আরেক রকম ● ত্রয়োদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৫ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩২
সমসাময়িক
রক্তাক্ত প্যালেস্টাইন
“কতটা কান পাতলে পরে কান্না শোনা যাবে
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে
বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে”
আজও এই গান বড় প্রাসঙ্গিক। ইতিহাসের রক্তাক্ত পুনরাবৃত্তিতে আজ আবারও পুড়ছে প্যালেস্টাইন। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে শুরু হওয়া ইজরায়েলের সামরিক অভিযান ইতোমধ্যেই শতশত শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে বাধ্য করেছে। গোটা গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে হাসপাতাল, বিদ্যালয়, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং গণপরিবহণের পরিকাঠামো। হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যারা কখনও এ দেশ ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি, কিংবা যারা সেই ছোটবেলাতেই শিখছে - বাবা-মায়ের আদরের ডাকের বদলে বোমার শব্দে ঘুম ভাঙে মানুষের। ইজরায়েলের এই নিপীড়ন রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত, পরিকল্পিত ও নির্মম। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা ও তার ন্যাটো মিত্ররা এই আগ্রাসনকে “আত্মরক্ষার অধিকার” বলে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। অথচ এই আত্মরক্ষার ছুতোয় একেবারে খোলা চোখে চলছে একটি জাতির অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার প্রয়াস।
প্যালেস্টাইন সংকটকে বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা ছিল সেই উপনিবেশিক যুগেরই এক নিদর্শন, যেখানে ব্রিটিশ সরকার একতরফাভাবে এই অঞ্চলে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে সমর্থন জানায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, নাৎসি বাহিনীর নির্মম গণহত্যার শিকার ইউরোপীয় ইহুদি জনগণের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের সহানুভূতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক আধিপত্য কায়েমের অভিপ্রায়ে ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া হয় ১৯৪৮ সালে। এই রাষ্ট্র গঠনের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা নেয় একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক মতবাদ - জায়নবাদ, যার লক্ষ্য ছিল একটি ‘বিশুদ্ধ’ ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। প্যালেস্টাইনের মাটি থেকে প্রায় সাত লক্ষ আরব অধিবাসীকে উচ্ছেদ করে তৈরি হয় এই রাষ্ট্র, ইতিহাসে যা ‘নাকবা’ নামে পরিচিত। ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাষ্ট্রটি তার সীমানা বাড়াতে থাকে, পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় বারবার সামরিক আগ্রাসন চালায়। প্যালেস্টাইনের জনগণ যেসব গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে সামনে রেখে তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, যেমন ইয়াসের আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ ও পিএলও, তাদের আন্দোলনকে ভাঙতে ইজরায়েল নিজেই গোপনে আর্থিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে তৈরি করেছিল 'হামাস' নামক একটি চরমপন্থী ইসলামপন্থী সংগঠন। উদ্দেশ্য ছিল প্যালেস্টাইন আন্দোলনের রাজনৈতিক ঐক্যকে বিভক্ত করা এবং আন্দোলনটিকে ধর্মীয় চেহারা দিয়ে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি কমানো। আজ সেই হামাসই পরিণত হয়েছে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে, যা নানা সময়ে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হিংসাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে, আবার অনেক সময় প্রতিরোধের প্রতীকও হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর অস্তিত্ব ও কার্যকলাপ প্যালেস্টাইনের প্রকৃত গণআন্দোলনের বদলে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়া বিস্তার করেছে। আর আজকে তারা প্যালেস্টাইনবাসীর সাথে সেই কাজটিই করছে যা নাৎসীরা তাদের সাথে করেছিল। ইজরায়েল আজ গোটা প্যালেস্টাইনকে কিছু ‘ঘেটো’তে পরিণত করতে চাইছে। সময় চলে যায়। একদা উৎপীড়িত আজ নিজেই উৎপীড়ক। ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস - "History repeats itself, first as a tragedy, second as a farce"।
