি

শিবাজীর সাফল্যের চাবিকাঠি কী? এটা কি সত্যি যে উনি মা ভবানীর বরে প্রাপ্ত তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে জেতেন, তাই বিজয়ী হতেন? মহারাষ্ট্রের জনৈক মুখ্যমন্ত্রী লন্ডনের রাষ্ট্রীয় সংগ্রহালয় থেকে শিবাজীর ওই তরবারি ফেরত আনার প্রতিজ্ঞা করে একসময় ভাল ফুটেজ খেয়েছিলেন।

গবেষকরা দেখিয়ছেন যে শিবাজীর তরবারিটি আসলে পর্তুগালে তৈরি হয়েছিল। সে যুগে ইউরোপে বিভিন্ন সংকর ধাতুর থেকে অস্ত্র ঢালাই করে তলোয়ার তৈরির শিল্পকলা বেশ উন্নত হয়েছিল। ওই তলোয়ারটি পর্তুগীজদের সঙ্গে গোয়ায় পৌঁছে যায়, সেখান থেকে মারাঠি সন্তদের হাত ঘুরে শিবাজীর কাছে যায়। সাতারা শহরের মিউজিয়ামে একটি তলোয়ার আছে। অনেকে বলে ওটাই নাকি শিবাজীর ভবানী তলোয়ার। এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু যে কেউ কাছে গিয়ে তলোয়ারটি ভাল করে দেখুন। তাতে পর্তুগীজ ভাষায় খোদাই করা কিছু শব্দ চোখে পড়বেই।

মহান ব্যক্তিদের ট্র্যাজেডি

ইতিহাসের নায়কদের কপালে ভোগান্তি আছে। বেঁচে থাকতে কেউ তাঁর কথা শোনে না। ক্ষমতাসীন লোকেরা তাঁদের আদর্শের বিরোধ করে, কাজ করতে দেয় না। বরং জনমানসে তাঁদের ছাপ মুছে ফেলার এমনকি প্রাণনাশের চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু তারা সবসময় সফল হয় না। কারণ, সাধারণ মানুষ জীবিতকালে তাঁদের স্বীকার করে এবং মৃত্যুর পর তাঁদের ভাবধারায় দীক্ষিত হয়ে কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

কিন্তু ক্ষমতার পীঠাসীন লোকেরা খুব চালাক। তারা যাঁর জীবিতকালে বিরোধিতা করে তাঁদেরই মৃত্যুর পর পুজো করতে শুরু করে। খালি একটা চালাকি করে। তাঁদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পক্ষে বলা কথাগুলো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিয়ে ভাবাদর্শকে জল মিশিয়ে পানসে করে দেয়। ওরা সতর্ক থাকে যাতে মহামানবের বিদ্রোহের কন্ঠস্বর নিপীড়িতের কানে পৌঁছতে না পারে। তারা সত্যের সঙ্গে অসত্য মিশিয়ে এক নতুন এবং জালি ইতিহাস রচনা করে।

ধ্যানেশ্বর (১২৭৫-৯৬) পরম্পরাগত জ্ঞানভান্ডারকে সংস্কৃত থেকে মুক্ত করে প্রাকৃত ভাষায় নিয়ে এলেন যাতে তা সাধারণের বোধগম্য হয়। অভিজাতকুল তাঁকে শাস্তি দিল সমাজে বহিষ্কার করে, তাঁর সহোদর ভাইদের ‘সন্ন্যাসীর সন্তান’ বলে বদনাম করে। ধ্যানেশ্বর অল্প বয়সে ‘সঞ্জীবন সমাধি’ নিলেন, অর্থাৎ তাঁকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দেওয়া হল!

তাঁর মৃত্যুর পর ওরাই জুটে গেল দিনরাত ওঁর বন্দনাগীত গাইতে, বলল ইতিহাসে এমন কেউ হয়নি, হবেও না।

সন্ত তুকারামকে (১৬০৮-৪৯) সইতে হল মাম্বাজীর অত্যাচার। তাঁর রচিত ‘অভঙ্গ’ ও ‘গাথা’ ইন্দ্রায়নী নদীতে ফেলে দেওয়া হল। তাঁর মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত। রটিয়ে দেওয়া হল তাঁর শরীর ও আত্মা সোজা বৈকুন্ঠে পৌঁছে গেছে!

