আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩২

প্রবন্ধ

ওয়াকফ বিক্ষোভ থেকে হিন্দুত্ববাদঃ পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তিত সাম্প্রদায়িক সমীকরণ

সুমন নাথ


সাম্প্রতিক কালে একই পরিবারের পিতা ও পুত্রের দাঙ্গায় মৃত্যু, যা পশ্চিমবঙ্গের ওয়াকফ বিক্ষোভের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে তা নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই হিন্দুত্ববাদীরা এবং শাসকদল নিজস্ব ন্যারেটিভ প্রচারে ব্যস্ত। ঘরছাড়া হিন্দু পরিবারের অসহায়তা সঙ্গত কারণেই দেশভাগের ক্ষত জাগিয়ে তুলেছে। সংসদে এই সংশোধিত ওয়াকফ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে, বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই উল্লসিত, এবং তাঁদের আচমকা দরিদ্র মুসলমান প্রীতি আর যারাই হোক মুসলমান সমাজ যে সন্দিহান ভাবে দেখছেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। একথা বলাই যায় যে নতুন ওয়াকফ আইনের হস্তক্ষেপের পরিধি নিয়ে বিভ্রান্তি ও গুজব রয়েছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যখন এই বিলের বিরুদ্ধে দাখিল করা পিটিশনগুলির তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে, তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ জেলায় সাম্প্রদায়িক হিংসা খবরের শিরোনামে। এই ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণগুলি বোঝার জন্য নিবিড় নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রয়োজন।

হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি রাজ্যে ইসলামপন্থী বিশুদ্ধতাবাদী সংগঠনগুলির উত্থানকে সর্বদা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে। শাসকদল তাদের সমর্থন ভিত্তি তৈরি করেছে এই সাংগঠনিক ভিত্তিকে ব্যবহার করে, এবং বাম-কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে ক্রমবর্ধমান ইসলামিক মৌলবাদকে উপেক্ষা করেছে। এই প্রসঙ্গে আমরা ২০১৬ সালের কালীয়াচক থানা আক্রমণের কথা স্মরণ করতে পারি, প্রাথমিকভাবে যা মুসলিম-প্রধান এলাকায় (৫১.২৭%) সাম্প্রদায়িক ঘটনা বলে মনে করা হলেও, আমরা এক সচেতন প্রয়াস 'ফোরাম' নামক একটি তথ্য-সন্ধানী দল এটিকে হিন্দু মহাসভার এক নেতার আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদে মুসলিমদের একটি মিছিলকে কাজে লাগিয়ে অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত বলে জানতে পারে। লক্ষ্য ছিল পুলিশের নথি, হিন্দুরা নয় (স্থানীয়ভাবে প্রায় ১০%), যাদের সম্পত্তি মূলত অক্ষত ছিল। তা সত্ত্বেও, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। উক্ত প্রতিবেদনে মেরুকরণ রোধে আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

ধারাবাহিক বহু-স্থানিক নৃতাত্ত্বিক কাজ দেখায় যে তৃণমূল স্তরে ইসলামের উগ্রতার বৃদ্ধি একটি দীর্ঘমেয়াদী ঘটনা যা পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্বের উত্থানের সমসাময়িক।

প্রথমত, বাংলায় প্রচলিত সমন্বয়ী, তুলনামূলক উন্মুক্ত এবং লোকায়ত সুফি-পীর ঐতিহ্য এবং বিশুদ্ধতাবাদী ওয়াহাবি/সালাফি আদর্শের মধ্যেকার বৈপরীত্য সম্পর্কে অজ্ঞতা রয়েছে। যদিও এই দুই-এর তাত্ত্বিক পার্থক্য বিদ্যমান, দুটি বিস্তৃত ঐতিহ্যের দৈনন্দিন আচার-অনুষ্ঠান প্রায়শই 'সরল অজ্ঞতা'র কারণে এই বিভাজনগুলিকে অস্পষ্ট করে তোলে। এই অজ্ঞতা, অভিন্ন ইসলামিক পরিচয়কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এই ঘটমান বাস্তবতা লৌকিক ইসলাম এবং তার উন্মুক্ততার পরিপন্থি। এর ফলে সুফি মাজারের উপর মৌলবাদের আক্রমণ বহু অঞ্চলের রোজকার ঘটনা যা কঠোর ইসলামিক রীতিনীতির দিকে সমগ্র মুসলমান সমাজকে পরিচালিত করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ পান্ডুয়ার একটি সুফি মাজারে মহিলাদের ও হিন্দুদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং হুলাসপুরে পীর বদর মাজারে আক্রমণ ইত্যাদির কথা মনে করা যায়।