এই প্রেক্ষাপটে ইজরায়েলের সামরিক বাহিনী ও সরকারের প্রতিক্রিয়া একটি পরিকল্পিত গণহত্যার দিকেই ইঙ্গিত করে। একদিকে পুরো গাজা উপত্যকা অবরুদ্ধ করে তার জলের লাইন, বিদ্যুৎ, ওষুধ, খাদ্য ও জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। স্কুল, হাসপাতাল, রিলিফ শিবির - কোনও স্থানই নিরাপদ নয়। ইজরায়েলি সরকার একে "সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান" বলে দাবি করলেও, বাস্তবে এটি একটি প্রথাগত রাষ্ট্রীয় হিংসার রূপ, যা মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং ন্যূনতম মানবিকতার পরিপন্থী। তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও আশার আলো দেখা যায় ইজরায়েলের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা কিছু সাহসী প্রতিরোধে। একদিকে যেমন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’, ‘জিউস ভয়েস ফর পিস’, ‘স্ট্যান্ডিং টুগেদার’-এর মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলি প্রতিবাদে মুখর হয়েছে, তেমনি বহু সাধারণ ইহুদি নাগরিকও ইজরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছে। তাঁরা বলছেন, “এই যুদ্ধ আমাদের নাম করে নয়।” ইজরায়েলের সরকার এই প্রতিবাদ দমন করতে গ্রেপ্তার, হয়রানি, এমনকি সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের হুমকিও দিচ্ছে। তবুও এই প্রতিবাদ প্রমাণ করে - একটি গোটা জাতি নয়, বরং একটি রাষ্ট্রযন্ত্র এই যুদ্ধের পেছনে দায়ী।
বিশ্ব রাজনীতিতে, বিশেষ করে তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের ভূমিকাও এক গভীর হতাশার বিষয় হয়ে উঠেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, কাতার কিংবা পাকিস্তান - এইসব রাষ্ট্র কেবল মুখে সহমর্মিতা জানিয়ে নিজেদের দায়িত্ব সারছে। এদের একাংশ ইতিমধ্যেই ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে কার্যত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আনুগত্য বজায় রাখছে। প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি ন্যূনতম কার্যকর পদক্ষেপ তারা নেয়নি। এই দ্বিচারিতা গোটা মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও নৈতিক ভঙ্গুরতাকে নগ্ন করে দিয়েছে। প্যালেস্টাইনের প্রশ্নে যারা একসময় ‘ভ্রাতৃত্বের’ বুলি আওড়াত, আজ তারাই নীরব দর্শক। কিন্তু কেবল মুসলিম রাষ্ট্রই নয়, ব্যর্থ হয়েছে আন্তর্জাতিক বামপন্থী রাষ্ট্রগুলিও। যারা কখনও সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিল, আজ তারাও কার্যত নিষ্ক্রিয়। চীন ও রাশিয়া কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক বিবৃতি দিলেও তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনও কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। ব্রিকস গোষ্ঠী কিংবা জি-৭-এর বাইরের দেশগুলিও প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বজনমত গঠনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। লাতিন আমেরিকার কয়েকটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র, যেমন বলিভিয়া ও কলম্বিয়া কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা বৃহত্তর একতা তৈরি করতে পারেনি। এ যেন এক নৈতিক দেউলিয়াপনার প্রতিচ্ছবি, যেখানে পুঁজিবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার দাবি থাকলেও বাস্তবে অনেকে পরিণত হয়েছে একটি পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার আত্মীয় স্বজনে।
বামপন্থীরা যদি সত্যিই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে এবং মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নিতে চায়, তবে এখনই সময় একযোগে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা। সারা বিশ্বের মানুষকে যুক্ত করতে হবে একটি নতুন আন্তর্জাতিকতাবাদী সংহতির ছাতার নিচে, যেখানে জাতি, ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে মানবতার পক্ষে একত্র হওয়া সম্ভব। এই আগ্রাসন বন্ধ হোক। ইজরায়েলি রাষ্ট্রের দখলদারিত্ব ও নিপীড়ন শেষ হোক। প্যালেস্টাইনের মানুষ যাতে তাঁদের নিজস্ব ভূখণ্ডে সম্মানের সঙ্গে বাস করতে পারেন, সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হোক। ধর্ম নয়, রাষ্ট্র নয়, জাতি নয় - মানবতাই হোক আমাদের একমাত্র পথনির্দেশ।