দেখা গেল যে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়ার পরও তাঁর ‘অভঙ্গ’ জনতার কন্ঠে ও স্মৃতিতে বেঁচে রয়েছে। মাম্বাজীর উত্তরাধিকারীরা নিরুপায় হয়ে তাঁর গীতে মিশিয়ে দিল নিজেদের রচনা এবং সেই ভেজাল গীতকে তুকারামের ভজন বলে গাইতে লাগল।

বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর অনেক পাড়ায় মিঠাই ও ঘি বিতরণ করা হয়েছিল। হত্যার ষড়যন্ত্রে যাঁরা সামিল ছিল তাঁদের কয়েকজনের ফাঁসি হল, বাকিরা ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল। ইদানীংকালে বলা হয় যে "ও তো এক পাগলের কাণ্ড!" তাই কি? নাথুরাম গডসেকে তো আজও প্রতিবছর শহীদের সম্মান দিয়ে স্মরণ করা হয়।

গান্ধীজিকে শেষ করার উত্তম উপায় হল তাঁর আদর্শকে বাদ দিয়ে তাঁর ভক্ত সাজা।

শিবাজীও ব্যতিক্রম ন’ন।

শিবাজী এবং ব্রাহ্মণসমাজ

শিবাজীকে যেসব অভিধায় ভূষিত করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয় ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বা গরু ও ব্রাহ্মণের রক্ষাকর্তা উপাধিটি।

কিন্তু শিবাজীর লেখা সব চিঠিপত্র পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রমাণিত - যা আজ সহজলভ্য। কোথাও উনি নিজেকে ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলেননি। তাঁর সমকালীন কেউই তাঁকে ওই অভিধায় সম্বোধিত করেন নি। বরং প্রত্যেকটি চিঠিতে উনি নিজেকে বলেছেন ‘ক্ষত্রিয় কুলবতংশ শ্রী রাজা শিব ছত্রপতি’।

শিবাজীকে নিয়ে প্রচূর কাজ করেছেন বি. এম. পুরন্দরে। উনি বলেছেন যে 'শিব চরিত্র সাধন' (খণ্ড ৫, আর্টিকল ৫৩৪ ও ৫৩৭) পড়লে দেখা যাবে যে শিবাজী নিজেকে ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলতেন!

কিন্তু বিদ্বান গবেষক টি. এস. শেজওয়লকার ওই সাক্ষ্য পরীক্ষা করে বলেছেন - বাজে কথা! শিবাজী কোথাও নিজেকে এসব বলেননি। আর্টিকল ৫৩৭-এ ওই শব্দটি একেবারে নেই। আর ৫৩৪-এ একজন ব্রাহ্মণ চিঠি লিখে শিবাজীকে ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলে সম্বোধন করেছেন, শিবাজী কদাপি নন। রাজার কাছে ভিক্ষাপ্রার্থী ব্রাহ্মণ রাজাকে এভাবে বলবে এতে আশ্চর্যের কী আছে?

গ্র্যান্ট ডাফের বই ‘দ্য হিস্ট্রি অফ মারাঠাজ’ এ দেখা যায় শিবাজী গোধন, রায়ত ও স্ত্রীলোকদের থেকে লুন্ঠনের বিরুদ্ধে নিজের সৈন্যদের কড়া করে নিষেধ করেছিলেন। শিবাজীর রাজত্বে ব্রাহ্মণদের কোনো বিশেষ অধিকার বা ছাড় ছিল না। একটি চিঠিতে দেখা যাচ্ছে যে শিবাজী এক দোষী ব্রাহ্মণের বিষয়ে বলছেন - অপরাধী শাস্তি পাবে, ব্রাহ্মণ বলে কোনো আলাদা নিয়ম হবে না। তাহলে ‘গো-রায়ত-স্ত্রী’ প্রতিপালক কীভাবে হঠাৎ ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক হয়ে গেল? ‘রায়ত’ বা প্রজার জায়গায় ‘ব্রাহ্মণ’ বসানো হল? বুঝতে রকেট সায়েন্স লাগে না।

সমস্ত ব্রাহ্মণ শিবাজীর পক্ষে ছিল না। কিছু ব্রাহ্মণ ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি মির্জা রাজা জয়সিংহের বিজয় এবং শিবাজীর পরাজয় কামনায় ‘কোল চণ্ডী যজ্ঞ’ করেছিল। হিন্দুধর্ম এবং গো-ব্রাহ্মণের প্রতিপালক শিবাজীর পরাজয় কামনায় যজ্ঞ!

শিবাজীর ‘ছত্রপতি’ হওয়ার বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ সমাজ

অনেক ব্রাহ্মণ শিবাজীর অভিষেকের বিরুদ্ধে ছিলেন। কেন? বর্ণাশ্রম সংস্কারের হিসেবে এটা নাকি শুধু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের অধিকার।

শিবাজী কি ক্ষত্রিয়? সন্দেহ আছে। আর হলেই বা কি! ওঁর নিয়ম মেনে উপনয়ন হয়নি। বিয়েটাও ঠিক বিধি মেনে হয়নি। তাহলে রাজা হবেন কী করে? খরচ আছে না? কেউ বললেন - নন্দবংশের পর ক্ষত্রিয় শেষ! (নন্দন্তম্‌ ক্ষত্রিয় কুলম্‌)। কেউ বললেন - পরশুরাম তাঁর কুঠারে ধরার বুক থেকে সমস্ত ক্ষত্রিয়দের শেষ করে দিয়েছিলেন। তাহলে কোনো ক্ষত্রিয় কী করে সিংহাসনে বসতে পারে?