রেজিনগর-এর একটি তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে উক্ত এলাকায় ২০১০ সালের পর মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। একেকটি মসজিদের চাকচিক্য স্থানীয় অভাবী মানুষের উপস্থিতির সাথে এক অদ্ভুত বৈপরিত্যে অবস্থান করে। একজন স্থানীয় ইমাম পীরপন্থীদের মাজার ভক্তি এবং সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতি পছন্দের সমালোচনা করেছিলেন। এই সমীক্ষা দেখায় যে ২০১০ সাল থেকে শরিয়তি গোষ্ঠী সুফি ঐতিহ্যের মাজার-এর বিরুদ্ধে সংঘটিত আক্রমণ চালিয়েছে। ২০১০ সালে নাজিরপুরের দরগাহগুলিতে উরস্ উদ্যাপনের দিনে এবং ২০১৬ সালে কাদিরিয়া অনুসারীদের উপর হামলা এবং ফতোয়া দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্তরা অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় সংঘাত এবং মসজিদ সংগঠনগুলির উপর শাসকদলের প্রভাবের কারণে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ করেছেন। বাউল-ফকির সঙ্ঘের এক সদস্য তাদের সমন্বয়ী রীতিনীতির জন্যেই যে তাঁরা পীরপন্থীদের আক্রমণের লক্ষ্য একথা উল্লেখ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, সমসাময়িক ইসলামিক জলসা, যা আদপে একটি দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যমণ্ডিত ধর্মীয় সমাবেশ, তা এই অভিন্ন ইসলাম নির্মাণ প্রক্রিয়াতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। দান (যাকাত)-এর মাধ্যমে অর্থায়িত এই অনুষ্ঠানগুলিতে স্থানীয় ইমামরা "আদর্শ ইসলামিক জীবনযাপন"-এর নিয়মাবলী নির্ধারণ করেন, যার মধ্যে নির্দিষ্ট দোয়া, শুধুমাত্র মুসলিমদের মধ্যে সামাজিক ও ব্যবসায়িক মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি এবং খারিজী মাদ্রাসাগুলিতে ভর্তির উৎসাহ প্রদান অন্তর্ভুক্ত। এই জলসাগুলি প্রায়শই আগ্রাসী ঘোষণার মাধ্যমে একটি হিংসাত্মক পরিবেশ তৈরি করে কঠোর আদর্শ মুসলিম প্রোটোটাইপকে শক্তিশালী করে।

তৃতীয়ত, মসজিদ কমিটি এবং স্থানীয় রাজনীতির মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রেজিনগরে, মসজিদ ও তাদের কমিটিগুলির সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে, বিশেষ করে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের বেতন দেওয়ার রাজ্য সরকারের উদ্যোগের পর, ২০১২ সালের পর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তৃণমূলের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা যায়। যদিও কিছু স্থানীয় লোক মাজার ভক্তির গভীর ঐতিহ্যের কথা স্বীকার করেছেন, তবে মসজিদের বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান এবং তার ক্রমবর্ধমান শক্তির কাছে অসংগঠিত লৌকিক ইসলাম আক্ষরিক অর্থেই দুর্বল। গ্রাম বাংলায় মসজিদ সংগঠন তাঁদের রাজনৈতিক সংযোগ ক্রমাগতই ইসলামিক রীতিনীতির অন্যান্য স্থানীয় রূপগুলিকে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছে।

সুফি ঘরানাকে প্রস্থাপিত করে শরিয়া ইসলাম-এর উত্থান রাজ্যে হিন্দুত্বের উত্থান, অস্থির বাংলাদেশ এবং ধর্মীয় রাজনীতির বহুল ব্যবহার-এর প্রেক্ষাপট বোঝা জরুরী, যা সমসাময়িক ভারতে সামাজিক বিভাজনের একটি প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। যদি কলকাতায় এক বাসচালককে গেরুয়া পতাকা সরাতে বাধ্য করার অভিযোগে উগ্র ইসলামিক লোকেদের ছবি প্রচারিত হয়, তবে ইসলামিক উপাসনালয়ে অনুরূপ পতাকা স্থাপনকারী উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ছবিও একই সাথে এবং একই রাজনৈতিক প্রয়োজনে প্রচারিত হয়। এই প্রচার 'অপর' নির্মাণের একটি নিরবিচ্ছিন্ন এবং অভিন্ন প্রক্রিয়ার অংশ, যা আদিম পরিচয়, দেশভাগের স্মৃতি এবং নতুন করে উদ্ভাবিত ভয় (যেমন, হিন্দুরা বিপদে, মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি) ব্যবহার করে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দূরত্ব বাড়িয়ে তোলে। এর বিরোধিতা করা বুদ্ধিজীবীদেরও 'অপর' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