মহারাষ্ট্রের কোনো ব্রাহ্মণ শিবাজীর অভিষেকে পৌরোহিত্যে রাজি হল না। শেষে বারাণসী থেকে গঙ্গা ভট্টকে এনে বৈদিক রীতিতে অভিষেক সম্পন্ন হল।

কিন্তু শিবাজীর ‘স্বরাজ্য’ মন্ত্রীসভায় সাথী ছিলেন অনেক ব্রাহ্মণ। কেউ সেনাপতি, কেউ প্রশাসক। যেমন পুণের দায়িত্বে থাকা দাদাজী কোণ্ডদেব, পেশোয়া মোরপন্ত পিঙ্গলে, আন্নাজী দত্তো এবং দত্তাজী ত্র্যম্বক। শিবাজীর আগ্রা থেকে গোপনে পালিয়ে আসায় সাহায্য করেছিলেন চারজন ব্রাহ্মণ।

আসলে শিবাজীর অভিষেকে ব্রাহ্মণদের আপত্তির কোন ব্যক্তিগত কারণ ছিল না। হিন্দুধর্মের মৌলবাদী ব্যাখ্যায় মনুস্মৃতি অনুযায়ী কোনো শূদ্র রাজ্যাভিষেকের অধিকারী নয়, কারণ সে জন্মেছে প্রজাপতি ব্রহ্মার পাদদেশ থেকে। শেষে শিবাজী চুয়াল্লিশ বছর বয়সে গঙ্গা ভট্টের পৌরোহিত্যে উপবীত গ্রহণ করলে এবং বৈদিক রীতিতে স্ত্রীকে পুনর্বিবাহ করলে তবে তাঁর অভিষেক সম্পন্ন হল।

শিবাজী অন্য সমস্ত ইতিহাস-পুরুষদের মতো তাঁর সময়ের ফসল। নিঃসন্দেহে উনিও তাঁর কালখণ্ডের সংস্কারে আবদ্ধ ছিলেন।

শিবাজী কি শূদ্র ছিলেন?

এ নিয়ে বিতর্ক আজও অব্যাহত। শিবাজীর সমসাময়িক উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও অভিজাত বংশীয় ৯৬টি মারাঠা পরিবার তাঁকে শূদ্র ভাবত; তাঁর ‘রাজা’ উপাধি জুড়ে চিঠিতে দস্তখত করায় আপত্তি করত। তাঁরা নিজেদের ‘পাতিল’ পদবী লিখত। জাবালীর রাজা চন্দ্ররাও মোরে উপরোক্ত কারণে শিবাজীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিল।

তাঁর পদবী ছিল ভোঁসলে। আজও জাতটাত মেনে সম্বন্ধ করে বিয়ে করার সময় পাতিলরা ভোঁসলেদের ‘নিম্নবর্ণ’ ভাবে।

সমাজ সংস্কারক মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে (তাঁর ‘গোলামগিরি’ বইটা পড়ে দেখার মতো) শিবাজীর বন্দনায় একটি গাথা রচনা করেছিলেন। তাতে উনি শিবাজীকে ‘কুলওয়াড়ি ভূষণ’ বলেছেন। ব্যালাডের শেষে ভণিতায় বলছেনঃ "জ্যোতিরাও ফুলে গায় - হে শূদ্র-সন্তান"!

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে ভোঁসলেরা এবং শিবাজী দলিত ছিলেন, ক্ষত্রিয় নন।

তবে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। আজকের অনেক ঐতিহাসিক শিবাজীকে রাজপুতানা থেকে আগত রাজপুত বংশাবতংস হিসেবে দেখাতে চান। তবে শিবাজীর বংশের জাত নিয়ে বিতর্ক আজ অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক।

শিবাজীর কৃষক সাথীরা

শিবাজীর ‘স্বরাজ’ পরিকল্পনায় এবং তার প্রয়োগে কারা শিবাজীর পাশে ছিল? কারা লড়াই করেছিল? ইতিহাস সাক্ষী - অধিকাংশই নিম্নবর্ণের গরীব চাষির দল। তাঁর সৈন্যবাহিনীর মেরুদন্ড ছিল ‘মাওলা’ কৃষকেরা।

শিব এবং জীব মহালা ছিল জাতে নাপিত। ওরা ওঁকে পানহালা দুর্গ থেকে পালাতে সাহায্য করেছিল। আফজল খাঁকে বাঘনখ দিয়ে হত্যার সময় শিবাজীর সঙ্গে ছিল জীব মহালা শংখপাল। শিবাজীর গুপ্তচর বিভাগের প্রধান ছিল বাহিরজী নায়েক - অস্পৃশ্য রামোশী সম্প্রদায়ের। ‘সভাসদ বাখার’ গ্রন্থ বলছে শিবাজীর ঐতিহাসিক মিশনে কিছু ব্যক্তিবিশেষ নয়, নীচুতলার গোটা সম্প্রদায় যুক্ত হয়েছিল।

ওঁর নৌবাহিনীর প্রধান ছিল একজন মুসলমান। অধিকাংশ নাবিক এবং নৌসেনারা এসেছিল কোলি, সংখোলি, ভান্ডারি ও মুসলমান সম্প্রদায় থেকে। এইভাবে শিবাজী তাঁর ‘স্বরাজ্যে’ যথাস্থিতি ভেঙে দিলেন। এই কারণেই উচ্চবর্ণ ও অভিজাত কুলের সামন্তেরা গোড়ায় ওঁর বশ্যতা স্বীকার করেনি বা পক্ষে দাঁড়ায়নি। কারণ তারা চাইছিল সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে।

শিবাজীঃ ধর্মপরিবর্তন, কুসংস্কার ইত্যাদি

শিবাজী হিন্দু ছিলেন, কিন্তু ‘অসহিষ্ণু হিন্দু’ নন। সে যুগে নিজের ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হলে "নিধনং শ্রেয়ঃ", ফিরে আসার পথ নেই। শিবাজীর পরবর্তী পেশোয়া শাসকেরা ওই গোঁড়া হিন্দুত্বের পথই বেছে নিয়েছিলেন। পেশোয়া বাজীরাও-এর স্ত্রী মস্তানী ছিলেন মুসলমান। তাই বাজীরাও নিজের ছেলে শমসের বাহাদুরকে চেষ্টা করেও হিন্দুসমাজে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না।

অথচ শিবাজীর সময়ে বাজাজি নিম্বলকর ও নেতাজি পালকর ইসলাম গ্রহণ করে দশ বছর মুসলমান রইলেন। তারপর ইসলাম ছেড়ে ফিরে এলেন হিন্দুসমাজে। শিবাজী নিজের মেয়েকে বিয়ে দিলেন বাজাজী নিম্বলকরের ছেলের সঙ্গে। ছেলেকে খৎনা করার জন্য ‘কাটোয়া’ বলা হতো।

নেতাজি পালকর মুসলমান হয়ে আফগানিস্থানে আট বছর কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। তারপর শিবাজীর উপস্থিতে ফের হিন্দুসমাজে যুক্ত হলেন।

শিবাজী অস্পৃশ্য মাহার (প্রসঙ্গতঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর একজন মাহার) দলপতিকে কেল্লার কম্যান্ডার বানিয়েছিলেন। অথচ পরবর্তী পেশোয়া রাজত্বে ‘মাহার’দের কোমরে ঝাঁটা বেঁধে পথে চলতে হতো, যাতে রাস্তা আপনাআপনি সাফ হয়ে যায়!

শিবাজী প্রচলিত কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তখন বলা হতো যে কোন শিশু যদি মায়ের পেট থেকে উপুড় হয়ে জন্মায় তাহলে সেটা পরিবারের জন্যে অশুভ। শিবাজীর ছেলে রাজারাম এভাবেই উলটো হয়ে জন্মাল। সবাই আতংকিত। শিবাজী হেসে বললেন - উলটো হয়ে জন্মেছে? এ ছেলে ভবিষ্যতে মোগল সাম্রাজ্যকে উলটে দেবে!

ঋণ স্বীকারঃ হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণে নিহত মুম্বাইয়ের মারাঠি বুদ্ধিজীবী গোবিন্দ পানসরের বই - 'হু ওয়াজ শিবাজী'।


তথ্যসূত্রঃ

● গোবিন্দ পানসরে, 'হু ওয়াজ শিবাজী'?, পৃঃ ৯২।
● ঐ, পৃঃ ৭৫।
● গোবিন্দ পানসরে, 'হু ওয়াজ শিবাজী?', পৃঃ ৭৬।
● ঐ, পৃঃ ৮০।
● ঐ, পৃঃ ৮২।
●‘বাখার’ হল মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ লোক-কবিদের রচিত ব্যালাড বা গৌরবগাথার সংকলন।
● ঐ, পৃঃ ৮৫।