মুর্শিদাবাদের আজকের ঘটনা এই ধারাবাহিকতার ফসল। এটি উপলব্ধি করা জরুরী যে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক ঘটনার বাড়বাড়ন্ত সবসময়েই 'বহিরাগত' (সংগঠিত শক্তি) দ্বারা পরিকল্পিত নয়। বরং, এই ঘটনা অভ্যন্তরীণ হিন্দু/মুসলিম বিভাজনের ফলস্বরূপ। শুরুর দিকের ঘটনা যেমন বাদুরিয়া-বসিরহাট, ধুলাগড় ইত্যাদিতে বহিরাগতের উপস্থিতি ছিল মূল চর্চার বিষয়, আজকের ঘটনাগুলি নির্দেশিত করে স্থানীয় স্তরের মৌলবাদ এবং প্রতিবেশীর প্রতি অবিশ্বাস। বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গে, আত্মপরিচয় কেন্দ্রিক অতিসংবেদনশীল এলাকা নির্মিত হয়েছে। আমরা এই এলাকাগুলিকে মূলত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি: ক) জুটমিল এলাকার মতো অনিশ্চিত শিল্পাঞ্চল, খ) অস্থির সীমান্ত এলাকা এবং গ) মিশ্র জনসংখ্যার এলাকা। এই প্রতিটি অঞ্চলে আমরা যেমন দেখছি রাম নবমীর মিছিল, হনুমান মন্দির কেন্দ্রিক রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, তেমনই আগ্রাসী ইসলামী জলসা, 'নারা-এ-তকবীর' রণহুংকার এবং স্মরণীয় অতীতে একাধিক দাঙ্গার ঘটনা। আজকের এই অস্থির রাজ্য নির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে বর্তমানে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলগুলির ইচ্ছাকৃত প্রশ্রয়। বিজেপি এবং আরএসএস-এর ঘোষিত কর্মসূচি যদি হিন্দুত্বের সম্প্রসারণ হয় সেক্ষেত্রে তা প্রতিহত করার মূল দায়িত্ব যাঁদের, সেই শাসকদলের তরফ থেকে কিছু মৌখিক বিবৃতি ছাড়া বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বরং ২০১৫-২০১৬ সালের পর থেকে দেখা যাচ্ছে কে বেশী হিন্দু সেই কুৎসিত প্রতিযোগীতায় রাজ্যের শাসক এবং প্রধান বিরোধী দল এককাট্টা। এমত অবস্থায় মুসলমান সমাজ, যেসকল এলাকায় নিতান্তই সংখালঘু সেখানে শাসকদলকে ভাবছেন তাঁদের শেষ আশ্রয় এবং প্রশ্রয়দাতা, আর যেখানে সংখাগুরু সেখানেই তাঁরা হয়ে উঠছেন অতিসক্রিয় এবং উগ্র। এই পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের দমন পীড়ন হয়ে পড়ছে অনিবার্য এবং শান্তি অবশ্যই ক্ষণস্থায়ী।

পরিশেষে বলাই বাহুল্য এই রাজ্য বহু বছর ধরেই পরিচয় সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, যা কেবল উপেক্ষা করা হয়নি বরং উৎসাহিতও করা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির উত্থান এবং ওয়াকফ বিক্ষোভের সাম্প্রতিক সহিংসতা একটি মৌলিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। পশ্চিমবঙ্গে সুফি ঐতিহ্যের সাথে ক্রমবর্ধমান বিশুদ্ধতাবাদী ইসলামের সংঘর্ষ, রাজনীতিকৃত মসজিদ নেটওয়ার্ক এবং হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক বিভাজনকে কাজে লাগানোর একটি জটিল পারস্পরিক ক্রিয়া বিদ্যমান। তৃণমূল স্তরের হিন্দুত্ববাদী উগ্রতা, সুফি স্থানগুলিতে হামলা এবং মেরুকরণকারী জলসাগুলি এক নতুন ধরনের গণপরিসর নির্মাণ করেছে যার দরুন এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসা এখন এ রাজ্যের রোজনামচা।